ওরেব্বাস!!! কি ঠাণ্ডা! হাত পা জমে যাওয়ার জোগাড়।তার মধ্যে আবার ভূতের ভয়! তারিনীখুড়ো গল্পের ছলে গল্প বলেই খালাস। আর সেই সব অত্তো বড় স্ক্রীনে দেখার পর থেকে কার না গা ছমছম করে বল তো? ভুলতেই পারছি না কিছুতেই। তবে ‘যেখানে ভূতের ভয়’-এর শেষের ভূতটা বেশ মজার।এরকম মজার ভূতের বাংলা সাহিত্যে খুব একটা অভাব নেই। তবে আমার কাছে অমর মজার ভূত কে জান? লুল্লু।যদি না পড়ে থাক তবে আজই পড়ে ফেল।কোনোদিন শুনেছ ভূতকে ঘানিতে ফেলে নিংড়ে তার তেল বের করা হয়? আবার সেই তেল মাখাও হয়।‘ভূত’ হল এমন এক সুযোগ যাকে নিয়ে কল্পনা সুদূরপ্রসারী হতে পারে।খুউউউব কম লেখকের লেখনীতে সেই সুযোগ বিভৎসতা বা আতঙ্ক বা ভয় বাদ দিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় পারতেন।ইংরেজদের ও ভাল ভূত আছে। আমার প্রিয় হল Casper। তবে তোমার কানে কানে একটা কথা বলি চুপিচুপি --সন্দীপ রায় এই ছবির নামকরণে একটা বড় ভুল করে ফেলেছেন। ওটা ‘যেখানে ভূতের ভয়’ হবে না, হবে ‘যেখানে-সেখানে ভূতের ভয়’ ।
ভূত মানে কি জান? পরশুরামের বিখ্যাত গল্প হল ‘বিরিঞ্চিবাবা’। সেই গল্প নিয়ে ছবি করেছিলেন সন্দীপ রায়ের বাবা, সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিত রায়। ছবির নাম রেখেছিলেন ‘মহাপুরুষ’। সেখানে একটি দৃশ্যে Tense বা ‘কাল’ সম্পর্কে যে শিক্ষা বিরিঞ্চিবাবা দিয়েছেন, তা অক্ষয়।‘কাল’-এর প্রাথমিক পাঠ নিতে হলে ব্যাকরণ বই-এর শুকনো পাতা গুলো আর না চিবিয়ে একবার বাবা-মাকে বলে ছবিটা দেখেই নাও। অদ্ভুত শব্দযোগ! ‘ভূত’ মানে ‘অতীত’।ভেবে দেখ, যাঁরা মৃত, তাঁরা তো অতীত-ই।তাই না! অতীত তো আর ফিরে আসবে না। আর সেখানেই যত্ত গন্ডগোল।সেই অতীত হয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে যখন বর্তমান কাল কোনো ভাবে প্রত্যক্ষ করে, তখনই তার নাম হয় ‘ভূত’।
তোমার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে তবে কি ‘ইতিহাস’ ভূতেরই নামান্তর? না। কারণ আমাদের সেই সৌভাগ্য হয় নি যে বর্তমান কালে বসে সেই ‘ভূত’ বা অতীতকে প্রত্যক্ষ করব।ইতিহাস থেকে আমরা শুধু সেই জ্ঞানটুকু আহরণ করি যে বর্তমান-কে কি করে অতীতের চেয়ে আরও উন্নত করব।
আর সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন অনন্য কৃষক নেতা তিতুমীর।তোমাকে ওয়াহাবি নেতা সৈয়দ আহমেদের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? সৈয়দ আহমেদ ১৮২১ সালে কলকাতায় এসেছিলেন।চব্বিশ পরগণার গোবরডাঙ্গার কৃষক পরিবারের সন্তান তিতুমীর। ওয়াহাবী আদর্শে অনুপ্রানিত তিতুমীর তাই সোজা চলে এলেন সৈয়দ আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায়।আর কালবিলম্ব না করে সেই সাক্ষাৎকারের পরেই ঠিক করে ফেলেন কর্মপন্থা।তিনি জানতেন ইংরেজ শাসনে গ্রামের চাষীরা কোনোদিনই ন্যায় বিচার পাবেন না।তাদের সৃষ্ট জমিদার শ্রেনী কৃষকের শত্রু,জাতির শত্রু।
তিতুমীর অত্যাচার দমনের জন্য দল গড়লেন।চব্বিশ পরগণায় হয়ে উঠলেন এক প্রবাদ-পুরুষ।তাঁর আন্দোলনে ধর্মীয় আবেদন থাকলেও তিতুমীর মূলতঃ কৃষকদের শোষণমুক্তি ও বিদেশী শাসনের বিরূদ্ধে তাঁর আন্দোলন সংগঠিত করেন। কৃষকদের প্রতিরোধ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে চব্বিশ পরগণার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। জমিদারদের ভাড়াটে বাহিনী তাদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। বহু গ্রামে ইংরেজদের পুলিশ আর জমিদারদের পাইক লাঠিয়াল-রা কৃষকদের প্রতিরোধ বেষ্টনী ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকতে পারে নি। পুলিশ ক্ষেতের শস্য জ্বালিয়ে দিয়েছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করেছে, কিন্তু তিতুর কৃষক সংগঠনের শক্তি তাতে দুর্বল তো হয়ই নি বরং ঘৃণা আর আক্রোশ বাড়িয়ে তাদের আরো শক্তিশালী আর সংগঠিত করে তুলেছে।তিতুর নির্দেশে গ্রামে গ্রামে কৃষকেরা নিজেদের হাতে ক্ষমতা গ্রহণ করে জমিদার ও ইংরেজদের শোষণ ও শাসন ব্যবস্থা সাময়িকভাবে উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয়। ইংরেজ সরকারের পিঠ ঠেকে যায় শুধু তিতুমীরের মোকাবিলা করতে।
তোমরা ‘সোনার কেল্লা’র নাম শুনেছ। ‘বাঁশের কেল্লার নাম শু্নেছ চব্বিশ পরগণার নারকেলবেড়ি্যা গ্রামের বাঁশের কেল্লা? শোনো নি তো!!! তবে শোনো, বলি।
সাল ১৮৩১। তিতুমীর-কে শায়েস্তা করার জন্য ক্যাপ্টেন আলেকজ়ান্ডারের নেতৃত্বে কামান ও আরো নানা রকম অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, ইংরেজ সেনাবাহিনী নারকেলবেড়িয়ার দিকে রওনা হয়। তিতুমীর সেখানে বাঁশ দিয়ে তৈরী করেছেন এক দুর্গ; নাম রেখেছেন ‘বাঁশের কেল্লা’।কামান-বন্দুকের সামনে আর বাঁশের তৈরী দুর্গের স্থায়িত্ব আর কতটুকু!তবু সেখানেই লড়াই।তিতুর যোদ্ধারা পথেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ইংরেজ সৈন্যদের ওপর। তারপর এমন লড়াই করল যে ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার আহত হয়ে হেরে গিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন।সেদিন ছিল ১৪ই নভেম্বর।
তিনদিন পর, ১৭ই নভেম্বর, এক সুসজ্জিতে বিশাল ইংরেজ সেনাবাহিনী তিতুমীরের দলবলের ওপর হামলা চালায়।ইংরেজ সৈন্যদের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে তিতুর কৃষক সেনারা সহজেই হেরে যায়।একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে তিতুমীর তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন তাঁর বাঁশের কেল্লার ভিতরে।তৈরী হলেন চুড়ান্ত লড়াইএর জন্য।ইংরেজ সেনারাও তাঁকে ধাওয়া করে আসে ধরবার জন্য। হেরে যাওয়া তিতুমীর ও তাঁর কৃষক সৈন্যদের ইংরেজ সেনাপতি আত্মসমর্পণ করতে বলেন, গ্রেপ্তারী পরোয়ানাও দেখান।তিতুমীর এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।হয় মুক্তি, না হয় মৃত্যু, এই মন্ত্রে প্রেরণা দিয়ে তিতুমীর তাঁর আন্দোলনকে ধর্মযুদ্ধের রূপ দিয়েছিলেন।শুরু হয় আড়াই ঘন্টার এক অসম লড়াই, বল্লম-তির-ধনুক বনাম কামান-বন্দুক। কামানের গোলাতে আহত হয়ে তিতুমীর সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন। জীবিত অবস্থায় তিনি ইংরেজদের হাতে ধরাও দেন নি বা বশ্যতা স্বীকারও করেননি।তিতুমীরকে না পেয়ে তাঁর সেনাপতি গোলাম মাসুমকে কেল্লার সামনে ফাঁসি দেয় ইংরেজরা।শেষ হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের আর এক পর্যায়।
এক অতি অসম লড়াই দিয়ে মৃত্যুর সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে তিতুমীর যে স্বাধীনতার আগুন মানুষের মনে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন, তা-ই এক দাবানল হয়ে উঠেছিল।তাই তো আজও তিতুমীর অনন্য।
আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা