এর মধ্যে প্রত্যেকেরই ব্যাগের খাবারদাবার ক্রমাগত শেষ হতে থাকায় প্রথমদিনের তুলনায় ব্যাগের ওজন অনেকটাই কমে গিয়েছিল, আর তা ছাড়া ভারী ব্যাগ পীঠে করে ক্রমাগত হাঁটার অভ্যেসও অনেকটা হয়েছে এর মধ্যে। তাই পঞ্চমদিনে উঁচুনীচু পার্বত্য উপত্যকার উপর দিয়ে অনেকটা পথ চলার পরেও আমরা কেউই তখনও পুরোপুরি ক্লান্ত হয়ে পরিনি। আরও খানিকটা যাওয়ার বাকি সেই দিন। সেই সময়েই আরেকটা মজার ব্যাপার ঘটল। রবার্ট বলল যে যেহেতু আমাদের হাতে একটু সময় আছে, তাই আমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে চিরাচরিত যে রাস্তা দিয়ে ও সবাইকে নিয়ে যায়, সেটা না নিয়ে ও একটা নতুন রাস্তা খুঁজে বের করতে চায়।
হঠাৎ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছোট এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি
আপত্তি কিসের, আমরা সকলেই নতুন অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়ে তখন দু'পায়ে খাড়া। কোথায় পৌঁছতে হবে সেটা জানা আছে, কিন্তু অনেকটা হেঁটে আমরা একটা উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখান থেকে নীচে নামার জন্য খাড়া খাত ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। অগত্যা এরকম একটা খাত বেয়ে আমরা একে একে নীচে নামছি। কিন্তু পায়ের নীচের আলগা মাটি আর ছোট ছোট পাথরের জন্য প্রায়ই আছাড় খেয়ে পড়তে হচ্ছে।
ঝরণার সামনে বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া
একটা সময় যখন বুঝলাম যে হাত, পা ভাঙ্গার ভয় খুব একটা নেই তখন আর দ্বিধা না করে পীঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে আর খাতের উপর বসে পড়ে বাকি রাস্তাটা গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এলাম। এই ক'দিনের রাস্তায় এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে মোটা চাকার জীপ পৌঁছতে পারে। সেইরকম এক জীপ গাড়িতে আমাদের ট্রাভেল কোম্পানির লোকেরা সেদিন পৌঁছে দিয়ে গেল আমাদের পরবর্তী চার দিনের খাবার আর সেদিন রাতে খাওয়ার জন্য ভেড়ার মাংস। আইসল্যান্ডের ভেড়ার মাংস এমনিতেই বেশ সুস্বাদু, কিন্তু প্রতিদিনের এই নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা, শারীরিক ক্লান্তি, আর তারপরে প্রকৃতির বুকে বসে আগুনে ঝলসানো সেই মাংস খেতে অমৃতের মত মনে হল।
টিলার উপর থেকে দেখা এক সুদূরবিস্তৃত হিমবাহ, এর কিছুটা অংশ পরের দিন পার হতে হবে
পরেরদিন সকালে জীপে করে এসে আমাদের সাথে যোগ দিল আমাদের পরবর্তী চার দিনের আরও তিনজন সহযাত্রী। এদের মধ্যে দু'জন আইসল্যান্ডেরই বাসিন্দা; মার্গারেট, যে রবার্টের সহকর্মী হিসেবে কাজ করবে, আর এলি, যে আমার মতই ফোটো তুলতে খুব উৎসাহী। আর এল নেদারল্যান্ডের আইন্ডহোভেন শহর থেকে আসা জো। সেদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে এক জায়গায় আমাদের পাহাড়ের গায়ে ঝোলানো একটা শিকল বেয়ে খানিকটা উপরে উঠতে হল। পথে দেখলাম অনেক জলপ্রপাত। দলে আরেকটু ভারী হয়ে, আর নতুন লোকের সাথে আলাপ করার উৎসাহে আমরা তখন এতদিনের পরিশ্রমের কথা ভোলার চেষ্টা করছি। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন দিন এল এর দু'দিন পরে, আমাদের সপ্তম দিনে। এদিনেও আমাদের পার হতে হল একটা অনেক চওড়া হিমবাহ।
হিমবাহ যখন এক দিক থেকে অন্য দিকে এগিয়ে চলে তখন তার পথে তৈরি হয় এরকম দাগ, যেন এর উপর দিয়ে অনেকগুলো বড় গাড়ি ছুটে বেড়িয়েছে
কিন্তু এই হিমবাহের অনেক জায়গাতেই বড় বড় খাত (যাকে বলে "ক্রেভিস"), যার মধ্যে একবার পিছলে পড়ে গেলে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম। তার সাথে রয়েছে এক অভিনব জিনিস, যাকে এখানকার লোকেরা নাম দিয়েছে "ব্ল্যাক ফরেস্ট" - হিমবাহের বরফের সাথে তার নিচের আগ্নেয় ছাই মিলেমিশে তৈরী হয়েছে বিরাট বিরাট সাদা-কালো স্তুপ। একদিকে নজর দিতে হচ্ছে যেন কোন খাতের কাছাকাছি পা না যায়, আর অন্যদিকে এই স্তুপ ডিঙ্গিয়ে পার হতে সময় লেগে যাচ্ছে অনেক। কিন্তু পরিশ্রম করলে তার পুরস্কার পাওয়া যায় শুনেছি। আর সেদিনের দিনের শেষে যে পুরস্কার আমরা পেলাম, তার জন্য এই পরিশ্রম করতে বারবার রাজী আছি। আমরা যেখানে এসে আমাদের তাঁবু খাটালাম সেই জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বাকরূদ্ধ হয়ে আমরা সকলেই তখন চুপ করে বসে মুগ্ধ হয়ে তা উপভোগ করছি।
চারিদিকের পাহাড়ের মাঝে আটকে থাকা এক গাঢ় নীল হ্রদ
পিছনে উঁচু পাহাড়, আমরা যেখানে বসে আছি তার সামনে যেখানে সেই পাহাড় শেষ হয়েছে, সেখানে এক খাড়া খাত নেমে গেছে এক সুদূরপ্রসারী হিমবাহে। তার একদিকে পাহাড় আর হিমবাহের মাঝে আটকে পড়ে থাকা গাঢ় নীল রঙের এক "লাগুন" (হিমবাহের মাঝে আটকে থাকা বৃষ্টি আর বরফগলা জলের লেক)। তার উপরে ছড়িয়ে পড়েছে দিনের শেষের সূর্যের সোনালী রঙের ছটা। এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম যে ঝর্ণা থেকে খাওয়ার জল আনার সময় রাস্তা হারিয়ে অনেক ঘুরপথে সঠিক জায়গায় ফিরে এলাম।
যখন আমরা হাঁটছি মেঘের উপর দিয়ে
এর পরের দিন আমাদের যাত্রার শেষ দিন। সকালে আমরা প্রথমে পাহাড়ের উপরে চড়লাম, এখানে অনেক জায়গায় বরফ পড়ে আছে, আর আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে মেঘের দল। দিনের দ্বিতীয়পর্বে নেমে আসার পালা। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আর আরো একটা নদীর ধার বেয়ে অনেকক্ষণ হেঁটে দিনের শেষে আমরা ফিরে এলাম আমাদের সভ্যসমাজে, স্কাফতাফেল নামের একটা ছোট শহরে। এই ক'দিনের যাত্রায় অনেকরকম নতুন অভিজ্ঞতা হল, দেখলাম প্রকৃতির অনেক নতুন রূপ, তার সাথে ঐ কয়েকটা মানুষের সাথেও একাত্ম হয়ে গেছিলাম। কিন্তু এবার সবাইকে বিদায় জানানোর পালা। সেদিন রাতে স্কাফতাফেলের একটা রেস্তোরাঁতে ডিনার খেয়ে একটা কেবিনে সেদিনের রাতটা কাটালাম।
সমুদ্রতটে পাহাড়ের মাথায় পাফিন পাখির সারি
পরদিন সকালে বাসে করে আবার রেইকাভিকে ফেরা। এবারেও মোটামটি সেই একই রাস্তা দিয়ে বাস ফিরে এল। এক জায়গায় সমুদ্রের ধারে গিয়ে অনেক পাফিন পাখি দেখলাম। রেইকাভিকে যখন ফিরেছি তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। এই আমার এ যাত্রায় আইসল্যান্ডের শেষ রাত্রি। তাই ক্লান্তি উপেক্ষা করে শহরের মধ্যে হাঁটতে বের হলাম, ডিনার খেলাম এক আইসল্যাণ্ডিক রেস্তোরাঁতে, শেষ বারের মত চেষ্টা করলাম ওদের ভাষায় কথা বলতে।
পরেরদিন সকালে আমার ফিরে আসার ফ্লাইট। জানালার পাশেই আমার সিট ছিল। প্লেন যখন উড়ল, জানালা দিয়ে নীচে অনেক অনেক দূর অবধি দেখতে দেখতে ভাবছি এর কোথায় যেন আমি এই শেষ ৮/৯ টা দিন হেঁটে বেরিয়েছি। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেছিল। হঠাৎ প্যান্টের পকেটে কি একটা হাতে লাগল। বের করে দেখি একটা ছোট লাভা পাথরের টুকরো। কোন একদিন হাঁটার সময় এই পাথরটা দেখে খুব পছন্দ হয়েছিল বলে পকেটে তুলে রেখেছিলাম। সেই পাথরটা এখন আমার ড্রয়িং রুমে রাখা আছে। মাঝে মাঝে সেটা দেখে পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করি, আর তার টানেই আবার কোন একদিন একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে আবার পাড়ি দেব।
ছবিঃ লেখক