একটা বড় অসুবিধা হল, হয়ত পৃথিবীর সব সমাজেই, কিন্তু বিশেষ ভাবে আমাদের দেশে যে, আমরা বড়রা, শিশুদের কোলে রাখব না পিঠে রাখব বুঝে উঠতে পারি না। শিশুদেরও যে একটা নিজস্ব ভাবনার জগৎ আছে, তারাও যে স্বাধীনতা চায়, তা যেন আমাদের- অর্থাৎ বড়দের বোধবুদ্ধির বাইরে। সবচেয়ে বড় কথা বাবা-মা আর ছোট ছোট পরিবারে থাকতে থাকতে শিশুরাও অন্যরকম হয়ে উঠল। এই যে ডিজিটাল দুনিয়া - টিভি বা কম্প্যুটার তাদের কতটা পালটে দিল, এই নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা সাধারণতঃ মাথা ঘামান না। ফলে যুগে যুগে তাদের হাতে থাকে শুধুই পাগলা দাশু বা সত্যজিৎ রায়ের ধরণের গোয়েন্দা গল্প। তার মধ্যেই ঋতুপর্ণ ঘোষের "হীরের আংটি" বা রাজা সেনের "দামু" কোথাও কোথাও গতানুগতিক ছেলেমানুষীর হাত এড়াতে পেরেছে। সাম্প্রতিককালে অবশ্য চিল্ড্রেন্স্ ফিল্ম সোসাইটি এই বিষয়ে সংগঠিত উদ্যোগ নিয়েছে। তার ফলে নানা ভারতীয় ভাষায় নানা ছবি আজকের ছোটদের কথা বলে।
যেমন ২০০৯ সালে কন্নড ভাষায় তৈরি 'পুতানি পার্টি'। এই ছবিটি পুণে ফিল্ম ইন্স্টিটিউটের একজন তরুণ ছাত্র রামচন্দ্র তৈরি করেছেন। ছবিটা ছোটদের মন কেড়ে নেয়, কারণ এই ছবিতে মূলতঃ তারাই অভিনেতা। তাছাড়া এই ছবির ছোটরা একেবারেই ধারোয়ার জেলার কথ্য ভঙ্গীতে কথা বলায় ছবিটি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় হয়।
এরকমই একটি মারাঠি ছবি হল ক্রান্তি কানাড়ে পরিচালিত 'মাহেক' (২০০৭)। পুরো ছবিটাই পুণে শহরে তোলা। এই ছবিটি একটা শিশুর চোখ দিয়ে সারা সমাজকে দেখে---খানিকটা আমাদের দেশের ' ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ' বলা যেতে পারে ---যে সমাজ শিশুদের কোন অনুভূতিরই দাম দেয় না, সেই সমাজের দিকে তাকিয়ে একটা শিশু কি ভাবতে পারে...ধনী ও গরিবদের ভেদাভেদের কথা, সমাজের নানা পরিবর্তনের কথা- এই সবই আমরা দেখি একটি ছোট মেয়ের চোখ দিয়ে। এই ছবিটির মধ্যে ঋত্বিক ঘটকের 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' ছবির একটা প্রভাব আছে।
২০১২ সালে তৈরি রাজন খোসার 'গাট্টু' বেশ হাল্কা খুশির মেঘ।নীল আকাশ, ঘুড়ি ওড়ানোর মেলায় রাস্তার একটা পুঁচকে ছেলে কিভাবে জিতে যায়, তারই গল্প 'গাট্টু'।
কিন্তু আমার মনে হয়, সাম্প্রতিক কালের পরিচালকদের মধ্যে বিশাল ভরদ্বাজ সবথেকে বেশি ছোটদের মন ছুঁতে পেরেছেন। বিশালের দুটি হিন্দি ছবি 'মকডি' আর 'দ্য ব্লু আমব্রেলা' বিষয়ের দিক দিয়েই ছোটদের নজর কাড়ে। কেননা সেখানে কোন বড় বড় জ্ঞান বা উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা ছাড়াই ডাইনিদের নিয়ে বা তুচ্ছ একটা ছাতা চুরি নিয়ে এমন অনেক কথাই বলা হয় যে ছোটরা চুপ করেই শোনে, বুঝতেও পারে , আর হয়ত বা সাড়াও দেয়।
কিন্তু সমস্যা হল এই যে, যাঁরা ছবি তৈরি করছেন, তাঁরা সারা বছর ধরে ছোটদের চাহিদার কথা ভুলে থাকেন আর শুধু পুজোর ছুটি, গরমের ছুটি বা নববর্ষের সময়ে ভাবেন যে কয়েকটি স্পেশাল এফেক্ট ও অ্যানিমেশন ভর্তি ছবি দিলেই ছোটরা বাবা-মায়ের সাথে সিনেমা হলে ভীড় করবে। ছোটরা যে আমাদের ঘরের নিত্যসঙ্গী এবং গুরুজন নিরপেক্ষভাবে তারাও যে দামি , এই সত্যটা কিছুতেই বোঝা বা বোঝানো যাচ্ছে না বলেই ছোটরা ক্রমশঃ টিভির পর্দার সামনে একা হয়ে পড়ছে।
অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ছবিঃউইকিপিডিয়া