ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। কিন্তু সকাল ৭ টার বাস ধরতে হবে আর না ধরতে পারলে সারাদিনে আর কোন বাস নেই, এই চিন্তায় অনেকক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। হাতে সময় ছিল বলে ভালরকম একটা স্নান সেরে নিলাম - তথাকথিত সভ্য কায়দায় স্নান করার পরবর্তী ৮ দিনে এই আমার শেষ সু্যোগ। বাসস্টপ আমার হোস্টেল থেকে পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। রাস্তায় এক জায়গায় আমরা সকলে ব্রেকফাষ্টও সেরে নিলাম। এর মধ্যে আমাদের গাইড রবার্টও এসে গিয়েছিল।
আইসল্যান্ডের অনন্য ভূপ্রকৃতি
বাস মোটামুটি ভর্তিই ছিল। তবে আমরা ৫ জন ছাড়া বাকি সকলেই বাসে করে এদিক ওদিক সাইটসিয়িং করতে যাচ্ছে। রাস্তায় একটা জলপ্রপাত দেখে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে ঘন্টাখানেকের বেশি সময় লাগল না। গন্তব্যস্থল বলতে ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটা জায়গা - মাঠ বললে অবশ্য বুঝতে অসুবিধে হতে পারে। এরকম ভূ-প্রকৃতি দেখার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম - আর তারপরেও এখনও অবধি অনেক জায়গা ঘুরলেও আর কোথাও এরকম দেখিনি। চারিদিকে আগ্নেয়গিরির পাহাড়, তার মাঝে সুদূরপ্রসারী উঁচু-নীচু উপত্যকা যার অনেকটাই আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত, ছাই, পাথর জমে তৈরী হয়েছে। আর তার উপরে পুরু মস আর ঘাস জমে তৈরী হয়েছে মখমলের চাদর। নরম হলেও হাঁটাচলা করা বেশ কষ্টকর। নরম আর পুরু মসের মধ্যে পা ঢুকে গিয়ে ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, আর এর নীচেই রয়েছে লাভাস্রোত জমে তৈরী হওয়া রুক্ষ আর হালকা পাথর।
আট দিনের ব্যাকপ্যাকিং এর শুরু
বাস থেকে নেমে এক জায়গায় আমরা আমাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে পায়ে হেঁটে কাছাকাছি খানিকটা ঘুরে এলাম। এখান থেকে একটু দূরে চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা গাঢ় নীল রঙের একটা হ্রদ দেখা যায়। সেখান থেকে নেমে ব্যাগের জিনিসপত্র শেষ বারের মত একবার দেখে নিয়ে শুরু হল আমাদের হাঁটা। আট দিনের মধ্যে প্রথমদিনই আমাদের সাথে সবচেয়ে বেশী খাবার ছিল, আর তা ছাড়া অত ভারী ওজনের ব্যাগ পীঠে নিয়ে হাঁটতে অভ্যস্ত হতেও একটু সময় লাগে। তাই লাঞ্চ ছাড়াও কয়েক জায়গায় দাঁড়ানো হল বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আর আর তার মাঝে টুকটাক স্ন্যাক্স খেয়ে নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করা। লাঞ্চে খাওয়া হল স্যান্ডউইচ, প্রসেসড্ মিট আর চকোলেট।
কালচে ছাই বর্ণের উপত্যকা
বিকেলের দিকে যেখানে এসে পৌঁছলাম, সেখানকার ভূ-প্রকৃতি আবার একেবারেই অন্যরকম। অনেক দূর অবধি কালচে ছাই বর্ণের উপত্যকা, মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে থাকা বেশ কিছু আগ্নেয় পর্বত, আর তার পিছনে অন্তহীন হিমবাহ।
এই জলস্রোত ঘোলাটে হলেও নিশ্চিন্তে পান করা যায়
সেদিনের মত আমাদের হাঁটা প্রায় শেষ। আমরা তখন এমন একটা জায়গা খুঁজছি আমাদের তাঁবু খাটানোর জন্য যার কাছাকাছি জল পাওয়া যাবে - যা দিয়ে আমাদের আমাদের রাতের খাবার তৈরী আর খাবারের জলের কাজ চালানো যাবে। বালি আর ছাইয়ের নীচে এদিক-ওদিক ঢুকে গিয়ে হিমবাহ থেকে আসা জলস্রোত অনেক সময়েই নতুন নতুন রাস্তা খুঁজে নেয় এখানে। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একটা পছন্দমত জায়গা পাওয়া গেল। জল বেশ ঘোলাটে হলেও রবার্টের কথামত এই জল একেবারেই জীবাণুমুক্ত আর নিরাপদ। সারাদিনের ক্লান্তির পর আমরাও আর গরিমশি না করে সেখানেই আমাদের ঘাঁটি বাঁধলাম। পাস্তা, এক টুকরো কেক আর চা খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নিজেদের তাঁবুতে ঢুকে পড়লাম আর চোখে ঘুম লাগতে বিন্দুমাত্র সময় লাগল না।
প্রচন্ড হাওয়ায় যাতে উড়ে না যায়, তাই তাঁবুর সাথে বাঁধা একাধিক পাথরের টুকরো
পরদিন সকালে উঠে দুধ, সিরিয়াল দিয়ে ব্রেকফাষ্ট খেয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু। এইদিন আমাদের অনেকক্ষণ হাঁটতে হল একটা হিমবাহের উপর দিয়ে। লাঞ্চের একটু পরে হঠাৎ কোথা থেকে অনেক মেঘ আর কুয়াশা এসে চারিদিক আচ্ছন্ন কর দিল। সেই সময় বরফ, মেঘ, কুয়াশা মিলিয়ে যেদিকেই চোখ যায় শুধু ধবধবে সাদা। বরফের উপর দিয়ে সারাদিন হাঁটার পর যখন হিমবাহের অন্য প্রান্তে এসে পৌঁছলাম, তারপরেও সেদিন আমাদের তিনটে নদী পার হতে হবে। কোনটাই হাঁটু জলের বেশী নয়, আর খুব বেশী চওড়াও নয়, কিন্তু প্রচন্ড স্রোত আর তার সাথে কনকনে ঠান্ডা বরফগলা জল।
এই হিমশীতল জলে ভরা নদী হেঁটে পেরোতে হল
একজোড়া জুতো আর মোজা সাথে বেশী এনেছিলাম নদী পার হওয়ার সময় ব্যবহার করার জন্য। প্যান্টের উপর ওয়াটারপ্রুফ কভার পরে সকলে একে অপরের হাত ধরে খুব সন্তর্পনে পার হলাম। রবার্টের কয়েকটা উপদেশ খুব কাজে লেগেছিল - যেমন, ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যতটা সম্ভব পা না তুলে হাঁটা, আর একদম আড়াআড়ি পার না হয়ে স্রোতের সাথে সাথে একটু এগিয়ে কোণাকুণি পার হওয়া। দিনের শুরুতে আরেকটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছিলাম। বিশাল বড় বড় বরফের চাঁই ঢাকা পরে আছে মাটি, বালি আর ছাইয়ের নীচে। কিন্তু যেখানেই এই আস্তরণ খুব পাতলা, সেখানে একটু অসতর্ক হলেই পিছল খেতে হয়। বরফের উপরের এই আস্তরণ তাপের কুপরিবাহী বলে হিমবাহ থেকে বেরিয়ে আসা এই বরফের চাঁইগুলো নাকি কয়েকশ বছর ধরে একই ভাবে পরে থাকে।
নদীর পাড়ের তৃণভূমিতে নাম না জানা রঙিন ফুল
পরের দু'দিন তুলনামূলকভাবে হাঁটার পরিমাণ অনেকটাই কম ছিল। তাই দু'দিনই লাঞ্চের ঘন্টাখানেক পরেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। তৃতীয়দিন যেখানে আমাদের তাঁবু পাতা হল তার পাশেই একটা হিমবাহ গলা জলের একটা নদী বয়ে গেছে। কাঁচের মত স্বচ্ছ তার জল আর পাশে সবুজ নরম ঘাসের উপর আমাদের থাকার জায়গা। বছরের কয়েকমাস একাধিক দলকে নিয়ে এই পথে যেতে হয় বলে লোকালয় থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত এই জায়গাগুলোও আমাদের গাইড রবার্টের প্রায় নখদর্পণে। তাই কাছেই খুঁজে পেল একটা ঊষ্ণ প্রস্রবণ, যার জলে আধ ঘন্টাখানেক গা ডুবিয়ে আমরা দিনের ক্লান্তি দূর করলাম। এরপর ডিনার করে শরীরে যেন নতুন উদ্যম এল। তাই আশেপাশের জায়গাগুলো ঘন্টাখানেক হেঁটে ঘুরে আসার জন্য সবাই এক কথাতেই রাজী হয়ে গেলাম। চতুর্থদিনের থাকার জায়গাটা ছিল আরও সুন্দর। দু'দিকের দুটো টিলার মাঝে একটা ত্রিকোণাকৃতি উপত্যকা। তার মাঝে একটা পাহাড়ী নদী, আর তার দুই দিকের সবুজ ঘাসের উপর নাম না জানা কত রকমের লাল, হলুদ আর বেগুনী রঙের বুনো ফুল।
(ক্রমশঃ)
ছবিঃ লেখক