ছোটবেলা থেকেই ভবঘুরে পোকাটা মাথায় বাসা বেঁধেছিলো তবে কি করে কোথা থেকে এসে আমার মাথায় বাসা বাঁধলো সেটা বলতে পারবো না। মাঝে মাঝেই স্কুলের বইপত্র নিয়ে বেরিয়ে আর স্কুলে পৌঁছানো হতো না – রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম শহরটাকে চেনার জন্য, নানা ধরনের মানুষকে দেখার জন্য। নতুন বা একটু অদ্ভুত ধরনের কিছু দেখলে দাঁড়িয়ে পড়তাম জিনিসটা দেখার জন্য, জানার জন্য। এই ভাবেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকলাম এবং গ্র্যাজুয়েসনের পর কলকাতাতেই একটা ছোট খাটো চাকরিও পেয়ে গেলাম। এতদিন পড়াশুনার চাপে ওই ভবঘুরে পোকাটাকে দাবিয়ে রেখেছিলাম – চাকরি পাওয়ার পর ওটা যেন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নড়ে চড়ে বসলো। দিন দুয়েকের ছুটি পেলেই ঘাড়ে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তাম অজানা গ্রাম গঞ্জের সন্ধানে। ভোর বেলাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যেতাম হাওড়া কিংবা শিয়ালদহ স্টেশনে তবে কোথায় যাবো সে সম্বন্ধে কোন রকম ভাবনাই ছিলো না। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা দূরপাল্লার প্যাসেঞ্জার ট্রেনে কোন একটা দূরের স্টেশনের টিকেট কেটে উঠে পড়তাম। যাত্রীদের সাথে গল্প টল্প করে সময়টা ভালোই কাটতো। তারপর যে স্টেশন দেখে হঠাৎই ভালো লেগে যেতো ওখানেই নেমে পড়তাম। সারাদিন ওই এলাকাতে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে দুপুরে কোন একটা পাইস হোটেলে পেট পূজার জন্য পাতলা জলের মত ডাল আর দু চারটে আলু ভাজার সাথে লাল চালের ভাত। সন্ধ্যের দিকে কোন ছোট খাটো হোটেলে রাতটা কাটিয়ে দিতাম আর হোটেল না থাকলে কোন দোকানের বারান্দাতে দোকানদারের অনুমতি নিয়ে শুয়ে পড়তাম। এই ভাবে পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার অনেক গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছি – দেখেছি সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা, নানা ধরনের মানুষের অদ্ভুত সব চরিত্র ও বিশ্বাস।
সেদিনও এমনি বেরিয়ে পড়েছিলাম শিয়ালদহ স্টেশন থেকে পশ্চিমে যাবার একটা ট্রেনে। বিকেলের দিকে ছোট একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতে চোখ একেবারে জুড়িয়ে গেলো – ট্রেন লাইনের দু দিকে যত দূর চোখে পড়ে শুধু সূর্যমুখী আর সরষের চাষ। সমস্ত গাছে ফুল ফুটে দূর দিগন্ত অবধি চলেছে হলুদ রঙের খেলা আর হাওয়াতে চারদিকে হলুদ রঙের ঢেউ বয়ে চলেছে। সূর্যমুখী ফুলগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে যেন খুবই গল্পে ব্যস্ত। স্টেশনের নামটাও বড় সুন্দর – গোধুলি। ব্যস, কোন কিছু না ভেবেই ট্রেন ছাড়ার হুঁইসেলের সাথে সাথেই লাফিয়ে প্লেটফর্মে নেমে পড়লাম আর ট্রেনটা হেলে দুলে বেরিয়ে গেলো তার বহু দুরের গন্তব্য স্থানের দিকে। পুরো প্ল্যাটফর্ম লাল মোরামে ঢাকা – একেবারে খোলা মেলা। স্টেশন বলতে লাল রঙ করা দুটো ছোট ইটের ঘর। দেখি স্টেশনে আমিই একমাত্র যাত্রী নেমেছি, পুরো প্ল্যাটফর্ম একেবারে ফাঁকা ধুধু করছে শুধু অফিস ঘরের সামনে স্টেশন মাস্টার একটা সবুজ ফ্ল্যাগ হাতে নিয়ে এবং আর একজন লোক হাঁটু অবধি ধুতি আর রেলের লাল সার্ট পরে দাঁড়িয়ে। চারদিকে যত দূর চোখ যায় শুধু হলুদের খেলা – কোন জন বসতি নজরে এলো না। এবার একটু দমে গেলাম – রাতটা কোথায় কাটাবো? ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম অফিসের দিকে – ওরাই একমাত্র ভরসা। দেখি স্টেশন মাস্টার ও সঙ্গের লোকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে যেতে স্টেশন মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন,
"আপনি কোথায় যাবেন?"
"এখানে রাত্রে থাকার কোন হোটেল আছে?"
ওরা অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। স্টেশন মাস্টারই আস্তে আস্তে উত্তর দিলেন,
"সাব, এখানে সব থেকে কাছের গাঁও চার মাইল দূরে – ওখানে একটা চায়ের দোকান আছে আর হোটেলের জন্য কুড়ি মাইল দূরের টাউনে যেতে হবে। তা আপনি কি টাউন থেকে কোন গাড়ি আসতে বলেছেন?"
আমি মাথা নাড়লাম,
"এই গোধুলি জায়গাটা ভালো লাগলো বলে নেমে পড়েছি – আর কিছুই জানি না।"
ওরা দুজন এমন ভাবে তাকালো যেন কোন বদ্ধ পাগলই এই ধরনের কাজ করতে পারে। স্টেশন মাস্টার উত্তর দিলেন,
"এই স্টেশনটা বছর দশেক আগে কোন মিনিস্টার সাব বানিয়েছিলেন ওই টাউনে ওর শ্বশুরালয় বলে – দিনে আপ ডাউনে একটাই ট্রেন দাঁড়ায় আধ মিনিটের জন্য। গত এক সপ্তাহে আপনি প্রথম প্যাসেঞ্জার এখানে নামলেন। আমরা দুজন গত জন্মে বোধহয় অনেক পাপ করেছিলাম বলেই প্রায়শ্চিত্তের জন্য এই স্টেশনে পোস্টিং পেয়েছি। আপনার ফেরার ট্রেন কাল সকাল সাতটার সময়। তার আগে কিছু করার নেই তবে কুড়ি মাইল হাঁটতে পারলে টাউনে যেতে পারবেন। এখানে গরুর গাড়িও পাবেন না।"
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো – রাত কাটাবো কোথায়? খাবো কি? টাউনে যাবার জন্য কুড়ি মাইল হাঁটা তো অসম্ভব। এ রকম ঝামেলাতে আগে কখনও পড়ি নি। স্টেশন মাস্টার লোকটা বেশ ভালোই – আমার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজে থেকেই বললেন,
"অফিসের পাশের ঘরটা খুলে দিচ্ছি – রাতটা ওখানে কাটিয়ে দিতে পারেন। রাত্রে বাইরে থাকা একেবারেই উচিত নয় – এখানে প্রচুর শেয়াল আছে আর মাঝে মাঝে ছোট বাঘও চলে আসে। রাত্রের খানার জন্য না হয় আমাদের অতিথি হয়ে যান – আমরা যা খাই তাই খাবেন। আমার নাম ভুবন চন্দ্র দাস আর এ হলো বৈজু।"
বৈজুর মনে হলো ওই ঘর সম্বন্ধে একটু আপত্তি আছে,
"লেকিন সাব, ও ঘর ম্যা - -"
বলতে গিয়েও স্টেশন মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বাকি কথাগুলো যেন গিলে নিলো।
'আপনাদের সাহায্য ভুলবো না – কোন কিছু না জেনেই এখানে নেমে সত্যিই খুব অসুবিধাতে পড়ে গিয়েছি। আমি না হয় ঘন্টা খানেক এদিক ওদিক একটু ঘুরে আসছি।"
বৈজু সাবধান করে দিলো,
"সাব আন্ধেরা হোনে কা পহেলেই ইধার আ যাইয়ে নেহি তো হামলোগ দরওয়াজা নেহি খুলেঙ্গে।"
আমি মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলাম। স্টেশন পেরিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা – কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে হয়তো বা পিচ হয়েছিলো। দু একটা পাথরের টুকরো দেখে তাই মনে হলো তবে বর্ষা কালে গরুর গাড়ি চলার ফলে একেবারে খানা খন্দে ভরা। নজর করে না হাঁটলে পা মচকাবার সমূহ সম্ভাবনা। রাস্তার এক দিকে সূর্যমুখী ও অন্য দিকে সরষের চাষ। চারদিকে শুধু হলুদ ফুলের ছড়াছড়ি – দূর থেকে দেখতে খুবই ভালো লাগে তবে কাছে থেকে বড্ড এক ঘেয়ে হয়ে যায়। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই শুধু হলুদ ফুল দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে স্টেশনে ফিরে এলাম। ভুবনবাবুর অফিস ও থাকার ঘর একটাই। দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা টেবিল ও একটা হাতল ছাড়া চেয়ার। টেবিলে একটা টেলিগ্রাফের যন্ত্র, কিছু কাগজ পত্র ইত্যাদি গুছিয়ে রাখা আছে আর দেওয়ালের দিকে একটা চওড়া কাঠের বেঞ্চি। অবশ্য ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম আছে। পেছন দিকে চারপাইতে ভুবনবাবুর বিছানা চারপাইএর উপর এক ধারে গোটানো আর পাশে মাটিতে তোলা উনুনে রান্নার ব্যবস্থা – বৈজু বোধহয় বেঞ্চেই ঘুমায়। বেঞ্চে বসে ভুবনবাবুর সাথে টুকটাক কথা বার্তা হচ্ছিলো। পাশের ঘরটা খালি পড়ে ছিলো বলে যাত্রীদের বিশ্রাম ঘর নাম দিয়ে রেলের পুরাতন জিনিসের গুদাম থেকে একটা ইজিচেয়ার ও বেঞ্চ আনিয়েছিলেন কিছুদিন আগে। এখানে ইলেকট্রিসিটি নেই তাই হ্যারিকেনেই কাজ চালাতে হয়। সন্ধ্যের মুখে বৈজু তোলা উনুনটা প্ল্যাটফর্মে নিয়ে কয়লার আগুন ধরিয়ে এনে হাতে গড়া মোটা মোটা আটার রুটি বানাতে বসলো। সাতটার আগেই আমরা খেতে বসে গেলাম। রুটির সাথে পেঁয়াজ ও চালতার আচার – প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছিলো তাই এই খাবারই অমৃত মনে হলো। খাওয়া দাওয়ার পর বৈজু আর একটা হ্যারিকেন বের করে জ্বালাতে ভুবনবাবু বললেন,
"রাত্রে বাইরে একেবারেই বেরুবেন না – এখানে শেয়ালের ভীষণ উপদ্রব তবে ভয় পাবার কিছু নেই। আমরা তো বছর দুয়েক কাটিয়ে দিলাম।"
বৈজু হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে বললো,
"চলিয়ে সাব, আপকো বাজুকা ঘর ম্যে ছোড় কে আতে।"
অফিস ঘরের দরজায় ভুবনবাবু হ্যারিকেন হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন বৈজুর ফেরার জন্য। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার – কাছে বা দূরে কোথাও কোন আলোর বিন্দু মাত্র নেই – রীতিমত গা ছমছম করার মত ব্যাপার। আকাশে চাঁদেরও দেখা নেই আর যে রকম ঘন কালো আলকাতরার মত অন্ধকার তাতে মনে হয় আজ অমাবস্যা। বৈজুকে জিজ্ঞেস করতে আস্তে করে মাথা নাড়লো। বৈজু পাশের ঘরের তালা খুললে ভেতরে এসে দেখলাম ঘরের মাঝখানে খুব সুন্দর কাজ করা পুরাতন কালের সেগুন কাঠের বিরাট একটা আরাম কেদারা যার বসার জায়গাটা বেতের ডিজাইন করে বোনা আর হাতল দুটো বেশ লম্বা যাতে পা তুলে আরাম করে শোয়া যায় – দেখলেই শুয়ে পড়ার লোভ লাগে। ঘরের এক পাশে পুরাতন কালের ঢালাই লোহার লতা পাতার ডিজাইন করা ফ্রেমের বেশ লম্বা চওড়া একটা বেঞ্চ যার উপর শাল কাঠের মোটা মোটা তক্তা দিয়ে বসার জায়গা।
আমাকে পৌঁছে দিয়ে বৈজু বলে গেলো,
"সাব দরওয়াজা লোহে কা রড সে আচ্ছা সে বন্ধ কিজিয়ে – বাহার কুছ ভি হো, সুবে হোনেকা পহেলে দরওয়াজা মৎ খুলিয়ে আর বাত্তি মৎ বুজাইয়ে গা।"
বৈজু বেরিয়ে যেতে দেখলাম দরজার ছিটকিনি খুব একটা সুবিধের নয় তাই বৈজুর কথা মত লোহার রড দিয়ে বেশ চেপেই দরজাটা বন্ধ করলাম। মোটা শাল কাঠের তৈরি দরজা তাই মনে হলো ভয়ের কিছু নেই – এটাকে সহজে ভাঙা যাবে না। ঘরের সাথেই লাগোয়া বাথরুমে আরাম করে হাত মুখ ধুয়ে হ্যারিকেনের আলোটা কমিয়ে এসে বেঞ্চে বসলাম। আমার এত বছরের ভবঘুরে জীবনে আজকের অভিজ্ঞতা একেবারে অন্য ধরনের। এভাবে হঠাৎ এই স্টেশনে নেমে যে বিরাট বোকামি করেছি তার জন্য নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিলো। ভাগ্যিস ভুবনবাবু রাত্রের খাওয়া ও মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন না হলে চরম বিপদে পড়তে হতো। চারদিক অসম্ভব রকম চুপচাপ – নিজের নিশ্বাসের আওয়াজও যেন শুনতে পাচ্ছি। প্রায় একটানা ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে – মাঝে মাঝে কোন পাখি ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটে ডেকে উঠছে। পেছনের গাছে বোধহয় পেঁচার বাসা – থেকে থেকেই ডাকছে সঙ্গিনীকে। পেঁচার ডাক আগেও শুনেছি তবে এই নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই ডাক একটু ভয় ধরিয়ে দেয়। হঠাৎ মনে হলো কোথায় একটা কচি বাচ্চা কেঁদে উঠলো আর সেই আওয়াজে সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো। এখানে বাচ্চা আসবে কোথা থেকে তারপর নিজের মনেই হাসলাম – গভীর রাত্রে হঠাৎ শকুনের বাচ্চার ডাক শুনলে এই রকমই মনে হয়। একটু ঘুমের ভাব আসতে বেঞ্চি থেকে উঠে আরাম কেদারাতে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখের পাতা লেগেছে কি লাগে নি মনে হলো প্ল্যাটফর্মে কিছু জন্তু এদিক থেকে ওদিক দৌড়াতে শুরু করেছে তার মানে শেয়ালের দল প্ল্যাটফর্মে খেলাধূলা করতে এসে গিয়েছে। একটু পরেই দরজাতে নখের আঁচড়ের আওয়াজ – বুঝলাম এই জন্যই বৈজু বলেছিলো দরজাটা লোহার রড দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে রাখতে। একটু ভয় ভয় করলেও ঘুমাবার চেষ্টা করলাম – মোটা শাল কাঠের দরজা লোহার রড দিয়ে চেপে বন্ধ করা অতএব শেয়ালের সাধ্য নেই এটা ভাঙ্গে। দরজার ওপাশে তিন চারটে শেয়াল বোধ হয় দরজা ঠেলে ঢুকতে না পেরে হঠাৎই এক সাথে ডাকতে শুরু করলো। আগেও গ্রামে গঞ্জে অনেক শেয়ালের ডাক শুনেছি তবে এত কাছে থেকে কখনোই নয় তাই বেশ চমকে উঠে ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে তাকালাম – শেয়ালের দলের হাত থেকে বাঁচার ওটাই তো একমাত্র প্রতিরোধ। বেশ কিছু সময় ধরে প্ল্যাটফর্মে শেয়ালদের হুটোপাটি আর ডাকাডাকি চললো আর আমার চোখও আস্তে আস্তে ঘুমে বন্ধ হয়ে এলো। হঠাৎ ভীষণ চমকে আরাম কেদারাতে সোজা হয়ে বসলাম – শেয়ালগুলো কেমন একটা অদ্ভুত গলাতে ডাকছে অনেকটা কুকুরের কান্নার মত তবে অনেক বেশি জোরালো যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। নিস্তব্দ রাত্রে শেয়ালের সেই ডাকে মনে হলো শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা জলের স্রোত বয়ে গেলো – ভয়ে বুকের মধ্যে কেমন গুড় গুড় করে উঠলো। আমি আরাম কেদারার হাতল দুটো জোরে চেপে বসে আছি। বার কয়েক এই ভাবে ডাকার পর শেয়ালগুলো হুড়মুড় করে প্রাণপনে দৌড়ে পালালো যেন কেউ ওদের তাড়া করেছে – ছোট বাঘ নয়তো? না হলে শেয়ালগুলো এত ভয় পেয়ে দুড়দাড় করে পালিয়ে গেলো কেন? চার দিক একেবারে নিস্তব্দ এমন কি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মিনিট খানেক পর মনে হলো প্ল্যাটফর্মের ওপাশ থেকে কে যেন মিলিটারি বুট পরে মার্চ করে এগিয়ে আসছে। আওয়াজটা প্রথমে খুব আস্তে হলেও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো তারপর আমার ঘরের সামনা দিয়ে প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকে চলে গেলো তারপর প্ল্যাটফর্মের ও মাথায় থেকে আবার এদিকে ফিরে আসতে লাগলো। এবার আমার সত্যিই ভয় ধরে গিয়েছে – একেবারে অজানা অচেনা জায়গা। চারদিকে শুধু সূর্যমুখী আর সরষের ক্ষেত – কোন লোক বসতি নেই। পাশের ঘরে দরজা বন্ধ করে স্টেশন মাস্টার আর বৈজু – হাজার চেঁচালেও ওরা দরজা খুলবে না। তাহলে? চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই – আমি প্রায় কাঠ হয়ে আরাম কেদারার হাতল দুটো গায়ের জোরে শক্ত করে চেপে ধরে সোজা হয়ে বসে আছি। জুতোর আওয়াজটা এবার হঠাৎই আমার ঘরের দরজার সামনে এসে থেমে গেলো তারপর দরজায় কেমন একটা খস্ খস্ আওয়াজ যেন কেউ দরজার উপর হাত বোলাচ্ছে। বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ আওয়াজটা এখন ঢাকের আওয়াজের মত শোনাচ্ছে। হার্ট প্রচণ্ড জোরে দৌড়াচ্ছে যেন এক্ষুনি ফেটে যাবে শুধু কান দুটো ভীষণ সতর্ক হয়ে গিয়েছে বিন্দু মাত্র শব্দের তারতম্য ধরার জন্য। এবার দরজা ঠেলার একটা ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ – হ্যারিকেনের এক চিলতে আলোতে মনে হলো বাইরের চাপে দরজার পাল্লা দুটো যেন লোহার রডের উপর চেপে বসেছে। দম বন্ধ হয়ে এলো – কত সময় ওই রড দরজাটাকে আটকে রাখতে পারবে? তারপর? আমার পুরো নজর ও মনোযোগ এখন ওই দরজার দিকে যেন দরজাটা ভেঙ্গে পড়ার অপেক্ষাতে বসে আছি। বিদেশ বিভূঁইতে অপঘাতে মারা পড়তে হবে – বাড়িতে খবর অবধি পৌঁছাবে না। ভয়ে হাত পা ভীষণ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে থরথর করে কাঁপছে, দাঁতে দাঁতে ঠকঠকানি সামলাতে পারছি না, গা পিঠ দিয়ে ঠাণ্ডা ঘাম ঝরে পরছে। হঠাৎ দুই হাতে গোটা ছয় সাত করে কামড় খেয়ে চমকে উঠলাম – কি সে কামড়ালো? বিছে টিছে নয়তো? এই ক্ষেত খামারের জায়গাতে এদের থাকা খুবই স্বাভাবিক। দরজার কথা ক্ষণিকের জন্য ভুলে হাত বাড়িয়ে হ্যারিকেনের আলোটা উসকে দিয়ে হ্যারিকেনটা উঁচু করে তুলে ধরে দেখি, বাপ রে বাপ, আরাম কেদারার নানা ফুটো থেকে হাজারে হাজারে ছারপোকা বেরিয়ে আমাকে আক্রমণ করেছে আর এই বুভুক্ষু ছারপোকাদের কামড়ে দুটো হাত ইতি মধ্যেই ফুলে গিয়ে নিদারুণ চুলকাতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ভালো করে জামা কাপড় ঝাড়তে গিয়ে দরজার কথা মনে পড়লো – তাকিয়ে দেখি দরজার তলা দিয়ে কেমন যেন ধোঁয়ার মত কিছু আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকছে। বাইরে তো কুয়াসা নেই বা এই সময় কুয়াসা হওয়ারও কথা নয় – তাহলে?? কোন রকমের ভূত জাতীয় ব্যাপার নয়তো!!!
আরাম কেদারার সামনে আর দাঁড়াতে সাহস হলো না, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হ্যারিকেনটা বেঞ্চের সামনে রেখে বেঞ্চের উপর উঠে বসে চোখ বুঁজে হাত পা প্রায় কোলে তুলে নিলাম। ছোটবেলায় দিদার কাছে শুনেছিলাম লোহার জিনিসে বসলে ভূত কিছু করতে পারে না – দাঁতের ঠক ঠকানি বেড়েই চলেছে। একটু পরে চিলতে চোখ খুলে দেখি দরজার ঠিক ভেতরেই ধোঁয়া জমা হয়ে একটা স্তুপের মত তৈরি হচ্ছে আর সেই স্তুপটা যেন একটা টুপি পরা ধোঁয়া মানুষের চেহারা নিচ্ছে। আর কত সময় বেঁচে থাকবো জানি না – ভয়ে জিভ শুকিয়ে টাকরাতে আটকে গিয়েছে তবে চোখ জোড়া কেমন যেন বড় বড় হয়ে ওই ধোঁয়া মানুষের দিকে কোন এক অদ্ভুত চৌম্বক শক্তিতে আটকে গিয়েছে। চোখ কিছুতেই ফেরাতে বা বন্ধ করতে পারছি না, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে ফলে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। সময় যেন দাঁড়িয়ে গিয়েছে আর আমি অপেক্ষা করে আছি কখন ধোঁয়া মানুষটা আমার দিকে আসবে। ধীরে ধীরে ধোঁয়া মানুষটার চেহারা সম্পূর্ণ হতে দরজার কাছ থেকে আরাম কেদারার দিকে এগিয়ে গেলো যেখানে মিনিট কয়েক আগেও আমি বসে ছিলাম। তারপর খুব আয়েস করে ওই আরাম কেদারাতে বসলো তখন দেখতে পেলাম ধোঁয়া মানুষটা হ্যাট কোট পরা এক সাহেব। মুখে আবার একটা ধোঁয়া ওঠা পাইপ ঝুলছে। আরাম কেদারায় বসে দুটো মিলিটারি বুট পরা পা তুলে দিলো দু পাশের হাতলের উপরে যেন সন্ধ্যেবেলা বারান্দাতে আরাম করে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করছে। কত সময় ধরে ধোঁয়া সাহেব ওই আরাম কেদারাতে বসে ছিলো জানি না – ঘরে তো সময় স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমি কোন রকম নড়া চড়া না করে বিস্ফোরিত চোখে ওই দিকে তাকিয়ে আছি। হাতে পায়ে খিল ধরে ঝিন ঝিন করতে শুরু করেছে আর সেই সাথে অসহ্য ব্যথা। আমার শরীরটা যেন স্ট্যাচুর মত হয়ে গিয়েছে – নড়া চড়া করার নিজস্ব ক্ষমতা টুকুও নেই। এক সময় যেন আদি অন্ত কাল পরে ধোঁয়া সাহেব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে আগের মত ধোঁয়া হয়ে দরজার তলা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। একটু পরে শুনতে পেলাম ওর বুটের আওয়াজ প্ল্যাটফর্মের লাল মোরামের উপর ঠক ঠক আওয়াজ তুলে প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিকে হারিয়ে গেলো।
ওই ভাবে বসে বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না হঠাৎ বৈজুর ডাকা ডাকিতে ঘুম ভাঙ্গলো,
"সাব, সাব, উঠিয়ে – সুবা হো গয়ি – দরওয়াজা খুলিয়ে।"
দেখি দরজার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে ঘরে পড়েছে – চারদিকে পাখিরা খুব কিচির মিচির করছে। একই ভাবে বসে বসে হাত পা একেবারে জমে গিয়েছে – দাঁড়াতেই পারছি না। অনেক কষ্টে দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়িয়ে একটু সময় অপেক্ষা করলাম পায়ের রক্ত চলাচল ঠিক হওয়ার জন্য তারপর টলতে টলতে দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় আরাম কেদারাটাকে দেখে গত রাত্রের ঘটনা মনে হতেই শিউরে উঠলাম। ভাগ্যিস ছারপোকার কামড় খেয়ে ওখান থেকে পালিয়ে বেঞ্চে এসে বসেছিলাম না হলে ধোঁয়া মানুষটা কী করতো? ভাবতেই প্রচণ্ড ভয়ে মনে হলো পায়ের আর দাঁড়িয়ে থাকার মত জোর নেই। আবার বৈজু দরজায় ধাক্কা দিতে খেয়াল হলো, কোন রকমে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতে বৈজু বললো,
"সাব, আপকা টেরেইন আ রহি হ্যায় –হাম সিগন্যাল দে দিয়া।"
বাইরে বেরিয়ে দেখি স্টেশন মাস্টার ভুবনবাবু লাল আর সবুজ ফ্ল্যাগ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। ওকে নমস্কার করে অনেক ধন্যবাদ দিলাম গত রাত্রের আতিথেয়তার জন্য।
ভুবনবাবু হেসে বললেন,
"এটা তো খুবই সামান্য ব্যাপার –আপনি না জেনে এখানে নেমে বিপদে পড়েছিলেন তাই এই টুকুনি তো করতেই হয়। ট্রেন মিনিট খানেকের মধ্যে প্ল্যাটফর্মে ঢুকবে। আপনি বৈজুর সাথে এগিয়ে যান –ওই আপনাকে ট্রেনে তুলে দেবে। নমস্কার।"
বৈজু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো, ওর সাথে এগিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম,
"আচ্ছা বৈজু, ও ইজিচেয়ার আপ কিধার সে লায়ে?"
"সাব, ও তো হাম রেলকা পুরানা সামানকা লিয়ে যো গোডাউন হ্যায় উধার সে উঠাকে লায়া। শো সাল সে ভি পুরানা চেয়ার হ্যায় লেকিন আভি ভি একদম নয়া মালুম হোতা। শুনা রেল কা কৈ বিরিটিস অফসার কা বহুত প্যার কা চিজ থা।"
এর মধ্যে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
বিদায় গোধুলি।
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ