দিব্যি ঘুমাচ্ছিলাম আমি আর ইচ্ছামতী। ভোরবেলা বোজা চোখ যেন আর খুলতেই ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু খুলতে হল। না খুলে উপায় আছে? জানালা দিয়ে চোখে এসে সোজা বিঁধছে ভোরের প্রথম আলো। সূয্যিমামাতো সেই কোন কাকভোরে উঠে পূবসাগরে ডুব দিয়ে নেয়ে ধুয়ে সাতসকালে আকাশে উঠে বসে আছেন। আর বসবেন নাই বা কেন? এসে গেছে গ্রীষ্মকাল। এখন তো দিন ক্রমশঃ বড় হবে আর রাত ক্রমে ছোট, তাই সূ্য্যিমামার কাজের সময়ও বেশি। সেই যে গত সংখ্যায় বলেছিলাম শীতবুড়োর কথা, সে তো পিঠে পায়েস খেয়ে, কম্বলখানি গায়ে জড়িয়ে কবেই আবার উত্তরমুখো হাঁটা দিয়েছে। তারপরে এল বসন্ত। তবে সে বড় চঞ্চল । এসেছে কি না এসেছে, ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই সে সরস্বতী পুজো আর দোলের রঙখেলার খুশি ছড়িয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি বিদায় নিল। যেতে যেতে অবশ্য তার কাজ সেরে গেছে - গাছে গাছে নতুন কচি সবুজ পাতা, আর নীল আকাশের কোল সাজিয়ে গেছে লাল কৃষ্ণচূড়া, হলুদ রাধাচূড়া, বেগুনী আকাশমণি, আর কমলা পলাশফুলে। আর বসন্ত যেতেই এসে গেল গ্রীষ্ম। এখন খালি গরম বাড়বে আর বাড়বে । সারা দিন ঝলসে যাবে সূর্যের প্রখর তাপে, কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় তিনি যখন কাজ শেষ করে দিনের মত বিশ্রাম নিতে যান, তখন, দখিণ দিক থেকে ভেসে আ্সে ঠাণ্ডা বাতাস। সারাদিনের পরিশ্রমের পর শীতল করে সবাইকে।
মাঝে মাঝে আকাশ কালো করে ধেয়ে আসছে কালবৈশাখী। জোরালো বাতাস আর ঝমঝমে বৃষ্টির পরশে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব উষ্ণতা। সেই ঝড়ে আমের ডাল থেকে খসে পড়ছে ছোট ছোট কুসি। সেই টকটক পুঁচকে পুঁচকে আম ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে খেতে যা ভাল না ... কি আর বলব তোমায়!
বেশ কয়েক বছর পরে এবার প্রায় দুয়েক দিন পরে পরেই কালবৈশাখী হচ্ছে। প্রকৃতি মা যেমন একদিকে খুব গরমে কষ্ট দিচ্ছেন, অন্যদিকে আবার মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা করেও দিচ্ছেন। বিশ্বের সব মায়ের সেরা মা হলেন প্রকৃতি। দেখ, ঋতু পরিবর্তন করে গরম নিয়ে এলেন ঠিকই, কিন্তু সাথে নিয়ে আসছেন কত ভাল ভাল উপহারও - গ্রীষ্মকাল মানেই তো নানারকমের রসালো, ঠাণ্ডা, মিষ্টি ফলের সময় - আম, তরমুজ, জামরুল, লিচু, কাঁঠাল...কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই...এই সময়েই ফোটে নানারকমের সুগন্ধী ফুল, সন্ধ্যাবেলা যাদের মধুর সুবাসে মন ভাল হয়ে যায়। আর প্রকৃতিকে যিনি এতরকম উপাদানে সাজিয়ে তুলেছেন, তিনি হলেন ধরিত্রী - আমাদের পৃথিবী। আমাদের জন্য এত ভাবনা চিন্তা করেন যিনি, সেই ধরিত্রী মাকে তো তাহলে একটা দিন অন্ততঃ বিশেষ ভাবে আদর যত্ন করতেই হয়, তাই না? সেই কারণেই গত ২২শে এপ্রিল পালিত হল 'ইন্টারন্যাশ্নাল মাদার আর্থ ডে' । প্রতি বছর এই দিনে পৃথিবীর নানা দেশে নানারকমে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর সম্পর্কে, প্রকৃতির সম্পর্কে সাধারন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা হয়। ধরিত্রীকে ভালবাসলে তিনিও আমাদের ভালবাসবেন। তাঁর মত সহনশীলা মা আর কেউ নেই। মানুষের সমস্ত অত্যাচার তিনি হাসিমুখে মেনে নেন, ঠিক যেমন তোমার প্রায় সব দুষ্টুমিকেই মেনে নেন তোমার মা।
কিন্তু মা যদি কোন কারণে রেগে যান? তাহলে কি হবে? তাহলে কি হতে পারে, সেটা আমরা দেখেছি গত ১১ই মার্চ , যেদিন বিশ্বের এক ছোট্ট কিন্তু খুব উন্নত দেশ জাপানে হল ভয়ানক ভূমিকম্প, আর তার পিছে পিছে জলদস্যুর মত ধেয়ে এল সুনামি। জাপান প্রযুক্তিবিদ্যা আর কারিগরী দক্ষতায় বিশ্বের সেরা দেশগুলির মধ্যে একটি। জাপানিদের সবাই চেনে এক নিয়মানুবর্তী, শৃঙ্খলাপরায়ণ জাতি রূপে। কিন্তু এই মানুষগুলিও কত অসহায় হয়ে পড়লেন, যখন তাঁদের দেশ কেঁপে উঠল প্রবল ভূমিকম্পে, দুলে উঠল বাড়িঘর, ভেসে গেল একেকটা পুরো শহর। সেখানেই শেষ নয়। তাঁদের এক পরমাণুকেন্দ্রে চরম ক্ষতি হল। পরমাণুশক্তির তেজস্ত্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁদের আকাশে, বাতাসে, সমুদ্রের জলে, খাবারে। আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম আর মনে মনে বুঝতে পারলাম, যতই উন্নত হোক না কেন, প্রকৃতির রুদ্র রূপের সামনে আসলে মানুষ কত অসহায়। তুমিও নিশ্চই দেখেছ...অথবা খবরের কাগজে পড়েছ? আমরা শুধুমাত্র সবাই মিলে প্রার্থনাই করতে পারি যেন এইরকম ক্ষতি আর কারো না হয়, তাই না?
ভূমিকম্পের পরে জাপান
তবে আমি জানি, ইচ্ছামতীও জানে, আর তুমিও জান, যতই কষ্ট আসুক না কেন, আমাদের সবার শুভেচ্ছার জোরে জাপানের মানুষ আবার নিজেদের দেশকে গড়ে তুলবেন ঠিক আগের মত করে। অনেক কিছু নষ্ট হয়েছে, অনেক মানুষ তাঁদের আত্মীয় পরিজনদের হারিয়েছেন, কিন্তু তাঁরা ভেঙ্গে পড়বেন না। তাঁরা আবার গড়ে তুলবেন তাঁদের দেশকে। সমস্ত রকমের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করে জিতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে সবারই মধ্যে। আর যদি সত্যি সত্যি জিতে যেতে পার, তাহলে কেমন লাগে?
কেমন যে লাগে, সেটা এবার ২০১১ এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় যারা ভারতকে সমর্থন করেছিল তারা সবাই জানে। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে, প্রতি চার বছর অন্তর লড়াই চালিয়ে গেছে্ন ভারতের ক্রিকেট দল। অনেকবারেই শেষ ধাপের কাছাকাছি এসে ফিরে যেতে হয়েছে হতাশ হয়ে। কিন্তু তাতেও তাঁরা হাল ছাড়েননি। প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা কিন্তু খুব সহজে নিতে দেয়নি বিশ্বকাপ। তারা শেষ মূহুর্ত অবধি কঠিণ লড়াই চালিয়ে গেছে। কিন্তু ভারতীয় দল ফাইনাল ম্যাচের দিনে দেখিয়ে দিলেন, নিষ্ঠা, পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষ অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও জিতে বেরিয়ে আসতে পারে। তুমিও নিশ্চয় দেখেছিলে সেই খেলা? ভারত বা শ্রীলঙ্কা, অথবা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ বা আয়ারল্যান্ড - যাকেই সমর্থন করে থাক না কেন, একটা কথা আমাদের সবার সবসময়ে মাথায় রাখা উচিত - একটা সুস্থ খেলার আনন্দ যেন নিছক রেষারেষিতে না বদলে যায়। প্রথম পুরষ্কারটা তো যেকোন একজন নিয়ে যাবেই, কিন্তু যারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, তারা কিন্তু সবাই একই রকম ভাবে পরিশ্রম করে জেতার জন্য। তাই হেরে গেলেও তাদেরকে জিতে যাওয়া দলের মতই একই রকম সম্মান জানাতে হয়।
বিশ্বকাপ জেতার পরে টিম ইন্ডিয়া
তুমি কি ক্রিকেট খেল? অথবা ফুটবল? বা কবাডি, খো খো অথবা কুমির ডাঙ্গা? ভাবছ, এত খেলার কথা উঠছে কেন? আরে, সামনেই তো স্কুলের গরমের ছুটি! আর ছুটি মানেই তো খেলাধুলো করার অফুরন্ত সময়, তাই না? তার মানে কিন্তু এই নয় যে পড়াশোনা বন্ধ - পড়াশোনা আর অন্যান্য নিয়মিত কাজকর্ম, যেমন আঁকা বা গান , নাচ অথবা সাঁতার, সব কিন্তু নিয়মমাফিক করে যেতে হবে। তার ফাঁকে ফাঁকে চলবে খেলাধুলো। আর সামনের কয়েকদিনের মধ্যেই রয়েছে কয়েকজন শ্রদ্ধেয় মানুষের জন্মতিথি। ২৫শে বৈশাখ হল রবি ঠাকুরের জন্মদিন, আর ১১ই জৈষ্ঠ হল আমাদের আরেক প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। এঁদের আগে অবশ্য থাকছে আমাদের আরেক মনের মানুষের জন্মদিন - আজ, ২রা মে হল সত্যজিত রায়ের জন্মদিন। এই দিন গুলিতে এঁদেরকে শ্রদ্ধা জানাতে ভুলো না কিন্তু।
আর এইসব নানান কাজ কর্মের মধ্যে, তোমার সঙ্গে অবশ্যই থাকছে ২০১১ সালের ইচ্ছামতীর নতুন গ্রীষ্ম সংখ্যা । নানা রকমের গল্প, ছড়া আর অন্যান্য নিয়মিত লেখা নিয়ে এবারেও বেশ সেজেগুজে এসেছে ইচ্ছামতী। সব পাতাগুলিকে একবার করে খুলেই দেখ না কেন !
সব শেষে তোমাকে আর তোমার পরিবারের সকলকে জানাই নতুন বাংলা বছর ১৪১৮ এর শুভেচ্ছা। আশা করছি ১লা বৈশাখ সবার খুব ভাল কেটেছে। বৈশাখ মাস যদিও শেষ হতে চলল, কিন্তু নতুন বাংলা বছরে আমাদের তো এই প্রথমবার কথা হচ্ছে , তাই আমরা তো বলতেই পারি 'শুভ নববর্ষ', তাই না ?
খুব ভাল থেক। তোমার নতুন বছর খুব ভাল কাটুক। এই গ্রীষ্মের ছুটিতে আমের আচার আর তরমুজের শরবতের সাথে তোমার সঙ্গী করে নাও নতুন ইচ্ছামতীকে। আর আমাকে অবশ্যই লিখে জানিও কেমন লাগছে ইচ্ছামতী।
চাঁদের বুড়ি
সোমবার,
১৮ই বৈশাখ, ১৪১৮
২রা মে, ২০১১