খেলাঘরখেলাঘর

সমুদ্রের জল নোনতা কেন

অনেক, অনেক দিন আগে, দুই ভাই ছিল, তাদের মধ্যে একজন ধনী আর অন্যজন গরিব। ক্রিসমাসের আগের সন্ধ্যাবেলায়, গরিব ভাইয়ের বাড়িতে খাওয়ার জন্য একটা দানাও ছিল না; তখন সে তার ভাইয়ের বাড়ি গেল, আর ক্রিসমাসের জন্য কিছু খাবার চাইল। তার ভাই এর আগেও তাকে বহুবার নানারকম জিনিষ দিতে বাধ্য হয়েছে, আর এইবারেও সে মোটেও নিজে থেকে কিছু দিতে চাইছিল না।

"আমি যা বলব, তুমি যদি সেটা কর, তাহলে তোমাকে একটা গোটা শুয়োরের মাংস দেব," বলল ধনী ভাই। গরিব ভাই তক্ষুণি কথা দিল।

"ঠিক আছে, এই নাও মাংস, কিন্তু এখন তোমাকে  সোজা যেতে হবে মৃতদের প্রাসাদে, " এই বলে ধনী ভাই  মাংসের খন্ডটা গরিব ভাইয়ের দিকে  ছুঁড়ে দিল।

"ঠিক আছে, আমি যে কথা দিয়েছি সে কথা রাখব।" বলল গরিব ভাই। এই বলে  সে মাংসের খন্ডটা নিয়ে  যাত্রা শুরু করল। সারা দিন ভর সে চলতেই লাগল, আর যখন রাত নেমে এল, সে একটা জায়গায় এসে উপস্থিত হল যেখানে আলো খুব উজ্জ্বল ছিল।

"আমার মনে হয় এইটাই সেই জায়গা, " সে ভাবল।

সেই বাড়িটার কাছে একজন লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো মানুষ কাঠ কাটছিল।
 
"শুভ সন্ধ্যা, " বুড়োর কাছে গিয়ে বলল সে।

"তোমাকেও শুভ সন্ধ্যা জানাই। তুমি এই রাতের বেলা কোথায় চলেছ?" বুড়ো জিজ্ঞাসা করল।

"আমি মৃতদের প্রাসাদের খোঁজে চলেছি, মনে তো হয় ঠিক পথেই চলেছি।" গরিব লোকটা বলল।

"ওহ!  হ্যাঁ, তুমি ঠিক পথেই এসেছ, কারণ  এই হল সেই প্রাসাদ," বলল বুড়ো । " তুমি যখন ভেতরে যাবে ওরা সবাই তোমার মাংস খন্ডটা কিনতে চাইবে, কারণ ওরা খুব একটা মাংস খেতে পায় না; কিন্তু তুমি ওদের কাছে এর বদলে দরজার পেছনে রাখা যাঁতাকলটা চাইবে। যখন তুমি বেরিয়ে আসবে, আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব যাঁতাকলটাকে কি করে থামাতে হয়। ওটা সব কাজের জন্যেই প্রয়োজনীয়।

তখন মাংস খন্ডা হাতে সেই গরিব লোকটা বুড়োকে তার উপদেশের জন্য অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে, দরজার কড়া নাড়ল।

যখন সে ভেতরে ঢুকল, বুড়ো যা বলেছিল ঠিক তাই হল ঃ ভেতরের সমস্ত লোক, সরু-মোটা-লম্বা-বেঁটে, পালে পালে তার দিকে এগিয়ে এল, আর প্রত্যেকেই মাংসের টুকড়োটা পাওয়ার জন্য তার সাথে দরাদরি শুরু করে দিল।

"এটা তো আমার আর আমার বউয়ের ক্রিসমাসের সন্ধ্যাবেলায় খাওয়ার কথা, কিন্তু, যেহেতু তোমাদের এটা পছন্দ হয়ে গেছে, তাহলে আমাকে তো এটা তোমাদেরকে দিয়েই যেতে হবে, বলল লোকটা। "কিন্তু, যদি আমি এটাকে বিক্রি করি, আমাকে তাহলে ওই দরজার পেছনে রাখা যাঁতাকলটা দিতে হবে।"

প্রথমে তারা তার কথা শুনল না, আর তার সাথে খুব দরাদরি করতে লাগল, কিন্তু লোকটা নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। তখন সেই লোকগুলি তাকে যাঁতাকলটা দিতে বাধ্য হল। সেটাকে নিয়ে সে যখন বাইরে এল, সে সেই বুড়ো কাঠুরেকে জিজ্জেস করল যাঁতাকলটা কিভাবে থামাতে হয়। যখন সে উপায়টা শিখে নিল, সে বুড়োকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথে হাঁটা দিল, কিন্তু বাড়ি পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল।

"এতক্ষণ তুমি ছিলে কোথায়?" তার বউ তাকে জিজ্ঞেস করল। " আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আছি, আর বাড়িতে আগুণ জ্বালানোর মত দুটো কাঠ পর্যন্ত নেই।"

"ওহ! আমি আগে আসতে পারিনি। আমার একটা দরকারি কাজ ছিল, আর অনেক দূরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তুমি এখন খালি দেখ!" এই বলে লোকটা যাঁতাকলটাকে টেবিলের ওপর বসাল, তারপরে সেটাকে প্রথমে বলল আগুণ দিতে, তারপরে টেবিলের ঢাকনা, তারপরে মাংস, আর সুরা, আর আরো ভাল ভাল খাবার যা ক্রিসমাসের আগের সন্ধ্যাবেলায় খাওয়া হয়। যাঁতাকল ধুরে যেতে থাকল আর যা চাওয়া হল সব কিছু দিয়ে যেতে থাকল। "হা ভগবান!" এইসব দেখেশুনে তার বউ বলল; সে তার স্বামীর কাছ থেকে জানতে চাইল সে কোথা থেকে যাঁতাটা পেয়েছে, কিন্তু তার স্বামী তাকে কিছুই বলল না।

"আমি কোথায় পেয়েছি সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না; তুমি দেখতেই পাচ্ছ এটা একটা খুব ভাল জিনিষ, আর এটা কখনো খারাপ হবে না। " এই বলে সে সমস্ত রকমের  ভাল ভাল খাবার বের করতে লাগল  আর অনেক খাবার জমিয়ে ফেলল, আর তিন দিনের দিন নিজের সব বন্ধুকে নেমন্তন্ন খেতে ডাকল।

ওদিকে তার ধনী ভাই যখন দেখতে পেল তার বাড়িতে ভোজ সভা বসেছে, তখন এত ভাল ভাল জিনিষ দেখে সে খুব অবাক হল আর রেগেও গেল।  "তিন দিন আগে ও এত গরিব ছিল যে আমার কাছে একটু খাবার চাইতে এসেছিল, কিন্তু এ কি দেখছি! ও এখন এত বড় একটা ভোজসভার আয়োজন করেছে ঠিক যেন এক রাজার মত। তাই সে তার ভাইকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, " কোথা থেকে এত সম্পদ পেলে, আমাকে এক্ষুণি বল।"

"দরজার পেছন থেকে, " বলল তার ভাই, কারণ সে কিছুতেই তার ধনী ভাইকে আসল কথাটা বলতে চাইছিল না। কিন্তু পরে সন্ধ্যার দিকে, যখন সে একটু বেশি সুরা পান করে ফেলেছে, তখন সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।সে যাঁতাকলটার কথা বলে ফেলল। "এইটাই আমাকে আমার সব সম্পদ এনে দিয়েছে," সে বলল, আর এই বলে সে
যাঁতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানারকমের জিনিষ বের করতে লাগল। তার ধনী ভাই যখন সেটা দেখল, সে তখন যাঁতাকলটা নিতে চাইল। অনেক করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে তার ভাইকে রাজি করালো যাঁতাকলটা দিয়ে দেওয়ার জন্য। ঠিক হল, তার বদলে সে ভাইকে দেবে তিন হাজার টাকা , আর যতদিন না ধান কাটা হচ্ছে, ততদিন গরিব ভাই নিজের কাছে যাঁতাকলটা রাখতে পারবে, কারণ, গরিব ভাই ভাবল- "আমি যদি ধান কাটা শেষ হওয়া অবধি এটাকে রাখতে পারি, তাহলে ততদিনে আমি এত খাবার সঞ্চয় করে ফেলতে পারব, যা অনেক অনেক বছর ধরে জমিয়ে রাখা যাবে।" বোঝাই যাচ্ছে সেই ক'দিনে যাঁতাটা একদমই বেকার পড়ে রইল না। ধান কাটা শেষ হলে ধনী ভাই গিয়ে সেটাকে নিয়ে এল, কিন্তু তার ভাই তাকে শিখিয়ে দিল না কিভাবে যাঁতাটাকে থামাতে হয়। ধনী ভাই সন্ধ্যেবেলা যাঁতাকলটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল, আর পরের দিন সকালে উঠে নিজের বউকে বলল , " যাও,  মাঠে গিয়ে খড়-শোকানোর তদারকি কর; আজকে বাড়ির সব কাজ আমি করব।"

তারপরে, যখন দুপুরে খাওয়ার সময় হল, সে যাঁতাকলটাকে রান্নাঘরের টেবিলের ওপর রেখে বলল " তাড়াতাড়ি আর ভাল করে মাংস আর পায়েস তৈরি কর।"

তখন যাঁতাকল মাংস আর পায়েস তৈরি করতে শুরু করল, আর প্রথমে সব থালা আর বাটি ভরে গেল, তারপরে সেগুলি রান্নাঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। ধনী ভাই যাঁতাকলটাকে নানারকম ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু যতরকমভাবেই চেষ্টা করুক না কেন, যাঁতাকলটা চলতেই থাকল, আর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘরে এত পায়েস হয়ে গেল যে লোকটা তাতে প্রায় ডুবেই যায় আর কি! তখন সে তাড়াতাড়ি বসার ঘরের দরজা খুলে দিল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরটাও খাবারে ভরে গেল। লোকটা কোনমতে সেই পায়েসের স্রোত ডিঙিয়ে বাড়ির দরজা খুলতে পারল। সে দরজা খুলেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে দৌড়াতে লাগল, আর তার পেছন পেছন মাংস আর পায়েসের স্রোত এগিয়ে আসতে থাকল আর মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। 

ওদিকে তার বউ, মাঠে খড় শোকানোর তদারকি করতে করতে, ভাবছিল দুপুরের খাবার কখন আসবে। সে তার আশেপাশের মজুরদের ডেকে বলল, "কত্তামশাই আমাদের এখনো বাড়িতে ডাকেন নি , কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের যাওয়া উচিত। হতে পারে উনি ঠিক ভাবে রান্না করতে পারছেন না, আর আমার উচিত ওনাকে গিয়ে সাহায্য করা।"

এই ভেবে তারা বাড়িত দিকে হাঁটা দিল। কিন্তু যখন তারা খানিকটা মাত্র পথ গেছে, তারা দেখতে পেল সেই মাংস আর পায়েসের ধারা, একে অপরের সঙ্গে মিশে ধেয়ে আসছে, আর তার সামনে ছুটে আসছে তাদের কর্তামশাই। "সাবধান, সাবধান, পালাও , পালাও। দেখ যেন পায়েসে ডুবে যেও না।" বলতে বলতে সে ছুটে চলল আর গিয়ে থামল তার ভাইয়ের বাড়ির সামনে। সে ভাইকে কাকুতি-মিনতি করে বলল যাঁতাকলটা ফেরত নিয়ে নিতে আর সেটাকে  থামাতে, কারণ সে বললঃ"ওটা যদি আর এক ঘন্টা চলে তাহলে সারাটা গ্রাম মাংস আর পায়েসে ডুবে যাবে।" কিন্তু তার ভাই বলল, আগে তিন হাজার টাকা দাও, তারপরে ওটাকে ফেরত নেব। তখন সেই ধনী ভাই বাধ্য হল তাকে টাকা দিতে। এখন গরিব ভাইয়ের কাছে টাকাও এল, আর যাঁতাকলটাও ফিরে এল। তাই খুব অল্পদিনের মধ্যেই সে তার ধনী ভাইয়ের বাড়ির থেকেও সুন্দর একটা খামারবাড়িতে থাকতে লাগল, আর যাঁতাকল থেকে সে এত টাকা পেল, যে সে সারাটা বাড়িকে সোনার পাতে মুড়ে ফেলল।তার খামারবাড়িটা ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি, তাই সমুদ্রের অনেক দূর থেকেও সেটাকে ঝকঝক করতে দেখা যেত। সেই পথ দিয়ে যারা যেত, তারা সবাই একবার করে সেই সোনার খামারবাড়ি দেখতে যেত, আর সবাই সেই অবাক করা যাঁতাকলটাকে দেখতে চাইত। তার খবর দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর এমন কেউ ছিল না যে কিনা তার কথা না জানত।

এর বেশ অনেক , অনেক দিন পরে, এক সওদাগর সেই যাঁতাকলটাকে  দেখতে এল। সে জানতে চাইল যাঁতাটা নুন বানাতে পারে কিনা। তার মালিক বলল, "হ্যাঁ, এটা নুন বানাতে পারে।"সেই শুনে সওদাগর ঠিক করল, যতই দাম লাগুক, সে এই যাঁতাকলটাকে কিনে নিয়ে যাবে। তাকে আর নুনের ব্যবসা করার জন্য বিপদশঙ্কুল সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হবে না। প্রথমে যাঁতাকলের মালিক কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু সওদাগর প্রচুর অনুরোধ-উপরোধ করে, অনেক অনেক টাকা দিয়ে সেটাকে কিনে নিল। একবার যাঁতাকলটাকে হাটে পেয়েই সওদাগর সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে এল, কারণ তার ভয় হচ্ছিল যে যাঁতাকলের আসল মালিকের যদি মত পরিবর্তন হয়, তাহলে সেটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। তড়িঘড়ি চলে আসার সময়ে, সে জেনে নিতে ভুলে গেল কিভাবে যাঁতাটাকে  থামাতে হয়। সে যত দ্রুত সম্ভব এসে নিজের জাহাজে উঠে পড়ল।

সমুদ্রে খানিক দূর যাওয়ার পরে, সে যাঁতাকলটাকে বলল, "তাড়াতাড়ি করে খুব ভাল নুন বানাও।" তখন যাঁতাকলটা নুন বানাতে শুরু করল, তার ভেতর থেকে ফোয়ারার মত নুন বেরোতে শুরু করল। যখন জাহাজটা নুনে ভরে গেল, তখ সওদাগর সেটাকে থামাতে চেষ্টা করল, কিন্তু কোনভাবেই যাঁতাকলটাকে থামাতে পারল না। যাঁতাটা নুন বানিয়েই চলল, জাহাজের ওপর নুনের পাহাড় ক্রমশঃ উঁচু হতে থাকল, আর শেষ অবধি জাহাজটা নুনের ভারে ডুবে গেল।

সেই যাঁতাকলটা সেই থেকে সমুদ্রের নিচে পড়ে আছে, আর এখনো , সারাদিন ধরে নুন বানিয়ে চলেছে; আর সেই কারণেই সমুদ্রের জল নোনতা।


অ্যান্ড্র্যু লাং এর রূপকথা।

অনুবাদঃ
মহাশ্বেতা রায়।
কলকাতা

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।