“বৃষ্টি ভেজা কত সন্ধ্যায় মোরা ক’জনে
হেঁটেছি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা এই আমরা
রাজপথের আকাশচুম্বিগুলো ছাড়িয়ে
স্তব্ধতার সুর খুঁজে ফিরেছি আমরা…
স্মৃতি,সবই স্মৃতি…”
পরশপাথর
জানো, এই লাইনগুলো আমার বড় হয়ে ওঠার সময়ের প্রিয় কয়েকটা। আজ অবশ্য ইন্টারনেট, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের যুগে শহুরে অবসর এভাবে কাটানো সময় নষ্টেরই নামান্তর। 3G থেকে 4G network transition period-এ কিশোরদের কাছে এই বিনোদন হাস্যকর।তুমি ঠিক বুঝবে না, বৃষ্টিতে ভিজে সারা গায়ে কাদা মেখে ফুটবল খেলার আনন্দ কি! বৃষ্টি এখন শুধু জানলা দিয়ে দেখতে হয়।একটু ভিজলেই পরদিন নাকের জলে জেরবার।জ্বর, স্কুল কামাই, ডাক্তার বাবুর সার্টফিকেট, তবে পরদিন ক্লাসে বসতে দেবে। বাব্বা !!!!! তার থেকে বৃষ্টি স্বপ্নই থাক।ভেজার অনাবিল আনন্দ তোমার জন্য নয়। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে স্বাধীন হওয়ার দিন শেষ।তুমি এখন এমন একজন যার সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক শুধু পড়ার বই-এর মাধ্যমে। প্রকৃতি তোমার দোরগোড়ায় ধরা দিলেও তোমার সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরী করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই তোমার কাছে নেই।সেই অধিকার তুমি অনেকদিন আগেই হারিয়েছ।
জান, প্রকৃতির সঙ্গে একসময়ে মিশে থাকত সাঁওতালরা। সরল আদিবাসী সাঁওতালরা ছিল সত্যিই অরণ্যের সন্তান। বনের শ্যামলিমার সহজাত সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা তাদের জীবন। না তারা কোনোদিন বাইরের কোনো সমজের ওপর কর্তৃত্ব করতে চেয়েছে, না তাদের ওপর বাইরের কোনো শক্তি কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করেছে। তাদের অধিকারে মুঘল-পাঠান আমলেও কেউ হস্তক্ষেপ করতে চায় নি।
কিন্তু অত্যাচারী ইংরেজরা তাদের আর শান্তিতে থাকতে দিল না।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অর্থলালসায় সাঁওতালদের জীবনযাত্রার সহজ-সারল্য আর তাদের সংস্কৃতির অনার্দৃত বিকাশের ধারাটি ধর্মভ্রষ্ট হয়ে গেল।সুদের চক্রবৃদ্ধি হারের জালে এদের চিরকাল বেঁধে ফেলল দাস-শ্রমিক হিসেবে। নিজেদের বাসভূমিতে এরাই হয়ে উঠল পরবাসী। না জমি, না জীবিকা। সঙ্গে আদিবাসী জীবনের সহজ সারল্য প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই। ফল হল, তাদের পিঠ ঠেকল কুটিরের দেওয়ালে।ক্ষুধার্ত, ক্লিষ্ট, অপমানিত সাঁওতালরা মুক্তির পথ হিসেবে বাধ্য হল হাতে অস্ত্র তুলে নিতে।স্বাধীন সত্তাকে রক্ষা করতে, নারীর সম্মান বাঁচাতে, মানুষের মত বাঁচতে হলে সংগ্রামে সামিল হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় তাদের ছিল না।
ঔপনিবেশিক ইংরেজরা আদিবাসীদের মানুষ বলে গণ্য করত না।তাদের প্রসাদপুষ্ট জমিদার, দারোগা-পুলিশ, আমলা, মহাজন, ব্যবসায়ীরা এদের শোষণ করেই নিজের পরিপুষ্টি সাধনেই ব্যস্ত ছিল।এই অন্যায়-অবিচারের বিরূদ্ধে সাঁওতালরা মাথা তুলে দাঁড়াল দুই ভাই সিদহো-কানহু-র নেতৃত্বে। এঁদেরকে আমরা সিধু-কানহু বলেই জানি।
সিপাহী-বিদ্রোহের দুই বছর আগের ঘটনা। সাঁওতাল পরগণার ভাগনাদিহি গ্রামের মাঠ।১৮০৫ সালের ৩০শে জুন তারিখে এই অন্যায় শোষণের বিরূদ্ধে দশহাজার সাঁওতালকে অস্ত্র ধরতে ডাক দিল সিধু-কানহু। এরাই ছিল সবথেকে ব্যাপক সাঁওতাল বিদ্রোহের সংগঠক, আর ভাগনাদিহির সেই মাঠই ছিল সেই রণক্ষেত্র।সিধু-কানহু-র সামনে সমবেত দশহাজার সাঁওতাল সেদিন শপথ নিয়েছিল, তাদের বাসভূমি থেকে সমস্ত অত্যাচারীদের বিতাড়ণের।
শুরু হল সংঘর্ষ। ইংরেজ পুলিশ –বাহিনী-র নেতৃত্বে ছিলেন এক দারোগা।লড়াই-এ ঐ দারোগা নিহত হন।সাঁওতাল জাগরণের এই দৃশ্য দেখে গ্রামের সাধারণ মানুষ – তাঁতী, কামার, কুমোর, চর্মকার, তিলি সকলেই তাদের পাশে এসে দাঁড়াল।কারণ তারাও সকলে একই ভাবে অত্যাচারীত ও শোষিত।সিধু-কানহু-র নেতৃত্বে এক বিশাল সাঁওতালবাহিনী কলকাতার দিকে অভিযাত্রা শুরু করল। অত্যাচারীদের দূর্গ ধূলিসাৎ করে দেওয়াটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।কুখ্যাত অত্যাচারী পুলিশ অফিসার মহেশ ‘ত নিহত হল। একদল সৈন্য নিয়ে মেজর বারোজ বিদ্রোহীদের গতিপথ রোধের চেষ্টা করেন। তিনিও ব্যর্থ ও পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান।বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ সহ বিহারের একটা বড় এলাকা সাঁওতালদের করায়ত্ব হয়। ১৮৫৫ সালের ১৬ই জুলাই ইংরেজ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে পরাজিত করে সিধু-কানহু সাঁওতালদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে।
দুই ভাইএর পরিকল্পনা ছিল সাঁওতালদের জন্য একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। শোষণমুক্ত পরিবেশে যাতে গরীব সাঁঊতাল কৃষক-শ্রমজীবি মানুষ বাস করতে পারেন, এটাই ছিল তাঁদের স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়ীত করার জন্যই ছিল এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রাম।পঞ্চাশ-হাজার সাঁওতাল অনুগামী নিয়ে সিধু-কানহো মহেশপুর নামে একজায়গায় ইংরেজবাহিনীর গতিরোধ করেছিল।
ইংরেজ শাসকেরা সাময়িকভাবে এই বিদ্রোহের তীব্রতা দেখে হতচকিত হয়ে গেলেও সমস্ত শক্তি দিয়ে চূড়ান্ত আঘাতের প্রস্তুতি নিতে দেরী করে নি। বিদ্রোহ দমণ করতে ইঙ্গরেজ শাসকেরা গোটা এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। সিধু-কানহু-কে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তখনকার দিনে দশহাজার টাকা মাথা পিছু ইনাম ঘোষণা করে ইংরেজ সরকার। মহেশপুরের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সাঁওতালরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বীরভূম থেকে সরে গিয়ে সিধু-র বাহিনী সাঁওতালপরগণায় চলে যায় প্রতিরোধ প্রস্তুতির জন্য। ইংরেজরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সাঁওতালপরগণায় প্রবেশ করে। পাকুড় রাজপ্রাসাদ সিধুর বাহিনী দখল করে নেয়। ইংরেজরা ভয় পেয়ে পাকুড় দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল। পাল্টা অভিযান চালিয়ে ইঙ্গরেজ বাহিনী এক বিশ্বাসঘাতকের সাহায্যে সিধু-র গোপন আস্তানার সন্ধান পায় এবং তক্ষুনি তাকে ধরে গুলি করে হত্যা করে।
এই বিদ্রোহ দমনের জন্য ১৮৫৫ সালের নভেম্বরে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম থেকে শুরু করে বিহারের ভাগলপুর পর্যন্ত গোটা এলাকা ইংরেজ শাসকরা সেনা বাহিনীর ওপর ছেড়ে দেয়। চরম সন্ত্রাস ও বর্বর প্রতিশোধের নগ্ন দৃষ্টান্ত স্থাপণ করে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেতনভুক সেনাবাহিনী।১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের সময় পর্যন্ত সাঁওতালদের অভ্যুত্থান স্থায়ী হয়েছিল। আদিবাসী সাঁওতাল এই বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে বাংলার বুকে এক অবিস্মরনীয় ও গৌরবময় আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে। বাংলার মানুষ আজও তা বিনম্রচিত্তে স্মরণ করে।
কলকাতার ধর্মতলায় গিয়েছ কোনোদিন? বিশাল এক রাস্তার নাম রাখা হয়েছে ‘সিধো-কানহো ডহর’ – সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর ভ্রাতৃযুগলের স্মৃতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাঞ্জলী।
আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা