খেলাঘরখেলাঘর

আচ্ছা বলত ভারতের জাতীয় খেলা কি?
উঁহু, উঁহু, ভুল করে আবার ক্রিকেট বলে বস না যেন! যা ক্রিকেট পাগল দেশ ভারতবর্ষ!
তাহলে ভারতের জাতীয় খেলা কি? -এর উত্তরটা এই মূহুর্তে একটু গোলমেলে।
আমরা তো ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছি ভারতের জাতীয় খেলা হল হকি । এই মূহুর্তে উইকিপিডিয়াও তাই বলছে।আইস হকি নয়, ফিল্ড হকি- যা সবুজ মাঠে খেলা হয়।হকি শুধু ভারতের নয়, প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তানেরও জাতীয় খেলা। কিন্তু সমস্যাটা বেধেছে অন্য জায়গায়। আর সমস্যাটা শুরু হয়েছে, যখন উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌ এর দশ বছরের মেয়ে ঐশ্বর্য পরাশর, ২০১২ সালের মাঝামাঝি, তথ্যের অধিকার আইনের বলে, ভারতের প্রধাণ মন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে জানতে চায় ভারতের বিভিন্ন জাতীয় প্রতীকগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য লিখিত ঘোষণা আছে কিনা। সে সেই ঘোষণাপত্রগুলির সার্টিফায়েড কপিও চায়।

ভারতীয় হকি দল
ভারতীয় হকি দল

নানা দপ্তর ঘুরে শেষ অবধি সেই চিঠির উত্তর আসে ক্রীড়া দপ্তর থেকে। তাতে লেখা ছিল , ভারতে কোন খেলাকেই জাতীয় খেলা বলে ঘোষণা করা হয়নি ! কিন্তু তখনো অবধি ভারতের জাতীয় ওয়েবসাইট পোর্টালে জাতীয় খেলা রূপে হকির নাম দেখা যাচ্ছিল ।(এখন অবশ্য আর দেখা যাচ্ছে না)। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন হইচই হয়। ভারতের প্রাক্তন হকি খেলোয়াড়েরা সরকারের এই বক্তব্যে একই সঙ্গে দুঃখিত এবং ক্রুদ্ধ হন -কারণ, সেই ১৯২৮ সাল থেকে, যখন ভারতীয় দল ইউনিয়ন জ্যাক পতাকার জন্য খেলত, তখন থেকেই হকি ছিল ভারতের জাতীয় খেলা। নানা রকমের উতোর চাপানের পর মোটামুটি যা বোঝা গেল, তা হল এই যে, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে, বিভিন্ন কারণে, ভারতের হকি খেলার মান এতটাই নিচে নেমে যায় যে ভারতের সরকার আর হকিকে জাতীয় খেলার প্রতীক রাখতে চাইছিলেন না। যেহেতু খেলার মান নেমে যায়, তাই হকি খেলার জনপ্রিয়তাও ক্রমশঃ কমে আসে।
অথচ, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতের পুরুষ হকি দল ছিল প্রথম ইউরোপের বাইরের দল যা আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১৯২৮ সালে এই দল তাদের প্রথম অলিম্পিক সোনার পদক জিতে নেয় আমস্টারডম অলিম্পিকে।

হকি দল ১৯২৮
১৯২৮ সালে আমস্টারডম অলিম্পিকে সোনা জয়ী ভারতীয় হকি দল

১৯৫৬ অবধি পরপর ছয়বার অলিম্পিকে স্বর্নপদক জিতে রেকর্ড সৃষ্টি করে ভারতের পুরুষ হকি দল। সবশুদ্ধ ভারতের পুরুষ হকি দল অলিম্পিকে আটটি সোনা জিতেছে, যা সমস্ত জাতীয় দলের মধ্যে সবথেকে বেশি।

হকি দল ১৯৩৬
১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকে সোনা জয়ী ভারতীয় হকি দল

হকি দলই ছিল ভারতীয় খেলোয়াড়দের সেই দল, যারা প্রথম অস্ট্রেলিয়া/নিউজিল্যান্ড গেছিল (১৯২৬), ইউরোপ গেছিল (১৯২৮) আর জাপান/আমেরিকা গেছিল (১৯৩২)।

ধ্যান চাঁদ
মেজর ধ্যান চাঁদ

ভারতীয় হকির কথা বলতে গেলে মেজর ধ্যানচাঁদকে(১৯০৫-১৯৭৯) বাদ দিয়ে কোন কথা বলা সম্ভব নয়। ধ্যানচাঁদকে সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বকালের সেরা হকি খেলোয়াড় বলে মেনে নেওয়া হয়। তিনি বল এত ভাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন যে তাঁকে জাদুকর বলা হত। তাঁর সম্পর্কে এমন গল্প আছে যে, একবার খেলতে খেলতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিরুদ্ধে তিনি কিছুতেই গোল করতে পারছিলেন না। অনেকবার গোল না করতে পারার পর, তিনি ম্যাচ রেফারির সাথে তর্ক শুরু করে দেন যে গোলপোস্টের আয়তনে কিছু ভুল আছে।আর আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে, মেপে দেখা গেল গোলপোস্টের প্রস্থ সত্যিই আন্তর্জাতিক নিয়মে যা বলা আছে তার থেকে কম।
বিশ্ব হকির ইতিহাসে ভারতের যে কতটা অবদান, বা বিশ্বের খেলাধূলার ইতিহাসে ভারতের হকি খেলোয়াড়দের কতটা অবদান, সেটা ভারতের সরকার বা ওপরমহলের আধিকারিকেরা কতটা বুঝেছেন সেটা সত্যিই জানা নেই। কিন্তু সারা বিশ্ব সেটা খুবই ভাল বোঝে।তাই তো ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক্‌স্‌-এর সময়ে অতীতের এবং বর্তমানের বিভিন্ন বিখ্যাত অলিম্পিকে যোগদানকারী খেলোয়াড়দের নামে লন্ডনের ৩৬১ টা টিউব স্টেশনের আবার নামকরণ করা হয়। ৩৬১ টি স্টেশনের মধ্যে ছয়টি নাম হয় হকি খেলোয়াড়দের নামে। আর তাদের মধ্যে তিনটে নামই হল ভারতের অলিম্পিকজয়ী সেরা তিন হকি খেলোয়াড়-এর --- ধ্যান চাঁদ, রূপ সিং আর লেস্‌লি ওয়াল্টার ক্লডিয়াস। ভাবতে পার!!

হকি ইন্ডিয়া লিগের লোগো
হকি ইন্ডিয়া লিগের লোগো

ঠিক এই মূহুর্তে ক্রিকেটের আই-পি-এল- এর ধাঁচে ভারতে চলছে প্রথম হকি ইন্ডিয়া লিগ (HIL)।এই লিগ চলবে ১৪ই জানুয়ারি, ২০১৩ থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ অবধি। আন্তর্জাতিক হকি লিগ (FIH) এর অনুমোদন পাওয়া এই লিগে খেলছে পাঁচটি দল - উত্তর প্রদেশ উইজার্ডস্‌, দিল্লি ওয়েভ্‌রাইডারস, পঞ্জাব ওয়ারিয়র্স, মুম্বই ম্যাজিশিয়ান্‌স্‌ আর রাঁচি রাইনোস্‌। এই দলগুলিতে খেলছেন ভারত এবং অন্যান্যদেশের বাছাই করা ১২০ জন হকি খেলোয়াড়।
প্রাক্তন হকি খেলোয়াড়েরা এবং হকিপ্রেমীরা মনে করছেন, এই ধরনের লিগ ভারতীয়দের মধ্যে আবার ফিরিয়ে আনবে হকি্র প্রতি ভালবাসা। দেশের মানুষ এই খেলাকে ক্রিকেট বা ফুটবলের মত ভালবাসলে তা হকি খেলোয়াড়দেরও ভাল খেলতে উদবুদ্ধ করবে। হয়ত আগামি রিও অলিম্পিকে আবার মাঠ দাপিয়ে বেড়াবে ভারতের নতুন হকি দল।
আরো আশা করা যায়, ভারত সরকার হকিকে আবার তার পুরনো মহিমা ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় খেলা রূপে ঘোষণা করবেন।

মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা

ছবিঃউইকিপিডিয়া

তথ্য সূত্রঃ
এনডিটিভি ওয়েবসাইট
টাইম্‌স্‌ অফ ইন্ডিয়া ওয়েবসাইট
আইবিএনলাইভ ওয়েবসাইট
উইকিপিডিয়া

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।