শেষ এক মাস তো খুব হৈ হৈ করে কেটে গেল ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে। নিশ্চয়ই দেখেছ যে তোমার থেকে আরেকটু বড় দাদা, দিদি আর বাড়ির বড়দের এই এক মাসে অনেক সময়েই আলোচনা জুড়ে ছিল ফুটবল বিশ্বকাপ, আর তার সাথে টানটান উত্তেজনা, রাত জেগে খেলা দেখা। আমাদের নিজেদের দেশ বিশ্বকাপে না খেললেও ফুটবল নিয়ে মাতামাতি একটুও কম হয় না। বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় মানুষ নিজেদের পছন্দের দেশের পতাকা ঝুলিয়েছে, মিষ্টির দোকানে পাওয়া গেছে বিভিন্ন দেশের পতাকা আর বিশ্বকাপের মত দেখতে মিষ্টি, এমনকি তারকা ফুটবলারদের ছবি আর মূর্তি দিয়ে হয়েছে বিশ্বকাপের পূজো।
আমেরিকাতে ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মত ফুটবলের অতটা জনপ্রিয়তা না থাকলেও সেখানকার মানুষও কিন্তু বিশ্বকাপের জ্বরের কবল থেকে রক্ষা পায়নি। বড় বড় শহরগুলোতে বিশেষ বিশেষ খেলার দিনগুলোতে লোকেরা নিজেদের পছন্দের দলের জার্সি পড়ে একসাথে জমায়েত হয়েছে বড় পর্দায় খেলা দেখার জন্য। এইরকম একটা আসরে যেখানে খেলা নিয়ে এতটা মাতামাতি, সেখানে কি কাউকে সমর্থন না করে চুপচাপ বসে খেলা দেখা যায়? তাই সকলেরই থাকে একটা করে পছন্দের দল। তুমিও নিশ্ছয়ই অন্যদের সাথে খেলা দেখতে দেখতে ভালবেসে ফেলেছ কয়েকটা দল আর কয়েকজন খেলোয়াড়ের খেলা। যখন বড় হবে, তখন দেখবে এই বয়সে ভাল লেগে যাওয়া দলগুলোর প্রতিই সারাজীবন কেমন একটা অন্ধ সমর্থন থেকে যায়। আমিও সেই ছোটবেলায় যেবার প্রথম বিশ্বকাপ দেখলাম ১৯৯০-তে, তখন থেকে সমর্থন করা শুরু করি জার্মানীকে, আর তখন থেকে ওদেরকেই সমর্থন করে আসছি। সেই বছর ওরা জিতেছিল। আশা করছিলাম এইবারও জিতবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশাপূরণ হল না আর মন খারাপ হয়ে গেল। যাক্, সে কথায় পরে আসছি।
এটা বললে মনে হয় খুব একটা ভুল হয়না যে ফুটবল বিশ্বকাপই একমাত্র খেলার আসর যা সারা পৃথিবীর মানুষকে একসাথে নিয়ে আসে। অলিম্পিকও হয়তো অনেকটা করে, কিন্তু সেখানে নানা ধরণের খেলার মধ্যে মানুষের আকর্ষণ ছড়িয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রতি চার বছর অন্তর আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবলে সব মানুষেরই মন পড়ে থাকে একটা খেলার উপর। তার মধ্যে তো আবার এইবারের বিশ্বকাপে ছিল অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য। ১৯৩০ সালে শুরু হওয়া এই ফুটবল উৎসবের ১৯তম আসর (মাঝে ২ বার আয়োজিত হয়নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য) এই প্রথম আয়োজিত হল আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশে - দক্ষিণ আফ্রিকায়। তাই খেলার সাথে সাথে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক জড়িয়ে ছিল। আফ্রিকার অনেক দেশই এখনও রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দারিদ্র্যের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সেসব দেশে অনেক ক্ষেত্রেই ফুটবলই সবচেয়ে কার্যকরী শান্তির দূত হিসেবে মানুষের কাছে আসতে পেরেছে। এর ফলে কিছুদিন আগে আফ্রিকা মহাদেশে শান্তি আর নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য যে রাষ্ট্রদূতেদের নিযুক্ত করা হল তার মধ্যে ছিলেন আবেদি পেলে আর মাইকেল এসিয়েনের মত ফুটবলারেরা। আরো একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ হল আইভরি কোষ্ট। বহুদিন ধরে চলতে থাকা এই দেশের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ থামানোর আবেদনে টেলিভিশনের পর্দায় এসেছেন তাদের দেশের ফুটবল তারকা দিদিয়ের দ্রোগবা, আর তার ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। ১৯৭৮ সালের পর এই প্রথম খেলা আয়োজিত হল দক্ষিণ গোলার্ধে - সেবারে হয়েছিল আর্জেন্টিনায় আর এবারে দক্ষিণ আফ্রিকায়। বছরের এই সময়টাতে দক্ষিণ গোলার্ধে শীতের মরসুম চলে আর তার ফলে খেলোয়াড়দের পরিশ্রমও কম হয়। যে দশটি শহরে খেলা হল তার মধ্যে আবার বেশ কয়েকটির উচ্চতা বেশ বেশী - যেটাও আগের বিশ্বকাপগুলোতে হয়নি। এবারে খেলা হল নতুন এক ধরণের বল দিয়ে - তার নাম 'জাবুলানি'। এই অপেক্ষাকৃত হালকা বল যেমন নিয়ন্ত্রণ করা একটু কঠিন, তার সাথে এর গতিপথ মাঠের উচ্চতার উপরেও নির্ভর করে।
ভুভুজেলা
সব শেষে যেটা নিশ্চয়ই তোমার কান এড়িয়ে যায়নি সেটা হল 'ভুভুজেলা'র আওয়াজ। দক্ষিণ আফ্রিকার এই বিশেষ ধরণের বাঁশি এবারের বিশ্বকাপে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। অনেকগুলো যখন একসাথে বাজে তখন শুনলে মনে হয়, হাজার হাজার মৌমাছি একসাথে জমায়েত হয়েছে। শুরুতে অনেক দল আর দর্শক প্রতিবাদ জানিয়েছে যে এই জন্য তাদের খেলায় মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে 'ফিফা' (ফেডারেশন অফ্ ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) 'ভুভুজেলা'র ব্যবহারে কোনরকম বাধানিষেধ আনেনি। আর যত দিন গড়িয়েছে, তত আফ্রিকার মানুষের সাথে পাল্লা রেখে অন্যান্য দেশের মানুষও এই বাঁশি বাজিয়েছে মাঠে খেলা দেখার সময়।
এবারের বিশ্বকাপের থিম সং ছিল কলম্বিয়ার গায়িকা শাকিরা'র গাওয়া 'ওয়াকা ওয়াকা'। শাকিরার সাথে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যান্ড 'ফ্রেশলিগ্রাউন্ড'। এই গানটির মূল সংস্করণটি যদিও ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য, কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে গানটিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয় ফুটবল আর আফ্রিকার কথা মাথায় রেখে। এক্ষেত্রে গানটির মূল বক্তব্য ছিল খেলার মাঠে যোদ্ধাদের, অর্থাৎ ফুটবলারদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য। এই গানটার সাথে সাথে তুমি নিশ্চয়ই 'ওয়েভিং ফ্ল্যাগ' গানটিও শুনে থাকবে। এই গানটি জন্মসূত্রে সোমালিয়ার, আর কানাডার অধিবাসী ক'নান-এর গাওয়া। এটি ছিল বিশ্বকাপ উপলক্ষে কোকা কোলা কোম্পানীর থিম সং। এই গানটির মধ্যে আছে অদ্ভূত এক জীবনীশক্তি। এর সাথে জড়িয়ে আছে ক'নান-এর আফ্রিকায় কাটানো ছোটবেলার অনেক স্মৃতি, আর তাই এই গানটিও জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল মানুষের মধ্যে।
২০১০ বিশ্বকাপের লোগো
এবারের বিশ্বকাপের লোগোটির মধ্যে দেখা যায় বিভিন্ন রঙের পটভূমিকার সামনে এক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ 'বাইসাইকেল কিক্' করছে একটি ফুটবলে। তোমার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করেছে যে এর মধ্যে কি অর্থ লুকিয়ে আছে। আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণময় সংস্কৃতির জন্য দেশটিকে বলা হয় রামধনুর দেশ। এর প্রতিফলন ওদের নানা রঙের পতাকার মধ্যেও দেখা যায়, আর তার জন্যেই ওই বর্ণময় পটভূমিকা। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটিকে রাখা হয়েছে আফ্রিকার মানুষের প্রতীক হিসেবে। আর 'বাইসাইকেল কিক্ ' - যেটা খুবই দৃষ্টিনন্দন - আফ্রিকার মানুষের ফুটবল নিয়ে ভালবাসা, উদ্দীপনা আর আবেগের প্রতীক হিসেবে কাজ করছে।
স্যাটেলাইট টেলিভিশনের দৌলতে এখন বিশ্বের অনেক তারকা ফুটবলারের নাম আর খেলার ধরণ এখন মানুষের নখদর্পণে। বিশ্বের ৬টি মহাদেশ থেকে মোট ২০৫টি দেশ ২ বছরের বেশী সময় ধরে যোগ্যতা অর্জনকারী পর্যায়ের ম্যাচ খেলে শেষ পর্যন্ত ৩২টি দেশ অর্জন করেছিল বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার ছাড়পত্র। এদেরকে ভাগ করা হল ৮টি গ্রুপে। নিজেদের মধ্যে ম্যাচ খেলে প্রতি গ্রুপের প্রথম দুটি করে দল দ্বিতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ অর্জন করল আর তার পর চলতে থাকল নক্-আউট রাউন্ড। প্রথম পর্যায় থেকে বিদায় নিয়ে অনেককেই হতাশ করল ২০০৬-এর চ্যাম্পিয়ন আর রানার-আপ ইতালি আর ফ্রান্স। অন্যদিকে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করা নিউজিল্যান্ড একটিও ম্যাচ না হেরে সবাইকে অবাক করে দিল। যদিও নিজেদের গ্রুপে তৃতীয় হওয়ার কারণে তাদের প্রথম পর্যায় থেকেই বিদায় নিতে হল। দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৬টি দেশের মধ্যে ৮টি গেল কোয়ার্টার ফাইনালে। এদের মধ্যে যেমন ছিল জার্মানী, ব্রাজিল, হল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, স্পেনের মত টুর্নামেন্টের জনপ্রিয় দলগুলি, তার সাথে ছিল কম আলোচিত আর সকলকে তাক লাগিয়ে দেওয়া উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, আর ঘানা। আফ্রিকা মহাদেশের বাকি দলগুলো প্রথম পর্যায় থেকে বিদায় নেওয়ার ফলে ঘানার এই দলটির উপরেই ছিল গোটা মহাদেশের আশা-ভরসা।
কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ব্রাজিল হেরে গেল হল্যান্ডের কাছে। তারকাখচিত আর্জেন্টিনাকে চূর্ণ করে জার্মানীর তরুণ দলটি, যাদের অনেকের বয়সই ২০-২১, তারা জিতল ৪-০ গোলে। টানটান উত্তেজনার ম্যাচে স্পেন হারাল প্যারাগুয়েকে ১-০ গোলে। উরুগুয়ের সাথে এক্স্ট্রা টাইমের শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি মিস্ করে টাইব্রেকারে হেরে গেল ঘানা। কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্য দাবী করার সাথে সাথে পৃথিবীর অনেক মানুষের মন জয় করল এই তরুণ দলটি। সেমিফাইনাল ম্যাচে হল্যান্ড জিতল ৩-২ গোলে উরুগুয়ের সাথে আর স্পেন জিতল ১-০ গোলে জার্মানীর সাথে। এর ফলে ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য স্পেন খেলল বিশ্বকাপ ফাইনাল। অন্যদিকে হল্যান্ড এর আগে দুইবার, ১৯৭৪ এবং ১৯৭৮, ফাইনালে খেললেও দুইবারই ফিরতে হয়েছে রানার-আপ হয়ে। জার্মানী হেরে যাওয়ার পরে খুব খারাপ লেগেছিল, আর খেলা দেখতেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু তারপরে মনে হল যে স্পেন আর হল্যান্ড দলেও তো ভাল ফুটবলারেরা আছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে তো আমার খুব ভাল লাগে। জার্মানী না হয় আরেকবার জিতবে, কিন্তু তার জন্য মন খারাপ করে কি বাকি ম্যাচগুলো থেকে বঞ্চিত হওয়া যায়? তাই আর বেশী মন খারাপ করলাম না। তৃতীয় স্থান-নির্ধারক খেলায় জার্মানী হারাল উরুগুয়েকে ৩-২ গোলে। গোটা টুর্নামেন্টে তাদের চিত্তাকর্ষক ফুটবল মানুষের অনেকদিন মনে থাকবে।
স্পেনের দল
ফাইনাল খেলায় দুই দলই খানিকটা রক্ষণাত্বক পদ্ধতি অবলম্বন করায় খেলাটি খুব একটা আকর্ষক হলনা। এক্স্ট্রা টাইমের শেষের দিকে ইনিয়েস্তার দেওয়া একমাত্র গোলে স্পেন হল প্রথমবারের জন্য বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন। দারুণ খেলে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের পুরস্কার সোনার বল জিতে নিল উরুগুয়ের দিয়েগো ফোরলান।
দিয়েগো ফোরলান
শ্রেষ্ঠ তরুণ খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশী ৫টি গোল করে সোনার বুট জিতে নিল জার্মানীর একুশ বছরের থমাস মুলার।
থমাস মূলার
ভিয়া, স্নাইডার আর ফোরলান সমসংখ্যক গোল করলেও মুলার পুরষ্কারটি পেল এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গোলের সুযোগ তৈরী করার সুবাদে। অনেক তারকা ফুটবলার আশানু্রূপ ভাল না খেললেও ফুটবলপ্রেমীদের মনে দাগ কেটে গেল স্পেনের ভিয়া, ইনিয়েস্তা, জার্মানীর ওজিল, মুলার, সোয়েনস্টাইগার, হল্যান্ডের স্নাইডার, রবেন, উরুগুয়ের ফোরলান, সুয়ারেজ, ঘানার আসামোয়া জিয়ান, আর্জেন্টিনার মেসি, ব্রাজিলের মাইকন, লুই ফাবিয়ানো এবং আরো অনেকে।
স্পেনের ভিয়া
হল্যান্ডের স্নাইডার
জার্মানীর ওজিল
ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মত দলগুলো তাড়াতাড়ি বিদায় নেওয়ার ফলে আশাহত হয়েছে অনেক মানুষ। কিন্তু তার সাথে সাথে নতুন নায়কদেরও বরণ করে নিয়েছে।
আর এক মাসের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে বিভিন্ন দেশের ক্লাব ফুটবল, অংশ নেবে এই তারকারা। মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখবে তাদের খেলা আর শুরু হবে অপেক্ষা পরবর্তী বিশ্বকাপের - যা আয়োজিত হবে ২০১৪ সালে ব্রাজিলে। তুমিও নিশ্চয়ই এখন থেকে তার জন্য অপেক্ষা করা শুরু করে দিয়েছ।
পাভেল ঘোষ
টেম্পি, অ্যারিজোনা