খেলাঘরখেলাঘর

পাস্কাল

অনেকের ক্ষেত্রেই ছোটবেলায় মনে একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয় যে অঙ্ক বা গণিত হল একটা খুব নীরস বিষয়। এই ভুল ধারণাই অনেক সময় বিষয়টাকে ভাল না বাসা আর অবহেলা করার কারণ। আর তার থেকেই অনেক সময় তৈরী হয় অকারণ ভয় আর দুশ্চিন্তার। সত্যি কথা বলতে গণিতের বিভিন্ন বিষয় নীরস হওয়া তো দূরের কথা, বরং খুবই মজার, রহস্যময় আর উপভোগ্য। আর এই মজাটা ধরতে পারলেই দেখবে খুব ভাল লাগছে, কোন ভয়েরও কারণ নেই। আর তোমার যদি এর মধ্যেই অঙ্ককে বেশ প্রিয় বিষয় বলে মনে হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। তার মানে তুমি এই মজাটা জেনেশুনে বা নিজের অজান্তেই ঠিক বুঝতে পেরে গেছ। গণিতের বিভিন্ন শাখার মধ্যে শুধুমাত্র Number Theory বা সংখ্যাতত্ত্বের মজার রহস্যগুলো নিয়েই এত বই লেখা হয়েছে যে সেগুলো একসাথে করলে অনেক বড় বড় বইয়ের তাক ভর্তি হয়ে যাবে। আমি আজ সেরকমই একটা মজার জিনিস দেখাব।

প্রথমে কিছু সংখ্যাকে কয়েকটা সারিতে পরপর লিখে ফেলি।

পাসকালের ত্রিভূজ
পাসকাল-এর ত্রিভূজ

খুব স্পষ্টভাবেই দেখতে পারছ যে প্রথম সারিতে রয়েছে একটা সংখ্যা, দ্বিতীয় সারিতে দুটো সংখ্যা, তৃতীয় সারিতে তিনটে এবং এইভাবে ক্রমশঃ বাড়তে থেকেছে। তা ছাড়াও সহজেই দেখতে পারছ যে প্রতি সারির প্রথম আর শেষ সংখ্যাটা হল '1' । কিন্তু অন্য সংখ্যাগুলো এল কোথা থেকে? ওগুলো কি আমি এমনিই মন থেকে ইচ্ছেমত লিখে গেলাম? আরেকটু ভাল করে দেখ ত ওদের মধ্যে কোন নক্সা খুঁজে পাচ্ছ কি না! যদি বলি যেকোন সারির পাশাপাশি দুটো সংখ্যার যোগফল তার ঠিক নীচের সারির তাদের মাঝের সংখ্যাটা, তাহলে কি নক্সাটা দেখতে পারছ? মিলিয়ে দেখ ত!

পাশাপাশি দুটো সংখ্যার যোগফল নীচের সারির মাঝের সংখ্যার সমান

"পাশাপাশি দুটো সংখ্যার যোগফল নীচের সারির মাঝের সংখ্যার সমান"

এইবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ। উপরের ছবিতে তীরচিহ্ন দিয়ে সেটাই দেখিয়েছি। আর এবার তুমি ইচ্ছে করলে এই নিয়মটা মাথায় রেখে একের পর এক সারি এইভাবে লিখে ফেলতে পার। তাহলে চট্‌ করে একটা পেন বা পেন্সিল আর একটা কাগজ নিয়ে শুরু করে দাও। বাহ্‌, বেশ মজার না? এই সংখ্যার ত্রিভূজের মধ্যে আরও অনেক মজা লুকিয়ে আছে। সেগুলো একে একে বলছি। কিন্তু তার আগে এর ইতিহাস আর নামকরণের কথা একটু জেনে নেওয়া যাক।
সংখ্যার এই ত্রিভূজের বর্তমান নামকরণ হয়েছে সপ্তদশ শতকের ফরাসী গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ্‌, আবিষ্কারক, লেখক ব্লেজ পাসকাল-এর নাম অনুসারে। ১৬৫৩ সালে পাসকাল তার এক পান্ডুলিপিতে এই ত্রিভূজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আর গণিতের বিভিন্ন বিভাগে এর প্রয়োগ আর উপযোগিতার কথা একত্রিত করে লেখেন, যা তার মৃত্যুর পর ১৬৬৫ সালে প্রকাশিত হয় 'ট্রিট্রিজ্‌ অব্‌ অ্যারিথমেটিক ট্র্যায়াঙ্গল' নামে। যদিও তার অনেক আগেই ভারতবর্ষ, চীন, পারস্য, গ্রীস এবং ইতালির গণিতজ্ঞদের কাজে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁদের মধ্যে ভারতের পিঙ্গল, পারস্যের আল-কারাজী, ওমর খৈয়াম, চীনের চিয়া সিয়েন, ইয়াং হুই - এদের লেখাতে এই সংখ্যার ত্রিভূজের কিছু প্রয়োগের কথা জানা যায়। কিন্তু, যেহেতু পাসকাল-ই প্রথম সামগ্রিকভাবে সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও উপযোগিতার কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তাই বহুলভাবে এর পরিচিতি হয় Pascal's triangle বা পাসকাল-এর ত্রিভূজ নামে।

ব্লেজ পাসকাল-এর পান্ডুলিপি
ব্লেজ পাসকাল-এর পান্ডুলিপি"

ইয়াং হুই-এর পান্ডুলিপি
ইয়াং হুই-এর পান্ডুলিপি"

এবারে চলো আমরা এই ত্রিভূজের আরও কিছু রহস্য জেনে নিই। যদি এই ত্রিভূজের দ্বিতীয় সারির প্রথম বা শেষ '1' থেকে শুরু করে কোণাকুণি নীচের দিকে যেতে থাক, তাহলে দেখবে 1, 2, 3, 4, ... করে পরপর সংখ্যাগুলো পেয়ে যাচ্ছ।

সংখ্যাগুলো নিয়ে আরেকটু খেলা করে দেখা যাক

সংখ্যাগুলো নিয়ে আরেকটু খেলা করে দেখা যাক। যদি প্রতি সারির সংখ্যাগুলি পাশাপাশি যোগ করি তাহলে কি দাঁড়ায় দেখা যাক। প্রথম সারিতে 1, দ্বিতীয় সারিতে 1+1=2, তৃতীয় সারিতে 1+2+1=4, চতুর্থ সারিতে 1+3+3+1=8, পঞ্চম সারিতে 1+4+6+4+1=16, এভাবে চলতে থাকবে। প্রতি সারির এই যোগফলগুলো 1, 2, 4, 8, 16, ... -এদের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য লক্ষ্য করছ কি? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। প্রতি সারির যোগফল তার ঠিক আগের সারির যোগফলের 2 গুণ হয়ে যাচ্ছে। 1 এর পরে 2, 2 এর পর 4, 4 এর পর 8, ... এইভাবে।

সারির যোগফল
"সারির যোগফল"

অবাক হচ্ছো আর বেশ মজা লাগছে তো! এবার তাহলে আরেক কাজ করো। যেকোন সারির প্রথম বা শেষ '1' থেকে শুরু করে কোণাকুণি নীচের দিকে যেতে থাক এবং এক জায়গায় এসে থামো। এই কোণাকুণি পথে যে সংখ্যাগুলো পেলে সেগুলো পরপর যোগ করলে যে সংখ্যাটা পাবে, সেই সংখ্যাটা আছে কোণাকুণি পথটার ঠিক নীচে, পথটা যে দিকে যাচ্ছিল তার বিপরীত দিকে। নীচের ছবিতে যেমন লাল রঙ দিয়ে দেখানো হয়েছে 1, 2, 3 যোগ করে পাওয়া যাচ্ছে 6, আবার নীল রঙ দিয়ে দেখানো হয়েছে যে 1, 3, 6, 10 যোগ করে পাওয়া যাচ্ছে 20 । তোমরা নিজেদের ইচ্ছেমত অন্য জায়গা থেকে শুরু করে, আর এই নিয়ম মেনে যতটা ইচ্ছে নীচের দিকে গিয়ে মিলিয়ে দেখতে পার।

কোণাকূণি যোগফল
"কোণাকুণি যোগফল"

এবারে আরেকটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি। প্রতি সারিতে সংখ্যাগুলি পাশাপাশি রেখে যে বড় সংখ্যাগুলি পাবে, সেগুলি হল, প্রথম সারিতে 1, দ্বিতীয় সারিতে 11, তৃতীয় সারিতে 121, চতুর্থ সারিতে 1331, পঞ্চম সারিতে 14641 । এদের মধ্যে সামঞ্জস্য হল, 1 কে 11  দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যায় 11, 11 কে 11 দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যায় 121, 121 কে 11 দিয়ে গুণ করলে হয় 1331, 1331 কে 11 দিয়ে গুণ করলে হয় 14641 । অবাক হচ্ছো তো! তাহলে নিজেরাই একবার গুণ করে মিলিয়ে দেখ।

11-এর মজার কথা
"11-এর মজার কথা"

মানে প্রতি সারিতে সংখ্যাগুলি তার ঠিক আগের সারির সংখ্যার 11 গুণ হয়ে যাচ্ছে। ষষ্ঠ সারি থেকে যেহেতু কোন কোন জায়গায় এক-digit এর থেকে বড় সংখ্যা থাকতে পারে, তাই শুধুমাত্র সংখ্যাগুলো পাশাপাশি বসিয়ে কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যটা লক্ষ্য করা যাবে না। যেমন ধর, ষষ্ঠ সারিতে সংখ্যাগুলো পাশাপাশি বসিয়ে পাওয়া যায় 15101051 । এটা কিন্তু মোটেই আগের সারির 14641 আর 11 -এর গুণফল নয়। মজার খেলাটা মাঝপথে ভেঙ্গে যাওয়ায় কি একটু মন খারাপ হয়ে গেল? দাঁড়াও, আরেকটু সতর্ক হয়ে বড় সংখ্যাটা তৈরী করলে হয়তো এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। নীচের ছবিতে সেটাই দেখিয়েছি।

বড় সংখ্যাটা তৈরী

দেখলে বুঝতে পারবে, ডানদিক থেকে শুরু করে 1, 5 -এর পর আমরা যখন 10 পেলাম, তখন তার শুধু 0 রেখে বাকি সংখ্যাটা অর্থাৎ 1 কে তার বাঁদিকের 10 এর সাথে যোগ করে পেলাম 11 । একইরকম ভাবে 11 -এর 1 কে রেখে দিয়ে বাকি 1 কে তার বাঁদিকের 5 এর সাথে যোগ করে পাওয়া গেল 6, আর সবশেষে পরে থাকল একদম বাঁদিকের 1 । এইভাবে যে সংখ্যাটা তৈরী হল সেটা হল তাহলে 161051, এবং আশ্চর্যজনকভাবে এটাই 14641 আর 11 এর গুণফল। এই নিয়ম পরের সারির সংখ্যাগুলোর উপর প্রয়োগ করে তুমি পেয়ে যাবে 1771561, যেটা নাকি 161051 আর 11 এর গুণফল! এবারে খুশি তো তাহলে?

যাক্‌, পাসকাল-এর ত্রিভূজের আরও রহস্যের কথা বলতে গেলে আজ আর কথা শেষ হবে না। দেখা গেছে যে গণিতের জ্যামিতি (geometry), ত্রিকোণমিতি (trigonometry), বীজগণিত (algebra) এবং calculus-এর বিভিন্ন জায়গায় পাসকাল-এর ত্রিভূজের ব্যবহার রয়েছে। দেখলে তো তাহলে কত সহজ একদল সংখ্যার মধ্যে কতরকম রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে! যখন উঁচু ক্লাসে উঠে গণিতের আরও কঠিন বিষয়গুলো আয়ত্ত করবে, তখন তুমি এর সাথে আরও পরিচিত হবে। আর তাহলে এখন থেকে এই মজার ব্যাপারগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেই দেখবে সব কিছু আরও অনেক উপভোগ্য মনে হচ্ছে।

 

 

লেখাঃ
পাভেল ঘোষ
টেম্প, আরিজোনা

ছবিঃ
পাভেল ঘোষ
উইকিপিডিয়া

পাভেল ঘোষ পোর্টল্যান্ড, ওরেগন এর বাসিন্দা। কম্পিউটার এর খুঁটিনাটি নিয়ে পড়াশোনা ও কাজকর্ম করার ফাঁকে ফাঁকে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন; আর্সেনাল ক্লাব-এর একনিষ্ঠ ভক্ত।