ফুটবলে ''ডার্বি ম্যাচ'' কথাটা হয়তো তুমি শুনে থাকবে। যেমন ধরো, কিছুদিন আগেই তোমার বাড়ির কাছেই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে যখন ইষ্টবেঙ্গল - মোহনবাগানের মধ্যে খেলা হল তখন হয়তো অনেকের মুখে "কলকাতার ডার্বি" কথাটা শুনেছ। আসলে এক শহরের বা এক অঞ্চলের ফুটবল ক্লাবগুলো যখন নিজেদের মুখোমুখি হয়, তখন সেই খেলাগুলোকেই ''ডার্বি ম্যাচ" বলা হয়। পারিপার্শ্বিকের আবেগ, খেলা জেতা-হারার আনন্দ আর দুঃখ মিলিয়ে এই খেলাগুলোর উত্তেজনা স্বভাবতই একটু বেশি থাকে অন্য খেলাগুলোর থেকে। অনেক সময় হয়তো দেখা যাবে যে বন্ধুদের মধ্যে বা একই বাড়িতে কেউ পাগল একটা দলের জন্য - আর অন্য কেউ অন্য দলের জন্য। আর তার থেকে আলোচনা, টানাপোড়েন আর হারার দুঃখ সব মিলিয়ে ডার্বি ম্যাচগুলো হয়ে ওঠে খেলার থেকে অনেক বেশি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই সেখানকার ক্লাব ফুটবল লীগে কিছু কিছু ডার্বি ম্যাচ থাকে একই শহর বা একই অঞ্চলের দলগুলোর মধ্যে। যেহেতু বিশ্বের বেশীরভাগ দেশের বড় ফুটবলাররা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের লীগে খেলে থাকেন, তাই আজ তোমাকে ইউরোপের এরকম কিছু ডার্বি ম্যাচ নিয়েই বলব। আর আজকাল তো স্যাটেলাইট টেলিভিশনের দৌলতে এই লীগগুলোর অনেকগুলোই তুমিও ইচ্ছা করলেই দেখতে পারবে।
প্রথমেই চলো কথা শুরু করি ফুটবলের জন্মভূমি ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লীগ নিয়ে। পৃথিবীর সব লীগের মধ্যে প্রিমিয়ার লীগই হয়তো সবচেয়ে গতিশীল আর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। লীগের কুড়িটা দলের মধ্যে লন্ডনের ক্লাবের ছড়াছড়ি। এদের নিজেদের মধ্যে খেলাগুলো পরিচিত "লন্ডন ডার্বি" নামে। তবে তার মধ্যে যে খেলাটায় রেষারেষি সবচেয়ে তুঙ্গে থাকে - সেটা হল নর্থ লন্ডনের দুটি ক্লাবের মধ্যে - আর্সেনাল আর টটেনহ্যাম হটস্পার। যদিও সাফল্যের দিক দিয়ে চিরকালই আর্সেনাল টটেনহ্যামের থেকে অনেকগুণ এগিয়ে, কিন্তু তার জন্য নিজেদের ডার্বির গুরুত্ব কোনভাবেই কম হয়না। যদিও প্রায় এক শতক ধরে নর্থ লন্ডনের ক্লাব হিসেবেই পরিচিত, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ক্লাবের গোড়াপত্তন হয়েছিল লন্ডনের দক্ষিণ-পূর্ব উলউইচ এলাকায়। তাই এক অংশের টটেনহ্যাম সমর্থকরা আর্সেনালকে নর্থ লন্ডনের ক্লাব বলেই গণ্য করে না। তাদের মতে আর্সেনাল চিরকালই কোন না কোনভাবে টটেনহ্যামকে নকল করে এসেছে। অন্যদিকে, এর উত্তরে এক অংশের আর্সেনাল সমর্থকদের মতামত এটা শুধুমাত্র তাদের প্রতিবেশীদের আর্সেনালের সাফল্য দেখে হতাশার বহিঃপ্রকাশ। এরকমই আরেক রেষারেষির গল্প হল লিভারপুলের মার্সিসাইড অঞ্চলের দুটি ক্লাবের - লিভারপুল ফুটবল ক্লাব আর এভারটন। একই শহরের পাশাপাশি দুটি ক্লাবের জার্সির রঙের জন্য এদের অনেক সময় ডাকা হয় "রেড সাইড অফ্ মার্সিসাইড" আর "ব্লু সাইড অফ্ মার্সিসাইড" বলে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে লিভারপুলের সাফল্য তাদের সমর্থকদের কাছে যতটা গর্বের, সেটা ততটাই বেদনাদায়ক এভার্টন সমর্থকদের কাছে। যদি চট করে মানচিত্র বইটা একবার খুলে ফেল তাহলে এর কাছাকাছিই দেখবে ম্যাঞ্চেস্টার শহর, আর বৃহত্তর ম্যাঞ্চেস্টার অঞ্চলের দুটি ক্লাব - ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড আর ম্যাঞ্চেস্টার সিটি-র মধ্যে চলে "ম্যাঞ্চেস্টার ডার্বি"। এখানেও দেখা যাবে যে চিরকালই ইউনাইটেড সাফল্যের দিক দিয়ে সিটি-র থেকে অনেক এগিয়ে। সাম্প্রতিককালে কার্লোস তেভেজ যখন দলবদল করে ইউনাইটেড থেকে সিটি-তে খেলা শুরু করলেন আর তার সাথে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি অনেক খরচ করে দল বানিয়ে ইউনাইটেড-এর পাল্লা দিতে শুরু করল, তার মধ্যেই ম্যাঞ্চেস্টার সিটির স্টেডিয়ামের সামনে বড় ব্যানারে তেভেজের ছবির সাথে "ওয়েলকাম টু ম্যাঞ্চেস্টার" লেখাটা অনেকটাই ইউনাইটেড-এর সমর্থকদের তাতিয়ে দেওয়ার জন্য। এ ছাড়াও রয়েছে ওয়েষ্ট ব্রমউইচ অ্যালবিয়ন আর উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্সের মধ্যে "ব্ল্যাক কান্ট্রি ডার্বি", সান্দারল্যান্ড আর নিউক্যাসল ইউনাইটেড-এর মধ্যে "টাইন অ্যান্ড উইয়ার ডার্বি", সাউদাম্পটন আর পোর্টস্মাউথের মধ্যে "সাউথ কোষ্ট ডার্বি", আরও কত কি!
নর্থ লন্ডন ডার্বিতে সমীর নাসরি আর লুকা মদ্রিচের বলের লড়াই
ঠিক পাশের দেশ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরের আরেকটি ডার্বি ম্যাচের কথা না বলে এই বিষয়ে কোন লেখাই হয়তো শেষ করা যাবে না। এই শহরের দুটি ক্লাব সেলটিক আর রেঞ্জার্সের মধ্যে হওয়া "ওল্ড ফার্ম ডার্বি" পৃথিবীর সবচেয়ে রেষারেষির ডার্বিগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্কটিশ লীগের এই দুটি সবচেয়ে সফল ক্লাবের মধ্যে ফুটবল খেলা শুধু খেলা তো নয় - তার সাথে জড়িয়ে আছে বহু সামাজিক, ধর্মীয় আর রাজনৈতিক ইতিহাস । সেগুলো নিয়ে লিখতে বসলে হয়তো একটা আলাদা বই লিখে ফেলা যাবে।
ওল্ড ফার্ম ডার্বিতে সেলটিক আর রেঞ্জার্সের সমর্থকেরা
ইংল্যান্ড থেকে এবারে চলো যাই একটু দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে ইতালিতে। ইতালির সর্বোচ্চ পর্যায়ের লীগের নাম হল "সিরি এ"। এদেশে ফুটবল তো শুধুমাত্র আর খেলা নয়, মানুষের প্রতিদিনকার জীবনযাপনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই ফুটবল যেন এখানে জীবনযুদ্ধের একটা অংশ। সেটাই আরও প্রকট হয়ে ওঠে ডার্বি ম্যাচগুলোতে। দুর্ভাগ্যবশতঃ, অনেক সময়েই তার সাথে জড়িয়ে পড়ে সমর্থকদের মধ্যে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। প্রথমেই বলতে হয় মিলান শহরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এ. সি. মিলান আর ইন্টারন্যাজিওনেল (যা "ইন্টার মিলান" নামেই বেশী পরিচিত)-এর কথা। তুরিন শহরের জুভেন্টাস ক্লাবের পর সাফল্যের দিক দিয়ে মিলানের এই দুটি ক্লাবই ইতালিতে সবচেয়ে এগিয়ে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মিলান শহরের বিত্তবান আর উচ্চ মধ্যবিত্তরা ছিল ইন্টার-এর সমর্থক আর নিচুতলার খেটে খাওয়া মানুষেরা এ. সি. মিলানের সমর্থক। ক্লাবের সমর্থনের মধ্যে এই সামাজিক প্রতিফলন চিরকাল এই ডার্বি ম্যাচকে দিয়ে এসেছে এক অন্য মাত্রা। এর পরেই বলতে হয় মিলানের নিকটবর্তী তুরিন শহরের জুভেন্টাস আর তুরিনোর মধ্যে ডার্বি। জুভেন্টাস যদিও ইতালির লীগে সবচেয়ে বেশী সফল, আর সেদিক দিয়ে তুরিনো অনেকটা পিছিয়ে আর সাম্প্রতিককালে অনেক সময়েই সর্বোচ্চ স্তরে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু এই ডার্বি যখন খেলা হয় তখন দুই দলই সবকিছু ভুলে নিজের শহরের শ্রেষ্ঠত্ত অর্জনের জন্য খেলে থাকে। খানিকটা আশ্চর্যজনকভাবে তুরিন শহরের মধ্যে তুরিনোর সমর্থনের কখনও ঘাটতি হয়নি। যদিও জুভেন্টাসের সমর্থন তুরিনের বাইরেও ইতালির অন্যান্য শহর আর বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে আছে। তার সাথে বলতে হয় ইতালির রাজধানী রোমের লাজিও আর এ. এস. রোমা (বা, সংক্ষেপে রোমা)-র মধ্যে ডার্বির কথা। উত্তরের মিলান আর তুরিন শহরের ক্লাবগুলোর মত সাফল্য এদের কারোরই নেই। তাই অনেক সময় লীগ জেতার থেকেও ডার্বি ম্যাচে জেতাটা বেশী প্রাধান্য পেয়ে থাকে, আর তার থেকেই এই ডার্বিও পেয়ে থাকে এক অন্য উত্তেজনা।
মিলান ডার্বিতে সমর্থকের লাগানো আগুনে স্টেডিয়ামের একাংশে আগুন জ্বলছে
ইতালি থেকে এবারে দেখে আসি চলো ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমে স্পেন-এ। এই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লীগ "লা লীগা"-তে হয়তো তুমি দেখতে পাবে না ইংলিশ প্রীমিয়ার লীগের গতি, হয়তো দেখবে না সিরি এ-র জমাট রক্ষণ, কিন্তু হয়তো দেখতে পাবে আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন ফুটবল। আসলে ফুটবল এখানে শুধু একটা খেলা নয়, এদের সংস্কৃতির একটা অংশ। আর তাই স্পেনের মানুষের বর্ণময় জীবনযাত্রার সাথে সাথে এদের ফুটবলও খুব বর্ণময়। সেই লা লীগা-র সবচেয়ে দুটি সফল ক্লাব হল মাদ্রিদ শহরের রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনা শহরের বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব। এদের নিজেদের মধ্যে যে খেলা হয় সেটা বিখ্যাত "এল ক্লাসিকো" বলে, যার ইংরেজী অনুবাদ করলে হয় "দ্য ক্লাসিক"। ডার্বির সংজ্ঞা অনুযায়ী এটাকে ঠিক ডার্বি না বলা গেলেও, এটা নিঃসন্দেহে স্পেনের দুটি সবচেয়ে বড় শহরের দুটি সবচেয়ে বড় ক্লাবের নিজেদের মধ্যে সন্মানের লড়াই। যদিও রিয়াল মাদ্রিদের আসল ডার্বি হল নিজেদের শহরের অন্য ক্লাব অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে। রিয়াল মাদ্রিদ চিরকালই গণ্য হয়েছে মাদ্রিদ শহরের অভিজাত আর উচ্চ মধ্যবিত্তদের একটা প্রতীক হিসেবে, সেখানে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ তাদের সাথে পাল্লা দিয়েছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে। যদিও সত্তর আর আশির দশকের একটা সময় ছাড়া অ্যাটলেটিকোকে সাফল্যের দিক দিয়ে চিরকালই রিয়ালের ছত্রছায়ায় থাকতে হয়েছে, কিন্তু তার জন্য "মাদ্রিদ ডার্বির" আকর্ষণ আর উত্তেজনা কোন অংশে ক্ষুণ্ণ হয়নি। কিন্তু লা লীগা-র সবচেয়ে বড় ডার্বি হল দুটি মাঝের সারির ক্লাব সেভিয়া আর রিয়াল বেটিসের মধ্যে। সেভিয়ে অঞ্চলের দুটি ক্লাবের এই ডার্বিকে বলা হয় "সেভিয়ে ডার্বি"। সাম্প্রতিককালে অবশ্য রিয়াল বেটিস নীচের সারিতে নেমে যাওয়ার জন্য এই ডার্বি আয়োজিত হতে পারেনি। তেমনই রয়েছে বার্সেলোনার স্থানীয় ডার্বি এসপ্যানিয়লের সাথে, ভ্যালেন্সিয়া অঞ্চলের ভ্যালেন্সিয়া ফুটবল ক্লাব, ভিয়ারিয়াল আর লেভান্তের ডার্বি।
এল ক্লাসিকো শুরুর মুহূর্তে বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের ফুটবলারদের একে অপরকে অভিবাদন
জার্মানীর বুন্দেশলিগাতে একই শহরের ক্লাবগুলোর মধ্যে ডার্বি সচরাচর দেখা না যাওয়ার কারণ হয়তো বেশীরভাগ সময়েই একই শহরের ক্লাবগুলো একই পর্যায়ে না খেলার জন্য। সেই জন্য এখানে মুখ্যতঃ দেখা যায় আঞ্চলিক ডার্বি। যেমন উত্তর জার্মানীতে আছে হ্যামবার্গার আর ওয়ের্ডার ব্রেমেন-এর ডার্বি। তা ছাড়াও হ্যামবার্গার আর সেইন্ট পাউলির মধ্যে ডার্বিও খুব জমজমাট। অনেককাল থেকেই সেইন্ট পাউলির সাথে বিভিন্নভাবে স্কটল্যান্ডের রেঞ্জার্স ক্লাবের একটা সখ্যভাব ছিল। যার জন্য রেঞ্জার্সের চিরশত্রু সেলটিকের সাথে হ্যামবার্গারের বহুদিনের একটা বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছে।
এরকম বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন লীগে ছড়িয়ে আছে আরো অনেক ডার্বি। তার সাথে জড়িয়ে আছে তাই নিয়ে মানুষের আবেগ, আর আনন্দ-দুঃখের গল্প। তাই এরপর যখন খেলা দেখতে বসবে তখন এই খেলাগুলোর দিকে একটু বিশেষভাবে নজর রেখো, আর কোথাও এই নিয়ে পড়ার সুযোগ পেলে একদম হাতছাড়া কোরোনা। দেখবে জানতে পারবে আরো কত কিছু। আর এরপর যখন বাড়িতে বা পাড়ায় বড় দাদারা এইসব ফুটবলের ডার্বি নিয়ে আলোচনা করবে, তখন তুমিও তার মধ্যে অংশ নিয়ে সবাইকে অবাক করে করে দিতে পারবে।
লেখাঃ
পাভেল ঘোষ
হিলস্বোরো, ওরেগন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
ছবিঃ
ইন্টারনেট