এসে গেল আরেকটা বড়দিন। খ্রীষ্টধর্মের মানুষদের সবথেকে বড় উৎসব। যীশুখ্রীষ্টের জন্মদিন। আর এই উৎসবের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটা পরিচিত প্রতীক - বরফমোড়া উত্তরমেরু থেকে স্লেজগাড়ি চেপে উপহার বিলি করতে আসা সান্টাক্লজ, মোজাভর্তি উপহার, খ্রীস্মাস্ কেক আর খ্রীস্মাস ট্রি; সাথে রয়েছে মোমের আলোয় অর্গানের সুরে সুরে খ্রীস্মাস ক্যারল্স্।
সত্যি কথা বলতে গেলে, আমাদের দেশে, আজকের দিনে দুর্গাপুজো বা ঈদ-উল-ফিত্র্ যেমন শুধুমাত্র হিন্দু বা ইসলাম ধর্মের মানুষদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, ঠিক তেমনি খ্রীস্মাস বা বড়দিন মানে শুধুই খ্রীষ্টধর্মের মানুষদের উৎসব নয়। আমাদের প্রিয় এই উৎসবগুলি ধর্মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে কাছের -দূরের সবার সাথে আনন্দ ভাগ করে নিতে শেখায়।আর আমরা একে অপরের বিশ্বাস ও ভাবনাকে সমান মর্যাদা দিতে চাই বলেই দুর্গাপুজোর খিচুড়ি, ঈদের সেমাই আর খ্রীস্মাসের কেক সবার সাথে ভাগ করে নিতে ভুলি না।
আর ঠিক একই কারণে, আমরা যে ধর্মেরই হই না কেন, এই সময়ে আমাদের অনেকেরই বাড়িতে টেবিলের ওপরে সাজানো থাকে ছোট্ট ছোট্ট খ্রীস্মাস্ ট্রি। আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সেগুলি অবশ্য বেশিরভাগই নকল হয়; কারণ , যে সমস্ত গাছ আসলে খ্রীস্মাস ট্রি সাজাতে ব্যবহার হয়, সেসবগুলি তো এত গরমে জন্মায়ই না। কিন্তু তাতে কী? আমরা দোকান থেকে কিনে আনা টিনসেল বা প্লাস্টিকের গাছেই বেজায় খুশি। তবে উত্তর গোলার্ধের শীতপ্রধান দেশগুলিতে নানা ধরনের আসল চিরহরিৎ গাছ ব্যবহার করা হয়।
কারোর বাড়িতে , কিংবা রেস্তোরাঁতে বা শপিং মলে আলো ঝলমলে খ্রীস্মাস ট্রি দেখলে মনটা বেশ ভালই লাগে। কিন্তু এইভাবে একটা ধর্মীয় উৎসবের সাথে একটা গাছকে আলো, খেলনা, খাবার দিয়ে সাজিয়ে তোলার কারণটা কী? এই প্রশ্ন মাথায় এসেছিল বলেই উত্তরও খুঁজতে শুরু করেছিলাম। উত্তর খুঁজতে গিয়ে যত গল্প পেলাম, তার মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি, লোককথা, পুরাণের গল্প, প্রকৃতি পাঠ- কত কিছু ! এস সেগুলির থেকে কয়েকটা বেছে এবার তোমাকে একে একে বলি।
চিরহরিৎ গাছ
এই গল্পের শুরু ইউরোপে খ্রীষ্টধর্মের প্রচলন হওয়ার অনেকদিন আগে থেকে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশগুলিতেই শীত এলে তুষারপাত শুরু হয়। সাদা বরফের চাদরে ঢেকে যায় সবদিক। বেশিরভাগ গাছপালার পাতা ঝরে যায়, ফুল ফোটে না, ফল জন্মায় না। কয়েকমাস ধরে শুধুই সাদা, ঠাণ্ডা, প্রাণহীন এক দুনিয়ায় বসবাস করে সবাই। আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে, কবে আবার সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হবে, উত্তর গোলার্ধে বসন্ত আসবে, গাছে গাছে কচি পাতা, নতুন কুঁড়ি দেখা দেবে, সাদা প্রান্তর সবুজ হয়ে উঠবে। নতুন জীবনের জন্য এই অধীর ভালবাসা থেকেই ইউরোপের অনেক অঞ্চলের মানুষেরা শীতের সময়ে বাড়িতে চিরহরিৎ গাছ, যেমন ফার বা বার্চের ডাল ঝুলিয়ে রাখতেন। হলি, মিস্ল্টো, আইভি জাতীয় গাছের পাতা ও ফল ও ব্যবহার করা হত। অনেকে মনে করতেন এইভাবে তাঁরা অসুখ-বিসুখ এবং ভূত-প্রেতের হাত থেকেও রক্ষা পাবেন।
আসল রহস্যটা রয়েছে একটু ভূগোলের পড়াশোনার মধ্যে। সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২১শে জুন থেকে ২২ বা ২৩শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সূর্যের দক্ষিণায়ন চলতে থাকে। ডিসেম্বরের ২১ বা ২২ তারিখে সূর্য মকরক্রান্তিরেখার ওপর সরাসরি তার কিরণ ফেলে এবং উত্তর গোলার্ধে দিন সবথেকে ছোট আর রাত সবথেকে বড় হয়। দক্ষিণায়ন চলাকালীন উত্তর গোলার্ধে দিন ক্রমশঃ ছোট ও রাত বড় হতে থাকে; তার সাথে কমতে থাকে সূর্যের রশ্মির তেজ।ডিসেম্বর মাসের ২১ বা ২২ তারিখে সূর্যের দক্ষিণায়্ন সম্পূর্ণ হয়। এর পর থেকে পৃথিবীর বার্ষিক গতির নিয়ম মেনে উত্তর গোলার্ধ আবার ধীরে ধীরে সূর্যের দিকে বেশি হেলতে থাকে; তার ফলে উত্তরে দিন বড় হতে শুরু করে। কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তো আর প্রাচীন মানুষেরা পুরোপুরি জানতেন না। শীত এলে তাঁরা মনে করতেন সূর্যদেবতা ক্লান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আর দক্ষিণায়নের শেষে তাঁরা ভাবতেন এইবার সূর্য সুস্থ হয়ে উঠবেন। কনকনে শীতের দিনে সবুজ গাছের ডালগুলি তাঁদের সেইসব উষ্ণ দিনগুলির কথা মনে করাত।
তবে সবুজ গাছ যে জীবনের প্রতীক এটা শুধুমাত্র উত্তর ইউরোপের মানুষেরাই মানতেন না। একই ধারণা ছিল প্রাচীন রোমানদের এবং মিশরীয়দের। প্রাচীন মিশরীয়দের সূর্যদেবতা ছিলেন রা। বছরের এই সময়ে রা-এর সুস্থ হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা কচি খেজুর পাতা দিয়ে বাড়ি সাজাতেন। অন্যদিকে প্রাচীন রোমানেরা এই সময় কৃষিকাজের দেবতা শনির উদ্দেশ্যে 'স্যাটার্নালিয়া' নামের এক উৎসব করতেন। তাঁরাও এইসময়ে বসন্ত আগমনের কথা মাথায় রেখে বাড়ি সাজাতেন সবুজ গাছের ডালপালা দিয়ে। ওদিকে আবার স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভয়ানক যুদ্ধবাজ ভাইকিংরাও মনে করতেন তাঁদের সূর্য দেবতা 'বলডার' সবুজ গাছ পছন্দ করেন।
খ্রীস্মাস্ উপলক্ষ্যে আলো এবং খাবার, খেলনা ইত্যাদি দিয়ে গাছ সাজানোর প্রথা ঠিক কবে থেকে শুরু হল, এ বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়না। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মত ধরলে আন্দাজ করা যায়, মোটামুটি ষোড়শ শতকের আশেপাশে জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রিস্মাস ট্রি সাজানোর প্রচলন শুরু হয়। তবে এ বিষয়ে লাটভিয়ার রাজধানী রিগার দাবী এই যে, রিগাতেই নাকি ১৫১০ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম খ্রীস্মাস ট্রি সাজানো শুরু হয় (http://www.firstchristmastree.net/)। এইসব গাছগুলি সাধারনতঃ শহরের মাঝে টাউন স্কোয়ারে রাখা হত; সাজানো হত আপেল, বাদাম, কাগজের ফুল , প্রেত্জেল ( এক বিশেষ ধরনের বেক করা মিষ্টি খাবার )দিয়ে। পরে এর সাথে যোগ হয় অন্যান্য খাবার ও খেলনা। শুরুর দিকে গাছের মাথার ওপর বসানো হত সদ্যোজাত যীশুর ছোট্ট মূর্তি; পরে তার বদলে দেখা যায় রাখালদের যে পথ দেখিয়েছিল, সেই পরীকে, কিংবা পূবদেশের জ্ঞানী মানুষদের পথ দেখানো উজ্জ্বল তারাটিকে।
শুরুর দিকে সবসময়ে যে আসল গাছ এনে বসানো হত , তাও নয়। একটা বড় কাঠের বালতির মত পাত্রকে উল্টো করে বসিয়া তার গায়ে নানারকম জিনিষ আটকে গাছের আদল দেওয়া হত। অথবা সেটা একটা বড় বাঁশও হতে পারে, যেটাকে গাছের মত করে সাজানো হত। শহরের মানুষেরা এই সাজানো গাছের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে নাচ-গান করতেন। তারপরে সেই গাছটিকে পুড়িয়ে দেওয়া হত।
কিন্তু পুড়িয়ে কেন দেওয়া হত? আসলে প্রকৃতির বিভিন্ন গাছপালা, পশুপাখি, সূর্য-চাঁদ-তারা ইত্যাদিকে দেবতা ভেবে উপাসনা করার প্রথা পৃথিবীর সব দেশেই বহুদিন ধরে চলে আসছে। এই গাছকে ঘিরে উৎসবের পর তাকে পুড়িয়ে দেওয়ার প্রথাও সেইরকমের এক প্রাচীন অ-খ্রীষ্টিয় বা পেগান প্রথা। অন্যান্য ধর্মের মতই, খ্রীষ্টধর্মের মধ্যেও এমন অনেক প্রথা দেখতে পাওয়া যায় যার শিকড় রয়েছে আদিম প্রকৃতিপুজো বা পৌত্তলিক নিয়মকানুনের মধ্যে।
খ্রীষ্টধর্মের মানুষদের মধ্যে খ্রীসমাসের সাথে এই গাছের যোগাযোগের অনেকগুলি গল্প প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে দুটি গল্প বলি।
প্রথম গল্পটি সন্ত বোনিফেসকে নিয়ে। বলা হয়, অষ্টম খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ সন্ত বনিফেস জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একদিন তিনি দেখতে পান, কিছু আদিম জার্মান অধিবাসী একটি বিশাল প্রাচীন ওক গাছের নিচে বলি দিচ্ছে। ওক গাছ ছিল দেবতাদের রাজা থরের প্রতীক। এই ঘটনা ঘটতে দেখে তাদের থামানোর জন্য সন্ত বনিফেস নিজের কুঠার দিয়ে গাছটিকে কেটে ফেলেন। প্রকৃতি উপাসকেরা মনে করেছিল, এর ফলে বনিফেসের মাথায় বাজ পড়বে, কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। বরং সেই ওক গাছের ভেতর থেকে একটা ফার গাছ গজিয়ে উঠল। এহেন অলৌকিক ঘটনা ঘটার পর বনিফেস তাদের খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করলেন। ত্রিকোণ আকারের ফার গাছটিকে নতুন জীবন, হোলি ট্রিনিটি এবং যীশু খ্রীষ্টের প্রতীকরূপে ধরা হল।
দ্বিতীয় গল্পটি ষোড়শ শতাব্দীর জার্মান সন্ন্যাসী মার্টিন লুথারকে নিয়ে। বলা হয়, এক খ্রীস্মাস্ ইভে, অর্থাৎ খ্রীস্মাসের আগের সন্ধেবেলায়, মার্টিন লুথার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। চলতে চলতে যীশুর প্রার্থনা করার সময়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার আকাশে রাতের তারাগুলিকে দেখে তাঁর ভারি ভাল লাগছিল। বাড়ি ফিরে এসে পরিবারের কাছে সেই সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়ার জন্য তিনি একটি গাছ বাড়িতে নিয়ে আসে। তার ডালে ডালে মোমের আলো জ্বালিয়ে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের সেই অপরূপ দৃশ্যের অনুভূতি দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর এইভাবেই বাড়িতে খ্রীস্মাস ট্রি সাজানোর প্রথা শুরু হয়।
গল্প যেটাই হোক না কেন, একথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে মোটামুটি ষোড়শ শতাব্দী থেকেই বাড়িতে ক্রীস্মাস ট্রি সাজানোর প্রথা জার্মানিতেই প্রথম শুরু হয়েছিল। সাধারন মানুষদের সাথে সাথে এই প্রথা জার্মানির রাজপরিবারগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। জিঞ্জারব্রেড, বাদাম, আপেল- এই সমস্ত লোভনীয় খাদ্যবস্তু দিয়ে তাদের খ্রীস্মাস ট্রি গুলি সাজানো হত। রাজকীয় গাছগুলি আরো সাজানো হত সোনার পাতা, কাগজের ফুল, মোমবাতি দিয়ে। এই সময় থেকেই জার্মানরা যে যে দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন, সেই সেই দেশেও তাঁরা যীশুর জন্মদিনে এই গাছ সাজানোর প্রথা মেনে চলতেন। তবে খ্রীষ্ট ধর্মের সব গোষ্ঠীই কিন্তু প্রথম থেকে এই প্রথাকে ভালভাবে স্বাগত জানাননি। অনেক গোষ্ঠীর মানুষেরা যীশুর জন্মদিবসে এইরকম গাছপালা সাজানোকে খ্রীষ্টধর্মের বিরোধী মনে করতেন। তাই দুনিয়াশুদ্ধ খ্রীষ্টানদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে লেগে গেল আরো প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি সময়। আর সেই জনপ্রিয়তা আনলেন ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া।
ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের রাজপুত্র-রাজকন্যাদের সাথে সাথে জার্মানির রাজপরিবারের রাজপুত্র-রাজকন্যাদের বিবাহ অনেকদিন ধরেই প্রচলিত ছিল। তাই তাঁদের হাত ধরে খ্রীস্মাস্ ট্রি যে জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে এসে উপস্থিত হবে, এ আর আশ্চর্যের কী? ১৮০০ সালে, রানী শার্লটের উৎসাহে উইন্ডসর প্রাসাদে ইংল্যান্ডের প্রথম রাজকীয় খ্রীস্মাস ট্রি দেখা যায়। রানী ভিক্টোরিয়ার মা'ও একজন জার্মান রাজকন্যা ছিলেন, তাই তিনিও ছোট্ট ভিক্টোরিয়ার জন্য খ্রীস্মাস ট্রি সাজাতেন। ভিক্টোরিয়াও রানী হওয়ার পরে সেই প্রথা মেনে চলতেন।
১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে, 'ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ' নামের একটি পত্রিকায় একটি অলঙ্করন ছাপা হয়। তাতে দেখা যায়, ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়া, তাঁর জার্মান স্বামী প্রিন্স অ্যাল্বার্ট এবং ছেলেমেয়েদের সাথে , একটি সুন্দরভাবে সাজানো খ্রীস্মাস্ ট্রি- কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। ভিক্টোরিয়া নিজে খুব শৌখিন ছিলেন; এবং একজন জনপ্রিয় রানীও ছিলেন। তাই তাঁদের প্রিয় রানীকে এরকমভাবে খ্রীস্মাস পালন করতে দেখার পরে ইংল্যান্ড, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকার পূর্ব উপকূলের খ্রীষ্ট ধর্মের মানুষেরা অনেকেই এই প্রথাটিকে আপন করে নিতে থাকেন।
এই ছবি নিয়ে একটা মজার তথ্য আছে। মূল ছবিটি ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হওয়ার দুই বছর বাদে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে 'গোডিজ লেডিজ বুক' (Godey's Lady's Book) নামের একটি পত্রিকাতে ছাপা হয়। কিন্তু সেটিকে আমেরিকার পাঠকদের মনোমত করার জন্য রানীর মাথার মুকুট আর রাজার গোঁফ মুছে দেওয়া হয়েছিল !
মোটামুটি ১৮৫০ সাল থেকেই আমেরিকাতে খ্রীস্মাস ট্রি বিক্রির ব্যবসা শুরু হয়।১৮৯০ সালের আশেপাশে জার্মানি থেকে গাছ সাজানোর জন্য নানারকমের সুন্দর খেলনা এবং টিনসেল আমদানি করা হতে থাকে। খ্রীসমাস ট্রি সাজানোর একটা বড় সমস্যা ছিল মোমবাতি। অনেক সময়েই জ্বলন্ত মোমবাতি থেকে আগুণ ধরে পুরো বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যেত। এইরকম ঘটনা খুব বেশি বেশি ঘটে থাকায় বীমা কোম্পানিগুলিও খুব রেগে যাচ্ছিল। এই সময়ে সবার সমস্যার সমাধান করেন টমাস এডিসন এবং তাঁর সহকারীরা । ১৮৮০ সাল নাগাদ তাঁরা ক্রীসমাস ট্রি কে সাজানোর জন্য একটি তারে অনেকগুলি আলো লাগিয়ে আলোর মালা তৈরি করেন। এই আলো আসা ফলে খুব সুবিধা হল। আগুন লাগারও ভয় রইল না; আর আলো অনেকদিন ধরে জ্বালিয়ে রাখা গেল। কিন্তু তাও এই আলোর ব্যবহার বাড়তেও অনেকদিন সময় লেগেছিল, কারণ সেই সময়ে বিদ্যুতের উপযোগিতা বা ভাল দিকগুলো সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
আজকের দিনে খ্রীস্মাস ট্রি ছাড়া খ্রীস্মাস পালন করার কথা কেউ ভাবতেই পারেন না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খামার করে খ্রীস্মাস ট্রি সাজানোর জন্য গাছের চাষ করা হয়। স্কচ পাইন, ডগ্লাস ফার, ফ্রেসার ফার, বালসাম ফার, হোয়াইট পাইন- এই গাছগুলি বাড়িতে সাজানোর জন্য কদর বেশি। একেকটা গাছ বিক্রয়যোগ্য হতে অন্তত ছয় থেকে আট বছর সময় নেয়। গাছগুলিকে খ্রীস্মাসের অনেকদিন আগে থেকেই কেটে দোকানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইউরোপীয়রা চার ফুট মত উচ্চতার ছোট গাছ পছন্দ করেন, কিন্তু আমেরিকানরা পছন্দ করেন বিরাট লম্বা গাছ, যেটা মাটি থেকে ছাদ অবধি যাবে।
বিশ্বের বিখ্যাত খ্রীস্মাস ট্রি গুলির মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় হচ্ছে নিউ ইয়র্কের রকেফেলার সেন্টারের বিরাট ক্রীস্মাস ট্রি। রকেফেলার সেন্টারের সামনে বিশাল উচ্চতার একটি খ্রীস্মাস ট্রি প্রতিবছর সাজানো হয় হাজার হাজার আলো দিয়ে। দেশ বিদেশ থেকে মানুষ ভীড় করেন সেই আলোয় সাজানো গাছ দেখতে।
কিন্তু যে সব দেশে তেমন ঠাণ্ডা পড়ে না, বা চিরহরিৎ গাছ পাওয়া যায়না, যেমন নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলি, বা দক্ষিণ গোলার্ধের অনেকগুলি দেশে, যেখানে এই সময়ে আসলে শীতকালের বদলে গ্রীষ্মকাল, সেখানে কোন গাছ ব্যবহার করা হয়? এইসব দেশের মানুষেরা সেখানকার নিজস্ব কোন গাছের ডাল কেটে এনে সাজান, অথবা বাজার থেকে নকল গাছ কিনে আনেন। কিন্তু গাছ নকল হোক বা আসল, কোথাওই খ্রীস্মাস ট্রি নিয়ে উৎসাহের অভাব থাকে না। দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলিতে তো আর এই সময়ে শীতকাল থাকে না, তাই চিরহরিৎ গাছের সঙ্গে উত্তর গোলার্ধের আদিম মানুষদের সম্পর্কের গল্পটার হয়ত তাঁদের জীবনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই। কিন্তু তাও তাঁরা খ্রীস্মাস পালনের সময়ে গাছ সাজাতে ভোলেন না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বড় দিন উপলক্ষ্যে সারা দুনিয়া জুড়ে যে এত এত গাছ সাজানো হয়, উৎসবের শেষে সেগুলিকে নিয়ে কী করা হয়? সেই প্রথম দিন গুলি থেকেই , বাড়িতে গাছ এনে খ্রীস্মাস ট্রি সাজানোর বিষয়ে যেমন একদল মানুষের উৎসাহের অন্ত ছিল না, তেমনি পরিবেশ সচেতন মানুষেরা এত এত গাছকাটার বিরোধিতা করে গেছেন। একথা সত্যি যে, এই সমস্ত গাছগুলিকে যদি উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য যেখানে সেখানে মরে যাওয়ার জন্য ফেলে রাখা হয়, তাহলে তার ফলে পরিবেশের দূষণ অনেক বেশি বাড়তে পারে। এই কারণেই, বেশিরভাগ দেখেই, খ্রীস্মাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরে, গাছগুলিকে নিয়ে অন্যান্য কাজে লাগানো হয়। বেশিরভাগ জায়গাতেই গাছটিকে কেটে কাঠের গুঁড়ো এবং ছোট টুকরো তৈরি করা হয়, যেগুলিকে নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। অনেক জায়গায় গাছগুলিকে সমুদ্র ও নদী-নালার পাড়ে মাটির ক্ষয় রুখতে বাঁধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। একই সাথে গাছগুলি হয়ে ওঠে ছোট ছোট পশু পাখিদের বসবাসের জায়গা। ওনেকে সাজানোর জন্য বাড়িতে টবে পোঁতা জীবন্ত গাছ নিয়ে আসেন; সেগুলিকে উৎসবের পরে বাগানে রেখে দেওয়া হয়।
বিশ্বের যেকোন ধর্মের যেকোন নিয়ম-কানুনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মানুষের সাথে প্রকৃতির নিবিড় সংযোগের ইতিহাস। আমাদের আধুনিক জীবনে আমরা এই সহজ সত্যিটাকে ভুলে যেতে বসেছি। বরং মাঝে মাঝে বড় বেশি ধর্মের রং চড়িয়ে সেইসব সহজ সত্যিকে করে তুলি জটিল মিথ্যে। চিরসবুজ খ্রীস্মাস ট্রি-এর বিষয়ে আমাদের উৎসাহ আসলে প্রকৃতির উপর মানুষের আদিম নির্ভরতা আর বিশ্বাসেরই আরেক রূপ।
ছবিঃ পিক্সাবে,উইকিপিডিয়া, রকেফেলার সেন্টার ওয়েবসাইট