খেলাঘরখেলাঘর

স্বাধীনতার গল্প

উরিব্বাস, কি বৃষ্টি, কি বৃষ্টি!!!! থামতেই চায় না। চারিদিক টইটম্বুর। এমন বৃষ্টি আগে কোনোদিন দেখেছি কি না মনে পড়ছে না। তবে আমদের স্বাভাবিক জীবনের গতি কিন্তু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্স এ বেশ হাঁটুর কাছাকাছি জল। দেখি, তোমার বয়েসি সবাই বেশ সেখানে সাঁতরানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল আমার ছোটোবেলার কথা, উঠোনে নৌকা ভাসানোর কথা – যে নৌকার সাথে ভেসে যেত আমাদের স্বপ্ন। জানি না, তোমার সেই নৌকায় ওঠার সময় আছে কি না।

বাস্তবের সঙ্গে আমাদের মানসচক্ষের অপূর্ব মিলনে তৈরী হয় ইতিহাস। তবেই টান তৈরী হয় অতীতের দিকে। চলো, সেই উলটো টানেই তোমাকে নিয়ে ভেসে পড়ি।

পাশ্চাত্য সম্পর্কে আমরা মনের কোণে সব সময় একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করি। কিন্তু জানলে অবাক হবে যে অষ্টাদশ শতাব্দী-তে বৃটেনের কৃষি ব্যবস্থা ভারতের থেকে কোনো অবস্থাতেই উন্নত ছিল না। শিল্পও ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পরে বাংলায় ক্ষমতা লাভ ইংরেজ বণিকদের সামনে ধনরত্ন ও পুঁজি সংগ্রহের এক বিরাট সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল। এ তো ছিল ক্ষমতালাভের বাইরে না চাইতেই জল। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় দেওয়ানি লাভ করল। পুঁজি সংগ্রহের মাত্রা ছাড়িয়ে  লুঠতরাজ চলতে লাগল। বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। ছলে বলে কৌশলে কোম্পানি বাংলার মানুষের কাছ থেকে  বর্ধিত হারে খাজনা আদায় করতে লাগল। বেশ মজার রাজত্ব – শাসনের কোনো দায়িত্ব নেই অথচ বাঁধনছাড়া অর্থাগম। বাংলার রাজস্ব থেকে আদায় হতে থাকল বিপুল পরিমাণ অর্থ। সেই অর্থ ইংরেজ বণিকরা ব্যবসার কাজে তো লাগাতই। সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রসারের জন্য নিজেদের সামরিক শক্তির বৃদ্ধির কাজেও লাগাত। আর এভাবে যে সম্পদ তারা বাংলার বুক থেকে লুঠ করত, তা পন্যের আকারে নিজেদের দেশে চালান দিত। কোম্পানির কর্মচারীরা বে-আইনি ভাবে ব্যক্তিগত ব্যবসা করে অনেক টাকা উপার্জন করে তা বিলেতে পাচার করত। ভাবতে পার, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৃটেনের জাতীয় আয়ের দুই শতাংশ ছিল শুধুমাত্র বাংলা ও ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে লুঠ করা সম্পদ।

 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা

একটা আর্থিক হিসেবের খসড়া দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে। কোম্পানি বাংলায় একচ্ছত্র দেওয়ানি লাভের আগে, নবাবী আমলে, ১৭৬৪-৬৫ সালে, বাংলায় রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৮ লক্ষ ১৭ হাজার পাউন্ড। কোম্পানী দেওয়ানী লাভের পরেই প্রথম বছরে ১৭৬৫-৬৬ সালে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ লক্ষ ৭০ হাজার পাউন্ড। এ ভাবে প্রতি বছরেই আয় বাড়তে বাড়তে ১৭৭১-৭২ সালে তার পরিমাণ  বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ লক্ষ ৪১ হাজার পাউন্ড। আর ১৭৭৫-৭৬ সালের হিসেব অনুযায়ী এই হিসেব গিয়ে দাঁড়ায় ২৮ লক্ষ ১৮ হাজার পাউন্ডে। লর্ড কর্নওয়ালিশ যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন (১৭৯০ সাল) তখন বার্ষিক রাজস্বের স্থায়ী পরিমাণ নির্দিষ্ট করেন, ৩৪ লক্ষ পাউন্ড। এই অর্থ আদায় করা হত দরিদ্র কৃ্ষকদের রক্ত শোষণ করে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ইংল্যান্ডে একটার পর একটা আবিষ্কার হতে থাকল। জন্ম নিল নতুন নতুন প্রযুক্তি। ঘটে গেল শিল্পবিপ্লব। কিন্তু সেই বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে প্রয়োজন শিল্পদ্রব্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল। ইংরেজরা ভারত থেকে লুন্ঠিত  সম্পদ ও জবরদস্তি করে অল্পমূল্যে কেনা সামগ্রী দিয়ে তা সরবরাহ করতে থাকল। কিন্তু শুধু উৎপাদন করলেই তো আর চলবে না। উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির জন্য বাজার চাই। ভারত ছিল কাচাঁমাল ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনের দিক থেকে স্বয়ং-সম্পূর্ণ। কিন্ত নিজেদের বাজার তৈরী করার জন্য ইংরেজ বণিক, শাসক-রা সব দিল ধ্বংস করে। বাংলার বস্ত্রশিল্পের তখন ছিল ভুবন-জোড়া খ্যাতি। ইংরেজরা তাই প্রথমেই থাবা বসাল বাংলার বিখ্যাত তাঁত শিল্পে।

ভুবনবিখ্যাত বাংলার তাঁতের কাপড়
ভুবনবিখ্যাত বাংলার তাঁতের কাপড়

ইংরেজ লুন্ঠনকারীরা তাঁত শিল্পকে ধ্বংস করে, কাঁচামাল তুলো আর কার্পাস ইংল্যান্ড-এ রপ্তানি করতে বাধ্য করল। উল্টে আমদানী হতে থাকল ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরী কাপড় ও কাপড়জাত অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী। নীল রপ্তানীর জন্য বাধ্য করা হল কৃষকদের নীল চাষ করতে। চীন সরকার আফিমের আমদানী বন্ধ করে দেয়। ইংরেজরা ভারতের মাটিতে আফিমের চাষ বাড়িয়ে চীনে তা রপ্তানী করতে থাকে। কলকাতা ক্রমে হয়ে ওঠে চীনে আফিম রপ্তানী-র প্রধান বন্দর।

পৃথিবীর মানচিত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী হয়ে উঠল শিল্প-বিপ্লবের দ্বারা সৃষ্ট বিকাশমান শিল্প পুঁজিবাদের প্রবক্তা। কিন্তু কিভাবে? উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পঞ্চাশ বছর ধরে এই একতরফা বাণিজ্যের নামে শোষণ ও ভারতীয় পণ্য-সামগ্রীর বাজার নষ্ট করার ফলে গ্রামের মানুষ, তাঁতী, কারিগর ও কুটিরশিল্পে নিযুক্ত শ্রমজীবিরা তাদের উপার্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে নিঃস্ব ও হতদরিদ্র হয়ে যায়। চাষী ও কারিগরেরা নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হল। দেশের সম্পদ  জমা হতে থাকল পুঁজিপতিদের হাতে। দেশীয় মহাজন ও সুদখোরেরা তার কিছু অংশ ভাগ পেল। শুধু তাই নয়, বৃটিশ শিল্পপতিদের স্বার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতিতে হাত দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বৃটিশ পুঁজি লগ্নি করে হয় রেললাইন স্থাপনে। এছাড়া, চা বাগান, কয়লাখনি, চটকল ইত্যাদি লাভজনক ব্যবসায় ইংরেজরা টাকা লগ্নি করে জাঁকিয়ে বসল।এ সব ব্যবসায়  ভারতীয় দের দাস শ্রমিকদের মতই ব্যবহার করা হত। ভারত হয়ে উঠল ইংরেজের সোনার ডিম পাড়া হাঁস। সে কেটে ফেললেও ডিম দেয়, মেরে ফেললেও দেয়।

ভারতের অর্থনীতি কে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করে দিলেও তার কোনো সুফল দেশের মানুষ পায় নি। ভারত বৃটিশ সাম্রাজ্যের মুকুটমণি বলে অভিহিত হলেও, আমদের দেশের মানুষ না পেল বাঁচবার অধিকার, না পেল অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ।

গোটা দুই শতক জুড়ে ভারতের সাধারণ মানুষের বিদ্রোহের এটাই হল প্রেক্ষাপট।


আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা

ছবিঃ
উইকিপিডিয়া

আর্য চ্যাটার্জি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বেশ কয়েকবছর বিভিন্ন ইংরেজি পত্র-পত্রিকায় নানা বিষয়ে লেখালিখি করেন। বর্তমানে পারিবারিক ঐতিহ্যের টানে একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। হাওড়া সালকিয়ার বাসিন্দা আর্য নিয়মিত গান বাজনার চর্চা করেন; নিজের ইচ্ছায় একাধিক তাল যন্ত্র বাজানো রপ্ত করেছেন তিনি। নিজের শখের কিছু লেখা আর ইচ্ছামতী-তে লেখা ছাড়া এখন আর কোনো পত্র-পত্রিকার সঙ্গে আপাততঃ যুক্ত নন। শখের লেখা ব্লগে লেখেন। বেশিরভাগই বড়দের জন্য কবিতা।