তুতুল আজ বিকেলে খেলতে যায়নি। আজ খুব মন খারাপ ওর। এমনিতে তুতুল খুশি খুশি থাকে সবসময়েই। সামনের একটা দাঁত বেশ কয়েকদিন আগে পড়ে যাওয়াতে ও ফোকলা হয়ে গেছে (মিন্নিদিদি বলেছে আর কোনোদিন দাঁত গজাবেনা কিন্তু ও বিশ্বাস করেনি), তা সেই ফোকলা দাঁতেই দিবারাত্র হেসে গড়িয়ে পড়ছে তুতুল। মা মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বকে দেয়, "সবসময় হ্যা হ্যা কোরোনা তুতুল, বোকা বলবে লোকে"। তা বলুক গে বোকা, বললেই কী হয়ে যায় নাকি! দাদাই বলেছে মনটাকে সর্বদা হাসিখুশি রাখতে হয়, তাহলে দুঃখরা কোনো ফাঁক গলে ভেতরে আসতে পারেনা। সব্বাইকে ভালবাসতে হয়; সে মানুষ হোক কী পশুপাখি। আর তুতুল তো দাদাইকে খুউব ভালবাসে, তাই তো সারাক্ষণ আনন্দে থাকতে চায় আর হাসিতে ভরিয়ে রাখে মুখ।
দাদাইকে ভালবাসলেও দাদাইয়ের সঙ্গে খুব বেশিসময় থাকা হয়না ওর। গরমের ছুটি আর শীতের ছুটিতে ওরা দাদাইয়ের বাড়ি আসে। পুজোতেও আসতে ইচ্ছে হয় কিন্তু পুজোর সময় মা-বাবা কেউ কলকাতা ছেড়ে এই আধা-শহর মুকুন্দপুরে আসতে চায়না। এখানেও তো পুজো হয়, তুতুল ছবি দেখেছে। কী সুন্দর সাদা রঙয়ের সাজে মা দুগ্গা আর ছেলেমেয়েরা। সবাই সাদা। দাদাই বলেছে মায়ের এইরকম সাজ-কে একধরণের ডাকের সাজ বলে। শোলা দিয়ে বানানো হয়। অনেক সময় চুমকি, রূপোলী জরি এসব-ও দেওয়া হয় শোলা'র ওপর ডিজাইন করতে। অনেক আগে, নাকি জার্মানি থেকে কলকাতা'র বড় বড় জমিদার বাড়িতে আসল রূপোর এই সাজ বানানোর সরঞ্জাম ডাকে আনানো হতো। সেই থেকে এই নাম। ডাকে আনানো হতো শুনে তুতুল প্রথমে না বুঝে বোকার মত বলে ফেলেছিল "মানে হাঁসের পিঠে করে আনতো?" সেই শুনে মিন্নিদিদি হেসেই খুন। আশ্চর্য তো! না বুঝতে পারলে জিজ্ঞেস করবেনা? কই, দাদাই তো হাসেনি। বুঝিয়ে দিয়েছিল যে "ডাক" মানে বাই পোস্ট।
সেসব যাক। এইবার শীতের ছুটি পড়ার আগেই ওরা এসেছে মুকুন্দপুরে। বাবা ওদের পৌঁছে দিয়ে কলকাতা ফিরে গেছে। এখান থেকে অফিস করা মুশকিল বলে। এসে থেকেই তুতুল দেখছে দাদাই বিছানায় শুয়ে থাকছে বেশীরভাগ সময়। মা বলেছে দাদাইকে বেশি ডিস্টার্ব না করতে কারণ দাদাইয়ের শরীরটা ঠিক নেই। অবাক হয়েছে তুতুল। এই গেলবার গরমের ছুটিতেও দাদাইকে আম গাছে উঠতে দেখেছে, সাইকেল নিয়ে কত্তদূর চলে যায় দাদাই জমি দেখাশোনা করতে, তরতরিয়ে পুকুরে সাঁতার কাটে, সেই দাদাইয়ের শরীর খারাপ! বিশ্বাস-ই হয়না। কিন্তু নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে নয়ত মা স্কুল অ্যাবসেন্ট করিয়ে ওকে নিয়ে চলে আসতোনা। তাও প্রতিদিন দুপুরে মা ঘুমালেই চুপি চুপি ও দাদাইয়ের ঘরে চলে যায়। দাদাই চোখ বন্ধ করেও ঠিক বুঝতে পারে যে তুতুল ঢুকেছে ঘরে। অমনি চোখ খুলে বলে" কে রে, তুতুয়া নাকি?"
তখন ছুট্টে তুতুল দাদাইয়ের খাটে উঠে যায়, আর দুজনে মিলে অনেক গল্প করে, জানালা দিয়ে গাছ দেখে, পাখি দেখে।
কিন্তু আজ গল্পের ফাঁকে মা কখন যে ঘরে ঢুকে পড়েছে ওরা দুজনে কেউ খেয়াল করেনি। মা ভীষণ রেগে গেছিল। বিচ্ছিরি গলা করে তুতুলকে বকলো আর দাদাইকে বলল "আপনি ঘুমের ওষুধটা না খেয়ে এইভাবে জেগে আছেন আর এই অবাধ্য ছেলেটার সঙ্গে বকবক করছেন। এরপর কিছু হ'লে তখন সবাই বলবে আমি কিছু খেয়াল রাখিনা!" এই বলে তুতুলের কান পেঁচিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল।
তাই তুতুলের আজ মন খারাপ।
মন খারাপ থাকলে তুতুল দাদাইয়ের বাগানে ঘুরে বেড়ায়। বিশাল বড় বাগান দাদাইয়ের আর কত্ত যে গাছ, দাদাই সব এখনও তুতুলকে চিনিয়ে উঠতে পারেনি। তবুও তুতুল যা গাছ, পাখি, পোকা দেখেছে আর চেনে, ওর ক্লাসে কেউ অত জানেনা। একদিন ক্লাসটিচার ম্যাম একটা কালো রঙের পাখি'র ছবি টাঙিয়ে ওদের ড্রয়িং করতে বলেছিল। ছবির তলায় সবাই লিখেছিল "ক্রো", শুধু তুতুল লিখেছিল "ড্রঙ্গো"। খুব অবাক হয়েছিলেন ম্যাম, তুতুল নামটা জানে দেখে। পেরেন্ট-টিচার মিটিং-এ তুতুলের খুব প্রশংসা-ও করেছিলেন। মা বলেছিল "উৎকর্ষ'স ফাদার হ্যাজ আ হিউজ অ্যানসেস্ট্র্যাল প্রপার্টি ইন আ রিমোট ভিলেজ। হি নোজ দিস থিংস ফ্রম হিজ গ্র্যান্ডপা হু স্টিল লিভস দেয়ার"।
এছাড়াও তুতুল আরো অনেক পাখি চেনে। সব দাদাই চিনিয়েছে। বাংলা-ইংলিশ দুটো নামই জানে ও। দাদাইয়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ও বেজি দেখেছে, কাঠবেড়ালি দেখেছে, শেয়াল এমনকি একবার শকুন-ও দেখেছিল। এমনিতে বাগানে ময়না, বুলবুলি, ফিঙে, বৌ-কথা-কও, বসন্তবৌরি, খঞ্জনা, টিয়া, কোকিল, টুনটুনি, হাঁড়িচাচা, চন্দনা, ঘুঘু এসব পাখি তো আসেই কিন্তু এবার একটা ছোট্ট নতুন পাখি দেখেছিল ও এসেই। একটা কমলা আর হালকা কালো পালকওয়ালা পাখি। পেটের দিকটা কমলা। সারাদিন খালি এ ডালে সে ডালে ঘুরে বেড়ায় একা একা। ওর বন্ধু নেই কেউ। একদিন দুপুরবেলা পাখিটা দাদাইয়ের জানালায় এসে বসতেই লাফিয়ে উঠেছিল তুতুল "এটার নাম কী, দাদাই?" দাদাই চোখ কুঁচকে খানিকক্ষণ দেখে বলেছিল "এ তো এখানকার পাখি নয়, দাদাভাই। এ অন্য জায়গা থেকে উড়ে এসেছে। শীতে এরা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব-মধ্য চীন থেকে ভারতে এলেও এদিকে আসেনা, এ হয়ত দলছুট হয়ে চলে এসেছে। এর নাম ব্ল্যাক রেডস্টার্ট বা লাল গির্দি"। সেই থেকে পাখিটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিল তুতুল। আহা, ও হয়ত হারিয়ে গেছে। ওর কেউ নেই এখানে। সব অন্যরকম পাখি। মনে মনে ওর নাম রেখেছিল লালু।
সেই লালু এখন একটা কুলগাছের ডালে বসে আছে। কুলগাছে এর মধ্যেই ফুল এসে গেছে। ছেয়ে আছে সব ডালে। তুতুল আঃ আঃ করে হাত বাড়িয়ে ডাকতে থাকে লালুকে। কিন্তু আসলো না কচু। উড়ে গিয়ে একটা পেয়ারা গাছের ডালে গিয়ে বসেছে। সাবধানে লতাঝোপ বাঁচিয়ে, বুনো ফুল না মাড়িয়ে তুতুল একটু এগোতেই চেনা গলার আওয়াজ কানে আসে। বাবা না? বাবা কখন এলো, কেউ বলেনি তো ওকে। এগোতে গিয়েও থমকে যায় তুতুল। বাবা'র সঙ্গে আরো দুজন ভদ্রলোক, একটু পেছনে মা'ও আছেন। বাবা'র কথাগুলো কানে আসছে। একজন ভদ্রলোককে বলছে "এই এত বড় প্রপার্টি মেন্টেন করা সম্ভব না আর আমাদের পক্ষে। কলকাতা থেকে এদিকে রোজ আসা তো আর যায়না। বাবা যতদিন সুস্থ ছিলেন, দেখাশোনা করেছেন। এখন উনিও বলতে গেলে শয্যাশায়ী। কলকাতায় নিতে হবে ভাল ট্রিট্মেন্টের জন্য। তাই আমরা পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেল আউট করে দেবো।" ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, "আমাদের তো খুব-ই পছন্দ হয়েছে। প্রাইস-ও যা বলছেন, ভ্যালুয়েশন অনুযায়ী ঠিক আছে। তাহলে উই ক্যান সীল দ্য ডিল"।
আর এক পা-ও নড়তে পারেনা তুতুল। ছোট হলেও ও বুঝেছে এই এত বড় বাগান, বাড়ি সব বিক্রি করে দেওয়ার কথা হচ্ছে। আর ও শীতের সকালে শিশিরভেজা বাগানে ঘুরতে পারবেনা। গরমের দুপুরে কাঁচা আম-মাখার বাটি নিয়ে আম গাছের-ই গুঁড়িতে হেলান দিয়ে হ্যারি পটার পড়তে পারবেনা! টপ্টপ্ করে নিজের অজান্তেই চোখ থেকে জল পড়তে থাকে তুতুলের।
ওদিকে ভদ্রলোক তখনও বলে চলেছেন "এসব জায়গা কয়েক বছর বাদে কিন্তু ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে যাবে মিস্টার মিত্র। আমরা তাই সেভাবেই এগোবো। আমার কোম্পানি এই বাগানের বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলবে। স্ট্র্যাটেজিক্যালি নতুন গাছ লাগানো-ও হবে। কিন্তু এতসব বড় বড় গাছ আমরা রাখবোনা। এতে আপনাদের আপত্তি নেই তো?" এবার মা হেসে বললেন "আপনাদের প্রপার্টি হ'লে, আপনারা কী করবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার। আমাদের আপত্তির কী আছে?"
হঠাৎ একটা কান্নাভেজা কচি গলা বলে ওঠে "একটাও গাছ কাটবেনা তোমরা। আমি সব দাদাইকে বলবো। দাদাই বলেছে গাছেদের প্রাণ আছে"।
বাবা কঠিন চোখে তুতুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মা ওর হাত ধরে যখন টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তখনও তুতুল চেঁচিয়েই যাচ্ছে।
বেশ কয়েকদিন পর আজ তুতুল দাদাইয়ের ঘরে ঢোকার পারমিশন পেয়েছে সকালে। গতকাল থেকে কীসব যন্ত্রপাতি এসেছে বাড়িতে আর কয়েকজন লোক। সেই দুজন ভদ্রলোক-ও এসে রয়েছেন। আজ থেকে নাকি গাছ কাটা শুরু হবে। দাদাইয়ের ঘরে ঢুকতেই দাদাই হেসে বললো "এসো দাদুভাই" । হাসিটা যেন কেমন। কিছুক্ষণ আগে থেকে একটা খড়রখড়র শব্দ শুরু হয়েছে, তীব্র, কর্কশ। দাদাই বলল "ওরা গাছ কাটা শুরু করে দিয়েছে"।
কান চেপে ধরলেও শব্দটা সরে যাচ্ছেনা। আর শোনা যাচ্ছে অসংখ্য পাখির ডাক। দাদাই কেমন অদ্ভুত স্বরে আবার বলে ওঠে "ওদের ঘর ভেঙে যাচ্ছে, তুতুয়া, বাসা থাকছেনা আর। এবার ওদের চলে যাওয়ার পালা"।
লালুকে এই ক'দিনে একবার-ও দেখেনি, হঠাৎ খেয়াল হয় তুতুলের। গেল কোথায়!
দাদু যেন ওর মনের কথা আন্দাজ করেই বলে "ওরা পরিযায়ী পাখি। ও উড়ে চলে গেছে যেখানে ওর ভাল লাগে। অন্য কোথাও। সবাইকেই একদিন যেতে হয়, দাদুভাই। তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছো আমি জানি। তুমি গাছ ভালবাসতে, পাখি ভালবাসতে। তোমার এই ভালবাসা যেন কোনোদিন হারিয়ে না যায়। যত্ন করে রেখে দিও। যখন তুমি বড় হবে, তখন যেন তোমার এই ভালবাসা-ও অনেক বড় হয়ে চারদিকে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে।" এইটুকু বলেই যেন হাঁপিয়ে যায় দাদাই। "ক্লান্তভাবে বলে "তুমি এখন যাও, দাদুভাই। আমি একটু ঘুমোবো"।
মা চেঁচাবে আবার, তুতুল জানে। হয়ত ফেলেও দিতে পারে। তাও তুতুল একটা বড় ভাঙা পোর্সিলিনের বাটিতে আমের আঁটিটা পুঁতে দেয়। আজকাল ও যেখানে ভাঙাচোরা বাটি, মাটির ভাঁড়, যা পায়, সব কিছুর মধ্যে পাশের মাঠ থেকে মাটি ভরে নিয়ে আসে আর যা ইচ্ছে হয় পুঁতে দেয়। জল-ও দেয় রোজ। মা অনেকগুলো ফেলে দিয়েছে ফ্ল্যাট নোংরা হচ্ছে বলে। তাও ও করে।
একদিন ডালপালা মেলবে ঠিক ওর ভালবাসা, ও জানে। দাদাই বলেছিল।
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ