সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ভালোবাসার নবনীতা দিদি

নবনীতা দেব সেন - নামটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সেই কোন ছোট্টবেলায়, এই যখন ধর আমি এই ইচ্ছামতীর থেকেও ছোট, সেইরকম বয়সে। 'সন্দেশ'-এর শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হল 'নীলমণিয়া' । এই রূপকথার সঙ্গে ছিল সত্যজিৎ রায়ের আঁকা সাদা-কালো রেখাচিত্র। আর একই বছরে আনন্দমেলার পুজোবার্ষিকীতে প্রকাশিত হল 'মরিচকলি' । সেই গল্পের সঙ্গে ছবির কথা আজ আর মনে নেই। 'নীলমণিয়া' আর 'মরিচকলি' পড়ে যে সেই ছোট্ট আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম, সেটা আর আলাদা করে বলার কী আছে? খুব ভালো লেগে না থাকলে কি আর এই এত বড় হয়ে গিয়েও সেইসব গল্পের নাম মনে রাখি? আর অনেক বড় হয়ে গিয়েও, বইয়ের দোকান থেকে খুঁজে নবনীতা দেব সেনের রূপকথার বই কিনে আনি?

তো সেই যে পরিচয় হল, নবনীতা দেব সেনের নাম আমার পছন্দের গল্পকারদের তালিকায় ঢুকে গেল। যেখানে সুযোগ পাচ্ছি, পড়ে ফেলছি রূপকথা, গল্প; বন্ধুদের থেকে চেয়ে আনছি আরও পুরনো পত্রিকা; 'ডিম্ববতী', 'চিকচিক আর রাজহাঁসদাদু', পড়ে ফেললাম সেইভাবেই। ক্রমে বড় হতে হতে একটু একটু পড়তে শুরু করলাম তাঁর অন্যান্য লেখাগুলি - নানা স্বাদের মজার গল্প, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনি। বড়দের জন্য সেই সমস্ত লেখাগুলি বিভিন্ন ভাবে আমার জীবন সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা বদলে দিতে পেরেছে।

তারপরে, আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে, আমার কাছে এল এক দারুণ সুযোগ। একটা বিশেষ কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য আমি নবনীতা দেব সেনের সঙ্গে সরাসরি দেখা করার সুযোগ পেলাম। যাঁর লেখা সেই ছোট্টবেলা থেকে এই বড়বেলা অবধি মুগ্ধ হয়ে পড়ছি, তাঁর সঙ্গে, তাঁর বাড়িতে সামনা সামনি দেখা করে কথা বলতে হবে ভেবে তো আমার একটু ভয়ের সঙ্গে খুব আনন্দ ও হচ্ছিল, আর উত্তেজনাও ছিল। নির্দিষ্ট দিনে, ঠিক সময়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম 'ভালো-বাসা' বাড়ির দরজায়। এর আগে বহুবার এই বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি, অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছি সেই তিন তলা অবধি, কিন্তু দরজায় কড়া তো নাড়ার কথা ভাবিইনি। দরজা খুলে দিয়ে আমাকে দোতলার বৈঠকখানায় বসালেন বাড়ির কেউ একজন। এই বিখ্যাত বৈঠকখানার গল্প কে না জানে! সেখানে চারিদিকে দেয়াল ঘেঁষা আলমারিতে কত কত পুরনো-নতুন বই, দেওয়ালের ঝোলানো নানা ছবি, আর একটা বিশেষ আরামকেদারা- ঘরের বড় সোফার এক কোণে বসে এইসব দেখতে দেখতে নানা কথা ভাবছি। একটু পরে যান্ত্রিক শব্দের টানা আওয়াজে বুঝতে পারলাম দিদি তিনতলা থেকে দোতলায় আসছেন। ঘরে ঢোকার আগেই সিঁড়ির রেলিং ধরে চ্যানেল করে একেবারে তিনতলা থেকে এক তলা অবধি নামা-ওঠা করতে পারা চেয়ারটা দেখেছি।

একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন দিদি। তারপরে আমার সব ভয় এক মূহুর্তে উড়িয়ে দিয়ে, দূরের আরাম কেদারার বদলে একেবারে সোফায় আমার পাশে বসে পড়লেন। শুরু হল আলাপ, কথাবার্তা। আমাদের এই কাজের আলোচনায় আরও দুয়েকজনের উপস্থিত থাকার কথা ছিল, তাঁরা তখনও এসে পৌঁছান নি। দিদি নিজের ডায়রি নিয়ে আসার জন্য কানাইদাকে ডাকলেন। হ্যাঁ, সেই 'কানাই', যার কথা আমরা মাঝেমধ্যেই দিদির যত ব্যক্তিগত মজার অভিজ্ঞতার গল্পে পেয়ে থাকি। কানাইদা ডায়রি নিয়ে এলে, দিদি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন- “এই হল আমার ছেলে কানাই...এরাই আমাকে দেখে শুনে রাখে…" আর একটু পরেই কানাইদার স্ত্রী ঝর্নাদি চা-মিষ্টি নিয়ে হাজির হলে, তাঁকে দেখিয়ে দিদি বললেন- “এ হল আমার বৌমা…"। জীবনের এক অসাধারণ পাঠ দিলেন আমায়, মাত্র কয়েকটি কথায়, পরিচয় হওয়ার মাত্র কয়েক মূহুর্তের মধ্যে, একেবারে গল্পচ্ছলে, নিতান্তই সাধারণ ভাবে।

না, তখনও আমি তাঁকে দিদি বলে ডাকতে শুরু করিনি। মনে মনে ভাবছি- কী বলে সম্বোধন করব? বয়সে তিনি আমার বাবার থেকেও বড়, আবার ম্যাডাম বললে যদি রাগ করেন? জনপ্রিয় মানুষ, যাঁদের আমরা সাধারণত 'সেলেব্রিটি' বলি, এমন মানুষদের সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচিতি প্রায় নেই বললেই চলে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম, তিনি ছোট-বড় সবার কাছেই 'নবনীতাদি' কিংবা শুধুই 'দিদি' । আর ভালোবাসায় ভরা সেই বৈঠকখানার দরজা সবার জন্য খোলা। সেদিন রবিবার ছিল, কথাবার্তা শেষ হতে হতে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেল। দিদির নির্দেশে সেই প্রথম দিনই এক সঙ্গে বসে দুপুরের খাওয়া খেয়ে ফিরলাম।

কাগজে-কলমে বড় হয়ে যাওয়ার পরে, আরও নানারকমের গল্পের বই, লেখালিখি পড়ে বুঝতে পেরেছি, কেন সেই ছোট্টবেলাতেই নবনীতা দেব সেন আমার মনে, আমার মত আরও কত কত ছোট ছোট মেয়েদের মনে অনায়াসে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন। নবনীতা দেব সেনের গল্প এবং রূপকথাগুলিতে প্রধান চরিত্রে কিন্তু সব সময়ে মেয়েদের জায়গা বাঁধা। আর যদি এমন গল্প হয় যেখানে সেই অর্থে কোনো প্রধান চরিত্র নেই, বরং অনেক চরিত্র আছে, তাহলে সেই গল্পগুলিতেও ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট মেয়েরা খেলা করছে, তর্ক করছে, ঝগড়া করছে, আনন্দ করছে, দুঃখ ও পাচ্ছে। এক ছোট্ট মেয়ে হয়ে এমন গল্প পড়তে তো ভালো লাগবেই । তা বলে এমন নয় যে ছোট্ট ছেলেদের এমন গল্প ভালো লাগবে না। কিন্তু আজও, হিসেব কষে দেখলে দেখা যাবে, যত ছোটদের গল্প লেখা হয়, সেগুলির প্রধান চরিত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সংখ্যা বেশি। স্কুলের পড়ার বইয়ের উদাহরণেও তাই থাকে, যদিও ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে এই অভ্যাস।

...মহারানি বুক থেকে ছোরাটা বের করে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিলেন। এসব খুন-খারাপির অস্ত্র মানুষের কোনোও কাজে লাগেনা। ভালবাসাই হল আসল অস্ত্র। আর চাই সৎ সাহস।...
-'ইচ্ছামতী'

আরও যেটা ভালো ব্যাপার, নবনীতা দিদির রূপকথাগুলিতে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করার জন্য কিন্তু একেবারেই বড়সড় যুদ্ধ হয়না। রক্তপাত আর অস্ত্রশস্ত্রের ঝন্‌ঝনানিকে গুরুত্ব দেননি তিনি কোনোদিন। বরং ভালোবাসা দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে আর বুকভরা সাহস নিয়ে বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান করেন তাঁর রূপকথার প্রধান চরিত্রেরা। তাই বোধ হয়, আমরা যারা যুদ্ধ ভালোবাসিনা, হানাহানি-কাটাকাটি অপছন্দ করি, তাদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন এই সব রূপকথা বুনে চলা দিদি।

মেয়েরা নিত্য কাজকর্মের পরেও নিজেদের জন্য আলাদা করে কিছু করুক, নিজেদের কথা বলুক, নিজেদের ভাবনা এবং মতামত সবাইকে জানাক -এমনটাই সর্বদা চেয়েছেন নবনীতা দিদি। তাই মেয়েরা লিখলে, ছবি আঁকলে, গান-নাচ-নাটক-ফোটোগ্রাফি-স্থাপত্য-যেকোনো নান্দনিক কাজকর্মে যুক্ত থাকলে খুব খুশি হতেন তিনি। গায়ের রং বা চেহারার মাপে নয়, মেয়েরা যুক্তি-বুদ্ধি-মেধা-পান্ডিত্যের আলোয় পরিচিত হোক, সম্মান পাক সর্বত্র, এমনই চেয়েছিলেন তিনি। এই ভাবনাগুলোই ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর লেখাগুলির পরতে পরতে। তাঁর গল্পগুলিতে বুদ্ধিমতী, সৎ, সাহসী মেয়েরা সামনে আসা জটিল সমস্যাগুলির সমাধান নিজেরাই করে ফেলতে পারে। সবসময়ে কোনোও বীর রাজপুত্র বা রাজার প্রয়োজন হয়না।

আর বেড়ানোর গল্প? সেইসব মজায় ভরা, বেজায় সাহসে আর গন্ডগোলে ভরপুর কিন্তু একেবারে সত্যি সমস্ত বেড়ানোর গল্প পড়তে পড়তে মনে হবেই হবে- আমিও তাহলে অমন দুটো ব্যাগ নিয়ে এখনই অমন বেড়াতে চলে যাই; কোথায় কী বিপদ আসতে পারে, সেই দুঃশ্চিন্তা পড়ে থাক ঘরের কোণে।

আবার অন্যদিকে, নিজেই নিজেকে নিয়ে মজা করে লিখেছেন নানা রকমের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প। নিজেকে নিয়ে হাসতে পারা কিন্তু সহজ কাজ নয়। নিজের না-পারা গুলোকে নিয়ে, নিজের অসুস্থতা নিয়ে হাসি-মজা করে নবনীতাদি নিজেকে আমাদের ঘরের মানুষ বানিয়ে নিতে পেরেছিলেন, দূরের সেলেব্রিটি হয়ে থেকে যান নি।

...

আপন প্রাণরক্ষার অধিকার সব জীবেরই আছে...পরোপকার যদি শর্ত বেঁধে করা হয় তবে পরোপকারের পুণ্যটা হয় না।
-'নীলমণিয়া'

নবনীতা দিদিকে নিয়ে গল্প করতে শুরু করলে সহজে তো শেষ হবে না। সহজ কয়েকটি রেখায় তাঁর ছবি ফুটিয়ে তোলা বেশ শক্ত। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, অনুবাদ, ছোটদের জন্য গল্প, রূপকথা - সাহিত্যচর্চার সব দিকেই তিনি সমান উৎসাহে কাজ করে গেছেন। তার সঙ্গে তিনি আবার ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপিকা। তাঁর পান্ডিত্য আর গবেষণার কারণে বিশ্বের সাহিত্যিক মহলে সম্মানিত আর সমাদৃত ছিলেন তিনি। কিন্তু এইসবের বাইরে যেটা ছিল, সেটা ছোট হই বা বড়, সবার কাছে একটা অনুকরণীয় অভ্যাস। নবনীতা দিদি সবসময়ে নতুন নতুন বিষয়ে শিখতে, জানতে আগ্রহী ছিলেন। অন্তত দুই দশক বা তারও বেশি আগে থেকে দিদি কম্পিউটারে বাংলা লেখা শিখে নিয়েছিলেন। কেউ নতুন কোনো বিষয়ে জানালে খুব খুশি হতেন। এই আমাদের 'ইচ্ছামতী'র কথা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাদের নিজস্ব অ্যাপ আছে শুনে সঙ্গে সঙ্গে বললেন- “তাই নাকি? দাও তো দেখি আমার মোবাইলে ইন্সটল না কী করো তোমরা, সেটা করে দাও...আমি দেখব।" 'ইচ্ছামতী' নাম শুনে বেজায় খুশি হয়ে একেবারে ছোট্ট মেয়ের মত বলেছিলেন - “আরে, আমারও তো ইচ্ছামতী নামে একটা রূপকথা আছে! তার সঙ্গে নাম মিলিয়ে নাম রেখেছ বুঝি!..."

বছরখানেক আগেই তাঁর সামনে আর এক বন্ধুর কাছ থেকে ইচ্ছামতীর জন্য নতুন গল্প চাইছি, অমনি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন-"কই, আমাকে লিখতে বলিস না তো?" আমাদের দুর্ভাগ্য, তার পরে পরেই দিদির অসুস্থতা বাড়তে থাকে, তাই আলাদা করে আবদার করার আর সুযোগ হল না।

কিন্তু তাতে কী? আমাদের পড়ার জন্য, বোঝার জন্য পড়ে রইল তাঁর অসংখ্য লেখালিখি। সেই সমস্ত লেখা ছেলে-মেয়ে এবং ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার পড়া দরকার। জীবনের সবথেকে জরুরী পাঠগুলি, অতি সহজ ভাষায় আমাদের জন্য বারে বারে লিখে রেখে গেছেন নবনীতা দিদি। তাঁর লেখার পালার আপাততঃ ছুটি। এবার জানার পালা, পড়ার পালা আমাদের।


ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা