মেঘ বৃষ্টির দেশে (পর্ব-২)
সিরাজুল, ভুলে গেছো কী আমায়? ও চিনতে পারছো না বুঝি? তা তো হবেই। সেই যে আগষ্টের দু-তারিখে আমাকে তুমি টাটা করে একটা ছোট্ট ডিঙিতে উঠলে তারপর তোমার আর পাত্তাই নেই। মাঝে একটা চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে। চাঁদের বুড়ি সেটা ইচ্ছামতীতে ভাসিয়ে দিলো। আর কাগজের নৌকা হয়ে ভাসতে ভাসতে সে তোমার সুন্দর বনের সুন্দর গ্রাম পাখিরালায় যখন পৌঁছোলো তখন শীত এসে গেছে গুটি গুটি পায়ে। চারিদিকে কুয়াশা নামছে ঘন। তুমি আর তোমার বোন আনন্দি পড়তে চলেছো ভবেশ স্যারের বাড়ি বাঁধের রাস্তা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে। বিন্দু এই শীতেও বাগদার মীন ধরতে নেমেছে জলে। আনিসুল চাচা খেজুর রসের হাড়ি নামাতে যাচ্ছেন গাছ থেকে। আর হীরু ময়রা এই মাত্র উনুনে আগুন দিয়েছে। সাড়ে ছটার নৌকা আজ ঢের দেরী করবে। তাই লুচি ভাজার জন্যে আজ তাড়াতাড়ি নেই। সামনের হাটের লোকজন সবে জড়ো হতে শুরু করেছে। তুমি আর আনন্দি সেই হাট পেরোলে, মাঠ পেরোলে, প্রাইমারী স্কুলটার পেছনে ফুলে ভরা সজনে গাছটা পেরোলে-আমি চোখ বন্ধ করে সবটা দেখতে পাই সিরাজুল এখোনো। জানতে চাইছো তাহলে কেনো আসছি না তোমার গ্রামে? কেনো ভাসিয়ে দিচ্ছি না আমার ছোটো পানসিটা হরিণভাঙার স্রোতে? কেনো রাতে করিম চাচার নৌকায় রাতের আঁধারে বসে কুমীরের গল্প শুনছি না? আর সেই দুষ্টু বাঘটাকে ভয় দেখানোর জন্যে কেনোই বা মশাল হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছি না বাঁধের চারধার তোমার আর আনন্দির সাথে? এই গুলো আমি কোনোটাই করতে পারবো না সিরাজুল যতক্ষণ না তুমি আমার চিঠির একটা লম্বা উত্তর লেখো। যতক্ষণ না তুমি এসে আমার উত্তরপাড়ার খেয়াঘাট থেকে আমাকে এসে নিয়ে না যাও। হ্যাঁ আমি তোমার ওপর রাগ করেছি সিরাজুল। খুব রাগ। দেখা হলে প্রথমে দুজনে মিলে খুব ঝগড়া করে নেবো একচোট। কিন্তু তার আগে তো শোনাতে হবে আমার সেই চেরাপুঞ্জি যাওয়ার গল্প। না হলে তোমার মুখ যেমন ভারী হবে ঠিক তেমনি আর কোনোদিন ইচ্ছামতীতে আমাকে কাগজের নৌকা ভাসাতে দেবে না চাঁদের বুড়ি। কী শুনতে চাও তো আমার সেই মেঘ বৃষ্টি দেশে ঘুরে বেড়ানোর গল্প? জানো সিরাজুল এক্ষুনি তোমার নাক ফোলানো রাগ করা মুখটা আমি দেখতে পেলাম। আচ্ছা ঠিক আছে এরপর যখন কোথাও দূরে যাবো...অনেক দূরে...তোমাকে সঙ্গে নেবো। এখন তুমি তো আর ছোটোটি নেই...তোমার গোঁফটাও শুনলুম বেশ হয়েছে। থুতনির কাছে কচি ঘাসের মতো কয়েকটা দাড়ি। উফ...আচ্ছা...আর বলবো না। লজ্জা পেয়েছো না? ঠিক আছে। তাহলে এই ছবিটা ভালো করে দেখো।
ফলটাকে কী চিনতে পারছো? হ্যাঁ ঠিক ধরেছো। ন্যাসপাতি। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথে এই রকম অনেক ন্যাসপাতি গাছের দেখা পেলাম আমি। বায়না করতেই, আমার গাড়ি চালক বাপি এনে দিলো কয়েকটা। কিন্তু সেগুলো তখোনো কোষ্টো। বিস্বাদে ভরা। পাকতে আরো দেড় দুই মাস। কিন্তু প্রথম ন্যাসপাতি গাছ দেখে আমার যা আনন্দ হলো তোমায় বলতে পারবো না সিরাজুল। লিখেও বোঝাতে পারবো না। তা সে তুমি আমার যতই মার্কস কাটো না কেনো। রাস্তায় চলতে চলতে যতই আমাদের গাড়ি পাহাড়ি উতরাই ধরে উঁচুতে চড়তে লাগলো ততই ঘন কুয়াশা ঘিরে ধরলো আমাদের। পাশের বন্ধু শীতের র্যাপার বের করে গায়ে পড়লো। কিন্তু তুমি তো জানো। আমার শীত বড় কম। কিচ্ছুটি পড়লাম না। শুধু একটু বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করলো। বন্ধুর ধমকানিতে সেটাও কী হবার জো আছে? হঠাত গাড়ির বাইরে জানলার দিকে চেয়ে দেখলাম কুয়াশা ঘিরে ধরছে আমাদের। ঘন কুয়াশা। মনটা আবার হঠাত ভালো হয়ে গেলো সিরাজুল। বৃষ্টি ভেজার কথা ভুলেই গেলাম।
গাড়ি থামাতে বললাম আমাদের সারথী বাপীকে। চারিদিকে যেদিকে তাকাই শুধু কুয়াশা আর বৃষ্টি। সেই আঁধার আলোর মধ্যেই চোখে পড়লো একটা সাইন বোর্ড। বুঝতে পারলাম আমি পৌঁছে গেছি চেরাপুঞ্জির প্রথম দরজা শোরেতে।
ছবি দেখে বুঝতে পারছো কি, কুয়াশার ঘন ঘটা কেমন ছিলো? না সত্যি ঠান্ডা লাগছিলো না জানো। অথচ চারপাশের লোকজন ভিজে ভিজে কাজ করছে। কারোর বারণ না শুনে আমি সামনের একটা চায়ের দোকান থেকে চা খে্তে চাইলাম। টুপ করে নেমে পড়লাম রাস্তায়। আর তখনি অবাক হয়ে দেখলাম রাস্তার ধারেই একটা ছোট্ট সুন্দর ঝরনা।
ঝরনা দেখে খুশিতে আহ্লাদে আটখানা হওয়ার জোগাড়। এই ঝরণা গুলোতে সারা বছর জল থাকে। বৃষ্টির জলে পুষ্ট হয়ে নেমে আসে পাহাড়ের খাদ বেয়ে। ঝরনার ছবি তুলে আমি চায়ের দোকান থেকে চা খেতে গিয়ে শুনলাম সামনে এখোনো অপেক্ষা করে আছে আরো নানান সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড়ের একটা সুন্দর শহর এই চেরাপুঞ্জি। ২০০১ সালের জনগনণা অনুসারে চেরাপুঞ্জির জনসংখ্যা ১০,০৮৬ জন। তাহলে ভাবতেই পারছো তোমার পাখিরালা বা আমার উত্তর পাড়া থেকে কতটা কম। হ্যাঁ এই বারো বছর পরেও। এখানে অনেকে ছোট-খাটো খনিতে কাজ করে। ক্ষেতে কাজ করে। কেউ কেউ পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে। আবার কেউ বা হাতের কাজে দক্ষ। তবে অনেকে খুব গরীব। সরকারের তরফ থেকে নানা কিছু চেষ্টা চলছে হয়তো কিন্তু তার সুদূর প্রসারী প্রভাব এইসব মানুষদের জীবনে আসতে এখোনো ঢের দেরী। তার সাথে আছে রাজনৈতিক নানা কিছুর অশান্তি। ওঃ ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার তো আবার এইসব শুনতে মোটেই ভালো লাগে না। আচ্ছা ঠিক আছে যে দুজনের সাথে রাস্তার ধারেই পরিচয় হলো তাদের ছবি আগে তোমাকে দেখাই। তারপর সিরাজুল আমাকে বলতে হবে এরা কী কাজের সঙ্গে যুক্ত। কেমন? রাজী তো?
বুঝতে পারছো কী ছবিটা দেখে কিছু? ধরতে পারলে না তো? তাহলে বলি শোনো। এখানে অনেক ছোট ছোট কয়লার খনি আছে। হ্যাঁ বেশিরভাগ গুলোই বে-আইনি। সরকার থেকে সেখানে কয়লা তোলার কোনো অনুমতি নেই। তবুও এরা সেই কাজ করতে বাধ্য হয়। ঠিক যেমন তোমাদের গ্রাম থেকে এখোনো অনেকে লুকিয়ে লুকিয়ে জঙ্গলে কাঠ কাটতে যায়, মধু আনতে যায় তেমন। ওদের সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই। ওরা কথা বলতে থাকলো ওদের খাসি ভাষায়। আর আমাদের ড্রাইভার বাপি সব অনুবাদ করে দিতে থাকলো বাংলাতে। আড্ডাটা যখন বেশ জমে উঠেছে, তখন ওরাই বললো, “এইবারে বেরিয়ে পড়ো বাবুরা...সামনে এখোনো অনেকটা পথ বাঁকি। কত কিছু দেখার আছে আমাদের এই দেশে। কত পাহাড়, কত নদী। অনেক দেখো...অনেক ছবি তোলো...।” ওদের সাথে...ওদের মতো করে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো সিরাজুল। মনে হচ্ছিলো ওদের সাথে গিয়ে দেখে আসি ওদের কয়লা খনিটাকে। কিন্তু সময় নেই হাতে। একদিনের মধ্যে আমাকে দেখতে হবে এই সুন্দরী চেরাপুঞ্জিকে। গাড়ি বাঁক নিলো। আর যে জায়গাটায় এসে দাঁড়ালাম সেটা হচ্ছে অন্ধকার এক সুড়ঙ্গের সামনে। প্রাকৃতিক এই সুড়ঙ্গটা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণের জায়গা।
বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না ভেতরটা ঠিক কতটা অন্ধকার হতে পারে। আর এই সুড়ঙ্গের মধ্যে তোমাকে খালিপায়ে হাঁটতে হবে সিরাজুল। জুতো পড়ে ঢুকতে দেয় না। আমি অনেক জঙ্গলে ঘুরেছি, হাতির পিঠে চড়ে জংলী হাতিকে তাড়া করেছি। অনেক রাতে সুন্দর বনের খাড়িতে তোমার সাথে কাঁকড়া ধরতে গেছি। সেই দুষ্টু কুমীরটাকে দেখতে ছুটে গেছি লাল কাঁকড়ায় মোড়া মোহনার কাছে। আমার আবার ভয় কি? বন্ধুদের স্বান্তনা দিই। কিচ্ছুটি হবে না চল না ভেতরে। বলছে তো লাইট আছে। কোনো রকমে রাজী করিয়ে, কুড়িটাকা দিয়ে টিকিট কেটে জুতো গুলো এক জায়গায় জমা রেখে আমরা ঢুকলাম সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে। আর ঢুকেই যেটা বুঝতে পারলাম, এই অভিজ্ঞতা অন্য সব কিছুর থেকে অন্য রকমের হতে চলেছে।
সুড়ঙ্গের ভেতরে পা দিতেই ছ্যাঁক করে উঠলো গাটা। এতো ঠান্ডা পায়ের তলার জলটা। আর পাথর গুলো এতো পেছল? সামনের পথটা আগে অনেকটা বেশি চওড়া ছিলো। কিন্তু যতই এগোতে থাকলাম ততই দেখতে পেলাম ক্রমশ শুরু হয়ে যাচ্ছে পথটা। আর পায়ের নীচে জলটাও বেড়ে যাচ্ছে। হাঁটু পর্যন্ত সমান। মাত্র চারজন করে লোক ঢোকায় এই সুড়ঙ্গে। আমরা চারজন খুব কাছাকাছি পরপর দাঁড়িয়ে। কারণ সামনেই জলের যে অংশটা দেখতে পাচ্ছি সেটা অনেকটা। নীচের কাঠের তক্তাগুলোকে অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু সেই তক্তা গুলোও অশক্ত। এদিকে বাইরে শুনে এসেছি গত সাতদিনের থেকে নাকি আজকে বেশি বৃষ্টি পড়ছে। আর সুড়ঙ্গের মধ্যে জল জমা হচ্ছে অনেক। আমরা আর একটুও দেরী না করে একে অপরের হাত ধরে ছোট বেলায় যেমন করে ট্রেন ট্রেন খেলতাম ঠিক সেই রকমভাবে পরপর দাঁড়ালাম। আর এক এক জন করে কাঠের তক্তা পেরোতে চেষ্টা করলাম। সবার শেষে আমি। আমার হাতে ক্যামেরা। সবাই এক এক করে টপকে গেলো সেই ঠান্ডা শীতল জল। খুব পিচ্ছিল পাথর। কাঠের তক্তা। ওপারে আরো অন্ধকার। ওরা ওদিক থেকে আমাকে ডাকতে থাকলো “কল্লোল খুব তাড়াতাড়ি…। এদিকের জল আরো বাড়ছে। সুড়ঙ্গ থেকে বেরোতে আমাদের আরো পাঁচমিনিট লাগবে।” আমি যেটা কোনোদিন করিনা সিরাজুল…সেই ভুলটাই করে ফেললাম। তাড়াতাড়ি সেই পাথর আর কাঠের তক্তার ওপর দিয়ে যেতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেলাম আচমকা সেই ঠান্ডা জলে। আর ঠিক তখনি সুড়ঙ্গের সব আলো গুলো নিভে গেলো। চারিদিকে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা।বন্ধুরা চিতকার করে ডাকতে থাকলো, “কল্লোল...কল্লোল...”। আমি তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে আমি আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছি অনেক অনেক গভীর জলে। চারিদিক থেকে যেন আমাকে ঘিরে ধরছে অনেক অনেক বছর আগে জমে থাকা শ্যাওলা। আমি বাঁচার জন্যে কাঠের তক্তা ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথায় কাঠের তক্তা? কোথায় কী? আমি আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে থাকলাম জলের তলায়। তাহলে কী আমি ডুবে যাচ্ছি? মাকে দেখতে ইচ্ছে করলো খুব...তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করলো সিরাজুল। কিন্তু ততক্ষণে শ্যাওলা গুলো আমাকে ঢেকে ফেলেছে। আমি আর কোনোদিন বেরোতে পারবো এখান থেকে? জলের তোড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম সেটা অসম্ভব। আমরা আটকে পড়েছি অন্ধকার সুড়ঙ্গে। আমাদের এখন বিপদ। মনে হলো আস্তে আস্তে তলিয়ে গেলাম গভীর জলে।
ছবি ও লেখা
কল্লোল লাহিড়ী, উত্তর পাড়া
তথ্য- উইকিপিডিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
সেইসব পৌষের সন্ধ্যা...
পৌষ সংক্রান্তির দিন কয়েক আগে মা বললেন- ময়দা, নারকেল, চালের গুঁড়ো , ক্ষীর, নতুন গুড় - এই্সব যোগাড় করে রাখতে। পিঠে পুলি বানাতে হবে যে! এখন যেহেতু আমি নিজে নিজেই পিঠে পুলি বানাতে পারি (অনেকটা বড় হয়ে গেছি কিনা) তাই আমিও মা'কে সাহায্য করলাম। করতে করতে মনে পড়ে গেল আমাদের ছোট বেলার পৌষ -পার্বণের কথা। মায়ের এখন বয়স হয়েছে, এখন আর অত পিঠে এক সাথে বানাতে পারেন না। আমারও নানা কাজের চাপে একসাথে প্রচুর রান্না করা সম্ভব নয়। কিন্তু যখন আমি আর ভাই ছোট ছিলাম, তখন পিঠে তৈরি হওয়াটা যেন একটা উৎসব ছিল। আমার মা সকালবেলা স্কুলে পড়াতে যেতেন। ফিরে আসতেন বেলা এগারোটা নাগাদ। তখন পৌষ সংক্রান্তি বলে স্কুলে ছুটি থাকত কিনা আমার ঠিক মনে নেই। তবে মনে আছে, দুপুরের পর থেকে মা রান্নাঘরে টুকটুক করে কাজ করতে শুরু করতেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামত। রান্নাঘরের এলামাটির হলুদ রঙা দেওয়ালকে আরো উজ্জ্বল করে তুলত হলুদ বাল্বের আলো। উঁচু কাউন্টার (এখন তার বিলিতি নাম শিখেছি, তখন তো বলতাম 'তাক') এর ওপরে হিটারে তাওয়া বসিয়ে মা ভেজে তুলতেন ক্ষীর নারকোলের পুর দেওয়া 'পাটিসাপ্টা'। তারই পাশে গ্যাসের মৃদু আঁচে ফুটতে থাকত দুধে ডোবা সাদা সাদা 'বকুল পিঠে'। পাশাপাশি ঘরের এক কোণে জ্বলে উঠত কয়লার উনুন। সেখানে বিশেষ ভাবে তৈরি মাটির সরায় চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হত 'সরা পিঠে', যেটাকে মাঝে মাঝে 'আস্কে পিঠে'ও বলা হত। সেই দক্ষিণী ইডলির মত দেখতে সরা পিঠে খাওয়া হত নতুন খেজুর গুড় দিয়ে।
ওদিকে পাটিসাপ্টা ভাজা শেষ হয়ে গেলেই সময় চলে আসত 'জিবেগজা' আর 'এলোঝেলো' তৈরি করার। মাটিতে খবরের কাগজ বিছিয়ে বেলনা-চাকি নিয়ে মা ঝটাপট বেলে ফেলতেন জিবেগজা; সেই গজাকেই ছুরি দিয়ে একটু কায়দা করে চিরে নিয়ে দুই হাতে ধরে একটু পাক দিলেই হয়ে যেত এলোঝেলো। আমি আর ভাই মা'কে এলোঝেলো বানাতে সাহায্য করতাম। তারপরেও সময় থাকলে তৈরি হত কুড়মুড়ে 'মুগের চাপ্টি'। শীতের সন্ধ্যেয় রান্নাঘরের নরম গরম হলুদ আলোয় মা আমাদের গরম গরম ভেজে খেতে দিতেন। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত মায়ের সেই হাসিমুখ আমাদের তৃপ্তিভরা মুখ দেখে খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠত।
এরই মধ্যে পিসিদের বাড়ি থেকে , বা পাশের বাড়ির মামির থেকে চলে আসত 'দুধ-পুলি' বা 'গোকুল পিঠে'। সব মিলিয়ে সন্ধ্যের খাওয়াটা হয়ে উঠত জমজমাট। রাতে আর ভাত খাওয়ার প্রশ্নই ছিল না।
আরেকটা জিনিসও তৈরি করা হত এই সময়েই। সেটা ছিল মুড়ির মোয়া বানানো। আজকাল আর কেউ বাড়িতে মুড়ির মোয়া বানায় না। মা বড় টিন ভর্তি করে মুড়ির মোয়া বানিয়ে রাখতেন। সেটা হত সন্ধ্যের জলখাবার। গরম এবং তরল হয়ে যাওয়া গুড়ের মধ্যে টাটকা মুড়ি মিশিয়ে হাত দিয়ে গোল গোল করে বড় বড় মোয়া বানানো হত। আমি আর ভাইও হাত লাগাতাম।বানাতে বানাতে বেশ কয়েকটা খেয়েও ফেলতাম।
আজকের এই ব্যস্ত দুনিয়ায়, আরো অনেক সাবেকি খাবারের মতই, শীতকালে মিষ্টির দোকানে বিক্রি হয় ঠাণ্ডা, শক্ত পাটিসাপ্টা; অতি বাজে খেতে হয়; প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া বাজে তেলের গন্ধওয়ালা এলোঝেলোও কিনে খেয়ে দেখেছি। মন ঠিক ভরে না। মায়ের হাতের স্বাদ ও পাই না, গরম গরম খাওয়ার সুখ ও নেই। কিন্তু কি আর করা যাবে - রান্নাঘরের দেওয়ালে এলামাটির জায়গা নিয়েছে নানারঙা অয়েল পেইন্ট। পেটমোটা উষ্ণ হলুদ রঙের গোলগাপ্পা বাল্ব জায়গা করে দিয়েছে শীতল সাদা ডায়েট করা সি-এফ-এল ল্যাম্পকে। গতিময় জীবনের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মেনে নিয়েছি অনেক বদল, এটাও তার মধ্যে একটা।
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
মজার পাতা
বলো তো দেখি কী—
১. হাত আছে করে খাও, শেষ ছেড়ে দিয়ে,
মধ্য বিহনেতে আছে নৌকায়, দেখ গিয়ে,
তিনে মিলে কাজে কিন্তু লাগে ধরিবার,
অভাবে বিকল কল, অস্ত্র, দ্বার, জলাধার।
২. পুরা জলযানে রয় শুরু শেষ মিলে,
আদি কিংবা অন্তহীনে গাছেতে তা মেলে,
তিনে মিলে স্বর্গলাভ আশে জলান্জলি,
নাম তুমি ভেবেচিন্তে দাও দেখি বলি।
৩. শুরুতে পাখির ডাক, যার অভাবে হাতি,
মধ্যহীনে কর্ম করি, তিনে লিখি পাতি।
৪. দুধের ওপরে রয়, প্রথম অক্ষর বিহনে,
শেষ ছেড়ে থাকি, মোর বসত যেখানে,
আগে পিছে দিনের নাম, ভেবে দেখ মনে,
বিবাহের শেষে লাগে যদি মেলে তিনে।
৫. মাথা কাটা গেলে কিন্তু ফসল ফলায়,
পেট কেটে অন্যে পাবে, আপন সে নয়,
তিনে বাড়ে ব্যবসাতে, লাভ হ’লে পেতে,
নাম তার ঠিকঠাক, পারো কি বলিতে?
উত্তরমালা :
১. হাতল
২. পাতাল
৩. কাগজ
৪. বাসর
৫. পসার
অধ্যাপক ( ডঃ ) জি০ সি০ ভট্টাচার্য্য
বারাণসী, উত্তর প্রদেশ
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জি সি ভট্টাচার্য্য
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
ইচ্ছেমতন
ইচ্ছামতীর বন্ধু ঐশী এক কাল্পনিক গ্রহের ছবি এঁকে পাঠিয়েছে । সে এই গ্রহের নাম দিয়েছে 'সোরিং' (Soarin'), কারণ এই গ্রহের গাছপালারা সব্বাই আকাশের দিকে বেড়ে উঠতে চাইছে। এই গ্রহের বাসিন্দাদের আবার পায়ের বদলে আছে রোলার বল, যার সাহায্যে তারা সোরিং এর ওপরে চলাফেরা করে।
ছবি এঁকেছেঃ
অমিতৌজা ঐশী বসু,
তৃতীয় শ্রেণী, ফার্মিংটন উড্স্ ইন্টারন্যাশনাল ব্যাকালরিয়েট এলিমেন্টারি স্কুল, কেরি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
এদিকে দেখ কান্ড! ইচ্ছামতীর আরেক বন্ধু অনির্বাণ এঁকে পাঠিয়েছে একটা রকেটের ছবি! এই রকেটটাতে চেপে ঐশী, অনির্বাণ আর ইচ্ছামতী সোরিং এ বেড়াতে যাবে নাকি? কি মনে হচ্ছে বলতো?
ছবি এঁকেছেঃ
অনির্বাণ দাশ,
তৃতীয় শ্রেণী, সারথী স্কুল, হায়দ্রাবাদ
তুমিও পাঠাও না তোমার মনের মত ছবি এঁকে আমাদের 'ইচ্ছেমতন' পাতার জন্য - এই পাতাটা একেবারে তোমার যা ইচ্ছে লেখা আর আঁকার জন্য।
তোমার আঁকা ছবি আর লেখা পাঠাও আমাদের মেইল ঠিকানায়ঃ
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সৃজন বিভাগ
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ
১৮৯২ সালের শেষ- ১৮৯৩ সালের শুরু দিকে স্বামীজি পায়ে হেঁটে ভারত দেখার অঙ্গ হিসাবে কন্যাকুমারী থেকে রামেশ্বরম হয়ে মাদ্রাজে আসেন। মাদ্রাজে প্রচুর শিক্ষিত উৎসাহী যুবক তাঁর অনুগামী হন , এবং এইখানেই বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগদান করার জন্য তাঁর যে ইচ্ছা ছিল সেটার দিকে প্রথম এক ধাপ এগোতে পারেন তিনি। ১৮৯৩ সালের মার্চ- এপ্রিল মাস ধরে তাঁর শিষ্যরা এই যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা যোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু আমেরিকা যাওয়ার আগে, স্বামিজী তাঁর শিষ্য, ক্ষেত্রীর মহারাজার সাথে দেখা করতে যান। ক্ষেত্রীর মহারাজার অনুরোধেই স্বামিজী বিবেকানন্দ নাম গ্রহণ করেন - যে নামে তিনি পরবর্তীকালে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৮৩ সালের ৩১শে মার্চ বম্বে থেকে জাহাজে চেপে যাত্রা শুরু করেন।
সিলোন, পেনাং, সিঙ্গাপুর, হংকং হয়ে ক্যান্টন দেখে তিনি নাগাসাকি যান। সেখান থেকে তিনি স্থলপথে ওসাকা, কিয়োটো, টোকিও হয়ে ইয়োকহামা যান। জাহাজী জীবনে স্বামিজী ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর যাত্রাপথে নতুন নতুন দেশে নানা রকমের সংস্কৃতির সাথে তিনি পরিচিত হন। ইয়োকহামা থেকে জাহাজ ভেসে চলে ভ্যাঙ্কুভারের দিকে । সেখান থেকে ট্রেনে চেপে তিনি শিকাগো পৌঁছান জুলাই মাসের শেষের দিকে। শিকাগো পৌঁছানোর কয়েকদিন পরে তিনি ধর্ম মহাসভার অফিসে গিয়ে দেখা করেন। সেখানে তিনি জানতে পারেন মহাসভা সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের আগে শুরুই হবে না। তাঁকে আরো বলা হয়, ঠিকঠাক শংসাপত্র না থাকলে কাউকে বক্তা হিসাবে যোগদান করতে দেওয়া হবে না, আর এমনকি সেই যোগদানের শেষ দিনও পেরিয়ে গেছে! এ ছিল এক চরম দুঃসংবাদ। তিনি বুঝতে পারলেন তিনি ভারত থেকে অনেক আগে চলে এসেছেন, আর তাঁর উচিত ছিল কোন সংগঠনের প্রতিনিধি হয়ে আসা। তাঁর টাকাপয়সা ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসছিল। স্বামিজী খুব হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি মাদ্রাজে বন্ধুদের তার পাঠালেন, যাতে একটা পরিচিত ধর্মীয় সংগঠন তাঁকে তাদের প্রতিনিধি নিযুক্ত করে। কিন্তু সেই সংগঠনের প্রধাণ তাঁর অনুরোধকে পাত্তাই দিলেন না।
এত সব বাধা-বিপত্তি সত্বেও স্বামিজী হার মানলেন না। যেহেতু শিকাগোর তুলনায় বস্টনে থাকা সস্তা ছিল, তাই তিনি বস্টনে চলে গেলেন।ভ্যাঙ্কুভার থেকে ট্রেনে আসার সময়ে তা৬র প্রথম আমেরিকান বন্ধু হয়েছিলেন ম্যাসাচুসেট্স্ এর এক ধনী ভদ্রমহিলা। সেই ভদ্রমহিলা স্বামিজীর চেহারা দেখে এবং কথাবার্তা শুনে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন , যে তিনি তাঁকে তাঁর বাড়িতে থাকতে বললেন। তিনি স্বামিজীকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীক ভাষা বিভাগের অধ্যাপক যে.এইচ.রাইটের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। স্বামিজী এই পন্ডিত অধ্যাপকেরস সাথে চার ঘন্টা ধরে নানারকমের বিষয়ে আলোচনা করলেন।অধ্যাপক রাইট স্বামিজীর সাথে কথাবার্তা বলে এতই প্রসন্ন হলেন যে তিনি তাঁকে বললেন ধর্ম মহাসভায় হিন্দুত্বের প্রতিনিধিত্ব করতে -'একমাত্র এইভাবেই আপনি সারা দেশের কাছে নিজের পরিচিতি রাখতে পারবেন।' স্বামিজী নিজের অসুবিধার কথা বললেন, জানালেন যে তাঁর কাছে কোন শংসা-পত্র নেই।কিন্তু অধ্যাপক রাইট তাঁকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন, তাই বললেন -, 'স্বামিজী, আপনার কাছ থেকে শংসাপত্র চাওয়া মানে তো যেন সূর্যের কাছে জানতে চাওয়া তার আলো দেওয়ার কি অধিকার আছে!' তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর বন্ধু , প্রতিনিধি নির্বাচনকারী কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ ব্যারোস কে একটা চিঠি লিখে দিলেন -' ইনি একজন মানুষ জিনি আমাদের সমস্ত পন্ডিত অধ্যাপকদের সবার থেকে বেশি পন্ডিত।' তার সাথে তিনি স্বামিজীকে শিকাগো যাওয়ার একটা টিকিট উপহার দিলেন, আর ধর্মমহাসভা পরিচালন কমিটির কাছে তাঁর পরিচিতি দিয়ে একটা চিঠি লিখে দিলেন। এই সব ঘটনা ঘটার ফলে স্বামীজি খুব খুশি হলেন।
কিন্তু শিকাগো রেল স্টেশনে পৌঁছানোর পরে আরেকটা গন্ডগোল হল। স্বামীজি দেখলেন তিনি কমিটির ঠিকানাটা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি বুঝতে পারলেন তিনি হারিয়ে গেছেন, আর কোথায় যাবেন তাও জানেন না। আশেপাশের কেউ তাঁকে সাহায্য করছিল না। ক্লান্ত আর হতাশ হয়ে, তিনি সেই রাত্তিরটা চরম ঠাণ্ডার মধ্যে স্টেশনের মালপত্র তোলার জায়গায় একটা বড় ফাঁকা বাক্সের ভেতরে গুটিশুটি হয়ে কাটিয়ে দিলেন। সকাল হলে তিনি শহরের দরজায় দরজায় খাবার চেয়ে বেড়ালেন, কিন্তু বড় শহরের কেতাদুরস্ত বাসিন্দারা তাঁকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। কেউ সাহায্য করল না। পথে পথে ঘুরে, ক্লান্ত হয়ে ঈশ্বরের ভরসায় তিনি শেষে একজায়গায় পথের ধারে বসে পড়লেন। ঠিক এই সময়ে, রাস্তার উল্টোদিকের একটা সাজানো-গোছানো বাড়ির ভেতর থেকে এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন, আর তাঁকে খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ' মহাশয় কি ধর্ম মহাসভার একজন প্রতিনিধি?' স্বামীজি তাঁকে তাঁর সমস্যার কথা খুলে বললেন। সেই দয়ালু মহিলা তাঁকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন, আর বললেন জলখাবারের পর তিনি নিজে স্বামীজিকে ধর্ম মহাসভার অফিসে নিয়ে যাবে। স্বামীজি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হলেন। সেই থেকে শ্রীমতী জর্জ ডব্লিউ হ্যালে, তাঁর স্বামী আর ছেলেমেয়েরা স্বামীজির প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলেন।
শ্রীমতী হ্যালের সাথে তিনি ধর্ম মহাসভার আধিকারিকদের সাথে দেখা করলেন, নিজের শংসা-পত্র দিলেন' তাঁকে সাদরে একজন প্রতিনিধি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হল, আর প্রাচ্যের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হল। ধীরে ধীরে তাঁর সাথে মহাসভায় আসা অন্যান্য বিখ্যাত প্রতিনিধিদের আলাপ হল। সমস্ত কিছুর জন্য তিনি ঈশ্বর এবং তাঁর গুরুকে বারবার প্রণাম জানাতে লাগলেন।
বিশ্বধর্ম সম্মেলনে প্রাচ্যের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে স্বামী বিবেকানন্দ
১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, সোমবার, মহাসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হল শিকাগোর বিশাল হল অফ কলম্বাস-এ, যেখানে জমা হয়েছিলেন সারা পৃথিবীর ১২০ কোটি মানুষের সমস্ত ধর্মের প্রতিনিধিরা। ঠিক মাঝখানে বসেছিলেন কার্ডিনাল গিবন্স্, আমেরিকার রোমান ক্যাথোলিক চার্চের প্রধাণ যাজক। তাঁর ডান দিকে এবং বাঁদিকে ছিলেন প্রাচ্যের প্রতিনিধিরা - ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধি বাংলার প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার আর বম্বে থেকে শ্রী নাগারকার; শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধদের প্রতিনিধি ধর্মপাল, জৈনদের প্রতিনিধি শ্রী গান্ধী, থিওসফির প্রতিনিধি শ্রী চক্রবর্তী ও শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত। তাঁদের সাথে বসে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর সুন্দর চেহারা, উজ্জ্বল মুখ আর জমকালো পোষাক সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। এই প্রথম তিনি এতবড় একটা সভাইয় হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তৃতা দিতে চলেছিলেন। সবাই একে একে বলতে শুরু করলেন। স্বামীজি নিজের বক্তৃতার সময় পিছিয়ে পিছিয়ে দিনের শেষে টেনে নিয়ে গেলেন।
শেষ বিকেলের দিকে, যখন তাঁকে জোর করা হল, তখন স্বামীজি উঠে প্রথমে বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে প্রণাম জানালেন।তাঁর মুখ আগুণের মত জ্বলজ্বল করছিল। তিনি একবার ভাল করে নিজের সামনের বিশাল জনসমুদ্রকে দেখে নিলেন। যখন তিনি মুখ খুললেন, তাঁর কথাগুলি যেন আগুণের শিখার মত নিঃসৃত হল। যেইমাত্র তিনি বললেন -'আমেরিকার বোন এবং ভাইয়েরা...' -অমনি সমস্ত শ্রোতা হইহই করে তাঁদের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সারা সভার মানুষ তাঁকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। প্রায় দুই মিনিট ধরে তিনি কথা বলের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর এই বিশেষ সম্ভাষণ যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল, তার ফলে তিনি আর এগোতেই পারছিলেন না। অবশ্যই তিনিই প্রথম সেই ব্যক্তি ছিলেন যিনি মহাসভার গাম্ভীর্য ত্যাগ করে শ্রোতাদের সাথে তাদের মনের মত ভাষায় কথা বললেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন আবার সবাই চুপচাপ হল, স্বামীজি তখন তাঁর ভাষণ আবার শুরু করলেন। তিনি এই নতুন পৃথিবীকে জানালেন প্রাচীণ দুনিয়ার কথা- বৈদিক সন্ন্যাসীদের কথা, আর হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করলেন সব ধর্মের সেরা ধর্ম রূপে - সেই ধর্ম , যা সারা বিশ্বকে সহনশীলতা আর সার্বজনীন স্বীকৃতি দিতে শিখিয়েছে। তিনি হিন্দুত্বের প্রাচীন পুঁথি থেকে দুটো সুন্দর অংশ তুলে ধরেনঃ
"যেমন বিভিন্ন উৎস থেকে আসা বিভিন্ন স্রোতের ধারা সবগুলি এসে সাগরের জলে মেশে, তেমনি হে ভগবান, মানুষ যত বিভিন্ন পথ ধরে, বিভিন্ন কারণে, সেগুলি নানারকম, বাঁকা অথবা সোজা হলেও, সবই তোমার দিকেই যায়।"
"আমার কাছে সেই আসুক, যেভাবেই আসুক, আমি তার কাছে পৌঁছে যাই; সব মানুষই নানা পথে কষ্ট করছে, যে পথগুলি সব আমাতেই এসে শেষ হয়।"
তাঁর বক্তৃতা খুব ছোট ছিল, কিন্তু তার সার্বজনীনতা, একান্ত ভাব এবং উদারমনস্কতা সবার মন ছুঁয়ে গেল। আরো অনেক হিন্দু প্রতিনিধি ছিলেন, যাঁরা বিভিন্ন সংগঠন বা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, কিন্তু স্বামীজি কোন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন না। তিনি ছিলেন পুরো ভারতবর্ষের প্রতিনিধি, আর তিনি সমস্ত ধর্মের সার্বজনীনতা আর আর সব ধর্মের একই লক্ষ্যের কথা বলছিলেন।মহাসভার পরের অধিবেশনগুলিতে , স্বামীজি তাঁর বিশেষ শ্রোতাদের সামনে বেদান্তের সারসত্যগুলি তুলে ধরেছিলেন, যেগুলি হল সমস্ত মানবজাতির সার্বজনীন ধর্ম।
তিনি বললেন -" যদি কখনো একটা সার্বজনীন ধর্ম তৈরি হয়, সেটা হবে এমন যার কোন অবস্থানে বা সময়ে বাঁধা নয়; যেটা হবে অসীম, ঈশ্বরের মত উপদেশ দেবে, যার আলোয় আলোকিত হবে কৃষ্ণ এবং খ্রীষ্টের ভক্তরা, সাধু এবং পাপী সবাই; যা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ, খ্রীষ্টীয় বা ইসলামি হবে না, বরং হবে এই সবগুলির মিলিয়ে এক- যার কাছে আশ্রয় পাবে সবথেকে খারাপ মানুষের থেকে শুরু করে সবথেকে মহৎ মানুষ- সবাই।সেটা হবে এমন এক ধর্ম যা কাউকে কষ্ট দেবে না, সবার প্রতি সহনশীল হবে; যা সমস্ত পুরুষ ও নারীর মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতে পাবে, আর যে ধর্মের মূল লক্ষ্য হবে মানবসমাজকে নিজের আসল, ঐশ্বরিক প্রকৃতি চিনিয়ে দেওয়া। এইরকম এক ধর্ম সৃষ্টি হলে সবাই কি তাকে অনুসরণ করবে? খ্রীষ্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হতে হবে না, বা হিন্দু বা বৌদ্ধকে খ্রীষ্টান হতে হবে না।কিন্তু প্রত্যেকের উচিত অন্যের থেকে সেরাটুকু গ্রহণ করে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এগিয়ে চলা।"
তিনি শেষ করলেন এই বলে যে ধর্ম মহাসভা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে পুণ্যভাব, পবিত্রতা আর মহানুভবতা কোন একটা ধর্মের অধিকারে নেই, আর প্রতিটা ধর্মই মহান নারী ও পুরুষ তৈরি করেছে। এই অবস্থায়, কেউ যদি মনে করে শুধুমাত্র তার ধর্ম বেঁচে থাকবে আর অন্যান্য সমসত ধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে, তাহলে তাকে করুণা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই; কারণ, অনেক বিরোধিতা স্বত্বেও, খুব দ্রুত সব ধর্মের পতাকায় দেখতে পাওয়া যাবে লেখা আছেঃ 'সাহায্য কর, লড়াই কর না', ' আত্মস্থ কর, ধ্বংস কর না', 'মিলিত হও, শান্তি আনো, ভিন্নমত এনো না।'
স্বামীজির এইসমস্ত জ্বালাময়ী কথার প্রবল প্রভাব হল। মহাশভার প্রতিনিধিদের সাথে সাথে এই ভাষণ শুনলেন সাধারণ মানুষও, আর স্বামী বিবেকানন্দ দ্রুত হয়ে উঠলেন মহাসভার সবথেকে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। আমেরিকার খবরের কাগজগুলি তাঁকে নিয়ে হইচই শুরু করে দিল। শহরের বিখ্যাত সংবাদপত্রগুলি তাঁকে নতুন যুগের একজন দূত, একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টারূপে ঘোষণা করল।বিখ্যাত কাগজ 'দ্য নিউ ইয়র্ক হেরান্ড' লিখল, ' ধর্ম মহাসভার সেরা প্রতিনিধি অবশ্যই ইনি...এঁর কথা শোনার পরে আমরা বুঝতে পারছি এই বিদগ্ধ দেশে মিশনারীদের পাঠানো কি বোকার মত কাজ।'
বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের অভাবনীয় সাফল্যের কথা ক্রমশঃ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বুঝতে পারল , এই একজন মানুষ এসেছেন এক বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য। এই ভাবে সেই উপাধিবিহীন, গোষ্ঠীবিহীন অচেনা সাধু হয়ে উঠলেন একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং সেই সময়ের একজন প্রতিনিধি।
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
সূত্রঃ স্বামী তেজসানন্দের লেখা -আ শর্ট লাইফ অফ স্বামী বিবেকানন্দ
স্বামী বিবেকানন্দের ছবি এঁকেছেন অনুভব সোম
ফটোগ্রাফঃউইকিপিডিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত