ধরা যাক, তুমি বাড়ির সবার সঙ্গে ভালোমন্দ খেতে বসেছ। সামনে নানারকমের লোভনীয় সব খাবার রাখা - গরম ঘি-ভাত, কষা মাংস, নলেন গুড়ের সন্দেশ --- এমন ভালো ভালো সব খাবার; তুমি নিজের থালায় অনেকটা করে খাবার তুলে নিলে। যতটা খেতে পারবে, তার থেকে বেশিই নিয়ে নিলে। খানিক পরে, তুমি আর পুরোটা খাবার খেতে পারলে না। তোমার পাতে পড়ে রইল খানিকটা ভাত, কিছু তরকারি, আধখাওয়া মিষ্টি। তুমি থালাটা ফেলে উঠে চলে যেতে চাইলে, কারণ পেট ভরে গেছে, আর খেতে পারবে না। তোমাকে এই সময় হয়ত বাড়ির বড়রা কেউ বকে বলবেন- " এমন করে খাবার ফেলে উঠে যাচ্ছ? এইভাবে কেউ নষ্ট করে!" এই বকুনি খাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক এবং দরকার। তাই অভিমান করে লাভ নেই। কারণ মুখের খাবার নষ্ট করার অধিকার আমাদের কারোর নেই।
এইবার, ধরো তুমি জাপানের বাসিন্দা। সেখানে এমন খাবার যদি তুমি নষ্ট করো, তাহলে তুমি ছোটই হও আর বড়ই হও, তোমাকে কেউ একজন মাথা নেড়ে বকে বলবেন -" মোত্তাইনাই!" এই শব্দটা ভাবানুবাদ ইংরেজিতে বললে হবে "What a waste!" , আর বাংলায় বলা যায় "কী অপচয়!"
প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্ম শেখায়, প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের জীবনধারণের জন্য যা কিছু উপহার দেয়, সেগুলিকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করে নষ্ট করলে অনুশোচনা আসা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে আমরা এমন উপহার পাওয়ার উপযুক্ত কিনা সেটাও ভাবা উচিত এবং প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। 'মোত্তাইনাই' -এর ভাবনা এসেছে সেই বৌদ্ধধর্ম থেকে। 'মোত্তাই' (mottai) শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ বা দামী কিছুকে বোঝায়, আর 'নাই' (nai) শব্দটা বোঝায় কিছু একটার অভাব। 'মোত্তাইনাই' একসঙ্গে বোঝায়, কোনো একটি দ্রব্য বা বস্তুর সঠিক মর্যাদা না দেওয়া, তার থেকে আরও যা পাওয়া যেতে পারত, সেইসব উপহার না নিয়েই তাকে বাতিল করার মত অন্যায় করা; প্রতিদিনের ছোট ছোট সজীব বা নির্জীব বস্তুকে পুরোপুরি কাজে না লাগিয়ে ফেলে দেওয়া, যা দেখে আমরা বলে উঠব - "কী অপচয়!"
এই 'মোত্তাইনাই' শব্দটাকে জাপানের কাছ থেকে প্রথম সারা পৃথিবীর সামনে তুলে আনেন কেনিয়ার নোবেলজয়ী পরিবেশবিদ ওয়াঙ্গারি মুটা মাথাই। 'Mottainai' /'মোত্তাইনাই' শব্দের মধ্যে তিনি এককথায় খুঁজে পেয়েছিলেন '4R' -Reduce, Reuse, Recycle and Respect' -এই সমস্ত ভাবনার সমাহার। এই পৃথিবীর প্রতিটি দান- গাছপালা, জল, বায়ু, ধাতু, তেল, পশু, পাখি; সমস্ত জৈব এবং অজৈব বস্তুকে আমরা যতটা আদর করতে পারি, ততটা আদর করতে ভুলে গেছি। তারা আমাদের যা যা দিতে পারে, সেই সব কিছু নিতে ভুলে গেছি। আর ভুলে গেছি বলে পুরনো জিনিষকে সম্মান করতেও ভুলে গেছি। শুধুই নিত্যনতুন জিনিষের মোহে আমরা পৃথিবীর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ - গাছপালা, জল, খাবার- সব শেষ করে ফেলতে চলেছি। আর শেষ করছি বড্ড বেশি ফেলে ছড়িয়ে। নিজেদের বলতে ভুলে গেছি - "মোত্তাইনাই!" - "কত কিছু অবহেলায় নষ্ট করি আমরা, তবুও প্রকৃতি আমাদের দিয়েই যায়, দিয়েই যায় - কী অপাত্রে দান! কী অপচয়!"
এমন নয় যে 'মোত্তাইনাই' এর কাছাকাছি ভাবনা অন্যান্য সভ্যতায় নেই। আমাদের নিজেদের দেশেই আছে এমন কত কত উদাহরণ। জাপানে 'নানবু সাকি-ওরি' পদ্ধতিতে পুরনো কাপড়ের টুকরোর সঙ্গে নতুন সুতো মিলিয়ে নতুন কাপড় তৈরি করার যে পদ্ধতি, তার সঙ্গে আমাদের 'খেস' বুনন পদ্ধতির কী দারুণ মিল! জাপানিদের মতই শুধু ধান গাছের কেন,নারকেল বা কলাগাছের বিভিন্ন অংশকে কাজে লাগাতে জানি আমরা। পুরনো জিনিস থেকে নতুন জিনিস তৈরি করে, অল্প ছেঁড়া- ফাটা জিনিসকে জোড়াতালি দিয়ে ব্যবহার করতে করতেই তো আমরা, আজকের বড়রা, বেড়ে উঠেছি।
আমাদের দেশে অনেক মানুষ - কেউ কেউ একা, কেউবা ছোট-বড় সংস্থার মাধ্যমে এমন নানাধরণের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন- যেখানে পুরনো জিনিস দিয়ে নতুন জিনিস তৈরি হয়, বা নতুন চেহারায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই কাজ শুধু কয়েকজন মানুষ করলে চলবে না। আমাদের সবাইকেই করতে হবে। প্রতিটা সিঙ্গল-ইউজ প্লাস্টিকের প্যাকেট ফেলার আগে, প্রতিটা অল্প ছেঁড়া বা রং জ্বলে যাওয়া জামা বাতিল করার আগে, ঘরের আলো বা পাখা অকারণে জ্বালিয়ে রাখার আগে, প্রতিটা খাবারের কণা নষ্ট করার আগে, ভাবা অভ্যাস করতে হবে - 'মোত্তাইনাই' - কী অপচয়! নিজেকে বদলাতে পারব না আমি?
তথ্যসূত্রঃ
দ্য গ্রীন বেল্ট মুভমেন্ট
অল অ্যাবাউট জাপান
বিবিসি
গ্রাফিকঃমিতিল