সেই ভোর চারটের সময়ে জোর করেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছি। ট্রেন নাকি সাড়ে চারটের সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। জানলার বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। ট্রেন থামল। এ.সি. কামরার এই এক ঝামেলা। দরজা খুলে না দেখলে অন্ধকারে কোথায় দাঁড়াল ট্রেন সে বোঝার উপায় নেই জানলার কালো কাঁচের মধ্যে দিয়ে। তবে দেখলাম, দরজা খুলেও বোঝার উপায় নেই সে ট্রেন কোথায় দাঁড়িয়েছে। বাইরেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই কলকাতা থেকে টানা চলছে তো, হাঁপিয়ে গেছে বেচারা। মাঝে মাঝেই নিজের খেয়ালে থেমে যাচ্ছে।
ধুঁকতে ধুঁকতে শেষমেষ পৌনে সাতটার সময় হরিদ্বারে এসে ট্রেন বলল, " দয়া করে নামুন এবার!"
স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার কথা। দেখলাম সেই কথামত সাদা অ্যাম্বাসাডর থেকে নেমে এসে এক বয়স্ক মানুষ বল্লেন,"আইয়ে সাব..." তাঁর বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বলে মনে হল। বলেই ফেললাম, "আপ চালায়েঙ্গে গাড়ি?" ভদ্রলোক ঠিক এমনভাবে হাসলেন, মনে হল এরকম প্রশ্ন তিনি অনেকদিন অনেকের কাছেই শুনেছেন। বললেন, "জী হাঁ, 'ম্যায়' হি চালাউঙ্গা!"
হরিদ্বারে গঙ্গা আরতি
হরিদ্বারে থাকার পরিকল্পনা নেই, তবে গাঢ়োয়ালে যেখানেই যাও, অনেক সময় লাগে গাড়িতেই, শুধু মুসৌরি ছাড়া। আমার গন্তব্য চোপতা- সুদূর চোপতা। আট থেকে নয় ঘন্টার রাস্তা। তাই একটু 'ফ্রেশ' না হয়ে বেরোনোর প্রশ্নই নেই। একটা হোটেলে উঠতে গেলাম।হরিদ্বারে আবার একা কোন হোটেলে ঠাঁই দিতে লোকে নারাজ। এখন নাকি অনেক কড়াকড়ি, 'ফ্যামিলি' ছাড়া অনুমতি নেই। আমি একা যাত্রী, রাস্তার মধ্যে 'ফ্যামিলি' কোথা থেকে যোগাড় করি? যা হোক করে রাজি করিয়ে একটা ঘর পেলাম। সেখানে এক ঘন্টায় সব কিছু সেরে দুটো ব্রেড টোস্ট মুখে পুরে সেই বয়স্ক ড্রাইভারের সাদা অ্যাম্বাসাডরে চেপে যাত্রা শুরু।
ইতিমধ্যে এত বৃষ্টি হয়েছে যে হরিদ্বারের রাস্তায় দেখি জল থইথই। সে যাই হোক, বৃষ্টির পরে তখন ঝকঝকে রোদ, নীল আকাশ। যেন গাড়ির কাঁচে অনেক জল পড়েছিল, একবার ওয়াইপার চালিয়ে এক্কেবারে পরিষ্কার। গঙ্গার ব্রিজে উঠেই মনটা ভাল হয়ে গেল। মিঠে আলোয় হরিদ্বারকে আরো পবিত্র মনে হচ্ছে। ব্রিজ পেরিয়েই গাড়ি সাইড করে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ির ড্রাইভার বেরোলেন, আমার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, " ম্যায় পয়ষট সাল কা আদমি হুঁ, আপকো অগর ভরোসা হ্যায় তো চলিয়ে।" আমি বুঝতে পারছি না ঠাট্টা করছেন, নাকি সত্যিই বলছেন! আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে উনি বললেন, " আপনে স্টেশন মে ওয়সা সওয়াল কীয়ে----" আমি বুঝলাম উনি কথাটায় বোধহয় একটু চটেছেন বা দুঃখ পেয়েছেন। বুঝিয়ে বললাম যাতে উনি কিছু মনে না করেন; আমি এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম।
ব্যাস! তারপর বাকি তিনদিন আমি শুধু এটাই ভেবে চললাম যে আমি কেন বলতে গেলাম এমন একটা কথা! না, না, অনুশোচনা নয়, বাকি তিনদিন ড্রাইভার চামেলিজি এমন গাড়ি চালালেন, জেট বিমান হার মেনে যায়। ভয়ে কাঁটা হয়ে বসে থাকতে হত মাঝে মাঝে। বললে হয়ত পাঁচ মিনিট আস্তে চালালেন, তারপরে আবার মিগ বিমান! পাহাড়ি রাস্তার আঁকবাঁক যেন আমেরিকান হাইওয়ে!
দেবপ্রয়াগ
একে একে পেরিয়ে চললাম ঋষিকেশ, ব্যাসি, দেবপ্রয়াগ, শ্রীনগর, রুদ্রপ্রয়াগ। দেবপ্রয়াগের পর থেকে যেমন গঙ্গাকে ছেড়ে অলকানন্দার পাশ ধরেছিলাম, রুদ্রপ্রয়াগের পর থেকে মন্দাকিনী সঙ্গী হল। আমার আজ অবধি দেখা সবথেকে সুন্দর নদী এই মন্দাকিনী।
মন্দাকিনী
তার পাশে অপূর্ব ধাপ চাষের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলা। অগস্ত্যমুণি, সিয়ালসোর, চন্দ্রপুরী পেরোতে বেলা গড়িয়ে বিকেল। একটা জায়গায় মন্দাকিনীর ওপর একটা ব্রিজ নজর পড়ল। ব্রিজ পেরিয়ে ওপাড়ে কেদারনাথের রাস্তা। আর আমরা ব্রিজ না পেরিয়ে পাহাড় বেয়ে চড়তে শুরু করলাম উখিমঠের রাস্তায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই উখিমঠের ছোট্ট জনবসতি। সেখান থেকেই শুনছি কানাঘুষো----আর পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যেই চাক্ষুষ দেখলাম আমার স্বপ্নভঙ্গ ! বিরাট এক ধ্বসে সমস্ত রাস্তা বন্ধ। কলকাতা থেকে প্রায় দু'হাজার কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে এসেছি, আর পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিলেই চোপতা, আর সেখান থেকে পায়ে হেঁটে তিন কিলোমিটার দূরে তুঙ্গনাথ। ভারতের তথা সমস্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ শৈবতীর্থ। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, রাস্তা বন্ধ! অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম সেই পড়ে থাকা পাথরের স্তূপের দিকে। বুঝলাম, ভগবান বোধহয় কালেভদ্রেই "তথাস্তু" বলেন। আমার অসহায় অবস্থা দেখে আশেপাশের গ্রামের কয়েকটা বাচ্চা ছেলে জড়ো হয়ে গেল। তাদের মধ্যে দুজন আমাকে গাঢ়োয়ালি ভাষায় শোনাল তাদের লোকগীতি। বিদায়ী বেলায়, বিশাল হিমালয়ের মধ্যে আমি কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম অন্য এক জগতে।
ঈশ্বরের বাসভূমি গাঢ়োয়াল
মনে মনে বললাম, হয়ত এই গান শোনবার সৌভাগ্য আমার অন্য কোথাও হত না। এও এক অদ্ভূত প্রাপ্তি। শুধু প্রকৃতি নয়, তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই অচেনা অজানা মানুষদের সারল্যও টেনে আনবে আমাকে এই হিমালয়ে, বার বার।
উখিমঠের চারপাশে ধাপচাষ
চামেলিজি কোত্থেকে দু' কাপ চা নিয়ে এলেন। সেই চায়ে চুমুক মেরে ফিরে চললাম খানিক দূরেই ফেলে আসা উখিমঠে। এই ছোট্ট জনপদে সেপ্টেম্বরের অবেলায়ে আমিই একলা ট্যুরিস্ট। একটা নতুন তৈরি ছিমছাম হোটেল পছন্দ হল। একটা ঘর বেছে নিয়ে মালপত্র নামালাম গাড়ি থেকে। তখনও দিন ফুরায়নি, শুনলাম মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হবে। ট্রাইপডে ভিডিও ক্যামেরা লাগানোই ছিল। গলায় স্টিল ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
কেদারনাথের মন্দির দেওয়ালির পর যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন এই উখিমঠের মন্দিরেই নামিয়ে আনা হয় তাঁর বিগ্রহ। আবার অক্ষয় তৃতীয়ার ঠিক আগে ধুমধাম করে যাত্রা হয় সেই বিগ্রহের, উখিমঠ থেকে কেদারনাথ মন্দিরের পথে। উখিমঠ যেন সেই শান্তির জায়গা যেখানে শীতের বরফ বিছানো দিনে স্বয়ং কেদারনাথও মোক্ষ অনুভব করেন।
আরতি শুরু হয়ে গেছে। ছবি তোলার সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে, পরণে থ্রি- কোয়ার্টার প্যান্ট আর গায়ে একটা ফোটোগ্রাফার'স জ্যাকেট চাপিয়ে চলেছি। কয়েকটা ছোট ছেলে দেখলাম বলাবলি করছে । "ইয়ে শায়দ হমারে দেশ কে নহি হ্যায়!" আমি ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে মনোজ কুমারের মত তাদের বললাম, "ম্যায় ভি তুমহারে তরহা এক হিন্দুস্থানি হুঁ।" পরে এই ফিল্মি ডায়ালগের কথা মনে করে নিজেরই হাসি পেল।
মন্দিরে পৌঁছে দেখি সেখানে মন্থর গতিতে ঢাক বাজছে, ঘন্টা বাজছে আর ক্যাসেট বাজিয়ে মন্ত্র পড়া চলছে মাইকে। কিন্তু সন্ধিক্ষণে সেই উখিমঠের মন্দিরে এসে, এখনও মনে হয় কত যুগ পেছনে চলে এসেছি কোনও এক সুদূর অতীতে। কলকাতার রাস্তা-ঘাট, যানজট, হুল্লোড়, সব মিথ্যে মনে হয়। এখানেই চিরকাল থেকে যেতে ইচ্ছা করে। ভাবি, কি হবে যদি আমি আর না ফিরি?
উখিমঠের মন্দির
পকেটে হটাৎ ফোন বেজে ওঠে।
"হ্যালো, মা! আমি এখন উখিমঠের মন্দিরে। আরতি হচ্ছে। তোমরা থাকলে কি ভাল হত!"
লেখা ও ছবিঃ
ঋতম ব্যানার্জি
কলকাতা