মধ্যবয়সী ঢোলগোবিন্দ ডাকসাইটে খাদ্যরসিক না হলেও, সুন্দরবন অঞ্চলের নেতিধোপানীতে বন্ধু বিমলের বাড়িতে এসে পর্যন্ত তাঁর পেটের বিশ্রাম নেই মোটেই। অবিবাহিত বিমল অধিকারী, তাঁর কলেজের বন্ধু। এই বাঘ-কুমিরের খাসতালুকে পৈতৃক ভিটেতে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে একাই থাকেন, এবং বহুদিন ধরেই বন্ধুকে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন কাটিয়ে যাওয়ার জন্যে বলে আসছেন। কিন্তু কলকাতা শহরে কড়া নিয়মের জাঁতাকলে পড়ে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠলেও, চাকরিবাকরি, সংসার সব সামলাতে সামলাতে ঠিক সময় বের করে উঠতে পারছিলেন না ঢোলগোবিন্দ।
বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারী ঢোলগোবিন্দ চাকলাদারের দিন শুরু হয় খালি পেটে হজমের ওষুধ খেয়ে। তারপরে সামান্য ফল আর দুধ দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে আবার একপ্রস্থ ওষুধ খেয়ে অফিস পৌঁছে, হাজারো কাজের ঝক্কি সামলে দুপুরে জোটে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া, টিফিনবাক্সে ঠাণ্ডা হওয়া জিয়োনো মাছের ঝোল আর ভাত। তারপরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে অফিসের পাশে শ্যামলের দোকানের লেড়ো বিস্কুটের সঙ্গে চিনি ছাড়া এক কাপ চা খেয়ে, ট্রাফিক গুঁতিয়ে বাড়ি ফিরে রাতে দুটি শুকনো রুটি আর একটু দুধ খেয়ে খবরের চ্যানেল খুলে ঝিমোতে ঝিমোতেই দিন শেষ। এই তাঁর স্বাস্থ্যবিধিসম্মত একঘেয়ে রুটিন। কাঁচবাধানো ঠান্ডা ঘরে বসে থাকতে থাকতে কখন যে সকল থেকে দুপুর, আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, টের পান না এক একদিন। এদিকে একমাত্র ছেলে চাকরি নিয়ে দক্ষিণভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে গিন্নী ভীষণ রকম খিটখিটে হয়ে গিয়েছেন। নিয়মের বাইরে এখানে-সেখানে যাওয়া-আসা, এটা- সেটা খাওয়া-দাওয়া সবেতেই কড়া নজর রাখেন, আর বেগড়বাঁই করলেই প্রাপ্তি হয় ভীষণ বকুনি। খেতে ভালোবাসুন বা না-ই বাসুন, এই ভাবে কি থাকা যায়! ডাক্তারবাবু মাঝেমধ্যেই তাঁর স্বাস্থ্যোন্নতির জন্যে হাওয়া বদলের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাই গিন্নী ছেলের কাছে যাওয়ার বায়না করতেই বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর ব্যাঙ্গালোরে যাওয়ার টিকিট কেটে দিয়ে নিজেও মনে মনে দুর্দান্ত পরিকল্পনা করেছেন, অফিসের জমে থাকা কিছু ছুটি সদ্ব্যবহার করে, কয়েকটা দিন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসবেন, সঙ্গে উপরি পাওনা গ্রাম বাংলার বিশুদ্ধ বাতাস আর সবুজ গাছগাছালির সমারোহে চোখের আরাম।
তবে আসার পর থেকেই, খাতিরের বহর দেখে বেশ বিব্রত হয়ে পড়েছেন ঢোলগোবিন্দ। না, ঠিক খাতির নিতে আপত্তি নয়, বরং এত নিয়ম বহির্ভূত আহারাদি তাঁর পেটে সইবে কিনা সেই নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন। তবে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা বিমলের মায়ের অসাধারণ রান্না পাতে পড়লেই সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে শিশুসুলভ সারল্যে রসনার পরিতৃপ্তিতে মশগুল হয়ে উঠেছেন তিনি, আর খাওয়া সেরে উঠতে উঠতে পেটের আয়তন ছোটখাটো মাটির হাঁড়ি থেকে বদলে চন্ডীমণ্ডপের সান্ধ্য হরিসভার ঢোলের মতো হয়ে গিয়ে তাঁকে সার্থকনামা করে তুলেছে। নানারকম তরি-তরকারি ছাড়াও, টাটকা মাছের বিভিন্ন পদ সেবন করেও তিনি বেশ ভালোই ছিলেন এবং উৎফুল্ল হয়ে মাঝে মধ্যে প্রকৃতির কোলে থাকার নানা সুবিধা বিড়বিড়ও করছিলেন আপনমনে, কিন্তু গোলমাল বাধল হাঁসের ডিম খেয়ে। অস্তগামী সূর্যের মত রাঙা টুকটুকে কুসুম দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একসাথে খানপাঁচেক পেটে চালান করেছিলেন একে একে, আর খাওয়ার পরে রাতে শুতে যাওয়ার পর থেকে তারা জানান দিতে শুরু করে, যে কাজটা মোটেই ভালো হয়নি। বন্ধুবান্ধবদের সামনে বারবার প্রাকৃতিক কর্ম সারতে গেলে বড় লজ্জা করে ঢোলগোবিন্দের সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই, তাই ঘন ঘন বাথরুম যেতেও পারছেন না, এদিকে প্রকৃতি ডাক দিচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। কিছু সময় অপেক্ষার পর বিমল ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে দেখেন বিমলের মা ঢুকেছেন বাথরুমে। পরিস্থিতি বেগতিক, হাতে সময়ও বেশি নেই, যা থাকে কপালে ভেবে পা বাড়ালেন বাড়ির পিছনের জঙ্গলে। হাল্কা হয়ে কাছাকাছি থাকা একটি খালের জলে পরিষ্কার হয়ে সবে ফিরতে যাবেন, এমন সময়ে ঘটলো বিপত্তি।
শৌচ করার সময়েই একটা ক্ষীণ বোঁটকা গন্ধ নাকে এলেও, ঝোপে ঝাড়ে কোনও কিছু থেকে আসছে ভেবে আমল দেননি সেভাবে, এতক্ষণে উদ্ধার করলেন, সেই গন্ধ বহনকারী আর কেউ নয়, সাক্ষাৎ যম! অন্ধকারেও ওই গুরুগম্ভীর গর্জন আর ক্ষিপ্র গতি জানান দেয়, ‘এসেছেন, তিনি এসেছেন’।
ঢোলগোবিন্দ প্রমাদ গণলেন, যদিও বিমলের বাড়ির চৌহদ্দি থেকে খুব দূরে তিনি নেই, তবুও বাঘের সঙ্গে দৌড়ে বা লাফিয়ে তিনি পারবেন কেন? ঘাপটি মেরে বসে থাকার জায়গাও বিশেষ নেই, আর থাকলেও লাভ নেই। এদের ঘ্রাণশক্তি প্রবল, ঠিক খুঁজে নেবে তাঁকে। অতি ভোজনের ফলাফল হিসেবে শেষে কিনা বেঘোরে প্রাণ যাবে বাঘমামার কাছে, এই ছিল তাঁর ভাগ্যে! ছেলের মুখটা মনে আসতে লাগলো বারবার। আর বুঝি সত্যিই দেখা হল না এই জন্মে!
প্রাণরক্ষার উপায় ভাবতে ভাবতেই ঠাহর করলেন কাছেই রয়েছে একটা বড়সড় গাছ। যদিও রয়েল বেঙ্গল টাইগার গাছে উঠতে অত্যন্ত পটু ,তাও যা থাকে কপালে এই ভেবে কোনোরকমে উঠে বসলেন একটা মাঝারি উচ্চতার শক্তপোক্ত ডালে। উঠে সবে খেয়াল করে দেখতে যাবেন বাঘ বাবাজী ধাওয়া করে এই পর্যন্ত এসে পড়লো কিনা, একটা খ্যানখ্যানে কিন্তু গা ছমছমে কণ্ঠস্বর বিটকেল গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করলো,
"অ্যাঁয়, তুই ক্যা লো? রাত্তির দুপুরে নিজের ডেরায়, কোথায় একটু আরাম করে জিরিয়ে নেব, তারও জো নেই কো!"
একে গোকুল অন্ধকার, আশেপাশে কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না, তায় জীবনে প্রথমবার বাঘের মুখোমুখি, তার ওপর পেট বিগড়ে চোদ্দটা বেজে আছে, এই অবস্থায় গাছে উঠে প্রাণ বাঁচানোর উপক্রম করতে গিয়ে যদি এরকম কণ্ঠস্বরের অধিকারী একটি সঙ্গী জোটে, কারই বা স্নায়ু সবল থাকে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন ঢোলগোবিন্দ,
"আমাকে বাঁচান দাদা, আমাকে এ যাত্রা রক্ষা করুন।"
আবার সেই ভীষণ কণ্ঠ বিরক্তি সহকারে ঝনঝনিয়ে উঠলো,
"আ মোলো যা, কান্দে কেন? আর এই বয়সে আমি কি গাছ থেকে নেমে বাঘ খ্যাদাবো, তাও এই সময়ে? চুপ করে বসে থাক। ও আসবে না এদিকে আমি জানি।"
কিন্তু চুপ করে বসে থাক বললেই কি আর তা করা যায়, আর তাছাড়া ঢোলগোবিন্দের কিরকম যেন ঠিক ভালো ঠেকছে না ব্যাপারটা। সুন্দরবনের অধিবাসী মানুষেরা বাঘের গতিবিধি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখবে তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু তা হলেও এতটা নিশ্চিন্তে থাকা কি যায়?
"বিশ্বাস হচ্ছে না ত আমার কথা! এই ছয়-কুড়ি আট বছরের জীবনে অনেক বাঘ দেখেছি। তোদের মত পড়ালেখা করা বাবুদের চেয়ে ঢের গুণ বেশি জানি আমি বাঘের ব্যাপারে। কিন্ত সে আর কে শুনবে বল!"
একটু বুঝি আক্ষেপ ফুটে উঠলো ব্যক্তির গলায়।
ঢোলগোবিন্দের মন পড়ে আছে বাঘের দিকে, তাই এঁর কথা কোনোকিছুই মাথায় ঢুকল না, বলা ভালো কানে ঢুকেও মরমে পশিল না, নাহলে হয়তো গাছ থেকেই লাফিয়ে পড়তেন বয়সের বহর শুনে।
"আচ্ছা সত্যি বাঘ আসবে না তো? আপনি ঠিক বলছেন?"
"আরে বাপু হ্যাঁ রে, আমি তোদের চাইতে ঢের বেশি বুঝি দক্ষিণরায়ের সাঙ্গপাঙ্গদের। সাহেব শিকারির দল শিকার করতে এসে ওই নাম দিয়েছিল এখানকার বাঘেদের, আগে নাহলে এদের রয়েল ব্যাঙ্গল কেউ বলত না। এরা লম্বায় প্রায় সাড়ে তিন গজ আর ওজনে তিনশো সেরের বেশি হয়। অ তোরা তো আবার এইসব গজ সের বুঝিস না। ওই ধর লম্বায় এগারো ফুট পর্যন্ত আর ওজনে তিনশো কিলোর কিছু বেশি হতে পারে। সাঁতার দেওয়া, গাছে চড়া, লাফিয়ে লাফিয়ে খাঁড়ি পার হওয়ায় এদের জুড়ি নেই। তবে মানুষের অস্তরের কাছে এসব আর কী! ওতেই এরা অর্ধেক সাবাড় হয়ে গেছে এখান থেকে। তাছাড়া জোয়ারের সময় জল বাড়লে কুমিরের সঙ্গে এরা পেরে ওঠে না, বেঘোরেই যায় পরাণটা। এদিকে গ্রামে ঢুকলে মানুষ পিটিয়ে মারে, বোঝে না এরা নিজেরাই অত ভিড় দেখে ভয়ে দিশেহারা হয়ে থাকে। সেই কয়েকবছর আগে যে ভীষণ ঝড় হল, আয়লা না কী যেন, তাতেও বেচারিরা সাবাড় হয়ে গেল খানকতক, পরে খাঁড়ির জলে ভেসে থাকতে দেখেছিলাম, বড় কষ্ট হয়েছিল দেখে, আহা অবলা প্রাণী।"
অন্ধকারে অদৃশ্য সঙ্গী বকেই চলেছেন, এরই মধ্যে আরও দুইবার অবলা প্রাণীটি তার কাছাকাছি থাকার প্রমাণ দিয়েছে গলাখাঁকারি দিয়ে। ঢোলগোবিন্দের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে আছে, পেটের মধ্যে জমে থাকা নিদারুণ বিপদের আশঙ্কা গুড়গুড় করে উঠছে, কিন্তু ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’, ভদ্রলোক ব্যাঘ্রকুলের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে জ্ঞানের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন অনর্গল।
"ওই দেখুন আবার ডাকল! দাদা আপনি তো এত জানেন, কিছু একটা করুন, আমাকে বাঁচান, আর এলে তো কেবল আমাকে নয়, আপনাকেও ধরবে, তখন?"
কাতর আর্তি জানান ঢোলগোবিন্দ।
"আমাকে ধরার সাধ্য আর নেই ওদের , ছিল এককালে, তখন ধরতে এসেছিল একবার। কিন্তু এখন আর কিছু করবার জো নেই , ওদের সামনে দিয়েই তো আমি হেঁটে বেড়াই।"
"বলেন কী? কিচ্ছু করে না? আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই!"
ভয়মাখানো বিস্ময় প্রচ্ছন্ন ঢোলগোবিন্দের গলায়।
"তবে আর তোকে তখন থেকে কী বলছি! তুই চুপ করে বসে থাক, আমি বলছি তো তোর কিছু হবে না। গল্প করি বরং আয়, অনেককাল মন খুলে কারুর সঙ্গে কথা বলা হয় না আমার। এই জঙ্গলে একা থাকতে থাকতে বোবা হয়ে গেছি। তা তুই এখানে কার বাড়ি এসেছিস?"
"বিমলের বাড়ি। ও আমার কলেজের বন্ধু, অনেকদিন ধরেই বলে আসছে আসার জন্যে কিন্তু আমার আর সময় হয় না।"
বললেন ঢোলগোবিন্দ। অজানা সঙ্গীর সাহসের বহর শুনে বাঘের ভয় কিছুটা দূর হলেও অস্বস্তি যাচ্ছে না। একে তো তিনি আশেপাশেই কোথাও রয়েছেন, তার ওপর গাছে বসে থাকা কি আর পোষায় এই বুড়ো বয়সে, কেবলই চমকে চমকে উঠছেন পড়ে যাওয়ার শঙ্কায়, কিন্তু সংকোচে বলে উঠতে পারছেন না, ভদ্রলোক ভাববেন ধন্য আনাড়ি হয় এইসব শহুরে লোক। তবে মধ্যরাত্রে গাছের ডালে চড়ে খোশগল্প করার মত মানসিকতা তার নেই, নামতে পেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন, বুড়ো বয়সে হাড় ভাঙলে আর রক্ষা নেই।
"অই দেখো,বাঘের ভয় পুরো যায়নি, এখন আবার গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়। না বাপু, ছেড়ে দে, চল তোকে দিয়ে আসি, বিমলের বন্ধু মানে আমার নাতির মতই তুই। আর গাছে বসে থেকে কাজ নেই।"
ভদ্রলোক বুঝি অন্তর্যামী, ঢোলগোবিন্দ যাই ভাবছেন, কী করে না জানি টের পেয়ে যাচ্ছেন তিনি।
"আচ্ছা নিচে নামলে আবার ধরবে না তো এসে?"
"আরে ধুর ব্যাটা, আয় তো চুপচাপ আমার পেছন পেছন। আমি সঙ্গে থাকলে কেউ তোকে কিচ্ছুটি করবে না।"
মনে মনে ইষ্টনাম স্মরণ করতে করতে সবে নামতে যাবেন, সেই ভদ্রলোক আবার বলে উঠলেন,
"আহা ওইভাবে নামিসনি। ওই ডালে অনেক কাঠপিঁপড়ে। এই দিক দিয়ে আয়।"
অদ্ভুত ক্ষমতা বটে, এই অন্ধকারে গোটা একটা মানুষকে দেখা যাচ্ছে না, তাও ইনি পিঁপড়ে দেখতে পেলেন। না, এঁর ওপর সন্দেহ করা উচিৎ হয়নি। সন্তর্পণে নেমে কিছুটা এগিয়ে এসেই বিমলের বাড়ির উঠোনে জ্বলতে থাকা আলো দেখতে পেয়ে, মনে বেশ বল পেলেন ঢোলগোবিন্দ চাকলাদার।
"ওই যে দাদা, দেখা যাচ্ছে, চলুন।"
"নারে, আমার এখন আর আলোয় যাওয়া অভ্যেস নেই বহুকাল, কিছু দেখতে পাই না তাই। তুই যা, আমি ফিরে যাই।"
"তাই বলে এত রাতে আবার ওই জঙ্গলে? আপনি আসুন, আমি আপনার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছি।"
ঢোলগোবিন্দের কথায় ভদ্রলোক বিশ্রীরকম খ্যাঁক খ্যাঁক আওয়াজ করে হাসতে লাগলেন। ওই ভূতুড়ে অট্টহাস্য শুনলে বাঘ কেন, ডাইনোসরও পালাবে, হাসি থামিয়ে বললেন,
"আচ্ছা তুই চল, আমি আসছি পেছন পেছন।"
আশ্বাসবাণী পেয়ে, ঢোলগোবিন্দ তরতরিয়ে ঝোপঝাড় টপকে এগিয়ে গেলেন বিমলের বাড়ির দিকে।
এদিকে বিমলের বাড়ি পৌঁছে দেখেন সেখানে হুলস্থুল পড়ে গেছে, শহরে থাকা প্রাণের বন্ধু মধ্যরাত্রে বাড়ি ছেড়ে কোথায় গেলেন তা কেউই বুঝে উঠতে পারছেন না, তার ওপর গ্রামের উপকণ্ঠে বাঘের ডাক সকলেই শুনেছে। বিমল বাড়ির উঠোন, ঘর, বাথরুম, বাড়ির চৌহদ্দির আশেপাশেও খুঁজেছেন, কিন্তু ঢোলগোবিন্দকে খুঁজে পাননি।
এতক্ষণে ঘামে ভেজা বিধ্বস্ত চেহারার বন্ধুকে দেখে বিমল এবং তার মা বুঝি ধড়ে প্রাণ পেলেন।
ঢোলগোবিন্দ অধোবদনে সব সত্যি কথাই জানালেন,এবং পিছনে ফিরে তার ত্রাণকর্তাকে না দেখতে পেয়ে ভাবলেন, নির্ঘাত পথে তিনি বিপদে পড়েছেন। যতই হোক মানুষই তো। ব্যস্তসমস্ত হয়ে বিমলকে সেই কথা জানালে, বিমল ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে একবার তার মায়ের দিকে আর একবার বন্ধুর দিকে চেয়ে নির্বাক হয়ে রইলেন, বিমলের মা-ও কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন উঠোনের একপাশে।
এদিকে অস্থির ও চিন্তিত ঢোলগোবিন্দ এই দুটি মানুষের অদ্ভুত নীরবতার অর্থ উদ্ধার করতে না পেরে, চঞ্চল হয়ে একবার বন্ধুকে আর একবার তার মাকে অনুরোধ করতে লাগলেন, আশেপাশের লোকেদের বলে-কয়ে বিপদে পড়া মানুষটিকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করতে।
উতলা ঢোলগোবিন্দকে শান্ত করতে অবশেষে বিমলের মা মুখ খুললেন, "অরে ও ঢোল ও যে মানুষ নয়। ও তো ভূত। ওকে কে উদ্ধার করতে যাবে!"
ঢোলগোবিন্দ এইবার ধপাস করে বসে পড়লেন উঠোনের মেঝেয়।
"কী বলো কী মাসীমা? ভূত? ভূতে এসে দিয়ে গেল আমায় বাড়ি অব্দি! "
"হ্যাঁ ভাই। উনি আমার ঠাকুরদা, ঈশ্বর প্রাণকৃষ্ণ ঘোষাল। গুপ্তধনের সন্ধানে গিয়ে বাঘের শিকার হয়েছিলেন। লোভ বড় ভীষণ জিনিস!"
আক্ষেপের সুর বিমলের গলায়।
লোভ যে সত্যি ভীষণ জিনিস তা আজ ভালোমতো টের পেয়েছেন ঢোলগোবিন্দ। লোভ করে অতগুলো ডিম খেয়ে পেটের সাড়ে সর্বনাশ বাধিয়ে, প্রাণটাই যেতে বসেছিল আজ।
সেই রাতে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বন্ধুর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু শুয়েও কি আর ঘুম আসে? এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভাবতে লাগলেন, গাছে বসেই যদি টের পেতেন ভূতের সঙ্গে বসে আছেন, তাহলে কী করতেন! আতঙ্কে ঘুম হল না সেই রাতে আর, কাকভোরে পাখিদের মৃদু কলরব কানে আসতেই তিনি উঠে পড়লেন। শেষরাত জুড়ে তার অস্থিরতা নজর এড়ায়নি বন্ধু বিমলেরও, ঢোলগোবিন্দ উঠে পড়তেই তিনিও উঠে পড়লেন।
কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে চা খেতে খেতে বিমলকে তাঁর ঠাকুরদার কথা জিজ্ঞাসা করতে বিমল তাঁকে নিয়ে গেলেন প্রায় চারশো বছর পুরানো একটি শিব মন্দিরে। ভাঙ্গাচোরা এই মন্দিরের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে বিমল বলতে লাগলেন তাঁর দাদুর গল্প,
"লৌকিক পুরাণমতে বেহুলা যখন লখিন্দরের শবদেহ ভেলায় নিয়ে ভাসতে ভাসতে এই জায়গায় এসে পৌঁছান, এখান থেকেই তিনি মহাদেবের কাছে যান তাঁর স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইতে, আর তাকে নিয়ে যান এই নেতিধোপানী, যিনি পদ্মাবতী বা মনসার সখী আর তাঁর নামেই এই জায়গার নামকরণ করা হয়েছিল। রাজা প্রতাপাদিত্য এই জায়গায় মন্দির বানিয়ে দেন আর লোকশ্রুতি আছে মন্দিরের ঈশান কোণে লুকিয়ে রেখেছিলেন বহুমূল্য সম্পদ। এই গুপ্তধনের কিংবদন্তীকে বিশ্বাস করে, অনেকেই সেই পথে পা বাড়িয়েছিলেন কিন্তু কেউই ফিরে আসেননি, তবুও সব জেনেও সেই সম্পদ উদ্ধার করার মনোবাঞ্ছা নিয়ে আমার দাদু একাই একটি লাঠি ও একটি কাটারি সম্বল করে পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। লোভে অন্ধ হয়ে নিশানলাঠি উপেক্ষা করে যেদিকে এগোচ্ছিলেন, সেই দিকেই ওঁত পেতেছিল সুন্দরবনের স্থলের রাজা।"
"নিশানলাঠি কী ভাই?"
"সুন্দরবন অঞ্চলের রীতি রে ঢোল। যেখান থেকে বাঘ এসে মানুষকে টেনে নিয়ে যায়, সেখানে একটি বাঁশের লাঠির ডগায় চাল ডাল আর একটি পয়সা বেঁধে রেখে পুঁতে রাখে স্থানীয় লোকেরা। এই নিশান দেখে সাবধান হতে বলা হয়, যে এখানে বাঘের আনাগোনা আছে। তিনি লক্ষ্যই করেননি সেসব। তাঁর মৃতদেহও আমরা পাইনি আর, কেবল রক্তমাখা পরনের ধুতিখানা পাওয়া গিয়েছিল বিস্তর খোঁজার পর, তাও ছেঁড়া।
তবে অনেকের মুখে শুনেছি আমাদের বাড়ির পেছনে জঙ্গলে থাকা বট-অশ্বত্থ গাছে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন মৃত্যুর পরে, অনেকে দেখাও পেয়েছে তাঁর, তোর মত, তবে আমরা পাইনি। আচ্ছা তুই টের পেলি না?
"না ভাই, তখন বাঘের ত্রাসে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়, অন্য কোনওদিকেই মন নেই তখন আমার। তবে এখন বুঝলাম, কেন তাঁর চড়া আলোয় দেখার অভ্যেস চলে গেছে।"
ঢোলগোবিন্দ টের পেলেন সকালবেলার এই গনগনে রোদ্দুরেও ভৌতিক সাক্ষাতের স্মৃতি উস্কে দিয়ে তাঁর গা ছমছম করছে। বিমল কথা বলতে বলতে ভাঙা মন্দিরের উঠোন ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেছেন লক্ষ্য করে তিনি পড়ি কি মরি ছুট লাগালেন সেদিকে, একা একা সুন্দরবন বেড়াবার সাহস তাঁর নেই আর। বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে দুপুরে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে হঠাৎ দেখলেন, ভেজানো দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন অচেনা এক বৃদ্ধ ব্যক্তি। এসে বিছানার এক পাশে বসে তাঁকে বললেন,
"বাবা ঢোল, লোভ করিস না বাবা আর। এই করেই আমার প্রাণটা গেল, গতকাল তোরটাও যেতে বসেছিল। আর শহরে থাকিস তুই, ফিরে একটু দেখিস যাতে এখানে বাঘগুলোকে মানুষের লোভের বলি হওয়া থেকে বাঁচাতে পারিস।"
"আ-আ-আপনি কে?"
"বিমলের ঠাকুরদা রে আমি।"
"কি-কি-কিন্তু দাদু, বাঘেই যে তোমার ঘাড় মটকে..."
"না বাছা, বাঘের হাতে প্রাণ যায়নি আমার, গুপ্তধনের লোভ করে এগোতে এগোতে টের পাইনি কখন দক্ষিণরায়ের জীব পিছু নিয়েছে আমার, তার হাত থেকে পালাতে পালাতে খাঁড়ির একেবারে প্রান্তসীমায় পৌঁছে গিয়েছিলাম সেদিন, টের পাইনি মা গঙ্গার বাহন হাঁ করে রোদ পোয়াচ্ছে, সে-ই টেনে নিয়ে জলে নেমে যায় আমায়। তবুও এই কথা বলছি, আমার মরণের কারণ আমার লোভ বাবা, বনের পশু নয়। এই লোভ করেই মানুষ একে একে সব উধাও করে দিয়েছে পৃথিবী থেকে, এখানেও বাঘ কমেছে, গাছপালা কমেছে। চোরাশিকারিরা কাউকেই রেয়াত করে না, বাঘ-কুমির-হরিণ সব প্রাণীই ওদের লোভের বলি। কিন্তু এইভাবে মারতে মারতে, সব উধাও হলে একদিন মানুষেরাও যে আর রক্ষা পাবে না বাবা! একটু দেখিস।"
বুক ধড়ফড় করে উঠে বসলেন ঢোলগোবিন্দ, না সত্যি নয়, স্বপ্ন ছিল তবে। গুপ্তধন খুঁজতে গিয়ে প্রাণ হারানো বিমলের দাদু স্বপ্নেই এসেছিলেন এবার। না, খুব শিক্ষা হয়েছে, আর হ্যাংলামো করবেন না কোনও বিষয়েই, আর অফিসের নাটকে সুন্দরবনের সংরক্ষণ নিয়ে এবার কিছু একটা করতেই হবে, ভূত যদি পরিবেশ সচেতন হতে পারে, তবে মানুষ হয়ে তিনি পারবেন না কেন!
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ