সাইকেলে করে সবকিছু প্যাক করে কোথাও একটা বেরিয়ে পড়ব এরকম বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম। এমনিতে সাইকেল চালাতেও খুব ভাল লাগে আর কোথাও ক্যাম্পিং করতেও খুব ভাল লাগে। আর এই দুটোকে যদি একসাথে করা যায়, আর পেট্রল খরচ করে প্রকৃতির ক্ষতি না করে যদি প্রকৃতিকে উপভোগ করা যায় তাহলে তো সবদিক দিয়েই ভাল। অপেক্ষা ছিল একটু বড় ছুটির, তাহলে কোথাও একটা গিয়েই আবার সাথে সাথে ফিরে আসার তাড়া থাকেনা; আর একটু ভাল আবহাওয়ার (বৃষ্টিতে এমনিতে সাইকেল চালাতে খারাপ লাগেনা, কিন্তু জামাকাপড় ভিজে গেলে আর তার উপর ভিজে মাটিতে টেন্ট পেতে থাকতে হলে সেটা একটা অস্বস্তি আর দুর্ভোগের ব্যাপার বটে!)।
যাই হোক, দিনটা ছিল ২০১৭ সালের ২৭ শে মে। শনিবার থেকে সোমবার অবধি তিন দিনের একটা ছুটি ছিল (দিনটা খুব ভালভাবে মনে আছে কারণ আমার প্রিয় দল আর্সেনাল সেই দিন সকালেই এফ,এ, কাপ জেতার পর যাত্রা শুরু করেছিলাম) আবহাওয়ার পূর্বাভাসও ভাল। তাই ঠিক করলাম এই সু্যোগ হাতছাড়া করব না। পোর্টল্যান্ড, ওরেগন - যেখানে আমি থাকি সেটা অনেকটা উত্তরে আর প্রশান্ত মহাসাগর থেকেও খুব একটা দূরে নয় বলে মে মাসের শেষের দিকেও খুব একটা গরম পড়ে না। কিন্তু বসন্ত আর গ্রীষ্মের এই সন্ধিক্ষণে আরেক উৎপাত আছে; গাছগুলো ওদের ফুলের রেণু হাওয়ায় ছড়াতে থাকে, আর তার থেকে পোলেন এলার্জি হয়ে অনেকেই কাহিল হয়ে পড়ে - ক্রমাগত হাঁচি, চোখে জল আসা, সব নিয়ে এক নাজেহাল আর অসহায় অবস্থা। শনিবার সকালে আমারও এভাবেই ঘুম ভেঙ্গেছিল। যদিও দুই দিনের খাবারদাবার, টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, জামাকাপড় সবকিছু আমার সাইকেলের ব্যাগে আগের দিন রাতেই ভরে রেখেছিলাম, কিন্তু শরীর অনেকক্ষণ ধরে মাথার মধ্যে না যাওয়ার চিন্তাটা ঢোকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। শেষে শরীরের উপর একটু জোর করেই বেরিয়ে পরলাম।
পোর্টল্যান্ডের পাশ দিয়েই ওরেগন আর ওয়াশিংটন রাজ্যের সীমানা বরাবর অনেকটা অবধি কলম্বিয়া নদী বয়ে গেছে। কলম্বিয়া নদী উত্তর আমেরিকা মহাদেশের অন্যতম বড় একটা নদী। এই অংশটায় নদীটা অনেক পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে বয়ে গেছে - তার দুই দিকে পাহাড়ের গা বেয়ে ঘেঁষাঘেষি করে থাকা উঁচু গাছের ঘন সবুজ জঙ্গল - আর পাহাড়ের উপর থেকে বরফগলা জলের অসংখ্য জলপ্রপাত এসে নদীতে পড়েছে। বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা রাস্তা আমি ট্রেনেই এলাম। ট্রেনে সাইকেল রাখার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। যে স্টেশন থেকে সাইকেল চালানো শুরু করব সেখানে যখন নামলাম তখনও শরীর পুরোপুরি ভাল লাগছে না, কিন্তু নতুন অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে মাথাটা অনেকটা ঝরঝরে হয়ে গেছে।
ঐতিহাসিক কলম্বিয়া রিভার হাইওয়ে
এখান থেকে আমাকে ৪০ মাইল মত যেতে হবে আমার গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য; তার মধ্যে আছে অনেক উঁচুনীচু রাস্তা; এর মধ্যে বেশিরভাগটাই 'হিস্টোরিক কলম্বিয়া রিভার হাইওয়ে' ধরে। নামে 'হাইওয়ে' হলেও এই রাস্তায় গাড়িঘোড়া খুব বেশী থাকেনা, আর পাহাড়ের মাঝে মাঝে যেখানে রাস্তা খুব সরু হয়ে গেছে সেগুলো বাদ দিলে আলাদা করে সাইকেলের লেন করা আছে। মিনিট দশ-পনেরো যাওয়ার পর শহরের ভীড় থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এলাম। এখন রাস্তায় আমার একদিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাছের সারি, আর অন্যদিকে একটা ছোট নদী- যেটা একটু দূরে গিয়ে কলম্বিয়া নদীতে পড়বে। শারীরিক পরিশ্রমের জন্য আর খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পেরে এখন শরীরও অনেকটা ভাল লাগছে। একটু পরেই রাস্তা চড়াই হতে হতে অনেকটা উপরে উঠে এলাম। ডানদিকে গাছপালার মধ্যে দিয়ে মাউন্ট হুড উঁকি দিল। মাউন্ট হুড প্যাসিফিক নর্থওয়েষ্ট অঞ্চলের অন্যতম উঁচু একটা পর্বতশৃঙ্গ। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ পাহাড়ের মত এটাও একটা আগ্নেয় পর্বত। ১০,০০০ ফুটের থেকেও একটু বেশি উচ্চতার জন্য বছরের ৮/৯ মাস সময়েই বরফে ঢাকা থাকে।
দূর থেকে ভিস্তা হাউজ
আরেকটু এগিয়ে পৌঁছে গেলাম 'ভিস্তা হাউস' নামে একটা জায়গায়। এটা এই রাস্তার সবচেয়ে উঁচু জায়গা। একটা ছোট মিউসিয়াম ছাড়াও ভিতরে টয়লেট আর খাওয়ার জলের ব্যবস্থা আছে। বাইরের চারিদিকের রেলিং-এ দাঁড়িয়ে কলম্বিয়া নদী আর আর দুই দিকের পাহাড়ের খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় এখান থেকে। পকেটে কয়েকটা এনার্জি বার ছিল; তাই দিয়ে একটু শক্তি সঞ্চয় করে আর খানিকক্ষণ এখানে বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। এখান থেকে রাস্তা ঢালু হয়ে অনেকটা নেমে গিয়ে একের পর এক অনেকগুলো জলপ্রপাত দেখা যায় রাস্তার ধারে। তার মধ্যে 'মাল্টনোমাহ ফলস্' এই অঞ্চলের একটা বড় দ্রষ্টব্য। ছুটির দিন বলে লোকের ভীড়ও খুব বেশি। জলপ্রপাতের সামনের রাস্তার দু'দিকেই অনেক দূর অবধি গাড়ির লাইন পড়ে গেছে। সাইকেল নিয়ে গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে রাস্তা করে এগোতে অবশ্য খুব একটা অসুবিধে হল না। প্রত্যেকটা জলপ্রপাতের সামনেই অল্প সময় করে দাঁড়িয়ে আর ফোনে কয়েকটা করে ছবি তুলে শেষ পর্যন্ত আবার ভীড়ের বাইরে একটা ফাঁকা রাস্তায় এসে পড়লাম। এখানে রাস্তা গাড়ির রাস্তার থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে গেছে - সাইকেল আর পথচারীদের জন্য জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খুব সুন্দর রাস্তা করা আছে। এরকম শুনশান রাস্তা দিয়ে আরো ঘন্টাখানেক এগিয়ে পৌঁছে গেলাম 'ক্যাসকেড লকস্' নামে একটা ছোট শহরে।
মাল্টনোমাহ ফল্স্
ম্যাপ দেখে আমার ক্যাম্পগ্রাউন্ড খুঁজে পেতে খুব বেশি সময় লাগল না। মে মাস বলে দিনের আলো তখনো পুরোদমে আছে। বেশ সুন্দর ব্যবস্থিত জায়গা; আমার তাঁবুটা যেখানে পাতা হবে সেটাও বাকিগুলো থেকে একটু দূরে বলে লোকজনের কোলাহল থেকেও অনেকটা বাইরে। তাঁবু পেতে আর ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী বের করে প্রথমেই বাথ্রুমে গিয়ে স্নান করে পরিষ্কার হয়ে গেলাম। এতে শরীরের ক্লান্তি যেমন এক ঝটকায় চলে গেল, তেমন হঠাৎ খুব খিদে পেয়ে গেল। স্টোভ জ্বালিয়ে রেডিমেড চিকেন জাম্বালায়া (এটা এক ধরণের 'ক্যাজুন' খাবার - যেটা আমেরিকার লুইসিয়ানা রাজ্যের স্পানিশ আর ফ্রেঞ্চ অধ্যুষিত অঞ্চলে খুব প্রচলিত) দিয়ে আজকের মত রাতের খাবার সমাপন হল। সারাদিনের ধকলের পর ক্যাম্পিং-এর সময় যে কোন খাবার খেতেই একদম অমৃত মনে হয়; এবারেও তার অন্যথা হল না। একটু পরেই সূর্য ঝুপ করে নেমে যাওয়ার পর তাঁবুর মধ্যে ঢুকে বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম সেটা বুঝতেও পারলাম না। জঙ্গলের বাইরেই একটা রেললাইন, যেখানে বেশি রাতের দিকে কিছু মালগাড়ি যাতায়াত করে। সেই ট্রেনের আওয়াজে হয়তো বার দুয়েক ঘুম ভেঙ্গেছিল; তা ছাড়া একদম সকালে গিয়ে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন শরীর একদম তরতাজা লাগছে।
ডগ মাউন্টেন থেকে কলম্বিয়া নদী
সকালে ব্রাশ করে আবার স্টোভ জ্বালালাম। এক কাপ কফি, আর এক বাটি ওট্মিলের সাথে গুঁড়ো দুধ আর কিশমিশ মিশিয়ে ভরপেট প্রাতঃরাশ সারা হল। আজ একটু বেলার দিকে আমার দুই বন্ধু - রুদ্রজিৎ আর সিন্ধু - আসবে। তারপর ওদের সাথে নদীর উলটো দিকে একটা পাহাড়ে হাইক করতে যাব। খাবারের বাসনপত্র ধুয়ে ক্যাম্পগ্রাউন্ডের ভিতরটা একটু ঘুরে দেখতে দেখতে একটু পরেই ওরা দুজন এসে হাজির হল। ক্যাসকেড লকস্ থেকে যে ব্রিজটা কলম্বিয়া নদী পেরিয়ে ওয়াশিংটন রাজ্যের স্টিভেনসন শহরের সাথে যুক্ত করেছে সেটা দেখতে খুব সুন্দর, আর নামটাও সুন্দর - 'ব্রিজ অফ্ দ্য গডস্'। শহর মানে খুবই ছোট শহর। সেখানে এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে শাটল বাস ধরে একটা পাহাড়ের নীচে আসতে হয়। এই পাহাড়টার নাম 'ডগ মাউন্টেন' - কেন জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দিতে পারব না, কারন পাহাড়টাকে কোন ভাবেই কুকুরের মত দেখতে নয়। যাই হোক, বছরের এই সময়ে এই পাহাড়টার পুরো ঢাল বরাবর হলুদ রঙের ফুলে ভরে থাকে। উপর থেকে দেখতে মনে হয় সবুজ ঘাসের উপরে কেউ হলুদ রঙের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। কলম্বিয়া নদীর এই দিকের পাহাড়গুলো বেশিরভাগই মাঝারি উচ্চতার - দুই থেকে তিন হাজার ফুটের মধ্যে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের মাথায় ওঠার রাস্তাটা এক জায়গায় গিয়ে দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক দিক দিয়ে গেলে গাছের ছায়া দিয়ে অনেকটা হাঁটা যাবে, আর অন্য দিকের রাস্তা একটু বেশি খাড়া কিন্তু দূরত্ব সামান্য কম। আমরা প্রথম রাস্তাটা দিয়েই ওঠা সাব্যস্ত করলাম। একটা জায়গায় গিয়ে গাছের ছায়া থেকে রাস্তাটা যখন আবার খোলা আকাশের নীচে এসে পরে, সেখান থেকে এক দিকে নীচে কলম্বিয়া নদী আর অন্য দিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হলুদ ফুলের মেলা দেখা যায়।
ডগ মাউন্টেন-এ বুনো ফুলের শোভা
প্রায় ঘন্টা দেড়েকের একটু বেশি সময় পরে যখন আমরা পাহাড়ের মাথায় এসে পৌঁছলাম, তখন উপর থেকে একদিকে হলুদ ফুলের মখমলের চাদর, আর অন্যদিকে পাহাড় আর গাছের ফাঁক দিয়ে তিনটে বড় বরফ-ঢাকা পাহাড়ের চূঁড়া - মাউন্ট হুড, মাউন্ট সেইন্ট হেলেন্স, আর মাউন্ট অ্যাডামস - সব মিলিয়ে স্বর্গীয় শোভা। বেশ অনেকটা সময় ঘাসের উপর বসে, সঙ্গে নেওয়া স্ন্যাক্স খেয়ে, আর গল্প করে নীচে নেমে আসার পালা। নামার সময় আমরা অন্য দিকের রাস্তা দিয়ে নামলাম। নামার পথে চোখে পড়ল এক হরিণ মা আর তার এক খুদে ছানা। আমাদের দেখেই দৌঁড়ে গাছের পিছনে পালিয়ে গেল। নীচে নেমে শাট্ল বাসে এসে আবার আমরা আমাদের গাড়ির জায়গায় এসে পৌঁছলাম। আমার বন্ধুরা আমাকে আমার ক্যাম্পগ্রাউন্ডে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। আমি স্নান করে বেশ খানিকক্ষণ শুয়ে শুয়ে বই পড়লাম। তারপর একটু বেলার দিকে যখন আবার খিদে পাচ্ছিল তখন স্টোভ জ্বালিয়ে আবার রান্না করলাম - আজকের মেনু কুসকুস (একধরণের মধ্যপ্রাচ্যের শস্য, যেটা খেতে অনেকটা সাবুদানার মত), আর সাথে কিছু সবজি আর সালামি মাংস।
হর্সটেইল ফল্স্
সারাদিনের ধকলের পর আর তারপর ভরপেট খেয়ে আজ রাতেও ঘুম আসতে মোটেই সময় লাগল না। পরেরদিন বেশ ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেল। শেষবারের মত ক্যাম্পগ্রাউন্ডটা হেঁটে এক চক্কর ঘুরে, কফি আর ওট্মিল দিয়ে প্রাতঃরাশ সারলাম। এবারে জিনিসপত্র গোছানোর পালা। সকাল ১১ টার মধ্যে জায়গাটা ছেড়ে দিতে হত, আর বাড়ি পৌঁছে একটু বিশ্রামও নিতে হবে। তাই দেরী না করে বেড়িয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। একই রাস্তা দিয়ে উল্টোদিকে ফিরে আসা - কিছুটা দূর অবধি উল্টোদিক থেকে প্রচন্ড হাওয়া আসায় জিনিসপত্র সাইকেলে নিয়ে খুবই আস্তে যেতে হচ্ছিল। সেটা বাদ দিলে বাকি রাস্তায় আর খুব একটা কিছু ব্যতিক্রম হল না। কোন একটা জলপ্রপাতের ধারে আর তারপর ভিস্তা হাউসের ব্যালকনিতে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে, আর এনার্জি বার খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে বিকেলের আগেই বাড়ি ফিরে এলাম।
ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আমার দুই দিনের আস্তানা
স্নান, খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে গত তিনদিনে তোলা ছবিগুলো দেখতে দেখতে আজও কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টের পেলাম না। আজ আর মাঝরাতে হঠাৎ ট্রেনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গার সম্ভাবনা নেই, মাথা আর পিঠের নিচে শক্ত মাটির জায়গায় রয়েছে নরম বালিশ আর তোশক; কিন্তু কেন জানি ঘুমের মধ্যে আমার গত তিন দিনের সেই অনারামের সময়টাকেই মিস্ করছিলাম - তাই এরকম ভাবে যে আরো ঘুরতে যাব আর ফিরে এসে সেই গল্প আবার তোমাকে বলব, সেটা মনে হয় ঘুমের মধ্যেই ঠিক করে নিয়েছিলাম।
ছবিঃ ব্যক্তিগত সংগ্রহ