আমাদের ভূগোলস্যারের দুই যমজ ছেলে, অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ। ক্লাস ইলেভেনের ফার্স্ট বয় অক্ষাংশ সারাদিন ঘরে বসে থান ইটের মতো মোটা-মোটা বই পড়ে, কঠিনস্য কঠিন সব অংকের ফর্মূলা নিয়ে মাথা ঘামায়। ওদিকে দ্রাঘিমাংশ হল টোটো কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। স্কুল ছুটির পর বাড়ি এসে পোশাকটা বদলেই এক ছুটে বেরিয়ে পড়ে সে। বিকেলবেলা সাইকেলে চেপে দু'-এক ঘন্টা এদিক সেদিক না বেড়িয়ে এলে ভাল লাগে না দ্রাঘিমাংশের।
গুয়াহাটির মালিগাঁওতে থাকে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের পিসতুতো দিদি রুমকিদিদি। তার বিয়ে উপলক্ষে গত শীতে বাবার সঙ্গে মালিগাঁও গিয়েছিল দুই ভাই। রুমকিদিদির একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর আছে। খয়েরি রং, বাঘের মতো চেহারা। কুকুরটার নাম জিয়ান। তার মুখের হাঁ এত বড় যে দেখলে পিলে চমকে যায়। এমনিতে সে শান্ত। তবে দ্রাঘিমাংশ জিয়ানকে দেখে মুখ ভ্যাংচানোর পর তাকে দেখলেই রেগে যাচ্ছিল জিয়ান। তার দিকে তেড়ে আসছিল বারবার। তবে অক্ষাংশর সঙ্গে বেশ বনিবনা হয়ে গিয়েছিল জিয়ানের। রুমকিদিদি দু'হাত দিয়ে জিয়ানকে ধরে রাখত, অক্ষাংশ জিয়ানের সোনালি-খয়েরি লোমগুলো ঘেঁটে দিয়ে ভয়ে ভয়ে আদর করত। জিয়ান কিছু বলত না।
গুয়াহাটি থেকে ফিরে আসার পর থেকেই অক্ষাংশ বায়না ধরেছে তাকে একটা কুকুর কিনে দিতে হবে। ছেলের আবদারে প্রথমটায় না-না করলেও পরের দিকে ভূগোলস্যার নিমরাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল দ্রাঘিমাংশকে নিয়ে। ঘাড়-টাড় নাড়িয়ে দ্রাঘিমাংশ বলল, কুকুর খুব খারাপ জানোয়ার। এ'বাড়িতে কোনও কুকুর যদি এক দরজা দিয়ে ঢোকে তবে অন্য দরজা দিয়ে আমি বেরিয়ে যাব। এ আমার সাফ কথা।
দ্রাঘিমাংশকে অক্ষাংশ বড্ড ভালোবাসে। তার কুকুর পোষার ব্যাপার দ্রাঘিমাংশর কড়া আপত্তি থাকায় অক্ষাংশ চুপ করে গিয়েছিল। আর
কুকুর প্রসঙ্গ তোলে না। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দ্রাঘিমাংশ একটা লিফলেট নিয়ে এসেছে বাড়িতে। রাতে খাবার টেবিলে সেই হলদে
কাগজটা ভূগোলস্যারের হাতে দিয়ে ঘোষণা করল, এবার পয়লা জানুয়ারিতে জাগ্রত সংঘ থেকে একটা সাইকেল রেসের আয়োজন করছে।
কোনও এন্ট্রি ফি নেই। আমি সেই রেসে নাম দিয়ে এসেছি।
মা-মরা ছেলেদুটোর কোনও আবদার চট করে বাধা দেন নে ভূগোলস্যার। বললেন, বেশ তো, এ তো ভালো কথা। তা কতদুরে সাইক্লিং করতে
হবে তোদের?
দ্রাঘিমাংশ হাসল, বেশি দূর নয়, চুইখিম আর অ্যালবাং থেকে জলপাইগুড়ি শহর পর্যন্ত। ভয় পেয়ো না, এটা ওয়ান ওয়ে জার্নি। জাগ্রত সংঘের লোকেরা অ্যালবাংয়ে নিয়ে যাবে আমাদের। সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে আমাদের ফিরতে হবে জলপাইগুড়িতে।
ভূগোলস্যার চোখ কপালে তুললেন, চুইখিম আর অ্যালবাং ? সে তো বহুদূর রে! বাগরাকোট থেকে সোজা উত্তরে দিকে ঢুকে গেলে জলপাইগুড়ি জেলার সীমানা শেষ আর দার্জিলিং জেলার শুরু। সামরিক ছাউনি পাশে রেখে পাহাড়ি খাড়া পথে পৌঁছে যাওয়া যায় চুইখিমে। আরও একটু এগোলে অ্যালবাং। সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে এতদূর ফিরে আসা কি চাট্টিখানি কথা?
অক্ষাংশর চোখ ছানাবড়ার মতো হয়ে গেছে। সে বলল, আর ইউ ক্রেজি! অতদূর সাইকেল চালালে তো মরে যাবি তুই! দ্রাঘিমাংশ হেসে বলল, অত ভয় পাচ্ছিস কেন, আমি কি যুদ্ধে যাচ্ছি নাকি? তছাড়া ওদের মেডিক্যাল টিমও তো থাকবে সঙ্গে। ভয়ের কিছু নেই। তাছাড়া আমি তো আর একা নাম দিই নি, পঞ্চাশের বেশি ছেলে নাম দিয়েছে রেসে।
ভূগোলস্যার রাগ করলে ছেলেদের বকেন না। শুধু গুম মেরে যান। এবারও তাই হল। তিনি মৌনব্রত অবলম্বন করলেন। অক্ষাংশও চুপ করে গেল। দুজনেরই আশংকা, ছেলেটা পাগলামি করতে গিয়ে অসুস্থ না হয়ে পড়ে।
ইংরেজি বছরের শেষ সূর্য ডুবে গেল একটুক্ষণ আগে। সন্ধেবেলা দোতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে দুই ভাই। কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। সাঁঝের আকাশে একটা দুটো করে ফুটছে তারার গুচ্ছ। আকাশে ভেসে আছে বিরাট গোল চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে দ্রাঘিমাংশ নিচু স্বরে বলল,গত কিছুদিন ধরেই একটা স্বপ্ন বারবার দেখছি জানিস।
অক্ষাংশ জানতে চাইল, কীসের স্বপ্ন?
দ্রাঘিমাংশ দূর আকাশের দিকে চোখ রেখে বলল, চুইখিম আর অ্যালব্যাংয়ের স্বপ্ন। ঘুমোলেই ওখানকার দৃশ্য ভিড় করে আসছে চোখে। পাহাড়ের ঘন পাইন গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে রডোডেনড্রন। চিরসবুজ বনের মাথা ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। পাহাড়ি পাকদন্ডীর নীরবতা ভেঙে দিচ্ছি ঝিঁঝিঁ পোকার দলের ঘন্টাধ্বনির মতো আওয়াজ। ওখানে যাবার জন্য আমার আর তর সইছে না রে!
অক্ষাংশ নরম গলায় বলল, কপাল ভাল থাকলে ওখানে ম্যাগপাই পাখির দেখা পেতে পারিস। ম্যাগপাই আকারে বেশ বড়, জেব্রার মতো সাদা-কালো মেশানো ডানার রং। এছাড়াও কিট নামে এক রকম লুপ্তপ্রায় পাখিরও আসাযাওয়া আছে অ্যালব্যাং আর চুইখিমে।
ভোররাতে বেরিয়ে গেল দ্রঘিমাংশ। প্রতিযোগীরা আর তাদের সাইকেল গেল আলাদা আলাদা গাড়িতে। অ্যালব্যাংয়ে থেকে ঠিক বেলা আটটায় শুরু হবে সাইকেল রেস। জলপাইগুড়ি জাগ্রত সংঘের মাঠে এসে শেষ হবে সেই প্রতিযোগিতা। তারপর হবে পুরষ্কার বিতরণ। দুটো টিভি চ্যানেলও থাকবে অনুষ্ঠানটা কভার করার জন্য।
অশান্ত মন নিয়ে খবরের কাগজ হাতে বসে আছেন ভূগোলস্যার। অক্ষাংশ একটা গল্পের বইতে মন বসানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। দ্রাঘিমাংশর জন্য বড় ভাবনা হছে তার। বসার ঘরের ঘড়িটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজল। অক্ষাংশ আর ভূগোলস্যার দুজনেই দুজনের দিকে তাকালেন। দুজনের মুখেই ফুটে আছে দুশ্চিন্তা।
বিকেলবেলা জাগ্রত সংঘের মাঠে চলে এসেছে সবাই। কানাঘুঁষো শোনা যাছে তিস্তা ব্রিজ পার করে এসছে সাইকেল আরোহীরা। সাতজন প্রতিযোগী নাকি প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে সাইক্লিং করছে। দ্রাঘিমাংশও নাকি আছে সেই সাতজনের মধ্যে। জাগ্রত সংঘের মাঠে শুরু হয়ে গিয়েছে গুঞ্জন। পুরষ্কার দিতে মন্ত্রী এসেছেন দুজন। মঞ্চে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছিলেন এতক্ষণ। এবার নড়ে চড়ে বসেছেন তাঁরও। মিডিয়ার লোকজনও ক্যামেরা আর বুম রেডি করে চলে গেছে মাঠের মধ্যিখানে। সবার মধ্যেই একটা উত্তেজনার আঁচ। দ্রাঘিমাংশকে দেখা গেল প্রথমে। দ্বিতীয় প্রতিযোগীকে প্রায় একশো মিটার পিছনে ফেলে প্রবলবেগে প্যাডল করতে করতে আসছে সে। চোখে একাগ্র দৃষ্টি, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে তার শরীর। তার পেছন পেছন ছুটে আসছে, কী আশ্চর্য, একটা দৈত্যের মত কুকুর! পাটকিলে রংয়ের গা ভর্তি চকচকে লোম কুকুরটার।ছোট্ট ল্যাজ, বিরাট বড় মুখ। লম্বা কান দুটো ঝোলা ঝোলা, লাল টুকটুকে জিভ বার করে দৌড়াচ্ছে কুকুরটা।
জাগ্রত সংঘের মাঠে পৌঁছে রিবনে সবার আগে বুক ছুঁইয়েই সাইকেল থেকে মাটিতে পড়ে গেল দ্রাঘিমাংশ। হাঁপাচ্ছে, ছোট্ট বুকটা উঠছে
নামছে হাপরের মতো। সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। ওদিকে কুকুরটা ছুটে এসে চুকচুক করে চাটতে শুরু করে দিয়েছে দ্রাঘিমাংশের গাল। অত
ক্লান্তির মধ্যেও দ্রাঘিমাংশ কুকুরটার মাথাটা ধরে আদর করে দিল একটু। আহ্লাদে কুঁই কুঁই করছে কুকুরটা।
ঘটনা দেখে স্তম্ভিত ভূগোলস্যার আর ওক্ষংশ। তাজ্জব মঞ্চের বিশিষ্টজনেরা, অবাক উপস্থিত মানুষজন। এমন অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী কেউ হন নি কখনও। দ্রাঘিমাংশ একটু ধাতস্থ হতেই সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। মিডিয়ার লোকজন ক্যামেরা তাক করেছে। দুজন দুটো বুম ধরেছে দ্রাঘিমাংশর মুখের কাছে। সবাই কৌতুহলী, প্রত্যেকেই এই আশ্চর্য ঘটনাটার কথা তার মুখে শুনতে চায়।
দ্রাঘিমাংশ কুকুরটাকে নিয়ে কোলে। লাজুক হেসে বলতে শুরু করল তার গল্প। সকালে রেস শুরু হবার আগে অ্যালবাংয়ে প্রতিযোগীদের চিকেন
স্যান্ডুইচ খেতে দেওয়া হয়েছিল। সবাই পুরোটা খেয়ে নিলেও দ্রাঘিমাংশ অত বড় স্যান্ডুইচ খেতে পারে নি। সে অর্ধেকটা ফেলে দিয়েছিল পথের ধারে। এই পাহাড়ি কুকুরটা ছিল আশেপাশে কোথাও। সে গলাধঃকরণ করেছিল সেই চিকেন স্যান্ডুইচের ভুক্তাংশ। তারপর থেকেই সে ছুটে ছুটে আসছে। কুকুরটা দ্রাঘিমাংশর সঙ্গে সঙ্গে পুরো পাহাড়ি পাকদন্ডী পথ ধরে নেমেছে, সমতল পথ ধরে ছুটেছে। প্রথমটায় দ্রাঘিমাংশ ভেবেছিল তাকে বুঝি তাড়া করছে কুকুরটা। সে প্রানভয়ে প্যাডল করে চলছিল। একটা সময় তার দম শেষ হয়ে যায়। চালসা মোড়ের কাছে এসে বাধ্য হয়ে তাকে থেমে যেতে হয়।কিন্তু অবাক হয়ে দ্রাঘিমাংশ দেখে কুকুরটা তাকে আক্রমন করতে আসছে না, বরং জিভ দিয়ে তার হাত-পা চেটে দিচ্ছে কুঁই কুঁই করে। এমনকী জাগ্রত সংঘের মাঠ পর্যন্ত সে চলে এসছে দ্রাঘিমাংশর পেছন পেছন।
বিরাট একটা ট্রফি আর মোটা টাকার চেক নিয়ে জাগ্রত সংঘের মাঠ থেকে পাড়ার ছেলেদের ঘাড়ে চেপে বাড়ি ফিরেছে দ্রাঘিমাংশ। সঙ্গে সঙ্গে এসেছে সেই কুকুরটা। ঠাঁই নিয়েছে এ'বাড়িতে। এখন অক্ষাংশের সঙ্গেও দিব্যি দোস্তি হয়ে গেছে তার। সে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করে না, ছোট্ট ল্যাজটা নাড়ে আর আদুরে গলায় কুঁইকুঁই করতে থাকে। সকালের খবরের কাগজ বারান্দায় দিয়ে গেলে সেটা মুখে করে ভূগোলস্যরের কাছে এনে দেওয়া এখন তার ডিউটি। তবে স্বভাবে সে মোটেই নিরীহ নয়। একটা বিরাট গন্ধগোকুল এ'বাড়িতে উৎপাত করছিল মাস খানেক ধরে। চালে উঠে লাফঝাঁপ করত, সিলিংয়ে হিসি করে দিত যখন থখন। একদিন রাতের অন্ধকারে গন্ধগোকুলটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফালাফালা করে দিয়েছিল কুকুরটা।
রাতের আকাশে যে কালপুরুষ দেখা যায় তার শিকারি কুকুরের নামে ভূগোলস্যার কুকুরটার নাম দিয়েছেন 'লুব্ধক'। দুই ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমোয় সে। বিছানা নোংরা করে না, বাইরে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজকর্ম করে আসে চুপ করে। খাওয়া নিয়েও ঝামেলা নেই। প্রতিদিন সোনামুখ করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে দুধভাত খেয়ে নেয় সে।
তবে লুব্ধক মোটেই সাধুসন্ন্যাসী নয়। তারও একটা দুর্বল জায়গা আছে। সেটা হল চিকেন স্যান্ডুইচ। যেদিন দ্রাঘিমাংশ লুব্ধকের জন্য চিকেন স্যান্ডুইচ কিনে নিয়ে আসে সেদিন লুব্ধকের ল্যাজ নাড়া অনেক বেশি বেড়ে যায় !