এই গান কারা গেয়েছিল? উত্তরটা কে না জানে!
বাঘার ঢোলে চাঁটির সঙ্গে গুপীর গান শুনে ভূতের রাজা বেজায় খুশি হয়ে তাদের দুইজনকে তিন তিনটে বর দিতে চাইলেন। বললেন, আমি জানি, তোদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তোদের কোথাও ঠাঁই নেই, কী চাস বল! গুপী আর বাঘা খুব বেশি ভাবার সময় তো পেল না। একে ভূতের রাজা, তার ওপরে তিনি আবার বর দিতে চাইলেন, বেশি ভাবার সময় কই? তাই গুপী প্রথমে বলল - "আমাদের যেন খাওয়া পরার কোনো অভাব না থাকে"; তারপরে বাঘা চাইল দ্বিতীয় বর। সে বলল, "আমাদের খুব দেশ বেড়ানোর শখ...", সঙ্গে গুপী জুড়ে দিল, "যদি একটু ঘুরে টুরে বেড়াতে পারতাম"; তো সেই বর ও মঞ্জুর হল। শেষ বরে গুপী চাইল, ' যদি আমরা গান-বাজনা করে লোককে এট্টু খুশি করতে পারতাম..." ভূতের রাজা খুশি হয়ে এই তৃতীয় বরও দিলেন তাদের। সঙ্গে জানালেন, "...লোকে শুনে ভ্যাবাচ্যাকা স্থির হয়ে থেমে যাবে..." । এই তিনটে বর পেয়ে, ভোরবেলা বাঁশবাগানের মধ্যে ঘুম থেকে উঠে সত্যি দুই জোড়া জুতো পেয়ে এবং নিজেরাই কত ভালো গাইতে আর বাজাতে পারছে বুঝতে পেরে, মনের আনন্দে গুপী আর বাঘা এই গানখানা গেয়ে ফেলল।
আচ্ছা, গুপী আর বাঘা কি বোকা ছিল? সরল মানুষ অবশ্যই ছিল, কিন্তু সরল হলেই তো আর বোকা হয়না। তিন তিনখানা বর পাওয়ার সুযোগ এল, দুজনে মিলে তো জবরদস্ত কোনো বর চাইতে পারত? এই যেমন - আমাদের অনেক অনেক টাকা হোক, কিংবা আমরা দেশের রাজা হয়ে যেতে চাই, কিংবা আমরা যখন যার খুশি গর্দান নেব, তাই সবাই আমাদের খুব ভয় পাক, সবসময়ে জী হুজুর বলে লম্বা সেলাম দিক। কিংবা ধরো, আমলকী গ্রামের বুড়োরা যারা গুপীর গান নিয়ে রসিকতা করত, বা হরতুকি গ্রামের যারা বাঘাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ গিয়ে তাদের গায়ে জলবিছুটি দিয়ে আসুক, কিংবা ভূতেরা গিয়ে তাদের ভয় দেখাক - এমন বেশ অন্যদের শায়েস্তা করার বর তো চাইতেই পারত দুজনে? নিদেনপক্ষে এটাও বলতে পারত, এখন থেকে যেখানেই গান গাইতে যাব, যেমনই গান গাই না কেন, সবাই যেন আমাদের সবসময়ে খুব খাতির করে, প্রথম পুরস্কার দেয়, সেরার সেরা খেতাব দেয়।
কিন্তু গুপী আর বাঘা এমন কিছুই চাইল না। তার বদলে যা যা চাইল, সেগুলি খুব সাধারন চাওয়া, দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ আসলে সেইটুকুই চায় - যা খেতে চাইব, যা পরতে চাইব, তাই যেন পাই; এত সুন্দর পৃথিবীটাকে ঘুরে দেখতে চাই, কেউ যেন বাধা না দেয়, আর যে কাজটা করে আনন্দ পাই, সেই কাজটা যেন ভালোভাবে করতে পারি, সেটা যেন অন্যকেও আনন্দ দেয়। সেইভাবে নিজেদের জন্য অনেক দামী বা শক্তিশালী কিছু কিন্তু চাইল না। তবুও, গল্পের শেষে গিয়ে আমরা দেখি, গুপী আর বাঘা এই সামান্য তিন বরের সাহায্যেই কিন্তু বিখ্যাত গায়ক-বাদক জুটি হয়ে উঠল, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ থামাল, না খেতে পাওয়া সেপাইদের মুখে খাবার এনে দিতে পারল, আর শেষ অবধি দুইজনেই দুই রাজকন্যাকে বিয়ে করে রাজার জামাই ও হয়ে যেতে পারল।
বড়রা এই অবধি পড়ে গম্ভীর গলায় বলবেন, " রূপকথায় অমন সব হয়েই থাকে, বাস্তবের গল্প তো এ নয়।" হয়ত ঠিক কথাই বলবেন। 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' শুরু থেকে শেষ অবধি একটা দারুণ ভালো রূপকথা। সত্যজিতের দাদু উপেন্দ্রকিশোরের লেখা মূল গল্পে (যেটা সম্ভবত ১৯১০ সালের আশেপাশে লেখা), বেড়াতে যাওয়ার বরের কথাও গুপী আর বাঘার মাথায় নিজের থেকে আসেনি। তারা গান বাজনা করতে আর খেয়ে পরে থাকতে চেয়েছিল। ভূতেরা নিজেরাই খুশি হয়ে তাদের তৃতীয় বরের সঙ্গে জুতোজোড়া উপহার দেয়। অনেক অনেক দিন পরে, ১৯৬৯ সালে সত্যজিৎ রায় যখন এই গল্প নিয়ে ছবিটা বানালেন, তখন তিনি বেড়ানোর বরটাকে গুপী আর বাঘার দ্বিতীয় ইচ্ছে করলেন। পৃথিবীর সব মানুষের সর্বত্র যাতায়াতের স্বাধীনতার কথা ছাড়াও, এই সময়ে নিশ্চয় একজন পরিচালক হিসাবে দারুণ সব লোকেশনে গিয়ে শুটিং করার কথা তাঁর মাথায় ছিল।
'গুপী গাইন বাঘা বাইন' ছবিটিকে ফিরে দেখতে গিয়ে মনে হয়, উপেন্দ্রকিশোর গল্পটি একেবারে ছোটদের কথা ভেবে লিখলেও, সত্যজিতের কাছে, এই ছবিটি শুধুমাত্র ছোটদের জন্য মনভোলানো রূপকথা ছিল না। কিংবা শুধুমাত্র যুদ্ধবিরোধী ছবি ছিল না। এই ছবি রূপকথার মোড়কে ছোট-বড় সবার জন্য এক সহজ-সরল জীবনবোধের পাঠ। আর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, এই গল্প যেন আমাদের সবার বার বার ফিরে দেখা জরুরী হয়ে পড়ছে।
'যা চাই পরতে খাইতে পারি' - এইটা যদি আজ সব মানুষের অধিকার থাকত? যদি ধর্মের নামে, সামাজিক নিয়মের নামে - কে কীসের মাংস খাচ্ছে বা কে কেমন জামা-কাপড় পরছে তাই দিয়ে আমরা জাতের তফাৎ, ধর্মের তফাৎ, মেয়েদের আর ছেলেদের তফাৎ না করতাম, তাহলে কেমন হত? যদি মন্দির,মসজিদ, গীর্জা বা অন্য কোনো উপাসনার জায়গাতে যার ইচ্ছে সে গিয়ে ঢুকতে পারত? কিংবা সব হাসপাতালে, সব পাঠাগারে, সব স্কুলে সবাই সহজেই যেতে পারত? যদি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মানুষ কোনোরকমের বাধা নিষেধ ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে পারত? যদি বিভিন্ন দেশের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া না থাকত, যদি 'দেশ' থেকে 'বিদেশ' যেতে পাসপোর্ট-ভিসা ইত্যাদির প্রয়োজন না পড়ত, তাহলে কেমন হত? তাহলে কি এই পৃথিবীটা আমাদের সবার জন্য আরও বেশি সুন্দর হয়ে উঠত না?
গুপী-বাঘার শেষ ইচ্ছেটার কথাও ভাবো। দুজনে গান-বাজনা করতে চায়, আর সেই সঙ্গে অন্যদের ও আনন্দ দিতে চায়। এখানে 'গান-বাজনা' শুধু গান বা বাজনা নয়, মানুষের নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার ভাষার প্রতীক, সৃজনশীলতার প্রতীক। খোলা মনে নিজের কথা, সত্যি কথা বলতে পারার স্বাধীনতার প্রতীক ও বটে। ওই যে কথায় বলে, মুখের ভাষা না বুঝলেও, গানের ভাষা, সুরের ভাষা সবাই বোঝে। আমরা ভাষা না বুঝলেও সুরে-লয়ে বুঝতে পারি, কোনটা আনন্দের গান, কোনটা দুঃখের গান। তাই এই ছবিতে, এবং গুপী-বাঘা সিরিজের অন্য দুটি ছবিতেও, সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তার বেশিরভাগ কিন্তু গানের মাধ্যমেই হয় - সেটা ষড়যন্ত্রী মন্ত্রীমশাইকে থামিয়ে দেওয়ার জন্যেই হোক, কিংবা যুদ্ধ থামাতে সৈনিকদের গান শোনানোতেই হোক। কারণ - 'সে ভাষা এমন কথা বলে/ বোঝে রে সকলে/ উঁচা-নীচা ছোট-বড় সমান...'।
এই মূহুর্তে, পুরো মানবসভ্যতা এক ভয়ানক সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। করোনাভাইরাস দুনিয়া থেকে চলে তো যায়ইনি, বরং ফিরে এসেছে আরও শক্তিশালী হয়ে। গতবছরের তুলনায় এই বছরে আমাদের দেশ ভারতের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। আমরা আবার আংশিক লকডাউনের মধ্যে দিয়ে চলেছি, জানিনা এবারেও গত বছরের মত সম্পূর্ণ লকডাউনের দিকে এগোচ্ছি কি না। আর এই বছর, ২০২১ সালে এই অসম্ভব দুঃসময়ের মধ্যে সত্যজিৎ রায়-এর একশো বছরের জন্মদিন পেরিয়ে গেল গত ২ মে তারিখে। তাঁকে মনে করে, তাঁর কাজকে মনে করে, শিল্পের বিভিন্ন ধারায় -সাহিত্য, চলচ্চিত্র, অলংকরণ, সঙ্গীত- সবেতেই তাঁর কাজগুলিকে ঘুরে ফিরে দেখা হচ্ছে। সত্যজিৎ তাঁর সুবিশাল সৃষ্টিসম্ভারের পরতে পরতে আমাদের জন্য রেখে গেছেন সহজ জীবনবোধের পাঠ, গরীব-ধনী সবাই মিলেমিশে থাকার আবেদন। কিন্তু আমরা কি সেসব বুঝতে পেরেছি? সেসব থেকে কোনো শিক্ষা নিয়েছি?
এই খুব খারাপ সময়ে, আমার খুব বেশি করে মনে পড়ছে প্রোফেসর শঙ্কুর নানারকম আবিষ্কার গুলোর কথা। সত্যি যদি বিজ্ঞানীরা বানিয়ে ফেলতে পারতেন 'বটিকা ইন্ডিকা' - যেটা একটা বড়ি খেলে অনেক্ষণ আর খিদে পায় না; কিংবা 'মিরাকিউরল', যে ওষুধ দিয়ে সব রকমের অসুখ সারানো যায়; কিংবা 'মাইক্রোসোনোগ্রাফ' - প্রকৃতির সবথেকে সূক্ষ্ম শব্দগুলি, এমনকী যে সব শব্দের কথা মানুষের কল্পনাতেও নেই, যেমন কিনা ভাইরাসের কথাবার্তাও ধরে ফেলে যে যন্ত্র। এই মূহুর্তে,খুব, খুব দরকার যে এমন সমস্ত আবিষ্কারের। সত্যজিৎ রায় যখন প্রফেসর শঙ্কুর নানারকমের অ্যাডভেঞ্চার এবং আবিষ্কারগুলির কথা লিখছিলেন, তখন কি তিনি অতীতের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যতে মানবসমাজের সামনে আসা বিপদগুলির কথা মাথায় রাখতেন? আজ থেকে ৫৬ বছর আগে, বাংলা ১৩৭২ সনে ( ইংরেজি ১৯৬৫ সালে) , 'প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক-রহস্য' গল্পে যখন তিনি 'মাইক্রোসোনোগ্রাফ'-এর মাধ্যমে ভাইরাসের বার্তা শোনার কথা লেখেন, তখন কি তিনি ভুলেও ভেবেছিলেন যে তাঁর জন্মশতবর্ষে এই দুনিয়া ছেয়ে যাবে করোনার আক্রমণে, দেশের লোক চিকিৎসা পাবে না, কাজকর্ম হারিয়ে খাবার যোগাড় করতে হন্যে হবে? ইন্টারনেট খুঁজে দেখলাম, গত একশো বছরেই, প্রায় প্রতি দশকেই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় থাবা বসিয়েছে নানা বিচিত্র মহামারি , যার মধ্যে কতগুলি অতিমারির চেহারাও নিয়েছে। তাই বোঝা যায়, এইরকমের অসুখ আগেও এসেছে, পরেও আবার আসতে পারে। তাহলে আমরা, এখন যারা বড়, তারা কেন এইরকম অবস্থার জন্য নিজেদের আগেভাগে প্রস্তুত করিনি? কেন মানবসমাজ বিলাসবহুল প্রাসাদ বা বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করার বদলে আরও হাসপাতাল, আরও গবেষণাগার তৈরি করেনি ? বা আরও অক্সিজেনের কারখানা তৈরি করেনি? কেন বিজ্ঞানের উন্নতি এবং প্রযুক্তিকে মানুষের উপকারে না লাগিয়ে, তৈরি করা হয় অ্যাটম বোমার মত ভয়ানক অস্ত্র?
ভেবে দেখো, প্রফেসর শঙ্কুর বেশিরভাগ আবিষ্কার কিন্তু হয় মানুষের জীবনযাপনের উন্নতি ও সুবিধার কথা ভেবে- খাবাবের সমস্যা, চিকিৎসার সমস্যা, ঠান্ডা বা গরম লাগার সমস্যা, ঘুম না আসার সমস্যা, স্মৃতি ভুলে যাওয়ার মত সমস্যার সমাধানে। এছাড়াও তিনি তৈরি করেছেন অতি সস্তায় উজ্জ্বল আলো, যেকোনো ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের যন্ত্র, নার্ভ সতেজ রাখার ওষুধ, পাহাড়ে চড়তে গেলে বেশি অক্সিজেনের যোগান দেওয়া পাউডার। কিন্তু কী আশ্চর্য, শত্রুকে বিনাশ করার জন্য কোনো বিরাট যুদ্ধজাহাজ, বোমারু বিমান বা প্রাণঘাতী বোমা তিনি তৈরি করেন নি। যাদের উপর তিনি নানা কারণে বিরক্ত, তাদের একটু শাস্তি দিয়েছেন 'স্নাফ-গান' দিয়ে বা ভয়ের স্বপ্ন দেখার ট্যাবলেট খাইয়ে। 'অ্যানাইহিলিন' তৈরি করেছেন আত্মরক্ষার জন্য এবং রক্তপাত পছন্দ করেন না বলে। কিন্তু সেটির প্রয়োগ খুব বেশি করেন নি।
বিজ্ঞানের অন্যায় প্রয়োগ বিষয়ে এই একই প্রশ্ন বারে বারে ফিরে এসেছে সত্যজিৎ-এর লেখায়, ছায়াছবিতে। গুপী-বাঘা সিরিজের দ্বিতীয় ছবিতেই আমরা দেখতে পাই, দুষ্টু হীরক রাজা কেমন করে একজন বৈজ্ঞানিককে হীরের লোভ দেখিয়ে পুষে রেখেছিল। সেই বৈজ্ঞানিক কোনোদিন শুকাবে না এমন সুগন্ধী ফুল ও সৃষ্টি করতে পারত, কিন্তু তার আসল কাজ ছিল 'যন্তর-মন্তর' ঘরে 'মগজ ধোলাই' যন্ত্র নিয়ে। এখানে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীকে ব্যবহার করে রাজাকে অমান্য করা কৃষক আর শ্রমিকদের মগজ ধোলাই করা হত। আবার 'আগন্তুক' ছবিতেও শোনা যায় আধুনিক 'সভ্যতা'র বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ, যেখানে গল্পের প্রধান চরিত্র, মন্টুদের বাড়িতে হঠাৎ আসা 'গ্লোব ট্রটার' দাদু মনমোহন মিত্র, এক সময়ে 'অসভ্য' আর 'সভ্য' মানুষদের মধ্যে তফাৎ বোঝাতে গিয়ে বলেন,
...সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ, যে আঙুলের একটি চাপে একটি বোতাম টিপে একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসী সমেত একটি গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর সভ্য কারা জানেন? যারা এই অস্ত্র-প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে উইদাউট টার্নিং এ হেয়ার।’
মনমোহনের মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন হিরোশিমা ও নাগাসাকির অ্যাটম বোমা বিস্ফোরনের বিরুদ্ধে।
প্রোফেসর শঙ্কুর শেষ সম্পূর্ণ গল্প, 'স্বর্ণপর্ণী'-তে ( যেটা আসলে শঙ্কুর প্রথম অভিযান ), তিনি শঙ্কুর জবানীতে সরাসরি হিটলারের এবং নাৎসিদের সমালোচনা করেছেন। আর এই গল্পেই, আমরা জানতে পারি, সদ্য খুব ভালো ফলাফল নিয়ে ডাব্ল্ অনার্স পাশ করা মাত্র ষোল বছর বয়সের ত্রিলোকেশ্বরকে তার বাবা, গিরিডির দয়ালু চিকিৎসক ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু কী উপদেশ দিয়েছিলেনঃ
... ক্ষমতা আছে বলেই যে অঢেল উপার্জন করতে হবে তার কোনও মানে নেই। সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য অর্থের প্রয়োজন ঠিকই, আর তাতে মানসিক শান্তির পথ সহজ হয়ে যায়; কিন্তু যাদের সে সংস্থান নেই, সুখে থাকা কাকে বলে যারা জানে না, সারা জীবন যারা দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বা যারা দৈবদুর্বিপাকে উপার্জনে অক্ষম - তাদের দুঃখ যদি কিছুটা লাঘব করতে পারিস, তার চেয়ে বড় সার্থকতা, তার চেয়ে বড় আনন্দ , আর কিছুতে নেই।"
বলা হয়, সত্যজিৎ রায়ের বেশিরভাগ লেখালিখি কিশোর-কিশোরীদের জন্য, প্রায় সব ছায়াছবিই বড়দের জন্য, আর 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' শুধু একেবারে ছোটদের কথা ভেবেই বানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আসল কথাটা হল, আমরা বড়রা খুব ভালো করে জানি- সত্যজিৎ রায়ের 'ছোটদের' জন্য লেখালিখি এবং ছায়াছবিও আসলে বড়দের জন্যেও করা। শুধুমাত্র চেহারায় বা অংকের হিসেবে বড় হলেই কি আর বড় হওয়া যায়, বলো? ছোটরা এটা সহজেই বোঝে, সত্যজিৎ ও বুঝতেন, শুধু আমরা বড়রা এটা বুঝলেও অস্বীকার করি।
এইবছর, যখন আবার ঘরে বন্দী থাকাটাই নিয়ম হয়ে থেকে যাচ্ছে, তখন সময় সুযোগ পেলে, চলো, আবার পড়ে ফেলি তাঁর সমস্ত লেখা; দেখে ফেলি বেশ কিছু ছবি। ঘুরে ফিরে শুনি তাঁর সৃষ্টি করা সুরে যত গান, গানের কথাগুলি। তাঁর নানারকমের সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই 'নয়ন মেলে' চিনে নিই আমাদের আশেপাশের আশ্চর্য 'জগতের বাহার'।
১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
১৬ মে, ২০২১
গ্রাফিকঃ মিতিল
প্রতিকৃতিসমূহঃ পার্থ মুখার্জি