শীত ২০১৩ এর ফটোগ্রাফি
ইচ্ছামতীর লেখক বন্ধু তরুণ কুমার সরখেল ইচ্ছামতীর ফটোগ্রাফি বিভাগের জন্য পাঠিয়েছেন এই ছবি দুটি।
এই ছবিটা পুরুলিয়ার কাঁসাই নদীর তীরে টুসু পরবের মেলায় তোলা। প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির দিনে কাঁসাই নদীর তীরে মেলা বসে।
এই ছবির নাম- শাপলা ও ছেলেটা
ইচ্ছামতীর এই নতুন ফটোগ্রাফি বিভাগের জন্য তুমিও পাঠাতে পার তোমার তোলা ছবি।
ছবি তুলেছেনঃ
তরুণ কুমার সরখেল
আমডিহা, পুরুলিয়া
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
ডঃ আনন্দ কুমার- এক দুর্লভ চরিত্র বিজ্ঞানী
ডঃআনন্দ কুমার
ডঃ আনন্দ কুমার (পুরো নাম Dr. Trichynopoly Chelvaraj Ananda Kumer) ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। মানুষের প্রজনন-সংক্রান্ত গবেষণায় তাঁর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
নারীদেহের জরায়ুতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনে যে কোষ তৈরি হয় সেটাই বারবার বিভাজিত হয়ে একটি শিশুর দেহ গঠন করে। কোন কারণে যদি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন সম্ভব না হয় তাহলে সন্তানলাভ সম্ভব হয় না। সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তান লাভে সাহায্য করতে বিজ্ঞানীরা নানা কৌশল অবলম্বন করেন। তার মধ্যে একটি হল নারীর দেহ থেকে ডিম্বাণু ও পুরুষের দেহ থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করে গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশে তাদের মিলন ঘটিয়ে উৎপন্ন কোষটিকে আবার জরায়ুতে ঢুকিয়ে দেওয়া। এই পদ্ধতিতে যে শিশু জন্ম নেয় তাকে বলা হয় টেস্ট টিউব বেবি।
টেস্ট-টিউব শিশুর দল
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সাফল্যের সাথে একটি টেস্ট টিউব বেবি সৃষ্টি করার জন্য ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী ডঃ রবার্ট জিওফ্রে এডওয়ার্ডস ২০১০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
ডঃ রবার্ট জিওফ্রে এডওয়ার্ডস
ভারতে প্রথম এবং পৃথিবীতে দ্বিতীয় টেস্ট-টিউব বেবি সৃষ্টি করেন কলকাতার স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডঃ সুভাষ মুখার্জি। স্বল্প ব্যয়ে, সামান্য উপকরণের সাহায্য নিয়ে তিনি একটি ডিম্বাণুর সঙ্গে শুক্রাণির মিলন ঘটাতে সমর্থ হল। ফলে ১৯৭৮ সালের ৩রা অক্টোবর এক দম্পতি একটি কন্যা সন্তান লাভ করেন।
ডঃ সুভাষ মুখার্জি
দুঃখের বিষয় ডঃ মুখার্জির গবেষণা স্বীকৃতি লাভ করেন নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিয়োজিত এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দল তাঁর দাবীকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয়। সরকারী চাকরির নিয়ম কানুন ঠিক মত না মানার জন্য ডঃ মুখার্জিকে ভর্ৎসনা করা হয়। বিদেশে গিয়ে নিজ্ঞানীদের সম্মেলনে নিজের গবেষণাপত্র পড়ার অনুমতিও তাঁকে দেওয়া হয় নি। হতাশা ভারাক্রান্ত মনে ১৯৮১ সালের ১৯শে জুন , মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে কলকাতায় নিজের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী।
এরপর মুম্বইয়ের ইন্স্টিটিউট ফর রিসার্চ অ্যান্ড রিপ্রোডাকশন Institute for Research and Reproduction গবেষণা গারে ডঃ আনন্দ কুমার আর একটি টেস্ট টিউব বেবি সৃষ্টি করেন। ফলে ১৯৮৬ সালের ১৬ই আগস্ট একটি ছেলের জম্ন হয় এবং তাঁর গবেষ্ণা যথাযথ স্বীকৃতি লাভ করে। এদেশে প্রথম টেস্ট টিউব বেবি তৈরি করার কৃতিত্ব লাভ করেন তিনি। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি নিজেই নিশ্চিত ছিলেন না। বিজ্ঞান কংগ্রেসের একটি অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি কলকাতা যান এবং ডঃ মুখার্জির গবেষণা সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করেন। এইসব কাগজপত্র খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তিনি ঘোষণা করেন যে ডঃ সুভাষ মুখার্জি-ই ভারতে প্রথম টেস্ট টিউব বেবির স্রষ্টা। ডঃ মুখার্জির গবেষণার ফলে যে মেয়েটি জন্ম নিয়েছিল , পঁচিশ বছর বয়স পুরো হলে সে নিজের জন্মের পশ্চাৎপটে ডঃ মুখার্জির অবদানের কথা ঘোষণা করে। মরণোত্তর স্বীকৃতি ও সম্মানে ভূষিত হন ভাগ্যবঞ্চিত বিজ্ঞানী।
ডঃ এডওয়ার্ডস-এর সাথে ডঃ আনন্দ কুমার
World Foundation প্রকাশিত Dictionary of Medical Biography তে মাত্র তিন জন কলকাতার বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্থানলাভ করে তাঁর নাম। এ সবই সম্ভব হয়েছে ডঃ আনন্দ কুমারের দুর্লভ সততার জন্য। দেশজোড়া যশ ও খ্যাতির প্রলোভন অস্বীকার করে তিনি নিজে যে ভাবে উদ্যোগী হয়ে ডঃ মুখার্জিকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দান করেন, আজকের এই হিংস্র পেশাদারিত্ব এবং চূড়ান্ত মূল্যহীনতার যুগে তা সত্যিই বিস্ময়কর। ২০১০ সালের ২৬শে জানুয়ারি ২৪ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। বিজ্ঞান চর্চায় মানবিক মূল্যবোধের যে অসামান্য নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন তার জন্য ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম।
লেখাঃ
ডঃ মাধব চট্টোপাধ্যায়
সেন্টার ফর সেল্যুলার অ্যাণ্ড মলিক্যুলার বায়োলজি
হায়দ্রাবাদ, অন্ধ্রপ্রদেশ
ছবি সৌজন্যঃ
ডঃ রাজভি মেহতা ও ডঃ মাধব চট্টোপাধ্যায়
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ডঃ মাধব চট্টোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
সুকুমার স্মরণে
সুকুমার রায়
গত ৩০শে অক্টোবর ২০১২ ছিল বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়ের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী। ইচ্ছামতীর বন্ধুদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে তাঁর লেখা আবোল-তাবোল পড়ে নি কিংবা "হ-য-ব-র-ল'-এর স্বপ্নের জগতে বেড়াতে যায়নি? সেই কোন্ ছোট্টবেলায় পড়তে শেখার সময় থেকেই আর পাঁচটা রঙবেরঙের ছবি-ছড়ার বই-এর ভিড়েও অদ্ভুত সব ছবিওয়ালা আবোল-তাবোলের আকর্ষণই ছিল আলাদা। কিণ্ডারগার্টেন স্কুলের ক্লাসরুমে বা পাড়ার অ্যানুয়াল ফাংশানে স্টেজে দাঁড়িয়ে আধো- আধো গলায় বাবুরাম সাপুড়ে আবৃত্তি করে নি এমন "বেচারাথেরিয়াম' অন্তত: আমাদের ছোটবেলায় মনে হয় না কেউ ছিল। এখন আছে কি ?
১৮৮৭ সালে কলকাতার বিখ্যাত রায়চৌধুরি পরিবারে জন্ম হয় সুকুমারের। তাঁর পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের এক পথিকৃৎ। বহুমুখী প্রতিভাধর এই মনীষী শুধুমাত্র শিশুসাহিত্য রচনাই নয়, তা শিশুদের হাতে তুলে দিতে স্থাপন করেন ইউ রায় এণ্ড সন্স প্রেস, যা ভারতীয় মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইলফলক। সুকুমারও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুদ্রণশিল্পে আকৃষ্ট হন। ফোটোগ্রাফি চর্চাতেও ছিল তাঁর আকর্ষণ। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ডবল অনার্স সহ বি এস সি পাস করে তিনি
মুদ্রণশিল্পে উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে ইংলণ্ড পাড়ি দেন। ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোর মাসিক পত্রিকা সন্দেশ প্রকাশ করে বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেন। এর দু-বছর পর উপেন্দ্রকিশোরের অকালপ্রয়াণের পর সুকুমার সন্দেশের সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। এরপর সন্দেশের পাতায় পাতায় ফুটে ওঠে সুকুমারের সাহিত্যপ্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তিনি লেখেন ছোটদের জন্য নানা বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ, মজাদার ছড়া-কবিতা ও ছোটগল্প।
সঙ্গে অসাধারণ ইলাসট্রেসন। লেখেন অবাক জলপান, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, ঝালাপালার মত দমফাটা হাসির নাটক। আবার "ইস্কুলের গল্প' সিরিজে নিয়ে আসেন পাগলা দাশুকে। অন্যদিকে হেঁশোরাম হুঁসিয়ার আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন এক অজানা "লস্ট ওয়ার্ল্ড'-এর সাথে। সুকুমারই আবার শিশু-কিশোরদের বাস্তবের জগৎ থেকে হাত ধরে সাদরে নিয়ে আসেন "হ-য-ব-র-ল'-র "ওয়াণ্ডারল্যাণ্ডে'!
সেখানে কাকেশ্বর কুচকুচে আমাদের নতুন করে অঙ্ক কষতে শেখায়। ইচ্ছে হলেই সেখানে কেউ বয়সটা কমতির দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। গায়ে পড়ে গা-জ্বালানো গান শোনায় ন্যাড়া। হিজিবিজবিজ নিজের মনে হিজিবিজি ভাবে আর হেসে খুন হয়। উধো-বুধো ফাটাফাটি মারদাঙ্গা করে আবার গলা জড়াজড়ি করে গাছের কোটরে অদৃশ্য হয়। এ এক অলীক ফ্যান্টাসির জগৎ। তবু যেন কত চেনা। সেই জগতে প্রবেশের চাবিকাঠিটি আছে সুকুমারের কলমে।
এইসব অতুলনীয় সাহিত্যকীর্তি সত্ত্বেও যে মাস্টারপিসটি তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে তা অবশ্যই আবোল তাবোল । বাংলা ননসেন্স রাইমের জনক সুকুমারের ছড়া-কবিতার এই সংকলনের জুড়ি বিশ্বসাহিত্যেও মেলা ভার। এই ক্লাসিকে আছে কচিকাঁচাদের প্রতি তাঁর এই "ভুলের ভবে অসম্ভবের ছন্দেতে' মেতে ওঠার হাতছানি। পাশাপাশি কচিকাঁচাদের মা-বাবারাও নতুন করে ফিরে দেখতে পারেন তাঁদের ফেলে আসা ছেলেবেলা। আবিস্কার করতে পারেন আবোল-তাবোল শুধুই ছেলেভুলানো হাসির ছড়া নয়, আরো বেশি কিছু। বাবুরাম সাপুড়ের কাছ থেকে গোটা-দুই নিরীহ নির্বিষ "জ্যান্ত' সাপ নিয়ে তাদের ডান্ডা পিটিয়ে ঠান্ডা করার ইচ্ছে যাদের হয়, তাদের মগজের ঘিলু "ভেস্তিয়ে' গেছে কি না সেটা "ফুটোস্কোপ' দিয়ে দেখে নিশ্চয়ই (মনো-)"বিজ্ঞান শিক্ষা'র প্রয়োজন আছে ! যে ভদ্রলোক তাঁর জীবনের সমস্ত প্রশ্নই নোটবুকে লিখে রাখেন, আর নিজে উত্তরের সন্ধান না করে মেজদাকে খোঁচাখুচি করে জবাবটা জেনে নিতে চান - তাঁকে কি খুব অচেনা লাগে? আবার আরেক পড়ুয়া দুনিয়ার সব খবর কেতাবের পাতা উল্টেই জেনে নেবেন। কিন্তু পাগলা ষাঁড়ের তাড়া থেকে রক্ষা পাওয়ার দাওয়াই তাঁর অজানাই রয়ে যায়। সৎপাত্র গঙ্গারাম, রামগরুড়ের ছানা, ট্যাঁশগরু, হেড অফিসের বড়বাবু সকলেই আছেন আমাদের আশেপাশেই। আজকাল টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে নানান রিয়েলিটি কমেডি শো-তে পরিবেশিত জোকস,( যা " শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি') - সাথে মিনিটে মিনিটে রেকর্ড করা অকারণ হাসির দমক একইসঙ্গে মনে করিয়ে দেয় আহ্লাদী আর কাতুকুতু বুড়োর কথা - টিভি পর্দার এপার আর ওপার!
লড়াই ক্ষ্যাপা পাগলা জগাইকে মনে আছে তো ? সাত জার্মানকে একাই মেরে শহীদ হবার নেশায় মত্ত কোনো ভবঘুরে পাগল সৈনিক কি ঘুরে বেড়াত প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতার রাজপথে ? সেদিনের ইংরেজ প্রভুর রাজত্বেই হোক বা আজকের দিনে - রাজনীতির ব্যবসাদারদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষের দম একুশে আইনের প্যাঁচে আটকা পড়েছে ! হাতে মুগুর আর মাথায় ব্যারাম নিয়ে তারা আশ্বাস দেয়, "ভয় পেয়ো না ভয় পেয়ো না - তোমায় আমি মারব না' ! - শিবঠাকুরের আপন দেশ !
রূঢ় বাস্তবের নানা খণ্ডচিত্র, প্রতিদিন ঘটে চলা অজস্র অসঙ্গতিকে হাস্যরসে শোধন করে সুকুমার জন্ম দিয়েছেন তাঁর আবোল-তাবোলের অমর চরিত্রদের। তাই তারা ছোটদের হাসায় আর বড়দের বিস্মিত করে। ১৯২৩ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগের আগে সুকুমার রায় তাঁর প্রিয় আবোল-তাবোল বই-আকারে দেখে যেতে পারেননি। অসামান্য প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এই চিরনবীন কবি নিজের অকালমৃত্যুকেও যেন ব্যঙ্গ করেছেন তাঁর শেষ কবিতায়।
আজকে দাদা যাবার আগে
বল্ব যা মোর চিত্তে লাগে-
নাই বা তাহার অর্থ হোক্
নাইবা বুঝুক বেবাক্ লোক ।
আপনাকে আজ আপন হতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে ।
ছুট্লে কথা থামায় কে ?
আজকে ঠেকায় আমায় কে ?
আজকে আমার মনের মাঝে
ধাঁই ধপাধপ্ তব্লা বাজে-
রাম-খটাখট্ ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্
কথায় কাটে কথার প্যাঁচ্ ।
আলোয় ঢাকা অন্ধকার,
ঘণ্টা বাজে গন্ধে তার ।
গোপন প্রাণে স্বপন দূত,
মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভূত !
হ্যাংলা হাতি চ্যাং-দোলা,
শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা ।
মক্ষি রাণী পক্ষীরাজ-
দস্যি ছেলে লক্ষী আজ ।
আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম ।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,
গানের পালা সাঙ্গ মোর ।
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
sukumarray.freehostia.org
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জ্যোতির্ময় দালাল
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
হাসিঘর
পথে ঘাটে চলতে চলতে নিশ্চয়ই ছোট সাদা গাড়ি দেখেছ যা সাইরেন বাজিয়ে চলছে আর তার সামনে লেখা আছে এইরকমঃ
এই লেখাটাকে আয়নায় দেখ তো! কি দেখছ?
লেখা আছে -AMBULANCE
অর্থাৎ যে গাড়িতে কোন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আয়না তো সবার বাড়িতেই আছে। সেটার দিকে তাকালেই বুঝবে সে কেমন উল্টোমত ব্যবহার করে। তোমার বামদিকের সিঁথিকে মনে হয় ডান দিকে, বাঁ-হাত, বাঁ-পা হয়ে ডান -হাত, ডান পা। তবে মাথাটা পায়ের দিকে বা পা'টা মাথার দিকে হয় না। এর একটা কারণ অবশ্যই আছে, সেটা পরে বড় হয়ে বুঝবে।
যা হোক যা বলছিলাম। ওই লেখাটা উলটো করে লেখার কারণটা বলি এবার।
ওই গাড়ির আগে যাওয়ার একটু তাড়া আছে সব সময়েই , কারণ ওতে গুরুতর অসুস্থ লোকজন যাতায়াত করে। রাস্তায় চলার সময়ে সামনে গাড়ি থাকলে সে গাড়ি যাতে পথ ছেড়ে দেয়, তার জন্য ঐ ব্যবস্থা। কিন্তু কি করে?
লক্ষ্য করে থাকবে প্রত্যেক গাড়িতেই চালকের ডানদিকে জানালার বাইরে একটা করে আয়না আছে। কোনওটা গোল, কোনওটা বা চৌকো। চালক ওই আয়নার সাহায্যে তাঁর পেছনে আসা গাড়িগুলিকে দেখতে পান। AMBULANCE লেখা থাকলে আয়নায় তার ছবি উলটো হত। চালক হয়ত সেটা গ্রাহ্যই করতেন না। কিন্তু উলটো লেখা সেই আয়নায় সোজা হয়ে চালকের চোখে পড়লেই তিনি ব্যস্ত হয়ে পথ ছেড়ে রাস্তার পাশে চলে আসেন। আর অ্যাম্বুলেন্স তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারে।
আয়নায় তৈরি হওয়া এই ছবিকে বলে প্রতিবিম্ব। গাড়ির চালকের ওই আয়নায় যে প্রতিবিম্ব তৈরি হয় তাতে পেছনের সব গাড়ির অর্থাৎ রাস্তার হাল পরিষ্কার দেখা যায়। ছোট আয়নার মধ্যে গাড়ি-ঘোড়া ছোট ছোট করে দেখা যায়। খেয়াল করে দেখেছ? না হলে দেখে নিও।
তোমার বাড়ির আয়নায় কি ছোট ছোট প্রতিবিম্ব দেখা যায়? মানে তোমার চেহারা কি ছোট্ট হয়ে যায়? না যায় না, তোমার স্বাভাবিক চেহারাটাই দেখা যায়।
কি রকম হল এটা? কোন আয়নায় স্বাভাবিক। একটু অবাক লাগছে তো?
এটা জান যে কোন কোন আয়নায় আবার বড়ও দেখা যায়। কোনটায় বা ব্যাঁকা-ত্যাড়াও দেখায়!
ছোট বেলায় একবার এক বন্ধুর সাথে মেলায় বেড়াতে গেছিলাম। সেখানে নানান খেলা, সার্কাস, ইত্যাদির সাথে 'হাসিঘর' বলে একটা তাঁবু ছিল। টিকিট কেটে ঢুকে দেখি হাসিঘরই বটে। অনেকগুলি একই আকারের ড্রেসিং টেবিল বা আলমারিতে লাগানো হয় এমন বড় বড় আয়না সারি সারি দাঁড় করানো রয়েছে সেখানে।
প্রতিটা আয়নার সামনে যেতেই নিজের কিম্ভূত কিমাকার প্রতিবিম্ব দেখেই হাসি পেল। প্রথম আয়নাতে স্বাভাবিক হলেও পরেরটাতেই একেবারে ছোট্ট, তার পরেরটাতে আবার বেশ বড় সড় স্বাস্থ্যবান দেখতে পেলাম। তার পরে আবার বেঁটে পেটমোটা বা সিড়িঙ্গে বা বাঁকামত চেহারার। অবাক কান্ড। কি করে হয় বলত?
সেটা বলি এবার।
সমতল আয়না
বাড়িতে আমরা যে আয়না ব্যবহার করি সেগুলিকে বলে 'সমতল' আয়না। সমতল মানে হল সমান তল বিশিষ্ট অর্থাৎ উঁচুনিচু নয় কোথাও। শান্ত পুকুরের জল সমতল। যদি পুকুরে ঢেউ থাকে তাহলে সেটা হয়ে যায় অসমতল।
সমতল আয়নায় স্বাভাবিক প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। অর্থাৎ প্রতিবিম্ব হয় নিজের চেহারার মাপে। বাকি যে নানারকমের প্রতিবিম্বের কথা বললাম, সে সব তৈরি হয় অসমতল আয়নার জন্য।
সমতল কাঁচের পেছলের তলে একটা বিশেষ ধরনের প্রলেপ লাগালে সামনের দিক থেকে তাকে চকচকে দেখায়। এটাই আয়না। এতেই প্রতিবিম্ব তৈরি হয়।
তুমি রুটি ভাজার তাওয়া দেখেছ। এর একটা দিক উঁচুমত, আর অন্য দিক নিচু। উঁচু তলাকে বলে উত্তল আর নিচু তলাকে বলে অবতল। যে কাঁচে আয়না তৈরি করা যায়, সেই জাতীয় কাঁচ দিয়ে যদি একটা তাওয়া বানানো যায়, আর ওই তাওয়ার একদিকের (উঁচু বা নিচু) তলে আয়নার মত বিশেষ প্রলেপ দেওয়া হয়, তবে সেটা একটা আয়নার মত ব্যবহার করবে। তবে সেটা আমরা প্রতিদিন যে আয়না ব্যবহার করি, তেমন হবে না, অর্থাৎ সমতল আয়না হবে না।
যদি নিচু দিকে প্রলেপ লাগানো হয় তবে উঁচু দিকটা চকচকে আয়নার মত ব্যবহার করবে। এই ধরণের আয়নাকে বলে "উত্তল" আয়না। এতে যে প্রতিবিম্ব তৈরি হবে সেটা হবে ছোট ছোট, যেমন গাড়ির চালকের ডানপাশের জানালার বাইরে থাকে। এখন বুঝতে পারি হাসি ঘরের যে আয়নায় আমি নিজের ছোট চেহারা দেখেছিলাম সেটাও ছিল "উত্তল" আয়না।
গাড়ির চালকের জন্য উত্তল আয়না
আর উঁচু দিকে প্রলেপ দিলে নিচু দিকটা আয়নার মত আচরণ করবে। তখন এই আয়নাকে বলে "অবতল" আয়না। এর কাছাকাছি দাঁড়ালে বড়সড় আকারের প্রতিবিম্ব তৈরি হবে। এমনটা ওই হাসিঘরে দেখেছি। এমন আয়না ব্যবহারিক জীবনেও কাজে লাগে। দূরে দাঁড়ালে এতে উলটো এবং ছোট বা বড় প্রতিবিম্ব তৈরি করা যায়। উচ্চ ক্ষমতার দূরবীন তৈরি করতেও এমন উত্তল বা অবতল আয়নার দরকার হয়।
একটা কাঁচের গ্লাসকে টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে যদি ওপর থেকে নিচু পর্যন্ত লম্বালম্বি কেটে ফেলা হয়( যদিও সেটা কাটা যায়না) তবে যে আকার পাবে তাতেও প্রলেপ লাগিয়ে আয়না তৈরি করা যেতে পারে।
প্রলেপ ভেতরের দিকে লাগালে বাইরে চকচকে হবে, আর বাইরে দিলে ভেতরে চকচকে হবে। এরকম আয়না হল চোঙাকৃতি আয়না।
এরকম আয়নাকে দাঁড় করিয়ে তার সামনে দাঁড়ালে সিড়িঙ্গে মার্কা দেখানে, তা যেদিকেই চকচকে থাক না কেন। আর যদি ওই আয়নাটাকে শুইয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তার সামনে দাঁড়ালে পেটমোটা দেখতে পাবে।আর আয়নার কাঁচটা যদি একেবারেই সমতল না হয়ে অসমতল হয়, তবে তাতে আঁকা-বাঁকা ছবি দেখা যাবে। অযত্ন করে বানানো আয়না এইরকম অসমতল হয়।
উত্তল আয়নায় বিকৃত প্রতিফলন
তাই আয়না কেনার সময়ে এটা খেয়াল করা দরকার যেন সেটা অসমতল না হয়। খেয়াল না করলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অনেকে ঠকেও যায়। পরে আফসোস করতে হয়।
কি করে খেয়াল করবে? খুব সোজা।
যে আয়নাটাকে কেনা হবে, সেটার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার পেছনের দূরের জিনিষগুলির প্রতিবিম্ব দেখার চেষ্টা করবে। ভাল আয়না হলে সোজা স্পষ্ট প্রতিবিম্ব হবে আর খারাপ হলে সেগুলি আঁকাবাঁকা হবে।
এ সম্পর্কে আরো কিছু বলা বাকি থাকল। পরের সংখ্যায় জানাব।
সন্তোষ কুমার রায়
কোদালিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
ছবিঃউইকিপিডিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সন্তোষ কুমার রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
লাইফ অফ পাই
বইটা কিনেছিলাম বেশ কিছুদিন আগেই। কিন্তু পড়া হয়ে উঠছিল না। যবে থেকে শুনলাম 'লাইফ অফ পাই' সিনেমাহলে মুক্তি পাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি, তবে থেকে তড়িঘড়ি পড়তে শুরু করলাম সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা ইয়ান মার্টেল এর এই বিখ্যাত বই। তবে আধাআধি পড়ে ওঠার আগেই বাড়ির কাছের মাল্টিপ্লেক্সে চলে এল থ্রি-ডি ভার্সনে 'লাইফ অফ পাই'। তাই বাকি গল্পটা পর্দায় দেখতে চলে গেলাম একদিন।
'লাইফ অফ পাই' ত্রিমাত্রিক বা থ্রি-ডাইমেনশান্ল্ ছায়াছবি। অর্থাৎ এই ছবির বেশ কিছু অংশ ত্রিমাত্রিক ভাবে দেখা যাবে। পর্দায় উড়তে থাকা পাখিটা হটাৎ তোমার চোখের একদম সামনে এসে ডানা ঝাপ্টাবে, বৃষ্টি পড়লে মনে হবে এই বুঝি আমি ভিজে গেলাম। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে গেলে চোখে পড়তে হয় এক বিশেষ ধরনের চশমা, যেটা কিনা সিনেমাহল থেকেই ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। আমি এক আগে কোনদিন থ্রি-ডি ফিল্ম দেখিনি, তাই প্রবল আগ্রহে চশমা চোখে পড়লাম।
আর তারপরেই সেই চমক! গল্পের পটভূমির চিড়িয়াখানার পশু-পাখিরা সব যেন হাতের নাগালে চলে এল - মনে হল হাত বাড়ালেই হয়ত বা ছুঁতে পারব হেলে-দুলে চলতে থাকা পেলিক্যান পাখিগুলিকে; গাছের মগডালের বাঁদরটা এই না লাফিয়ে এসে পড়ে আমার ঘাড়ে...মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলাম উন্নত প্রযুক্তির কম্প্যুটার অ্যানিমেশনের সাথে টানটান গল্প আর অনবদ্য অভিনয়ের যুগলবন্দী।
গল্পের শুরু পন্ডিচেরীতে। সেখানকার চিড়িয়াখানার মালিকের ছোট ছেলের এক সাঁতার-পাগল মামা তার নাম রাখলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত সুইমিং পুল পিসিন্ মলিটর্ (Piscine Molitor )এর নামে! যেহেতু তার বন্ধুরা সবাই তার নাম নিয়ে খ্যাপাত, তাই সে নিজের নামকে ছোট করে রাখল গণিতের চিহ্ন 'পাই' এর নামে। তার নতুন নাম হল পাই প্যাটেল। পাই যদিও হিন্দু ছিল, কিন্তু ইসলাম ও খ্রীষ্ট ধর্ম সম্পর্কে জানার তার সমান উৎসাহ ছিল। চিড়িয়াখানার পশু-পাখীদের মধ্যে তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল রিচার্ড পার্কার নামে এক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
পাই এর ষোল বছর বয়সে তার বাবা ঠিক করেন চিড়িয়াখানার পশুপাখীদের অন্যান্য চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দিয়ে তাঁর পরিবারকে নিয়ে কানাডাতে বসবাস করতে চলে যাবেন। পাই, তার দাদা এবং তার মায়ের অনিচ্ছা সত্বেও তিনি সব ব্যবস্থা হরে ফেলেন। তারপর একদিন জাপানি মালবাহী জাহাজ 'সিমসুম' এ চেপে বেশ কিছু পশু-পাখী সহ পাই- এর পরিবার চিরদিনের মত ভারত ছেড়ে কানাডার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে এক ভয়ানক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে ওই জাহাজ। পুরো জাহাজটাই তলিয়ে যায়। ঘটনাচক্রে প্রাণে বেঁচে যায় পাই। দুরন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে, পাহাড়সমান ঢেউয়ের সাথে লড়াই করতে একটা লাইফবোটে তার সংগী হয় একটা পা ভাঙা জেব্রা, একটা স্পটেড হায়না, অরেঞ্জ জ্যুস নামের এক বয়স্কা ওরাংউটাং আর হ্যাঁ - রিচার্ড পার্কার নামের সেই ভয়ানক সোঁদরবনের বাঘ। কয়েকদিনের মধ্যেই অবশ্য পশুরাজ্যের নিয়ম মেনে পাই ছাড়া লাইফবোটে রয়ে যায় একমাত্র রিচার্ড পার্কার।
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দিশাহীন অবস্থায় রিচার্ড পার্কারকে সঙ্গী করে ২২৭ দিন ভেসে বেড়ায় পাই প্যাটেল।
কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? উদ্দাম প্রকৃতির ভয়াল রূপের সামনে কি রিচার্ড পার্কার মেনে নিল পাই এর সাথে এই দীর্ঘ যাত্রা? গড়ে উঠল তাদের মধ্যে কোন নতুন সম্পর্ক? না, সেই গল্প আমি বলব না। যদি জানতে চাও গল্পের শেষে কেমন হল পাই আর রিচার্ড পার্কারের সম্পর্ক, তাহলে কিন্তু দেখতে হবে পরিচালক অ্যাং লি এর ছবি 'লাইফ অফ পাই'।
ফক্স ২০০০ পিকচার্স প্রযোজিত, ২০১২ সালে নির্মিত এই ছবিতে অভিনয় করেছেন ভারতের ইরফান খান, টাবু আর আদিল হুসেন। পাই এর ভূমিকায় জীবনে প্রথমবার অভিনয় করেছে দিল্লির ছাত্র সূরজ শর্মা। এক বিশেষ চরিত্রে আছে ফ্রান্সের বিখ্যাত অভিনেতা জেরার্দ দেপারদ্যু। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের ১১ টি বিভাগে মনোনয়ন পায় এই ছবি। জিতে নেয় আরো বেশ কিছু পুরষ্কার।
তাহলে কি ভাবছ, ভাব জমাতে যাবে নাকি রিচার্ড পার্কার আর পাই প্যাটেলের সাথে?
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
লাইফ অফ পাই অফিশিয়াল ওয়েবসাইট
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত