সেগুনবনি নামে একটি ছোট্ট জনপদে বদলি হয়ে এসেছি। প্রথমদিনেই বুঝলাম এই অফিস আর পাঁচটা অফিসের মতো নয়। এখানে সব কিছুই অদ্ভুত। মানুষগুলোও তথৈবচ। বড়বাবুর মাথাজোড়া টাক, শুঁয়োপোকার মতো মোটা ভ্রু, রাশভারী চশমা। এক টিপ নস্যি দিয়ে আমার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, "অ, আপনিই আমাদের নতুন অফিসার? আপনি তো দেখছি সেদিনের ছেলে! আমি অবশ্য আজকের লোক নই। এই অফিসবাড়িতে আমি যখন ঢুকেছিলাম তখন সদ্য ব্রিটিশ আমল শেষ হয়েছে। তখন আপনি জন্মাননি।"
আমি মনে মনে বড়বাবুর বয়স অঙ্ক কষে দেখছিলাম। থই পাচ্ছিলাম না। ওদিকে দেখি এক প্রৌঢ়া মহিলা থান ইট সাইজের বই পড়ছেন। মলাটে লেখা আছে ‘মহাভারত’। তাঁর টেবিলের এক কোণে রাখা একটা মান্ধাতা আমলের টাইপরাইটার। দুটো জিনিস বুঝলাম। এক, এই অফিসে কম্পিউটার আসেনি এখনও। আর দুই, উনিই এই অফিসের টাইপিস্ট। সেই দিদির পাশের টেবিলের ওপারে দুই প্রৌঢ় বাবু হয়ে বসে আছেন। দুজন যেন সত্যজিতের ছবির সেই দুই শতরঞ্জ কি খিলাড়ি। টেবিলের ওপারে বসে দাবা খেলায় তাঁরা এতটাই মগ্ন যে এদিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না।
বড়বাবু আরও এক টিপ নস্যি নিয়ে গলাটা একটু তুলে ডাকলেন,
"চারুবাবু একটু এদিকে আসুন তো!"
ধুতিপাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন আলমারির আড়াল থেকে। ঠোঁটের উপর লাল মাছির মতো গোঁফ।
বড়বাবু বললেন,
"চারুবাবু আমাদের ক্যাশিয়ার। উনি বায়োকেমিক চিকিৎসাও করেন। আমাশা থেকে সান্নিপাতিক, আধকপালি থেকে ফিট ব্যামো যে কোনও অসুখবিসুখে ওঁর ওষুধ ধন্বন্তরির মতো কাজ করে। তবে একটা সমস্যা আছে। অন্যের অসুখে ওষুধ অব্যর্থ হলেও নিজের চিকিৎসায় তাঁর ওষুধ কাজ করে না। চারুবাবু বছরে দু’বার নিয়ম করে ম্যালেরিয়া হয়। তখন মাসখানেক ওঁকে অফিস কামাই করতে হয়।"
চারুবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন তটস্থ হয়ে। বড়বাবু বললেন,
"উনি আমাদের নতুন অফিসার। যান, ওঁকে ওঁর চেম্বারে নিয়ে যান।"
চেম্বারে যে এমন হতে পারে সেটা আমার ধারণা ছিল না। রংচটা সারি সারি আলমারি দিয়ে দেওয়াল ঢাকা রাখা। ঘন সবুজ রেক্সিনে ঢাকা কাঠের টেবিলের প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। চেয়ারের একটা পা আধভাঙ্গা। সাবধানে ব্যালান্স রেখে রেখে বসতে হয়। দেওয়ালে পলেস্তারা খসে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। সিলিং ফ্যানটা কাৎ হয়ে আছে একদিকে। ঘটাং ঘটাং শব্দ করে চলে। প্রতি মুহূর্তে ভয় হয় এই বুঝি খসে পড়ল মাথার ওপর।
ধীরে ধীরে আলাপ হল অফিসের বাকি কর্মচারীদের সঙ্গে। পারচেজ দেখেন মধুবাবু। তাঁর টেবিলে ফাইলের স্তুপ। সেগুলো নড়েও না চড়েও না। বড়বাবুর মুখে শুনলাম মধুবাবুর ছোটবেলা থেকে শখ ছিল বড় হয়ে বিজ্ঞানতাপস হবেন। কিন্তু বিধি বাম। তিন বারের চেষ্টায় মাধ্যামিক পাশ করলেও পরে আর এগোতে পারেননি। বাবা চাকরি করতেন এই দপ্তরে। অকালে পিতৃবিয়োগ হওয়াতে মধুবাবু বাবার চাকরিটা পেয়েছেন। কিন্তু যাঁর এমন আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ছিল তাঁর পক্ষে নিজের এই ভাগ্যবিপর্যয় মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সারাদিন মধুবাবু মনমরা হয়ে বসে থাকেন। একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
"আপনি সারাদিন কী এত ভাবেন বলুন তো?"
মধুবাবু আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন অন্যমনস্কের মতো। তারপর চিন্তিত মুখ করে বললেন,
"একটা কথা কি আপনি কখনও ভেবে দেখেছেন স্যার, বিশ্বের প্রতিটি বিন্দু প্রতিনিয়ত পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে প্রতিটি জিনিসের মাপ বড় হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।"
আমি বললাম, "তা কী করে হয়। তাহলে তো জলপাইগুড়িতে কিনে রাখা দু’কাঠা জমি এত দিনে বেশ কয়েক বিঘে হয়ে যেত! তা তো হল না। আমিও যে পাঁচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চি আছি বরাবর সেই পাঁচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চিই রয়ে গেলাম। তাহলে?"
মধুবাবু গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন। দু’দিন বাদে আমার চেম্বারে এসে বললেন,
"আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি স্যার। আপনার জমি বা আপনার হাইট সত্যিই বাড়ছে। কিন্তু যে ফিতে দিয়ে আপনি মাপছেন সেটাও তো একই হারে বাড়ছে। তাই এফেক্টটা বোঝা যাচ্ছে না।"
প্রতিদিন থান ইটের মতো মহাভারত যাঁকে পড়তে দেখেছিলাম সেই দিদিই এই অফিসের টাইপিষ্ট। একদিন একটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে এলেন। তাতে অজস্র ভুল। অসন্তুষ্ট হয়ে বললাম,
"কী করেছেন এসব!"
দিদিটি আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,
"আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন আপনি জানেন? আমি নাটোরের জমিদারবাড়ির মেয়ে। আমাদের বাড়িতে এখনও সিনিয়র মেম্বাররা কথা বলেন ‘স্পোকেন সংস্কৃত’-তে। উইলিয়ামের নাম শুনেছেন? ইংল্যান্ডে থাকেন, বেশ কিছু নাটক লিখেছেন ভদ্রলোক। লোকে তাঁকে শেক্সপিয়র নামে জানে। তাঁর সঙ্গে আমার প্রপিতামহের চিঠি চালাচালি হত ইংরেজিতে। আমি ইংরেজি শিখেছি আমার প্রপিতামহের কাছ থেকে। আপনি আমাকে ইংরেজি শেখাবেন না স্যার।"
চারুবাবু এলেন একদিন ক্যাশবুক নিয়ে। খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে দেখি চক্ষু চড়কগাছ। ডেবিট আর ক্রেডিট নিজেদের ঠিকানা ভুলে গিয়ে যার যেমন খুশি হিসেবের খাতায় বসে পড়েছে। ফলে পুরো ব্যালেন্স শিট ঘেঁটে ঘ। আমি আঁতকে উঠে বললাম,
"সর্বনাশ! এ কী করেছেন?"
চারুবাবু মাছি গোঁফে তা দিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
"আমি যেমন পেরেছি করেছি। আপনার পছন্দ না হয় নিজে করে নিন।"
মাসখানেক বাদে সেগুনবনি থেকে দুদিনের জন্য বাড়ি ফিরলাম। আমার স্ত্রী স্বাতী কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, সেগুনবনি জায়গাটা কেমন? আমি বললাম, খুব সুন্দর জায়গা। দু’পা হাঁটলেই নদী ,জঙ্গল, পাহাড়। জল খুব ভাল। লোহা অবধি হজম হয়ে যায়। শাকসব্জি ফ্রেশ, একবারে টাটকা মাছ পাওয়া যায়, আনাজপত্রের দামও সস্তা। স্থানীয় মানুষজন সহজসরল। চোরডাকাতের উপদ্রব নেই। দরজা খুলে রেখে চলে বাইরে চলে গেলেও চুরি হয় না।
হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল,
"দুর দুর এ হতে পারে না। তুমি গপ্পো লেখো। তাই নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে এসব বলছ।"
তারপর বলল,
"তোমার মুখে সেগুনবনির গল্প শুনে আমার বড্ড লোভ হচ্ছে যেতে।"
আমি বললাম, "অসুবিধে কোথায়? দু’রাত্তির কাটিয়ে আসতেই পারো সেগুনবনি থেকে।"
স্বাতী বলল, "তথাস্তু।"
স্বাতী সত্যি সত্যিই চলে এল সেগুনবনিতে। এক রাত্তির থেকেই ফরমান জারি করল,
"খুব তো বলেছিলে এদিকে নানারকম বেড়াবার জায়গা। কাল তো রবিবার, তোমার ছুটি। তাহলে চলো কাল একটু বেড়িয়ে আসি।"
আমাদের অফিসের কোনও গাড়ি নেই। তেমন প্রয়োজন হলে দ্রব্যনাথের গাড়ি ভাড়া করা হয়। স্বাতীর কথায় দ্রব্যনাথকে তলব করা হল। গাড়ি বলতে ধ্যাদ্ধেড়ে অ্যামবাসাডর। রং চটে গেছে। পঁচিশের বেশি স্পিড ওঠে না। দ্রব্যনাথ অবশ্য পাকা ড্রাইভার। রণে বনে জলে জঙ্গলে তার হাতের ওপর আমাদের অবিচল আস্থা। দ্রব্যনাথকে বলে দিলাম কাল সকাল সকাল চলে আসতে গাড়ি নিয়ে। সেগুবনির আশপাশ দিয়ে একটু ঘুরে বেড়াব আমি আর স্বাতী। দ্রব্যনাথ মাথা চুলকে বলল, কাল বাড়ি থেকে না বেরনোই ভাল। কাল সেগুনবনিতে স্থানীয় জনজাতির এক বিরাট উৎসব আছে। এদিন দিনের বেলায় কেউ বাড়ি থেকে বেরোয় না। সূর্য ডোবার পর বেরোয়। এদিন এলাকার সমস্ত কেনাবেচা বন্ধ। হাটবাজার শুনশান থাকে। দোকানপাটের ঝাঁপ পর্যন্ত খোলে না কেউ। কাল না গিয়ে পরশু গেলে হয় না?
মাসখানেক হল এখানে এসেছি। এই এক মাসেই বুঝতে পারছি সেগুনবনি জায়গাটার বৈশিষ্ট্য। সকলেই একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে আর বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে। আমি বললাম পরশু নয়, কালই বেরোব। দ্রব্যনাথ নিমতেতো মুখ করে বলল,
"আপনার কথার ওপর তো আর চলে না। ঠিক আছে।"
সকাল সকাল বেরিয়েছি। সামনের সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছে দ্রব্যনাথ। পেছনের সিটে আমি আর স্বাতী। ছ্যাকড়া গাড়ির গতিতে মোটরগাড়িটি চলছে। গাড়ি পিচ ঢালা বড় রাস্তায় এল। পথের পাশে দোকানপাট সত্যিই দেখছি বন্ধ। রাস্তাঘাটও ফাঁকা ফাঁকা। যেতেই দেখলাম একটা কালো বেড়াল রাস্তা ক্রস করল। তখনই দ্রব্যনাথ মুখ চুন করে বলল,
"মিলিয়ে নেবেন স্যার, কিছু একটা অশুভ ঘটনা ঘটবে আজ।"
স্বাতী আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিন্তু দ্রব্যনাথের গলায় কী যেন ছিল, আমার বুকটা একটু কেঁপে উঠল।
সেগুনবনি ছেড়ে বেরতেই প্রথমে ফিতের মতো রাস্তা পেলাম। কিন্তু তা কিছুক্ষণের জন্য। একটু পরেই সেই ফিতের মতো পথ পাহাড়ে চড়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমরা নতুন রাজ্যে এসে পড়েছি। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। এমনি পাহাড় নয়, জঙ্গুলে পাহাড়। সে পাহাড়ে ভালুক, বাঘ বা হাতি থাকা আশ্চর্য নয়।
একটু একটু খিদে পাচ্ছিল। রাস্তায় একটা খড়ের ছাউনি দেওয়া দোকান পাওয়া গেল। তার আবার ঝাঁপ বন্ধ। দ্রব্যনাথ গিয়ে হাঁকাহাঁকি করে দোকানের ঝাঁপ খুলিয়ে মুড়ি আর আখের গুড় নিয়ে এল আমাদের জন্য। গুড়মুড়ি খেয়ে আমরা আবার বেরোলাম পথে। রাস্তাটা ঘুরে ফিরে পাক খেয়ে এসে হাজির হ্যেছে একটা বিরাট চওড়া নদীর কাছে। নদীটা বড়, কিন্তু শান্ত।
দ্রব্যনাথ জানাল, এই নদীর নাম সেগুনবনি নদী। বিরাট বালির বুকে মাত্র কয়েকটা জায়গা দিয়ে তিরতির করে জল বয়ে চলেছে।
কিন্তু সেগুনবনি নদীই বর্ষায় কী সাংঘাতিক আকার ধারণ করতে পারে সেটা আঁচ করতে অসুবিধে হল না। নদী পার হবার জন্য যে বিরাট কংক্রিটের সেতু ছিল তার একটা অংশ বন্যার তোড়ে ভেঙেছে। যেন কেউ একটা কোপ দিয়ে ওই শক্ত সেতুটাকে ভেঙ্গে দু’টুকরো করে দিয়েছে। ব্রিজের পাশ দিয়ে একটা ডাইভারশান করা আছে। শুকনো নদীর খাতের ওপর দিয়ে সেই পথ গিয়ে উঠবে আবার ওদিকের রাস্তায়। অজস্র গাড়ির টায়ারের দাগ পড়ে গেছে নদীর বালিতে। অর্থাৎ ডাইভারশান দিয়ে গাড়ি চলাচল করে।
আমাদের গাড়িটা ধীরে ধীরে চালিয়ে যাচ্ছিল দ্রব্যনাথ। হঠাৎ কী যে হল গাড়িটা সোজা পথে না গিয়ে বেঁকে যেতে লাগল নদীর বুকের দিকে। একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নট নড়নচড়ন হয়ে। দ্রব্যনাথ স্টিয়ারিং ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেও গাড়ির গতি সামলাতে পারল না। আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, আমার দোষ নেই, বিশ্বাস করুন স্যার, কেউ মনে হয় টেনে নামাল।
আমি, স্বাতী আর দ্রব্যনাথ গাড়ি থেকে নেমে ভাঙ্গা ব্রিজটায় উঠলাম। রোদ আছে তবে হাওয়া আছে মৃদু মৃদু। গরম লাগছে না তেমন। দ্রব্যনাথ বলল যে, এই রাস্তা দিয়ে ট্রাক যাবে, তখন তাদের সাহায্যে গাড়ি তুলে নেবে। কিন্তু ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করেও ট্রাকের দেখা পেলাম না। স্বাতী বলল, "আজ হঠাৎ করে এ লাইনে ট্রাকের ধর্মঘট হয়েছে নাকি!"
দ্রব্যনাথ পাংশু মুখে বলল,
"আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম স্যার।"
কী আর বলি! ভাঙা ব্রিজে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছিলাম। যানবাহন নেই। মানুষজনও নেই। হঠাৎ দ্রব্যনাথের চিৎকারে মুখ ফেরালাম। তাকিয়ে দেখি আমাদের গাড়িটার বনেট অবধি ডুবে গেছে বালির মধ্যে। কী হল কাণ্ডটা! তখন মাথায় এল, এ তো চোরাবালি! শুনেছি নদীর খাতে কোথাও এমন চোরাবালি থাকে কিন্তু নিজের চোখে এমন প্রথম দেখলাম।
গাড়ি টেনে তোলা আমাদের কর্ম নয়। দ্রব্যনাথ চলে গেল আশেপাশে গ্রাম থেকে লোকজন ধরে আনবে বলে। আমি আর স্বাতী ব্রিজের ওপর বসে আছি। নদীর ওপারের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে অজানা পাখির তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ। আমরা দুজনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি গাড়িটা অল্প অল্প করে বালির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। চারদিকের পাহাড়গুলিও দেখছে সে দৃশ্য। কিন্তু তাদের হেলদোল নেই। তারা যেমন ধ্যানগম্ভীর তেমনি নির্বিকার। হাজার হাজার বছর ধরে কত সভ্যতার উত্থান পতন দেখেছে তারা। এই সামান্য ঘটনায় তারা বিচলিত হয় না। কতক্ষণ যে কেটে গেছে জানি না। হঠাৎ সম্বিত ফিরল টুংটাং শব্দে।
তাকিয়ে দেখি পিচের রাস্তা দিয়ে একটা বিরাট হাতির পাল আসছে। তাদের গলায় বাঁধা ঘন্টা থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। সত্যি বলতে কী, প্রথমে পিলে চমকে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল হাতির গলায় যখন ঘন্টা বাঁধা আছে তার মানে এরা বুনো হাতির দল নয়। দেখি হাতিগুলো দারুণ সাজগোজ করেছে। তাদের শুঁড়ে ফুলের মালা, কপালে নানরঙের আলপনা। আর হাওদাগুলিও জমকালো। মধ্যের হাওদাটা সবচাইতে বড়। তার মধ্যে বসে আছেন একজন মানুষ। যেন কালো কষ্টিপাথরে খোদাই করা একটি মূর্তি। তাঁর গলায় মালা, মাথায় পাগড়ি।
তালে তালে হাতিগুলি আসছিল। আমাদের সামনে আসতেই হাতিরা থেমে গেল। একজন প্রহরী আমাদের এসে বলল,
"কিরাতরাজাকে প্রণাম করো।"
আমি বা স্বাতী আমরা কেউই কখনও রাজা দেখিনি। এবার রাজা বললেন,
"তোমরা কোথায় থাকো? আমি বললাম জলপাইগুড়ি।"
তাঁর মুখে যে ভাব ফুটে উঠল তাতে মনে হল তিনি এই জায়গার নাম শুনেছেন বলে মনে হল না। বললেন,
"এখানে কী করছ তোমরা?"
স্বাতী কান্নাকান্না গলায় বলল আমাদের দুর্দশার কথা। এতক্ষণে আমাদের অ্যাম্বাসাডরটার দিকে নজর গেল তাঁর। বনেট অবধি ডুবে গেছে চোরাবালিতে। বললেন,
"এত ছোট রথ? কীসে টানে এই রথ? ঘোড়া ? নাকি গরু?"
স্বাতী আমার দিকে আড়চোখে তাকাল। কিন্তু আমিই বা কী করি! কী করে বোঝাই মোটরগাড়ির তত্ত্ব? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি তখন তাঁর প্রহরীদের বিজাতীয় ভাষায় কী হুকুম করলেন। প্রহরীরা আবার হুকুম করল হাতিগুলিকে।
হাতিগুলি এগিয়ে এল নদীর দিকে। তারপর শুঁড়ে করে গাড়িটাকে উঠিয়ে টানতে টানতে নদী পার করিয়ে দিল। তারপর হাতিগুলি সার বেঁধে এগিয়ে চলল আবার। শব্দ হতে লাগল টুং টাং করে। আমি রাজাকে মাথা নুইয়ে নমস্কার করলাম। রাজা আশীর্বাদের একটা ভঙ্গি করে এগিয়ে গেলেন সামনের পথ ধরে।
দ্রব্যনাথ এল আরও অনেকক্ষণ পর। গোটা সেগুনবনি জুড়ে স্থানীয় মানুষের কী এক উৎসব আছে। এই দিন ওরা কেউ ঘর ছেড়ে বেরোয় না। এই শান্ত বালি নাকি এইদিন চোরাবালি হয়ে যায়। কোন পুরাকালের এক কিরাতরাজা নাকি হাতির দল নিয়ে বেরোন পুজো দিতে। লোকেরা তাই ভয়ে ঘরে থাকে।
গাড়িটাকে রাস্তার ওপার দেখে দ্রব্যনাথ একটু অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল,
"কেমন করে তুললেন?"
আমি বললাম কিরাতরাজার হাতিরা তুলে দিয়েছে। দ্রব্যনাথ একবার আমাকে আর একবার স্বাতীকে দেখল। তারপর কোনও কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিল।
সেগুনবনি থেকে আমি আর স্বাতী জলপাইগুড়ি ফিরছি। আমি স্বাতীকে পই পই করে বলেছিলাম চুপ করে থাকতে। কেননা কেউ আমাদের বিশ্বাস করবে না। এদিকে সমস্যা হল, স্বাতীর পেটে কথা থাকে না। ফলে হয়েছে মুশকিল। স্বাতী সেদিনের ঘটনাটা যাকেই বলতে যায় সে-ই হেসে গড়িয়ে পড়ে। অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলে,
"হি হি ... কিরাতরাজা সেদিন দেখা দেখা দিয়েছেন তোমাদের? তাই বুঝি?"
এখানে সুযোগ পেয়ে সেগুনবনির পুরো বৃত্তান্ত শোনালাম তোমাদের। আমার কথা বিশ্বাস করা আর না করা পুরোটাই তোমাদের ওপর ছাড়া থাকল।
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ