সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
মারি উইলকক্সের অভিধান

উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্ণিয়া প্রদেশের মাঝামাঝি রয়েছে সান হোয়াকিন (San Joaquin) উপত্যকা। এই উপত্যকায় বসবাসকারি বেশিরভাগ বাসিন্দাই আমেরিকার আদিম উপজাতির মানুষ, যাঁরা ইয়োকাট্‌স্‌ (Yokuts) নামে পরিচিত। অবশ্য এঁদের মধ্যে অনেকেই এই ইয়োকাট্‌স্‌ নামটাকে পছন্দ করেন না, কারণ তাঁরা বলেন এই নামটা তাঁদেরকে দিয়েছিল ইওরোপীয় ঔপনিবেশিকরা। বলা হয়, ইওরোপীয়রা উত্তর আমেরিকায় প্রবেশ করার আগে, এই আদিম উপজাতির মানুষেরা অন্ততঃ শ' খানেক রকমের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতেন। তারপরে সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে তার মধ্যে বেশিরভাগ ভাষা, হারিয়ে গেছে অনেক উপগোষ্ঠী। এখন এই সমস্ত উপগোষ্ঠীর মানুষেরা মূলতঃ ইংরেজি ভাষাতেই কথা বলেন। বেশিরভাগই ভুলে গেছেন নিজেদের আদিম ভাষা। যে ভাষায় তাঁদের মা-ঠাকুমারা কথা বলতেন, যে ভাষায় তৈরি হয়েছিল তাঁদের যত পুরাণ আর লোককথা, সেই ভাষা এই প্রজন্মের মানুষেরা জানেনই না।

ইয়োকাট্‌স্‌-দের মধ্যে এইরকমই এক উপগোষ্ঠী হল 'ওয়াকচুমনি'। আর এঁরা যে ভাষায় কথা বলতেন, সেটা ওয়াকচুমনি ভাষা হিসাবেই পরিচিত। এই ওয়াকচুমনি মানুষের সংখ্যা এই মূহুর্তে মোটামুটি দুশো। হ্যাঁ, মাত্র দু'শো জন। এই উপগোষ্ঠীর এক সদস্য হলেন মারি উইলকক্স। তাঁর বয়স একাশি। সান হোয়াকিন উপত্যকার বাসিন্দা মারি'র জীবন মোটামুটি কেটে গেছে ক্ষেতে খামারে কাজ করে। তাঁর মাতৃভাষা 'ওয়াকচুমনি' হলেও নিজের ছেলেমেয়ে- নাতি-পুতিদের সাথে বেশিরভাগ সময়েই ইংরেজিতেই কথা বলেন তিনি। কিন্তু এই মাত্র কয়েক বছর আগে, মারি উইলকক্স একদিন বুঝতে পারলেন, তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর মাতৃভাষা 'ওয়াকচুমনি'-ও হারিয়ে যাবে এই দুনিয়া থেকে; কারণ, তাঁর ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাত্‌নি কেউই এই ভাষায় কথা বলবে না। আশেপাশের মানুষেরাও খুব একটা এই ভাষায় সড়গড় নয়। তাহলে কি হবে? পৃথিবীতে যে ওয়াকচুমনি বলে একটা আলাদা ভাষা ছিল, সেটাই ভুলে যাবে মানুষ?

এর পরে মারি যে কান্ডটা ঘটালেন, সেটাকে বেশিরভাগ মানুষ 'অসম্ভব' বলেই চিহ্নিত করবেন। কিন্তু মারি সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে ফেললেন। তিনি ঠিক করলেন তিনি ওয়াকচুম্‌নি ভাষার একটা অভিধান লিখবেন। আমরা যেরকম ইংরেজি থেকে বাংলা বা বাংলা থেকে ইংরেজি শব্দের অর্থ বোঝার জন্য বা অনুবাদ করার জন্য অভিধান ব্যবহার করে থাকি, এই অভিধান হল ঠিক তেমনি ওয়াকচুমনি-ইংরেজি ভাষাযুগলের অভিধান। আর যাতে তিনি এই কাজটা করতে পারেন, তাই তিনি প্রবল উৎসাহ নিয়ে কম্পিউটার ব্যবহার করতে শিখলেন, টাইপ করতে শিখলেন। তারপরে দীর্ঘ সাত বছর ধরে, নিজের মেয়ে জেনিফার আর নাতি ডোনোভানের সাহায্য নিয়ে তিনি লিখে ফেলেছেন একটা গোটা অভিধান !

কিন্তু মারি এখানেই থেমে থাকলেন না। এই মূহুর্তে মারি তাঁর অভিধানের একটা 'অডিও' সংস্করণ তৈরির কাজে ব্যস্ত, যেখানে তিনি ওয়াকচুমনি ভাষায় ব্যবহার করা শব্দগুলিকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করছেন; তাঁর মাতৃভাষায় হাজার বছর ধরে চলে আসা নানা লোককথা রেকর্ড করে রাখছেন। নিজের মেয়েকে শেখাচ্ছেন কিভাবে শব্দগুলিকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে হয়। আর মেয়েকে সাথে করে নিয়ে আশেপাশের বিভিন্ন বসতিতে ওয়াকচুমনি ভাষার ক্লাস করাতে যাচ্ছেন প্রতি সপ্তাহে।

ইন্ডিজিনাস্‌ ক্যালিফোর্ণিয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সারভাইভাল (Indigenous California Language Survival) নামের একটি সংস্থার অনুপ্রেরণায় এবং সাহায্যে মারি উইলকক্স তাঁর এই কাজটি চালিয়ে যেতে পারছেন। এই সংস্থা চাইছে ক্যালিফোর্ণিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এইসব উপগোষ্ঠীদের ভাষাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে। ওয়াকচুমনি ভাষা নিয়ে এর আগেও কিছু কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু মারি'র এই কাজটি এখনো অবধি সবথেকে দীর্ঘ।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এক কাপ কফি আর একটু কিছু খেয়েই কাজ করতে বসে যান এই অশীতিপর বৃদ্ধা। টানা কয়েকঘন্টা কাজ করেন সারা দিন ধরে। মাঝে মাঝে রাত জেগেও কাজ করেন। মারি জানেন, ব্যাপারটা এমন নয় যে তিনি খেটেখুটে একটা অভিধান তৈরি করছেন বলেই আগামিকাল থেকে তাঁর আশেপাশের ওয়াকচুমনি গোষ্ঠীর সব মানুষ এই ভাষায় কথা বলা শুরু করবে, ভালবেসে ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু তিনি তাও কাজটা করে যাচ্ছেন, নিজের সংস্কৃতিকে ভালবেসে, নিজের মাতৃভাষাকে ভালবেসে।

মারি উইলকক্সের এই অভিধান তৈরি করা নিয়ে একটি ছোট্ট তথ্যচিত্র দেখতে পাওয়া যাবে ইউটিউবে। তথ্যচিত্রের লিঙ্কটা এইখানে দিলামঃ

মারি'র প্রচেষ্টা যেন বিফলে না যায়। নতুন প্রজন্মের ওয়াকচুমনি ছেলেমেয়েরা নিজেদের পুর্বপুরুষদের ভাষা শিখতে উদবুদ্ধ হোক। আর মারি'কে দেখে উৎসাহ পান আরো অনেক মানুষ, নিজের ভাষাকে ভালবেসে বাঁচিয়ে রাখতে শিখুন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে, ওয়াকচুমনি দিদিমা মারি উইলকক্সের জন্য ইচ্ছামতীর তরফ থেকে রইল অসংখ্য অভিবাদন।


তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট
ছবিঃ নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স্‌
ভিডিওঃ ইউটিউব

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা