আফ্রিকান ন্যাশনস্ কাপ শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন হল। তুমি নিশ্চয়ই তখন টেলিভিশনে আর খবরের কাগজে সব খবরই রেখেছ। কিন্তু অনেকগুলো কারণে এবারের টুর্নামেন্টটা বিশেষভাবে মনে থাকবে - তাই ভাবলাম আজ তোমার সাথে এই নিয়েই একটু গল্প করি। শুধু ফুটবল ছাড়াও আফ্রিকার অনেক দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাগুলিও এবারের প্রতিযোগিতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। টুর্নামেন্টে খেলতে আসা লিবিয়ার অনেক ফুটবলারই কিছুদিন আগেই নিজেদের দেশে চলতে থাকা যুদ্ধের একেবারে সামনে থেকে লড়াই করে এসেছে। এর সেখান থেকে একেবারে খেলার মাঠে দেশের সন্মানের জন্য লড়াই। একইরকম ভাবে খেলতে আসতে হয়েছে টিউনিশিয়ার ফুটবলারদেরও। অন্যদিকে মিশরের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল এতটাই টালমাটাল যে তার অনেকটাই প্রভাব পড়ল তার ফুটবলের উপরেও। আর ফলস্বরূপ আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে সফল ৭ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া দল প্রতিযোগিতার মূলপর্বেই উত্তীর্ণ হতে পারল না। আফ্রিকার বরাবরের ফুটবলের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, আলজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশগুলোর মূলপর্বে উত্তীর্ণ হতে না পারাও ছিল টুর্নামেন্টের একটা চমক।
এবারের টুর্নামেন্টের যৌথ আয়োজক ছিল গ্যাবন আর ইকুয়েটোরিয়াল গিনি। তিন সপ্তাহ ধরে চলা টুর্নামেন্টের খেলাগুলো হয়েছিল দুই দেশ মিলিয়ে চারটি শহরের চারটি স্টেডিয়ামে। আয়োজক দুই দেশ ছাড়াও আরও ১৪ টি দেশ সুযোগ করে নিয়েছিল মূল পর্বে খেলার। এই ১৬ টি দেশকে ভাগ করা হয়েছিল ৪ টি গ্রুপে। গ্রুপ পর্বের খেলাগুলো হল রাউন্ড রবিন নিয়ম মেনে। প্রত্যেক গ্রুপের প্রথম ২ টি দল উত্তীর্ণ হল কোয়ার্টার ফাইনালে। আর এই রাউন্ড থেকেই শুরু হয়েছিল নক্-আউট পর্যায়ের খেলা।
সবাইকে খানিকটা চমকে দিয়েই জাম্বিয়া শুধু যে তাদের নিজেদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হল তাই নয়, কোয়ার্টার ফাইনালে দারুণ খেলে ৩-০ গোলে সুদানকে হারাল তারা। এই জাম্বিয়ার ফুটবল দলের ইতিহাস হয়তো তুমি কিছুটা জান। তাদের এত ভাল খেলার কথা তো ছেড়েই দাও, কিছু বছর আগেও অনেকে কল্পনা করেনি যে তারা এর মধ্যে আবার এত বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। ১৯৯৩ সালের ২৭ শে এপ্রিল এক ভয়ঙ্কর বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন তাদের ফুটবল দলের প্রায় সকলেই। সেই ফুটবলারেরা জাম্বিয়া থেকে সেনেগাল যাচ্ছিলেন বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং ম্যাচ খেলতে। কিন্তু সেনেগাল পৌঁছনোর আগেই আটলান্টিক মহাসাগরে বিমানটি ভেঙ্গে পড়ে। ২৫ জন যাত্রী আর ৫ জন বিমানকর্মীসহ সকলেই মারা যান। এর মধ্যেই ছিলেন তাদের দেশের ফুটবলারেরা। সেই জাম্বিয়ার পরবর্তী প্রজন্ম শুধু যে সেই বিভীষিকা ভুলে মাথা উঁচু করে খেলতে শিখেছিল তাই নয়, বেশ চিত্তাকর্ষক ফুটবল খেলে পৌঁছে গেল সেমিফাইনালে।
সেমিফাইনালে জাম্বিয়ার মুখোমুখি ঘানা আর অন্য সেমিফাইনালে মালির মুখোমুখি আইভরি কোস্ট। জাম্বিয়ার প্রতি বিশ্বের মানুষের স্বাভাবিকভাবেই একটা সহানুভূতি ছিল। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও ঘানার সাথে কেউই তাদের খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। ঘানা শুধুমাত্র যে আফ্রিকার অন্যতম শক্তিধর দেশ তাই নয়, বিশ্বের আরও অনেক শক্তিধর দেশের সাথেও সমানে সমানে লড়াই করার যোগ্য। তাদের দলের অনেক বিশ্বমানের ফুটবলার ইউরোপের অনেক বড় ক্লাবে দাপিয়ে খেলে বেড়ান। সেখানে জাম্বিয়ার এই নতুন প্রজন্মের ফুটবলারেরা আফ্রিকারই বিভিন্ন ছোট ক্লাবে খেলে থাকেন। তাদের নামের সাথেও কেউ খুব একটা প্রচিত নন। তাই ঘানা আর অন্য সেমিফাইনালের আইভরি কোস্টের মধ্যেই যে ফাইনাল হবে তাই নিয়ে কারও মনেই খুব একটা সংশয় ছিল না। যদিও আইভরি কোস্টের ক্ষেত্রে মিলে গিয়েছিল মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী, কিন্তু আবার সবাইকে চমকে দিয়ে জাম্বিয়া ১-০ গোলে হারিয়ে দিল ঘানাকে।
এবারে ফাইনাল। ১২ই ফেব্রুয়ারী আইভরি কোস্টের মুখোমুখি। বাকিদের কথা তো ছেড়েই দাও, এই সময়ে জাম্বিয়ার মানুষেরও বিশ্বাস হচ্ছে না যে তাদের দল খেলতে চলেছে আফ্রিকার ফাইনালে। সকলে যেন তিন সপ্তাহ ধরে একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছে। পারবে কি তারা আরেকবার সবাইকে চমকে দিতে? আইভরি কোস্টের দলে যে আরও বেশী বিশ্বমানের ফুটবলার। এই বিখ্যাত ফুটবলারদের কি ফাইনালে হারানো সত্যিই সম্ভব হবে? নাকি এতদিন ধরে চলতে থাকা স্বপ্নের দৌঁড় সেষ মুহূর্তে হোঁচট খেয়ে পড়বে?
জাম্বিয়ার ফুটবলারেরা কিন্তু সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। তাই তারা আইভরি কোস্টের দলের ভারী নামগুলোর কথা না ভেবে প্রাণপণ লড়াইয়ের জন্য মাঠে নেমেছিলেন। নির্ধারিত ৯০ মিনিট গোলশূণ্য থাকার পর একস্ট্রা টাইমেও গোল হলনা কোন। তার মানে শেষ পর্যায়ে এসে পেনাল্টিতে টাইব্রেকারের মাধ্যমেই ঝুলছে বিজয়ী দলের ভাগ্য। জাম্বিয়ার সামনে হাতছানি দিচ্ছে আফ্রিকার বিজয়ী হওয়ার গর্ব। ১২০ মিনিট ধরে আইভরি কোস্টকে আটকে রাখার কঠিন কাজটা তাঁরা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন। এবারে শুধু ঠিকমত পেনাল্টি মারার পালা।
টাইব্রেকারও চলতে থাকল প্রচন্ড নাটকীয়ভাবে। প্রথম ১৪ টা শটের মধ্যে সবগুলোই গোলে ঢুকল। এইসময় ম্যাচের ফল ৭-৭। পেনাল্টি মিস করলেন জাম্বিয়ার কালাবা। কিন্তু পরক্ষণেই আইভরি কোষ্টের কোলো টুরেও নিজের শট গোলে মারতে ব্যর্থ হলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাম্বিয়ার মানুষ। আরেকটা সু্যোগ। গোল করলেন জাম্বিয়ার সুনজু। ম্যাচের ফল জাম্বিয়ার পক্ষে ৮-৭। শট নিলেন আইভরি কোষ্টের জেরভিনহো। নাটকের এই চরম মুহূর্তে তিনিও গোল করতে ব্যর্থ হলেন। আফ্রিকার ফুটবলের মুকুট উঠল জাম্বিয়ার মাথায়। বাস্তবে পরিণত হল একটা সুখের স্বপ্ন। এই দলের সাফল্যের পিছনে একটা বড় ভূমিকা ছিল জাম্বিয়ার ফরাসী কোচ হার্ভে রেঁনারের। অনেকদিন ধরে এদের সাথে কাজ করে প্রতিটা তরুণ ফুটবলারের মনে তিনি এই বিশ্বাসটা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে এই বিশ্বাস আর চেষ্টা ধরে রাখতে পারলে তাদের স্বপ্নও বাস্তবায়িত হতে পারে।
ফাইনালের এই জয়ের আনন্দ আর গর্ব জাম্বিয়ার ফুটবলারেরা উৎসর্গ করলেন ১৯৯৩ সালের দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ফুটবলারদের উদ্দেশ্যে। এর পরেও প্রতি বছর চলতে থাকবে ফুটবল আর খেলাধূলোর বিভিন্ন আসর। কিন্তু নাটকীয়তা, স্বপ্নের বাস্তব হওয়া - সবকিছু নিয়ে জাম্বিয়ার এই আফ্রিকা জয় কোনদিন ভোলা যাবেনা।
লেখাঃ
পাভেল ঘোষ
হিল্স্বোরো, ওরেগন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
ছবিঃ
ইন্টারনেট