আমার বন্ধু অনাথ
অনাথ আমার বন্ধু। ওর বাঁ পা-টা একটু ছোট তাই সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে। অবশ্য এই খুঁড়িয়ে হাঁটাটা খুব সহজে চোখে পড়ে না। তবে দৌড়নোর সময় তার শরীরটা বাঁ দিকে অনেকটা ঝুঁকে যায়।
অনাথ ও আমি একসঙ্গে পাকা তাল কুড়াতে যাই। ভাদ্র মাসের শেষে দিকে তাল পেকে নরম হয়ে ওঠে। তাই গাছ থেকে পড়ে মাটিতে বসে যায়। দু-একটা তাল মাঝে মধ্যে গড়িয়ে তালপুকুরের জলে এসে পড়ে। সেগুলো আমরা জল থেকে তুলে নিই। ভোরবেলা গাছের নীচে পাঁচ সাতটা পাকা তাল রোজই পড়ে থাকে। পাকা তাল সবাই খেতে পছন্দ করেনা। ভাদ্র মাসে তাল খেলে মাথা ঘোরে। আমারও খাই না। অনাথ আর আমি পাকা তাল এনে উঠানের একপাশে জমিয়ে রাখি। একটা তালের ভেতরে তিনটে শক্ত বীজ থাকে। ঐ তালবীজ থেকে কিছুদিন পর অঙ্কুর বের হয়। তখন তালবীজ কাটলে ভেতরে নরম কোয়া পাওয়া যায়। তালের নরম কোয়া খেতে দারুন মিষ্টি লাগে। আর ঐ নরম কোয়ার লোভেই আমরা ভোরবেলা ফাঁকা মাঠের ধারে তাল কুড়োতে চলে আসি।
বর্ষার শেষে মাঠঘাট সব জলকাদায় মাখামাখি। চোরকাঁটা আর বনতুলসীর ঝোপ পেরিয়ে পুকুর পাড় যেতে অনেকটা সময় লেগে যায়। অনাথ খুব ভোরবেলা উঠতে পারে। পথ ঘাট তখনও খুব একটা পরিষ্কার হয়না। ও তার মধ্যেই অন্ধকারে ঠিক তাল খুঁজে পায়। আমাকেও এই তাল কুড়োনোর নেশায় পেয়ে গেছে।
একদিন ভোরবেলা তাল কুড়োতে এসে দেখি গাছতলা ফাঁকা। কেউ নেই। অনাথ আজ পৌঁছায়নি বোধহয়। চারদিন শুনশান। অন্যদিন দূর থেকেই অনাথের আবছা মুর্তি দেখা যায়। অনাথ বলে ডাকলেই সাড়া দেয়। আজ তাই একটু ভয় ভয় করতে লাগল। এমনিতেই এই জায়গাটা আলো আঁধারিতে ভরা। রাত্রে শুকনো তালপাতায় নানা ধরনের আওয়াজ হয়, আর তাতেই গ্রামের লোকজন ভয় পায়। তবে অনাথ আর আমি ওসবে ভয় পাইনা। আমাদের চোখ থাকে পাকা তালের দিকে। আমি পুকুরের চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখলাম, না কেউ নেই। তারপর দু-হাতে দুটো তাল নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
যখন আটটা বাজে তখন কে যেন বলল, ভোর থেকে অনাথকে পাওয়া যাচ্ছেনা। বাড়ির সবাই অনাথের খোঁজ করতে শুরু করেছে। অনাথ কোথাও নেই। অনাথের মা আমার কাছে এসে জানতে চাইল অনাথ আজ তাল আনতে গিয়েছিল কি না। আমার সাথে আনাথের দেখা হয়নি শুনে অনাথের মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মায়ের মন কু ডাকতে শুরু করল। এরপরের ঘটনা অত্যন্ত করুণ। তালপুকুরের জলেই অনাথকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। পাকা তাল জল থেকে তুলে আনতে গিয়ে কোনোভাবে পা পিছলে ডুবে গিয়েছিল অনাথ
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। গ্রামের স্কুলের পাঠ শেষ করে শহরের স্কুলে ভর্তি হয়ছি। পড়াশুনো শেষে সরকারি কাজ পেয়েছি। মা-বাবকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে শহরে পাকাপাকি ভাবে বাস করছি। অনাথের স্মৃতি একদম ফিকে হয়ে এসেছে। নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে পুজোর সময়ে গ্রামে যেতে পারিনা। এবার অনেকদিন পর পুজোর ছুটিতে গ্রামে এলাম। এসেই মনে হল গ্রাম্য পুজোর একটা অন্যরকম স্বাদ আছে। এখানে এসময় প্রকৃতি অপরূপ সাজে সেজে থাকে। সবার সাথে পূজোর দুদিন বেশ হৈ-চৈ করে কাটল। নবমীর দিন শহরে ফিরে যাব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম তাই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মাঠের টাটকা বাতাস গায়ে মেখে একটু বেড়িয়ে আসব ঠিক করলাম। এসময় ভোরবেলা খুব কুয়াশা পড়ে। মাঠের ঘাস জলে ভরে যায়। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখলাম আমি তালপুকুরের কাছে এসে পড়েছি। পুকুরটি সেরকমই আছে। চারদিকটা গাছ-গাছালিতে ভরা। আর গাছের নীচে তখনো জমাট অন্ধকার। আর সেই আবছা অন্ধকার পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম দূরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ একটা তালগাছ থেকে ঝড় ঝড় করে আওয়াজ উঠল আর তারপরেই থপ্ করে আওয়াজ হল। বুঝলাম পাকা তাল পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারের মধ্যে একটা ছেলে দৌড়ে ঐ তালগাছটার দিকে চলে গেল। তখনো ভোরের আলো ঠিক মতো ফোটে নি। তবে আবছা একটা আলোর আভাস ফুটে উঠেছে আর তাতেই দেখতে পেলাম ছেলেটা একটু যেন খুঁড়িয়ে খূঁড়িয়ে তালগাছটার দিকে দৌড়ে গেল। ছুটে যাওয়াটা খুব চেনা চেনা মনে হল। হটাৎ বিদুৎ চমকের মত আমার মাথায় একটা প্রশ্ন জেগে উঠল, অনাথ নাকি? সেই রকম বেঁটে খাটো চেহারা আর বাঁ দিকে ঈষৎ ঝুঁকে দৌড়ে যাওয়া। আমি কি ভুল দেখলাম। ভুলই হবে। এতদিন পরে অনাথ আসবে কথা থেকে। আমিও ঐ গাছটার নীচে এসে দাঁড়ালাম। না! কেউ কোথাও নেই।
চারদিকটা ভালো করে নজর করে দেখলাম, কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে কি মনের ভুল। এই এতদিন পরে আমার বাল্যবন্ধু অনাথের স্মৃতি উঁকি মেরে গেল? কিছুই বুঝতে পারলাম না। ক্রমে আলো ফুটে উঠল। শারদ প্রভাতের সোনা আলো ঝরে পড়ল তালপুকুরের জলে। লাল-সাদা অজস্র শাপলা চুপচাপ চেয়ে রইল আমার দিকে। এই পুকুরের জলেই একদিন তলিয়ে গিয়েছিল অনাথ। মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। একটা চিনচিনে ব্যথা নিয়ে শহরে ফিরে এলাম।
তরুণ কুমার সরখেল
আমডিহা, পুরুলিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তরুণ কুমার সরখেল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
আমার বিড়ালছানা
তখন রানাঘাটে থাকতাম।ক্লাস ফোরে পড়ি।ছুটির দিনে সকালে বিছানায় শুয়েই শুনতে পেলাম,গেটের বাইরে একটা বেড়াল,‘মেউ,মেউ’,করে ডেকে চলেছে।বরাবরই আমার কুকুর,বিড়াল পালার ঝোঁক।বেড়ালের বাচ্চা হোক, কুকুরের বাচ্চা হোক,ওদের দেখলেই ভালো লাগে।
সকালে তখনও শোয়া ছেড়ে উঠতে পারিনি।শুনতে পার ছিলাম,বাড়ির বাইরের দরজার কাছে,‘মেউ,মেউ’,আওয়াজ!
ঘুম থেকে উঠে বাড়ির গেট গিয়ে খুললাম।দেখলাম,ছোট্ট একটা বিড়াল ছানা--কত বড় হবে?এই এক,দু মাসের বাচ্চা হবে।দেখতে কিন্তু চমৎকার! ধপ ধপে সাদা,পেটের আর মাথার দিকে হালকা খয়েরি রঙের।ওটা আমায় দেখেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে,আবার‘মেউ,মাউ’,করে ডাকতে লাগলো।ধরতে গেলাম।ও কিন্তু পালাল না।বরং আমার দিকে এগিয়ে এলো।কোলে তুলে নিলাম ওটাকে--ঘরের ভিতরে নিয়ে এলাম।ছোট ভাই,বোন দেখে খুব আনন্দ পেল।ওরা বাচ্চাটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।আর বাচ্চাটাও সবার আদর খেতে খেতে,‘মেউ,মেউ’,করে গায়ের লোম ফুলিয়ে সবার গা ঘেঁষে ঘেঁষে ঘুরতে লাগলো।
মনে মনে ঠিক করলাম বাচ্চাটাকে পালি।পালা মানে দু দিন খেতে দিলেই ওটা আমাদের ঘরে থেকে যাবে।কেবল ছোট বলে দেখতে হবে বাড়ির বাইরে চলে টলে না যায়।
মা সকাল বেলা স্নান সেরে এসেই দেখলেন,আমাদের আদিখ্যেতা--মানে বেড়াল ঘাঁটাঘাঁটিতে তখন আমরা খুব ব্যস্ত!মা বলে উঠলেন,‘এটাকে কোথায় পেলি রে?’
আমি ওটা পাওয়ার ফিরিস্তি দিলাম।
মা এসব পালা-পোষার পক্ষপাতী নন।একে তো ঘরে একটা বাড়তি প্রাণী--ঘর নোংরা করা,যেখানে সেখানে পায়খানা,পেচ্ছাপ করে দেওয়া,বেশ কিছুটা ঝঞ্ঝাট তো পোহাতেই হয়!এ সব ভেবেই হয় তো মা বললেন,‘যা যা,ওটাকে বাইরে দিয়ে আয়!তোদের পালার ঝঞ্ঝাটের পর আবার এটাকে পালতে পারবো না।এটাকে এখনি বিদায় কর!’
বোন তখন খুব ছোট,সে আধ আধ বলে উঠলো,‘না,বিদায় না!’
ভাই ক্লাস টুতে পড়ে,সে বলল,‘দেখ না কত সুন্দর ওটা--আমাদের সঙ্গে খেলবে ও!’
মার হাত ধরে আমি আবদারের সঙ্গে বললাম,‘মা,দেখ না,কি সুন্দর দেখতে,আমাদের দিকে তাকিয়ে কেমন ডাকছে দেখো!’
--‘না,না,ও বিদায় করে দাও!’বলে মা আড় চোখে বেড়ালের বাচ্চার দিকে তাকালেন।সোজা সুজি তাকালে যদি মারও পছন্দ হোয়ে যায়,ওটার দিকে মায়া এসে যায়,শেষে সেই দিকধারী সব মাকেই তো পোহাতে হবে!ঠিক এমনি সময় বাচ্চাটা মার পায়ের কাছে এসে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, ‘মেউ,মেউ’,করতে থাকলো।এবার মাকে বাধ্য হোয়ে বেড়ালের দিকে তাকাতেই হল।ওটার দিকে তাকালেন মা,মার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে বাচ্চাটাকে মারও পছন্দ।মা বললেন,‘ওটার খিদে পেয়েছে কিছু খেতে দে!খাওয়া হলে বাইরে ছেড়ে দিয়ে আয়!’
--‘মা,মা,মা’,আমি সে সঙ্গে ভাই,বোন আবদারের সুরে ডাকতে লাগলাম মাকে।
মা তবু বললেন,‘না,না,ওর গু,মুত কে পরিষ্কার করবে?’
--‘আমি দেখব ওটাকে,মা!আমি ওর গু,মুত পরিষ্কার করবো’,আমি বলে উঠলাম।
--‘তা হলেই হয়েছে’,বলে মা এবার চুপ করে রইলেন।মৌনতা নাকি সম্মতির লক্ষণ--বুঝে নিলাম চুপ থাকার অর্থ হল,ঠিক আছে।
আমাদের আনন্দ আর দেখে কে?বেড়ালের বাচ্চাকে খেতে দিলাম--দুধের সঙ্গে ভাত মেখে দিলাম।এক মুঠো ভাত খেয়ে নিলো,বাকি ভাত পড়ে রইল। বেলা দশটা,এগারটা বাজে তখন,বাবার বাজার যাবার সময় এটা।আমার হঠাৎ মনে পড়ল,আজ বাবার সাথে বাজার যাবার কথা!বাজার যাবার উত্সাহ ও আমার কম নেই--তখন আমার বাজারে যাবার বড় আকর্ষণ ছিল,কতবেল!বাজার গেলেই পাকা কতবেলের খোঁজ করতাম।পেলে আর কথা নেই--আবদার করে বাবাকে দিয়ে কিনিয়ে ছাড়তাম।
সে কতবেল আমি ভেঙে নুন,লঙ্কা,চিনি সহযোগে মাখতাম। ভাই,বোন,আর আমি বেশ মজায় চেটে চেটে খেতাম।মাও বেশ মজা করে খেতেন।কিন্তু বাবা খেতেন না।আমরা ছোটরা ভাবতাম একবার যদি কতবেল মাখা বাবা মুখে ছোঁয়াতেন তবে তার স্বাদ কতটা তা নিশ্চয় বুঝতে পারতেন!কিন্তু তা হবার নয়,অনেক বলেও বাবার মুখে কতবেল মাখা ছোঁয়ানো গেলো না!
আজ বাবার সঙ্গে বাজার যাবার পালা।কতবেল আনার উত্সাহ একেবারে কম নয়!কিন্তু এই বিড়াল ছানার কি হবে?--নতুন আজই এসেছে আমাদের বাড়িতে--কখন কোন দিকে হাঁটা দেবে কে জানে!ছোট ভাই বোনেরাও এত নজর রাখতে পারবে না জানি--ওরা নিজেদের খেলায় মত্ত হয়ে গেলে আর ওদের কোন দিয়ে নজর থাকবে না।মাকে বলাও বৃথা,সকাল থেকে উঠে রান্না ঘরেই অনেক সময় কাটিইয়ে দেন।এ সব ভেবে আমি এক কাজ করলাম।চার পাঁচ হাত লম্বা একটা রশি নিয়ে বিড়াল ছানার গলায় বাঁধলাম।রশি ধরে টেনে এদিক ওদিক ওটাকে হাঁটিয়ে দেখলাম--গলায় রশি নিয়ে থাকতে ও মোটেই ভালো বাসে না।কিন্তু কি করবো--অন্তত আমার বাজার করে ফিরে আসা পর্যন্ত এক দেড় ঘণ্টা তো বাঁধা থাক!বাঁধা অবস্থায় বারবার,‘মেউ, মেউ’,করছিল,গলার দড়ি খোলার জন্যে মাথা মোচড়া মুচড়ি করছিল।আমি ওকে তবু জানলার শিকে বেঁধে দিলাম।‘কুঁই কাই’,করছিল খুব--আবার একটু দুধে ভাতে মাখিয়ে এনে ওর মুখের সামনে রাখলাম।
মা রান্নাঘর থেকে অন্য ঘরে যাবার সময় বেড়াল ছানাকে বাঁধা দেখে বলে উঠলেন,‘বেড়াল কি গলায় দড়ি বেঁধে পোষা যায়!’
আমি বললাম,‘বাজার থেকে এসেই গলার দড়ি খুলে দেবো।’
বাবার সঙ্গে চলে গেলাম বাজারে।বাজার ঘুরে কতবেল নিয়ে এলাম।ঘরে তখন ঢুকতে পারিনি ছোট ভাই,বোন ঘরের বাইরে ছুটে এসে বলে উঠলো, ‘দাদা,দাদা,বেড়াল বাচ্চাকে না কুকুরে কামড়েছে--ওটা খুব কাঁদছে!’
আমি তিড়িং করে লাফ দিয়ে ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখলাম,সত্যি,বাচ্চাটার কমরের অনেকটা মাংস কুকুরে খুবলে নিয়েছে--ওর সারা গায়ে কাটাকুটি, আঁচরের চিহ্ন।ও উঠতে পারছিলো না--যন্ত্রণায় কেমন যেন গোঙড়াচ্ছিল।
মা,বাবা,ভাই,বোন সবাই এসে দেখল।মা বললেন,এটাকে তো খেয়ে নিচ্ছিল রে!আমি কুকুরের ঘেউ,ঘেউ আর এটার ফোঁসফোঁসানি শুনে বেরিয়ে এসে দেখি যে বড় একটা কুকুর বাচ্চাটাকে কামড়ে ধরেছে,আর এটা,‘ মাউ,মাউ’, করে গুঙড়ে চীত্কার করছে।দড়ি দিয়ে বাঁধা বলে পালাতে পারছে না।
আমি কাঁদো কাঁদো হোয়ে বললাম,‘এটা বাইরে এলো কি করে?’
মা বললেন,‘জানালার শিকে বেঁধে ছিলি--আর জানলা খুলে রেখে গিয়েছিলি,ছানাটা গলার দড়ি নিয়েই জানলাটা পার করে বাইরে চলে গিয়ে ছিল।
বেড়ালের ছানার কান্না দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল।পাশে দাঁড়ানো ভাই, বোনের অবস্থাও তেমনি--মুখে ওদের কান্না কান্না ভাব লেগে আছে।আমি ঘরে রাখা বরিখ পাউডার এনে ওর গায়ের ক্ষতে লাগিয়ে দিলাম। কোমরের অনেকটা জাগা নিয়ে মাংস নেই,কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে উঠলাম--‘বাবা,কেমন করে এমন হল!’
বাবা সব কিছু দেখে গম্ভীর হোয়ে বলে উঠলেন,‘ওটা আর বাঁচবে না--এমন বোকামি করেছিস তুই?’
আমার নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল খুব!জালনা কেন আমি বন্ধ করে যাই নি!ওই কুকুরের ওপর ভীষণ,ভীষণ রাগ হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল,ওটাকে যদি এখন হাতের কাছে পেতাম,পিটিয়ে মেরে ফেলতাম।
সারাটা দিন কিছুই খেলো না বেড়াল ছানা।আমার,ভাই-বোনের,মার মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ ভাবে কি যেন বলতে চাইছিল,ও কি কুকুরের বিরুদ্ধে নালিশ জানাচ্ছিল? নাকি আমার বিরুদ্ধে বলতে চাইছিল,‘কেন তুমি আমায় বাঁধলে?কেন বেঁধে একা আমায় ছেড়ে গেলে?কেনই বা জানলাটা খুলে গেলে?’
রাতে দুধের বাটিতে মুখ দিয়ে চুক চুক দুবার কেবল ওর মুখ ছোঁয়াল।পর দিন সকাল থেকেই চুপচাপ শুয়ে তাকিয়ে থাকলো।ওঠার শক্তি তো আগে থেকেই ছিল না--আজ যেন ও নিস্তেজ পড়ে আছে!ব্যথার গোঙ্গানিও নেই ওর!শরীরের লোমগুলি মাঝে মাঝে ফুলে ফুলে উঠছিল।
সন্ধ্যে হলে দেখলাম--বিড়াল ছানার শরীরে যেন শ্বাস নেই!আমি ডাকলাম,‘ মিনি!মিনি!’ও তাকাল না--ওর দেহ যেন কেমন টান টান হোয়ে পড়েছিল। ওর গায়ে হাত রাখলাম,ছট ছট করে ওর শরীর দু বার ঝাঁকিয়ে উঠলো--তারপর সব কিছু স্থির হোয়ে গেলো।বিড়াল ছানা মারা গেলো।বুক ঠেলে কান্না উঠতে লাগলো আমার।মা এলেন।তাঁকেও আঁচলে চোখ মুছতে দেখলাম।ভাই বোন দুটো কাঁদছিল।এক সময় আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।বুকের কান্না যেন প্রচণ্ড হাওয়ার মত বেগে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি।
এর পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,আর কোন দিন বিড়াল পুষবো না--সে প্রতিজ্ঞা আজ বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বজায় রেখেছি।
তাপসকিরণ রায়
জবলপুর, মধ্যপ্রদেশ
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তাপস কিরণ রায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
আস্থা
ছোট্ট শানুর দু দিন আগেই আট বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষে বাড়ীতে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান হয়েছে। মা, ঠাম্মি,কাজের মাসি মিলে কিছু স্পেশাল রান্না করেছিলেন আর বাবা ফ্লুরিস থেকে একটা বিশাল কেক এনেছিলেন। অতিথি বলতে ছিলেন মামা, পিসি আর কাকুরা। বেলুন দিয়ে ঘর’টা সাজানো হয়েছিল। প্রত্যেকেই নানান উপহার দিয়েছেন, কিন্তু তারমধ্যে কোনটাই শানুর ভীষণভাবে চাওয়া সেই পি এস পি নয়! ভেবেছিলো বাবা বা মা হয়তো একটা সারপ্রাইজ গিফট দেবেন। কিন্তু না, তার বদলে কিনা ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়া’র ঐ বিশাল ভারি ভারি বই গুলো! ধূর, অতো পড়বো কি করে? আর পড়েই বা কি হবে? অতো অতো পড়তে ভালো লাগেনা শানুর! আগে, আরো ছেলেবেলায় মা কেমন পাশে নিয়ে শুয়ে ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে সব বই গুলো পড়ে শোনাতেন! তখন বেশ ভালো লাগত। বোনি টা আসার পর সে সবই গেল। টানা সাতবছর একচ্ছত্র রাজ করার পর এই সহোদরাটির আগমনে শানুর ছোট্ট পৃথিবীটা যেন টলে গিয়েছিল। ঐ জ্যান্ত পুতুলটা যে সব্বাইকার মনোযোগ এইভাবে কেড়ে নেবে সে টা ভাবতেই পারেনি শানু। এমন কি মাও শানুর শোবার সময় হাত পা ছোঁড়ার অভ্যাস আছে বলে তাকে ঠাম্মির কাছে পাঠিয়ে দিল! কিচ্ছু ভাল লাগেনা শানুর! মাঝেমাঝে মনে হয় কেন যে তার দুনিয়া ওলটপালট করে দিতে এই আগন্তুকটি এল! বোনি প্রচণ্ড কাঁদতে থাকলে মা যখন তাকে কোলে নিয়ে আদরের নানান কথা বলে ওকে ভোলায়, ভীষণ কষ্ট হয় শানুর। গলার কাছটা কেমন যেন কাঁটা বেঁধার মত ব্যাথা হয়।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও শানু কেমন প্রতিদিন মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেত আস্ত।শরতের সকালের নরম রোদ্দুরে মা কখনও ঝরে যাওয়া শিউলি ফুলের গন্ধ চেনাতে চেনাতে, কখনও বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ নিতে নিতে আবার কখনও বা দুপুর রোদে ঐ বড় গাছ টাতে বসা হলুদ পাখি টার ডাক কান পেতে শোনাতে শোনাতে শানু কে নিয়ে স্কুলের পথে যাতায়াত করতেন। মায়ের সঙ্গে সেই একান্ত নিভৃত সময়গুলো সব কোথায় হারিয়ে গেল! ঐ পথেই ফুটপাথে্র একটা কোণে ঝুপরি তে থাকা ঢলঢলে প্যান্ট পরা খালি গায়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে প্রায়ই দেখতে পেত তারা। হাড় জিরজিরে রোগা ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। আপাত ভাবলেশহীন সেই দৃষ্টি টায় যে মায়ের হাত ধরে স্কুল যাবার ইচ্ছেটা যে উঁকি দিত সেটা মালা (শানুর মা) নিশ্চয়ই বুঝতে পারতেন। শানুকে বলতেন “দেখ তো, গরীব হয়ে জন্মেছে বলে ওর কত কষ্ট!” মা কখনো ছেলেটিকে শানুর পুরনো জামাকাপড়, বই, কখনও খাবার দিতেন। সেদিন সকালসকাল সুবলদার সঙ্গে স্কুলে যেতে গিয়ে দেখল ছেলেটা কেমন মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে ঘুমচ্ছে। ভীষণ হিংসে হল শানুর। ছোট্ট শানুর কাছে তথাকথিত বৈভবের চেয়ে মায়ের কোলের কাছের ওম ভরা উষ্ণতা আনেক বেশি দামী।এসব ভাবতে ভাবতে রাত্রিবেলা খোলা জানালার দিয়ে শানু যখন বাইরে তাকিয়ে থাকে, দু’চোখ তার জলে ভরে আসে। শানুর ছোট্ট মনে জমে থাকা দুঃখ অভিমান তার বড়বড় দুটি চোখকে জলে ভাসিয়ে তার মাথার বালিশ টাকে সিক্ত করে তোলে। পাশের বাড়ির পলেস্তারা ওঠা শেওলাধরা দেওয়ালটায় রাস্তার শিরীষ গাছের ছায়া হাওয়া্য দুলতে দুলতে নানারকম আকৃতি তৈরি করে! ওগুলি কি সব অশরীরী দুষ্টু আত্মা? নেমে এসেছে রাতের অন্ধকারে? ঘুমোতে দেরি করলে যাদের আসার কথা ঠাম্মি বলে? ওরে বাবা গো। প্রচণ্ড দম বন্ধ করা ভয়ে শানু চোখদুটো জোরে চিপ্পে বন্ধ করে থাকে। তারপর কখন যে ঠাম্মির প্রবল নাসিকাগর্জন এর শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে চলে যায় শানু।
ঘুমের রাজ্য বড় মজার। আমাদের অপূর্ণ বাসনা গুলো কেমন সত্যি হয়ে যায় স্বপ্নের মধ্যে। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে শানু! কি যে সুন্দর স্বপ্ন! দেখে মোড়ের মাথায় নতুন মলটায় ইলেকট্রনিক্সের ঝকঝকে দোকানটায় গিয়ে নিজেনিজেই একটা দারুন পিএসপি কিনেছে সে। কি অপূর্ব যে জিনিস তা! কত্ত রকমের গেম, কার রেসিং, ফাইট! বিদ্যুতের গতিতে দু’হাতে বাটন টিপেটিপে খেলে যায় শানু। জিতের পর জিত। ওঃ কি যে মজা! পড়ার চিন্তা নেই, পরীক্ষার ভয় নেই। বাবা, মা’র আশার উঁচু পাহাড়ের সামনে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে করবার মন খারাপ নেই - শুধু খেলা আর খেলা!
***
আজ সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠছে শানু। বোর্ডের পরীক্ষায় স্কুল ভাল ফল করেছে বলে ছুটি। যাই হোক তাই বলে কি মা আজ তাকে আদর করে ঘুম থেকে ওঠাতেও আসবেনা! নিশ্চয় বোনি কাল রাত্তিরে কেঁদে কেদে মাকে ঘুমোতে দেয়নি। গুটি গুটি পায় শানু মার ঘরের দিকে যায়, কোলের কাছে ঘেঁষে শুয়ে একটু আদর খাবে বলে।
এদিকে আজ সকাল থেকে বাড়িতে একটা চাপা উত্তেজনা চলেছে। সুমন মানে শানুর বাবা নাকি একটা নোটের বান্ডিল সে্দিন অফিস থেকে ফিরে ড্রয়ার এ রেখেছিলেন, সেটা এখন পাওয়া যাচ্ছেনা । মানসিক উষ্মার পারদ ক্রমশ চড়ছে। তার মধ্যে যেই না মালা বলেছেন, “তুমি ঠিক মনে করতে পারছ ওখানেই রেখেছিলে?” সুমন চিৎকার শুরু করলেন- “তার মানে আমাকে কি তোমার মতো ভুলো পেয়েছ? নির্ঘাত শানুর জন্মদিনের দিন ওটা গিয়েছে, বাড়িতে অত লোক এসেছিল!” তারপর একটু চাপা স্বরে যেন দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, “তোমার দুটি অপোগণ্ড খুড়তুতো ভাই তো এই ঘরে বসে ল্যাপটপ এ কি সব করছিল”। ইঙ্গিত টা বুঝতে পেরে মালার ও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। কান্নাকান্না গলায় বলে ওঠে, “কি – কি বলতে চাইছ তুমি? আমার কাকার অভাব থাকলেও ছেলেদের অসৎ হতে কখনও শেখান নি!” বলতে বলতেই দুর্বল স্থানে আঘাতে আহত মালা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। একটু বেচাল কথা বলে পরিস্থিতি বেসামাল দেখে সুমন তাড়াহুড়ো করে অফিসের জন্য তৈরি হতে শুরু করে।
মার কাছে এসেছিল শানু। সেও কথার মানে মাথা বুঝতে না পেরে, আবহাওয়া উত্তপ্ত দেখে দৌড়ে ঠাম্মির ঘরের দিকে পালিয়ে যায়।
ঠাম্মি বসে বোনের জন্য সোয়েটার বুনছেন আর পিসির সঙ্গে কথা বলছেন। পিসি শানুর জন্মদিনের আগে থেকে এসে এই কদিন এখানেই আছে। তাই শানুর বেশ মজা। ঘরে ঢুকতে গিয়ে শানু শুনতে পায় পিসি বলছে, “কোথায় টাকা টা যেতে পারে বলো তো’ মা? সেদিন তো দাদা আসার আগেই সব কাজের লোকও চলে গেছল!” ঠাম্মি পান চিবোতে চিবোতে উল বোনার কাঁটাগুলি তীব্র বেগে চালাতে চালাতে বলেন, “না না, সে সব সম্ভাবনা তো নেই ই। দ্যাখ গে সে টাকা বউ’মা বাপের বাড়িতে পাচার করেদিয়েছে। ওদিকে, মা বিধবা হবার পর ত ইনিই হাত খরচা সব জোটাচ্ছেন। যতোসব উটকো অশান্তি। মাঝখান থেকে আমার ছেলেটার কষ্ট!” কথার শ্লেষ আর তির্যক আক্রমণ শানু ঠাহর করতে না পারলেও টাকা নেবার ইঙ্গিত টা যে মায়ের দিকে সেটা শানু বুঝতে পারে । আর তখনই ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে শানুর। আর না দাঁড়িয়ে দৌড়ে ফিরে যায় মায়ের ঘরের দিকে । সুমন স্নান সেরে এসে প্যান্ট সার্ট পরতে পরতে বলে, “আচ্ছা শানু কি সেই পি এস পি না কি তার জন্য----- !” পুরো কথা শেষ হবার আগেই মালা চিৎকার করে কেঁদে বলে ওঠেন , “না কক্ষনও না – আমার ছেলে কোনোদিনও এ কাজ করতে পারে না” মা এর আকস্মিক সরব কান্নায় ঘুমন্ত বোনি চমকে জেগে উঠে তারস্বরে কাঁদতে থাকে। বেগতিক দেখে সুমন তাড়াতাড়ি অফিসে বেরিয়ে যা্ন। শানকে ঘরে আস্তে দেখে মা বলেন “বোন কে একটু খেলা তো বাবা! আমি চান টা সেরে আসি”। মালা বাথরুমে ঢুকে জলের কল জোরে খুলে দেন । জমে থাকা বাকি কান্না টা কি ঐ জল তরঙ্গ চাপা দিতে পারল?
***
বোনি টা একটা অদ্ভুত। তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দুম করে (শানুকে দেখেই বোধহয় ) “গি গি” আওয়াজ করে হাতের পুরো মুঠি টা নিয়ে নিজের মুখে পুরে দিয়ে ওয়াক তুলতে থাকে। শানু আস্তে আস্তে তার হাত টা মুখ থেকে বার করে আনতে যায়। অই এক রত্তি পুটকে আবার হাত টা মুখের কাছে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে আর মহানন্দে পা ছোড়ে। শানু কতবার ভেবেছে একে ব্যাল্কনিতে একা প্র্যামে শুইয়ে রেখে দিলে কেমন হয়! ওই যে বস্তা নিয়ে জিনিষ কুড়িয়ে বেড়ানো লোক গুলো ঠিক লুকিয়ে ওকে তুলে নিয়ে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেবে- কেউ জানতেও পারবেনা এদিকে শানু আবার মায়ের কাছে কাছে থাকতে পারবে! কিন্তু বোনি টা তার সদ্য বেরোনো দুটো দাঁত নিয়ে এমন একটা হাসি হাসল আর ‘দ –দ-দ-দ’ করে গান জুড়ল যে শানুর মন টাও জুড়িয়ে গেল। সত্যি বলতে কি এই ‘দ-দ’ শব্দ টা শানুর শুনতে বেশ মজা লাগে- বেশ একটা বড় দাদা দাদা ভাব হয় শানুর।
ইতিমধ্যে স্নান করে মা বেরিয়ে এসেছেন। শানুর মনে হল ছুট্টে মার কাছে যায়। কিন্তু যেতে পারে না, ভীষণ একটা কষ্ট হচ্ছে শানুর বুকের মধ্যে। মা ধীর পায়ে ঠাকুরের আসনের কাছে যান। অন্যমনস্ক ভাবে প্রদীপটা জ্বালান। প্রদীপের স্বর্ণাভ আলোর আভা’তে মা এর সদ্য স্নাত রক্তিম মুখ’টা কোন দেবীর মতই লাগে শানুর। এই সংসারে সন্তানের প্রতি স্নেহ, মায়া আর অগাধ বিশ্বাসের পরশ পাথর মাতৃত্ব কে যে দেবীতে উন্নীত করতে পারে।দৌড়ে গিয়ে শানু মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে “মা মা ---আমি আমি----,” কিছুই কথা বলতে পারেনা শানু- শুধু মার কোলে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। আস্তে আস্তে মা শানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। তাঁর ও কপোল বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা। বলেন “আর কোনও দিন কিছু পেতে ইচ্ছে হলে, এমন না বলে টাকা নিও না যেন” বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শানু ফোঁপাতে ফোঁপাতে উঠে বসে, আশ্চর্য --- মা তাহলে সব জানতেন যে শানুই সেই টাকাটা PSP কেনার জন্য ......!! তাহলে সব কিছু জেনেও উনি বাবার সঙ্গে শানুর হয়ে লড়লেন? মা কে জড়িয়ে ধরে শানু আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। লজ্জা আর অনুতাপে মুহূর্তে শানু যেন অনেকখানি বড় হয়ে যায়। তবু বুঝতে পারে না সেদিনের মায়ের শানুর প্রতি গভীর আস্থাটাই যে শানুর মধ্যে স্বীকারোক্তির সৎ সাহস টা জুগিয়েছিল। সেটা শুধু জানতেন মা।
পম্পা ঘোষ
সিঙ্গাপুর
- বিস্তারিত
- লিখেছেন পম্পা ঘোষ
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
লুব্ধক
আমাদের ভূগোলস্যারের দুই যমজ ছেলে, অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ। ক্লাস ইলেভেনের ফার্স্ট বয় অক্ষাংশ সারাদিন ঘরে বসে থান ইটের মতো মোটা-মোটা বই পড়ে, কঠিনস্য কঠিন সব অংকের ফর্মূলা নিয়ে মাথা ঘামায়। ওদিকে দ্রাঘিমাংশ হল টোটো কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। স্কুল ছুটির পর বাড়ি এসে পোশাকটা বদলেই এক ছুটে বেরিয়ে পড়ে সে। বিকেলবেলা সাইকেলে চেপে দু'-এক ঘন্টা এদিক সেদিক না বেড়িয়ে এলে ভাল লাগে না দ্রাঘিমাংশের।
গুয়াহাটির মালিগাঁওতে থাকে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের পিসতুতো দিদি রুমকিদিদি। তার বিয়ে উপলক্ষে গত শীতে বাবার সঙ্গে মালিগাঁও গিয়েছিল দুই ভাই। রুমকিদিদির একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর আছে। খয়েরি রং, বাঘের মতো চেহারা। কুকুরটার নাম জিয়ান। তার মুখের হাঁ এত বড় যে দেখলে পিলে চমকে যায়। এমনিতে সে শান্ত। তবে দ্রাঘিমাংশ জিয়ানকে দেখে মুখ ভ্যাংচানোর পর তাকে দেখলেই রেগে যাচ্ছিল জিয়ান। তার দিকে তেড়ে আসছিল বারবার। তবে অক্ষাংশর সঙ্গে বেশ বনিবনা হয়ে গিয়েছিল জিয়ানের। রুমকিদিদি দু'হাত দিয়ে জিয়ানকে ধরে রাখত, অক্ষাংশ জিয়ানের সোনালি-খয়েরি লোমগুলো ঘেঁটে দিয়ে ভয়ে ভয়ে আদর করত। জিয়ান কিছু বলত না।
গুয়াহাটি থেকে ফিরে আসার পর থেকেই অক্ষাংশ বায়না ধরেছে তাকে একটা কুকুর কিনে দিতে হবে। ছেলের আবদারে প্রথমটায় না-না করলেও পরের দিকে ভূগোলস্যার নিমরাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল দ্রাঘিমাংশকে নিয়ে। ঘাড়-টাড় নাড়িয়ে দ্রাঘিমাংশ বলল, কুকুর খুব খারাপ জানোয়ার। এ'বাড়িতে কোনও কুকুর যদি এক দরজা দিয়ে ঢোকে তবে অন্য দরজা দিয়ে আমি বেরিয়ে যাব। এ আমার সাফ কথা।
দ্রাঘিমাংশকে অক্ষাংশ বড্ড ভালোবাসে। তার কুকুর পোষার ব্যাপার দ্রাঘিমাংশর কড়া আপত্তি থাকায় অক্ষাংশ চুপ করে গিয়েছিল। আর
কুকুর প্রসঙ্গ তোলে না। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দ্রাঘিমাংশ একটা লিফলেট নিয়ে এসেছে বাড়িতে। রাতে খাবার টেবিলে সেই হলদে
কাগজটা ভূগোলস্যারের হাতে দিয়ে ঘোষণা করল, এবার পয়লা জানুয়ারিতে জাগ্রত সংঘ থেকে একটা সাইকেল রেসের আয়োজন করছে।
কোনও এন্ট্রি ফি নেই। আমি সেই রেসে নাম দিয়ে এসেছি।
মা-মরা ছেলেদুটোর কোনও আবদার চট করে বাধা দেন নে ভূগোলস্যার। বললেন, বেশ তো, এ তো ভালো কথা। তা কতদুরে সাইক্লিং করতে
হবে তোদের?
দ্রাঘিমাংশ হাসল, বেশি দূর নয়, চুইখিম আর অ্যালবাং থেকে জলপাইগুড়ি শহর পর্যন্ত। ভয় পেয়ো না, এটা ওয়ান ওয়ে জার্নি। জাগ্রত সংঘের লোকেরা অ্যালবাংয়ে নিয়ে যাবে আমাদের। সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে আমাদের ফিরতে হবে জলপাইগুড়িতে।
ভূগোলস্যার চোখ কপালে তুললেন, চুইখিম আর অ্যালবাং ? সে তো বহুদূর রে! বাগরাকোট থেকে সোজা উত্তরে দিকে ঢুকে গেলে জলপাইগুড়ি জেলার সীমানা শেষ আর দার্জিলিং জেলার শুরু। সামরিক ছাউনি পাশে রেখে পাহাড়ি খাড়া পথে পৌঁছে যাওয়া যায় চুইখিমে। আরও একটু এগোলে অ্যালবাং। সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে এতদূর ফিরে আসা কি চাট্টিখানি কথা?
অক্ষাংশর চোখ ছানাবড়ার মতো হয়ে গেছে। সে বলল, আর ইউ ক্রেজি! অতদূর সাইকেল চালালে তো মরে যাবি তুই! দ্রাঘিমাংশ হেসে বলল, অত ভয় পাচ্ছিস কেন, আমি কি যুদ্ধে যাচ্ছি নাকি? তছাড়া ওদের মেডিক্যাল টিমও তো থাকবে সঙ্গে। ভয়ের কিছু নেই। তাছাড়া আমি তো আর একা নাম দিই নি, পঞ্চাশের বেশি ছেলে নাম দিয়েছে রেসে।
ভূগোলস্যার রাগ করলে ছেলেদের বকেন না। শুধু গুম মেরে যান। এবারও তাই হল। তিনি মৌনব্রত অবলম্বন করলেন। অক্ষাংশও চুপ করে গেল। দুজনেরই আশংকা, ছেলেটা পাগলামি করতে গিয়ে অসুস্থ না হয়ে পড়ে।
ইংরেজি বছরের শেষ সূর্য ডুবে গেল একটুক্ষণ আগে। সন্ধেবেলা দোতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে দুই ভাই। কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। সাঁঝের আকাশে একটা দুটো করে ফুটছে তারার গুচ্ছ। আকাশে ভেসে আছে বিরাট গোল চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে দ্রাঘিমাংশ নিচু স্বরে বলল,গত কিছুদিন ধরেই একটা স্বপ্ন বারবার দেখছি জানিস।
অক্ষাংশ জানতে চাইল, কীসের স্বপ্ন?
দ্রাঘিমাংশ দূর আকাশের দিকে চোখ রেখে বলল, চুইখিম আর অ্যালব্যাংয়ের স্বপ্ন। ঘুমোলেই ওখানকার দৃশ্য ভিড় করে আসছে চোখে। পাহাড়ের ঘন পাইন গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে রডোডেনড্রন। চিরসবুজ বনের মাথা ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। পাহাড়ি পাকদন্ডীর নীরবতা ভেঙে দিচ্ছি ঝিঁঝিঁ পোকার দলের ঘন্টাধ্বনির মতো আওয়াজ। ওখানে যাবার জন্য আমার আর তর সইছে না রে!
অক্ষাংশ নরম গলায় বলল, কপাল ভাল থাকলে ওখানে ম্যাগপাই পাখির দেখা পেতে পারিস। ম্যাগপাই আকারে বেশ বড়, জেব্রার মতো সাদা-কালো মেশানো ডানার রং। এছাড়াও কিট নামে এক রকম লুপ্তপ্রায় পাখিরও আসাযাওয়া আছে অ্যালব্যাং আর চুইখিমে।
ভোররাতে বেরিয়ে গেল দ্রঘিমাংশ। প্রতিযোগীরা আর তাদের সাইকেল গেল আলাদা আলাদা গাড়িতে। অ্যালব্যাংয়ে থেকে ঠিক বেলা আটটায় শুরু হবে সাইকেল রেস। জলপাইগুড়ি জাগ্রত সংঘের মাঠে এসে শেষ হবে সেই প্রতিযোগিতা। তারপর হবে পুরষ্কার বিতরণ। দুটো টিভি চ্যানেলও থাকবে অনুষ্ঠানটা কভার করার জন্য।
অশান্ত মন নিয়ে খবরের কাগজ হাতে বসে আছেন ভূগোলস্যার। অক্ষাংশ একটা গল্পের বইতে মন বসানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। দ্রাঘিমাংশর জন্য বড় ভাবনা হছে তার। বসার ঘরের ঘড়িটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজল। অক্ষাংশ আর ভূগোলস্যার দুজনেই দুজনের দিকে তাকালেন। দুজনের মুখেই ফুটে আছে দুশ্চিন্তা।
বিকেলবেলা জাগ্রত সংঘের মাঠে চলে এসেছে সবাই। কানাঘুঁষো শোনা যাছে তিস্তা ব্রিজ পার করে এসছে সাইকেল আরোহীরা। সাতজন প্রতিযোগী নাকি প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে সাইক্লিং করছে। দ্রাঘিমাংশও নাকি আছে সেই সাতজনের মধ্যে। জাগ্রত সংঘের মাঠে শুরু হয়ে গিয়েছে গুঞ্জন। পুরষ্কার দিতে মন্ত্রী এসেছেন দুজন। মঞ্চে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছিলেন এতক্ষণ। এবার নড়ে চড়ে বসেছেন তাঁরও। মিডিয়ার লোকজনও ক্যামেরা আর বুম রেডি করে চলে গেছে মাঠের মধ্যিখানে। সবার মধ্যেই একটা উত্তেজনার আঁচ। দ্রাঘিমাংশকে দেখা গেল প্রথমে। দ্বিতীয় প্রতিযোগীকে প্রায় একশো মিটার পিছনে ফেলে প্রবলবেগে প্যাডল করতে করতে আসছে সে। চোখে একাগ্র দৃষ্টি, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে তার শরীর। তার পেছন পেছন ছুটে আসছে, কী আশ্চর্য, একটা দৈত্যের মত কুকুর! পাটকিলে রংয়ের গা ভর্তি চকচকে লোম কুকুরটার।ছোট্ট ল্যাজ, বিরাট বড় মুখ। লম্বা কান দুটো ঝোলা ঝোলা, লাল টুকটুকে জিভ বার করে দৌড়াচ্ছে কুকুরটা।
জাগ্রত সংঘের মাঠে পৌঁছে রিবনে সবার আগে বুক ছুঁইয়েই সাইকেল থেকে মাটিতে পড়ে গেল দ্রাঘিমাংশ। হাঁপাচ্ছে, ছোট্ট বুকটা উঠছে
নামছে হাপরের মতো। সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। ওদিকে কুকুরটা ছুটে এসে চুকচুক করে চাটতে শুরু করে দিয়েছে দ্রাঘিমাংশের গাল। অত
ক্লান্তির মধ্যেও দ্রাঘিমাংশ কুকুরটার মাথাটা ধরে আদর করে দিল একটু। আহ্লাদে কুঁই কুঁই করছে কুকুরটা।
ঘটনা দেখে স্তম্ভিত ভূগোলস্যার আর ওক্ষংশ। তাজ্জব মঞ্চের বিশিষ্টজনেরা, অবাক উপস্থিত মানুষজন। এমন অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী কেউ হন নি কখনও। দ্রাঘিমাংশ একটু ধাতস্থ হতেই সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। মিডিয়ার লোকজন ক্যামেরা তাক করেছে। দুজন দুটো বুম ধরেছে দ্রাঘিমাংশর মুখের কাছে। সবাই কৌতুহলী, প্রত্যেকেই এই আশ্চর্য ঘটনাটার কথা তার মুখে শুনতে চায়।
দ্রাঘিমাংশ কুকুরটাকে নিয়ে কোলে। লাজুক হেসে বলতে শুরু করল তার গল্প। সকালে রেস শুরু হবার আগে অ্যালবাংয়ে প্রতিযোগীদের চিকেন
স্যান্ডুইচ খেতে দেওয়া হয়েছিল। সবাই পুরোটা খেয়ে নিলেও দ্রাঘিমাংশ অত বড় স্যান্ডুইচ খেতে পারে নি। সে অর্ধেকটা ফেলে দিয়েছিল পথের ধারে। এই পাহাড়ি কুকুরটা ছিল আশেপাশে কোথাও। সে গলাধঃকরণ করেছিল সেই চিকেন স্যান্ডুইচের ভুক্তাংশ। তারপর থেকেই সে ছুটে ছুটে আসছে। কুকুরটা দ্রাঘিমাংশর সঙ্গে সঙ্গে পুরো পাহাড়ি পাকদন্ডী পথ ধরে নেমেছে, সমতল পথ ধরে ছুটেছে। প্রথমটায় দ্রাঘিমাংশ ভেবেছিল তাকে বুঝি তাড়া করছে কুকুরটা। সে প্রানভয়ে প্যাডল করে চলছিল। একটা সময় তার দম শেষ হয়ে যায়। চালসা মোড়ের কাছে এসে বাধ্য হয়ে তাকে থেমে যেতে হয়।কিন্তু অবাক হয়ে দ্রাঘিমাংশ দেখে কুকুরটা তাকে আক্রমন করতে আসছে না, বরং জিভ দিয়ে তার হাত-পা চেটে দিচ্ছে কুঁই কুঁই করে। এমনকী জাগ্রত সংঘের মাঠ পর্যন্ত সে চলে এসছে দ্রাঘিমাংশর পেছন পেছন।
বিরাট একটা ট্রফি আর মোটা টাকার চেক নিয়ে জাগ্রত সংঘের মাঠ থেকে পাড়ার ছেলেদের ঘাড়ে চেপে বাড়ি ফিরেছে দ্রাঘিমাংশ। সঙ্গে সঙ্গে এসেছে সেই কুকুরটা। ঠাঁই নিয়েছে এ'বাড়িতে। এখন অক্ষাংশের সঙ্গেও দিব্যি দোস্তি হয়ে গেছে তার। সে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করে না, ছোট্ট ল্যাজটা নাড়ে আর আদুরে গলায় কুঁইকুঁই করতে থাকে। সকালের খবরের কাগজ বারান্দায় দিয়ে গেলে সেটা মুখে করে ভূগোলস্যরের কাছে এনে দেওয়া এখন তার ডিউটি। তবে স্বভাবে সে মোটেই নিরীহ নয়। একটা বিরাট গন্ধগোকুল এ'বাড়িতে উৎপাত করছিল মাস খানেক ধরে। চালে উঠে লাফঝাঁপ করত, সিলিংয়ে হিসি করে দিত যখন থখন। একদিন রাতের অন্ধকারে গন্ধগোকুলটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফালাফালা করে দিয়েছিল কুকুরটা।
রাতের আকাশে যে কালপুরুষ দেখা যায় তার শিকারি কুকুরের নামে ভূগোলস্যার কুকুরটার নাম দিয়েছেন 'লুব্ধক'। দুই ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমোয় সে। বিছানা নোংরা করে না, বাইরে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজকর্ম করে আসে চুপ করে। খাওয়া নিয়েও ঝামেলা নেই। প্রতিদিন সোনামুখ করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে দুধভাত খেয়ে নেয় সে।
তবে লুব্ধক মোটেই সাধুসন্ন্যাসী নয়। তারও একটা দুর্বল জায়গা আছে। সেটা হল চিকেন স্যান্ডুইচ। যেদিন দ্রাঘিমাংশ লুব্ধকের জন্য চিকেন স্যান্ডুইচ কিনে নিয়ে আসে সেদিন লুব্ধকের ল্যাজ নাড়া অনেক বেশি বেড়ে যায় !
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
উপসংহার
“এরকম ছবি কারা তোলে?... কি রকম ক্যামেরা দিয়ে এইসিব ছবি তোলে?... কোন দেশে এরকম দেখা যায়?...” এক কালে, গ্রীষ্মের দুপুরগুলো এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই কেটে যেত। যদিও তার বহু আগে ছাত্রজীবনকে বিদায় জানানো হয়ে গেছে, তবু তখন আমার গ্রীষ্মের ছুটি। খড়গপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় অযাচিত ভাবেই জীবনে গ্রীষ্মের ছুটি আবার ফিরে এসেছিল। বিদ্যালয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লে ছাত্রদের সাথে শিক্ষকদেরও এক মাসের অব্যাহতি। আমার বাসস্থান ওই স্কুলের কাছেই ছিল। আর ওই ছোট একতলা বাড়ির বারান্দা থেকেই একটা প্রকাণ্ড মাঠ দেখা যেত। গ্রীষ্মের সকালে বা বিকেলে বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখতে পেতাম আমার কোনও না কোনও ছাত্র সেখানে হুটো-পাটি করে খেলছে। তাদের খেলার মধ্যে কৈশোরের উল্লাস দূর থেকে উপভোগ করতে বেশ লাগত। শিক্ষকের অনাহুত উপস্থিতি তাদের পাছে বিব্রত করে, তাই সামনে গিয়ে তাদের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাতাম না। তবে সেই খেলার মাঠে যে ছেলেটিকে একেবারেই দেখা যেত না, সে হ’ল বিমল। যে স্কুলে পড়াতাম, সেই স্কুলেরই ছাত্র ছিল বিমল পাত্র। কোনও বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা অসাধারণ মেধার জন্য এত বছর পরও তার নাম স্মরণে আছে, এমন ভাবলে ভুল হবে। বিমল ছিল পেছনের সারিতে বসা অতি সাধারণ মানের ছাত্র। তার চেহারা, বাচনভঙ্গি বা পড়াশুনোয় অমনোযোগিতা দেখে বোঝা যেত যে সে স্কুলের গণ্ডি পার হলেই তার পরিবার উদ্ধার হয়ে যাবে।
সেই ছেলেটি প্রায়ই কামাই করত। প্রায় তিন-চার দিন পর ক্লাসে এসে বলত “জ্বর হয়েছে”। প্রথম প্রথম এরকম হ’তে দেখে বেশ বিরক্ত লাগত। সেই সময়, গ্রাম বাংলায় বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষালাভ করার সামর্থ্য সকলের থাকত না। আর যারা স্কুলে যেত তারা মনোযোগ দিয়েই স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার চেষ্টা করত। বিমলের মধ্যে বিদ্যা-শিক্ষার প্রতি এহেন অবহেলা বড়ই অসন্তোষজনক ছিল। সহকর্মীদের বলতে তাঁরা বললেন “সব বাঁদর ছেলেপিলে... স্কুলের বদনাম... ঘার ধরে বেড় করে দেবে... ঠেঙ্গিয়ে ঠিক করে দেওয়া উচিৎ।” আপাত ভাবে প্রথম ভাগের রাখালের সাথে বিমলের সাদৃশ্য দেখা যেত। কিন্তু বিমল ক্লাসে বিশেষ চপলতা করত না। এমন কি খেলার মাঠেও তার দেখা মিলত না। আর পাঁচজন অভিজ্ঞ সহকর্মীর পরামর্শ মত তার সাথে কঠিন হওয়ার চেষ্টা করলাম। লঘুদণ্ড, কিঞ্চিৎ প্রহার বা স্কুল থেকে বেড় করে দেওয়ার আস্ফালনেও তার মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করলাম না। যত দিন যেতে লাগল সেই অতি সাধারণ বালকের প্রগলভতা যেন হঠকারিতার রূপ নিয়ে মাথায় শেলের মত বিঁধতে লাগত। কেবলই মনে হ’তে লাগল এই ছেলেটির অদ্ভুত ব্যবহারের পেছনে কোনও নির্দিষ্ট কারণ আছে। সেই কারণ জানার কৌতূহল এযাবৎ কেউ দেখায়নি। সেই কৌতূহল প্রকাশের ধৃষ্টতা আমিই দেখালাম।
যে সব ছেলেরা বিকেলে মাঠে খেলত, তাদেরই ক’জন কে ধরে আলাদা ভাবে জানতে পারলাম বিমলের খবর। বিমলের বাড়ি ঠিক কোথায় কেউই বলতে পারল না। তবে সেই খেলার মাঠ থেকে দু’মাইল দক্ষিণে সবেদাবাগান বলে এক অঞ্চলে বিমল থাকে। আরও জানলাম, বিমলের বাবার একটা চায়ের দোকান আছে, বিমলকে সেখানে পাওয়া যেতে পারে। এর বেশি খবর কেউ দিতে পারল না। এর পরের রবিবারই সবেদাবাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। পথের ধারে কোনও চায়ের দোকান, বা গুমটি চোখে পড়তেই খেয়াল করছিলাম বিমলকে পাওয়া যায় কি না। কিন্তু তাকে দেখা গেল না। গোটা সবেদাবাগান অঞ্চলের চক্কর দিয়েও বিমলের দর্শন পেলাম না। এরপর আরও দু’দিন সাইকেল করে গেলাম ওই দিকে। দু-তিন দিন এভাবে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন বিমলকে দেখা গেল। তখন সকাল সাড়ে সাতটা হ’বে, সেদিনও আমি সাইকেল করেই গেছি। দেখি আমার সামনে রাস্তা দিয়ে একটি ছেলে কাঁধে বাঁশের লাঠি বয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সেই লাঠির দু’ধারে দু’টো টিনের পাত্র ঝুলছে। সেই ওজনের ভারে ছেলেটি সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু সেই ভাবেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। সাইকেলের গতি বাড়িয়ে সেই ছেলেটির সামনে যেতেই দেখলাম সে বিমল। আমাকে হঠাৎ সম্মুখে দেখা সে থমকে দাঁড়াল। কাঁধ থেকে বাঁশটা ফেলে দিল। টিনের পাত্র দু’টো ধাতব শব্দ করে রাস্তার ওপর পড়ল। ছলকে পড়া জলের ধারা, মেঠো পথ সিক্ত করে রাস্তার পাশের ডোবার দিকে এগিয়ে চলল। আমরা দু’জনে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলাম, কিন্তু কেউ কিছু বললাম না। অবশেষে আমার মুখে হাসির রেখা দেখে সেও সামান্য হেসে পুনরায় তার গুরুভার বহন করে এগিয়ে চলল। আমি ধীর গতিতে সাইকেল চালিয়ে তার সাথে তাল রেখে এগিয়ে চললাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম – “তুই কি রোজই সকালে জল দিতে যাস?”। সে কেবল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
--- “আর তাই বুঝি স্কুলে যেতে দেরি হয়?” এই প্রশ্নের আর কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
--- “তোদের বাড়ি কোথায়?”
--- “সামনেই”
--- “কে কে আছেন?”
--- “মা আর আমি”
--- “বাবা?”
--- “নেই... গত বছর, মারা গেছেন।”
--- “তাহলে চায়ের দোকান?”
চায়ের দোকানের কথা শুনে সে থমকে দাঁড়াল, আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার চলতে শুরু করল। আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করতে বলল “মা বসে... আমিও থাকি... যতক্ষণ পারি।” তারপর আমাকে প্রশ্ন করল “আপনি এ পাড়ায় হঠাৎ?” আমি সরাসরি বললাম “তোর খোঁজ নিতে।” বিমল হা হা করে হেসে ফেলল। টিন থেকে জল ছলকে পড়ল আবার। বিমলকে আবার জিজ্ঞেস করলাম “তোদের বাড়ি কত দূর?”। সে এড়িয়ে গিয়ে বলল “এখন আমি ঘরে যাচ্ছি না... জল দিতে যাচ্ছি।” তারপর আর আমার কোনও বক্তব্যের অপেক্ষা না করে রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে গেল। আমার আর ওর পেছন পেছন যেতে ইচ্ছে করল না। ততক্ষণে বিমলের দেরিতে স্কুলে আসা, পড়াশুনোয় অমনোযোগ, প্রভৃতি রাখালবৎ আচরণের কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। কারণ না জেনে ছেলেটিকে তিরস্কার করার জন্য একটা আত্মগ্লানি মনকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল। ঘরে ফিরে স্নান করার পরেও সেই গ্লানি দূর হ’ল না। বিমল সেদিন আর স্কুলে এলো না।
এর দু’দিন পর বিমল আবার স্কুলে এলো। সেদিনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমি আর ওকে বিব্রত করলাম না। স্কুল ছুটি হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই সাইকেল নিয়ে মাঠের পাশে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম বিমল আপন মনে চলতে চলতে সবেদাবাগানের দিকে যাচ্ছে। সন্তর্পণে তার পিছু নিলাম। বেশ খানিকটা দূর থেকে তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলাম। মিনিট কুড়ি হাঁটার পরে সে পথে ধারে একটি গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। সেই গলিরই একটা ছোট্ট টিনের চালওলা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে সে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাস্তার ধারে সাইকেল দাঁড় করিয়ে সেই হতশ্রী গলির ভেতর প্রবেশ করলাম। সেই দরজার কাছে এসে দেখলাম, তার পাশে একটা জানালা, সেই জানালার একটা পাল্লা খোলা। আর সেই গলির বাকি গার্হস্থ চিত্রটাও একই রকম। পাশাপাশি টিনের চাল, আর দরজা। রাস্তা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে তিন নম্বর দরজাটা বিমলদের, এই সনাক্তকরণ নিশ্চিত করে সেদিন প্রত্যাবর্তন করলাম।
এরপর এক শনিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই বিমলদের ঘরের সামনে গিয়ে হাজির হ’লাম। দরজায় প্রথমবার টোকা দিতে কেউ খুলল না, দ্বিতীয়বার টোকা দিতে দরজা অল্প ফাঁক হ’ল। ভেতরে ঘনীভূত অন্ধকার থেকে কেবল একটা চোখের আভাস পেলাম। কাঁসার বাসনের মত খনখনে স্বর ভেসে এলো – “কাকে চাই?” আমি ইতস্তত করে বললাম “বিমল আছে?” প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ দরজার একটা পাল্লা খুলল। ফুরিয়ে যাওয়া দিনের পরে থাকা আলোয় এক মহিলাকে দেখতে পেলাম। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মলিন বস্ত্র দিয়ে কোন মতে মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। কপালে কোনও টিপ নেই, সিঁথি খালি। কপালে দারিদ্রের বলিরেখা আর চোখে করুন অভিব্যক্তি নিয়ে তিনি আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি নিজে থেকেই বললাম “আমি বিমলদের স্কুলে পড়াই... আপনি বোধহয় বিমলের মা...”। আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সলজ্জ-ব্যস্ততার সাথে তিনি দরজার দু’টো পাল্লা খুলে আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। একটি মাত্র ঘর, তার এক পাশে স্টোভ আর রান্নার অন্য সরঞ্জাম পড়ে আছে, আর এক পাশে মেঝেতে শতরঞ্চির ওপর কিছু বই পড়ে আছে। আর দেওয়ালের ধারে পড়ে আছে দু’জোড়া ক্ষয়িষ্ণু হাওয়াই চটি। এক কোনে একটা ছোট খাট, মলিন চাদর দিয়ে তোশক নিজের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছে। সেই খাটের ওপর পড়ে থাকা একটা হাত পাখা দিয়ে বিমলের মা আমাকে বাতাস করতে লাগলেন। ঘরের মধ্যে জ্বলা একটিমাত্র হারিকেনের আলোয় তখনও তাঁর চোখে অপ্রস্তুত হওয়ার আভাস। তিনি বললেন “বিমল একুন ঘরে নেই, সন্ধেবেলা দোকানে বসে... ওই দোকানটাই একুন শেষ সম্বল কিনা... আমি একুনি গিয়ে ডেকে আনচি... দু’মিনিট বসুন। চা করে দি, খান।” আমি বাঁধা দিয়ে বললাম “আপনাকে অত ব্যস্ত হ’তে হবে না। আমি আপনার সাথেই কথা বলতে এসেছিলাম। বিমলকে নিয়ে কিছু কথা ছিল।” উনি কেবল “ও” বলে থেমে গেলেন। আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম “বিমলের কি সত্যিই লেখাপড়ায় আগ্রহ আছে? নাকি আপনারা জোর করেন বলে স্কুলে যায়?” আমরা প্রশ্নের উত্তরে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন “ওর বাপের সাধ ছিল লেখাপড়া শিকে ছেলে বড় কিচু হবে। তাই অভাবের মধ্যেও ছেলেকে ইস্কুলে ভর্তি করল। বাপকে মান্যি করত, কোনও ঝামেলা ছিল না। গেল বছর ওর বাবা চোখ বুঁজলেন, আর এই ছেলেও কেমন হয়ে গেল। সকাল হলেই কাজে যাচ্চি বলে বেড়িয়ে যায়। কোনোদিন ইস্কুল যায়, কোনোদিন যায় না। আমার কোনও কথাই গেরাজ্জি করে না।” বক্তব্য শেষ করে তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। ওনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম “আহা, বিমলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নিয়ে আমি আসিনি। কেবল জানতে চাইছিলাম ছেলেটার পড়াশুনোর প্রতি কতটা আগ্রহ।” তিনি কান্না থামিয়ে বললেন “আগে পড়ত, এখন পড়তে চায় না। আপনি দেকুন যদি বুজিয়ে-ধমকিয়ে কিচু করতে পারেন। আমি আর পারচি না।”
অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ অনেক সময়ই কিশোর মনে গভীর ছাপ ফেলে। সংসারে অবশিষ্ট একমাত্র পুরুষ হওয়ার জন্য বিধাতা তার ঘারেই জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছেন। মা কে অধিক পরিশ্রম করতে না দিয়ে কৈশোরেই সংসারের ভার বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিমল। এমন সংকল্পের কাছে শিক্ষালাভের ব্রতও ম্লান হয়ে যায়। লেখাপড়া শিখে বিশেষ উপকার হবে, সেই আস্থা আর থাকা না।
বিমলের মায়ের করুন দৃষ্টি, আর অব্যক্ত মিনতি সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম। ফেরার পথে দেখলাম একটা চায়ের দোকানে বিমল বসে আছে। দু-একজন দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। দোকানের সামনে সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়েছিল, তাই বিমল আমাকে দেখতে পেল না।
... ... ... ... ...
সোমবার বিমল স্কুলে এলো এবং ক্লাস চলাকালীন কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে পাঠ্যর প্রতি কোন মনোযোগ নেই, কৌতূহলের বিষয় কেবল আমি। এরপর একদিন আবার বিমলের চায়ের দোকানে গেলাম। আমাকে দোকানের সামনে সাইকেল থেকে নামতে দেখে ওর হাতের কেটলি থেকে খানিকটা চা বাইরে পড়ে গেল। আর পাঁচজনের মত আমিও দোকানের সামনে বেঞ্চের ওপর বসলাম। সে উপস্থিত গ্রাহকদের হাতে চায়ের ভাঁড় তুলে দিয়ে আমার দিকে তাকাল। কোনরকম সৌজন্য না দেখিয়ে বলল “আপনার কি লাগবে?” হারিকেনের আলোয় সদ্য-প্রকাশিত গোঁফ-দাড়ির রেখায় ডাকা মুখটা বেশ কঠিন মনে হ’ল। কোন উত্তর না পেয়ে আবার সে বলল “আপনাকে কি চা দেব? সঙ্গে বিস্কুট না মামলেট?” আমি বললাম “শুধু চা।” একটা মাটির ভাঁড়ে চা ঢেলে সে আমার দিকে এগিয়ে দিল। সেটা হাতে নিয়ে পাশে রাখলাম, তারপর ওকে প্রশ্ন করলাম “তুই বাড়ি থাকিস কখন?”
--- “কেন?”
--- “তোর সঙ্গে জরুরি দরকার ছিল। এখানে হবে না।”
--- “আমি কখন থাকি, কখন থাকি না... কোনও ঠিক নেই।”
--- “আমি চাইলে তোর মার সাথে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু তোকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল... তোর হাতেই দেবো।”
---“তাহলে এখানেই দিন...”
--- “না”
--- “তাহলে রবিবার বিকেলে আসুন, ঘরেই থাকব।”
চা শেষ করে বিস্কুটের বয়ামের ওপর এক টাকার কয়েন রাখলাম। বিমল ঘাড় নেড়ে সেই টাকা নিতে অসম্মতি জানিয়ে বলল “মা বলল আপনি সেদিন কিছু না মুখে দিয়েই উঠে গেছেন... ” আমি ওর পিঠে একটা হালকা চাপর মেরে বললাম “বেশ গুরুজন হয়েছিস! চা তোদের বাড়ি গিয়েই খাব আবার। এখন এই টাকাটা রাখ।” টাকাটা ওই বয়ামের ওপর রেখেই বেড়িয়ে এলাম, পেছন ফিরে আর দেখলাম না। কেউ পেছন থেকে কিছু বলল বলেও মনে হ’ল না। সাইকেল করে খানিকটা দূরে এসে পেছন ফিরে দেখলাম বিমলের দৃষ্টি আমার গতিপথের দিকে।
রবিবারের বদলে শনিবার বিকেলেই ওদের ঘরে গিয়ে হাজির হ’লাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম বিমল খাটের ওপর বসে চোখ কচলাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরে ঘুমচ্ছিল, আমার জন্য ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। বিমলের মা বিমল কে বললেন “মাস্টারমশাই এসেচেন, দেকেচিস?” বিমলের চোখের মধ্যে ঘুমের ঘোর কেটে এক অযাচিত সচেতনতা চলে এলো। নিতান্ত অপ্রস্তুতের মত চারপাশ হাঁতরে একটা শার্ট গলায় গলিয়ে নিলো। তারপর ব্যস্ত ভাবে খাট পরিষ্কার করতে লাগল। ওর মা বললেন “আপনি সেদিন কিছু মুখে না দিয়েই চলে গেলেন। আজ চা খেয়ে যেতেই হবে... জল চাপিয়েচি।” বিমল বসা গলায় বলল “আপনি তো বলেছিলেন রবিবার আসবেন।” একথা শুনে আমার মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেল “হ্যাঁ, আমি রবিবার আসি, আর তুমি তাল বুঝে সরে পড়!” বিমলের মুখে ভদ্রতার হাসি ম্লান হয়ে গেল, কান লাল হয়ে উঠল। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল খাটের পাশে। বিমলের মা চুপ করে স্টোভে বসানো কেটলির দিকে চেয়ে রইলেন। বিমলের হাত ধরে কাছে টেনে বললাম “তোকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে বলেছিলাম? এই নে... ” প্লাস্টিকের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আসতে আসতে প্যাকেট থেকে জিনিসটা বার করে দেখল... একটা নতুন বই। যে বই না নিয়ে যাওয়ার জন্য ক’দিন আগেও ক্লাসে শাস্তি পেয়েছে। বইটা হাতে নিয়ে সে প্রথমে হাসল, তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
কেটলির ভেতর জমে থাকা বাষ্প তার মুখ থেকে উষ্ণ প্রবাহে নির্গত হয়। কিন্তু মনুষ্য-হৃদয়ে জমে থাকা বাষ্প নির্গত হয় অশ্রু রূপে। পৌরুষ-সম্ভ্রম নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরুষ তাকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করে। সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত বালকের সেই কৌশল অবগত নয়। আর স্ত্রী জাতি সেই চেষ্টা করে শক্তির অপচয় করে না। বিমলের মায়ের মুখে হাসি থাকলেও, স্টোভের শিখার আভায় তাঁর চোখের কোন চিক চিক করছিল।
... ... ... ... ...
এরপর থেকে মাসে দু-তিনবার বিমলের বাড়িতে বা চায়ের দোকানে যেতাম। সেই সাধারণ শ্রীহীন কিশোরের মধ্যে অদ্ভুত এক সারল্য ছিল যা আমার ভালো লেগে গেল। সেই ভাল লাগার মধ্যে দয়া বা করুণার লেশ মাত্র ছিল না। ছেলেটির এক অদ্ভুত চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল। মেধাবী না হলেও, লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা ছাই চাপা আগুনের মত ধিক্ ধিক্ করে তার ভেতরে জ্বলত। কখনও ছুটির দিনে ওকে সঙ্গে নিয়ে অল্প দূরে কোন ঝিল বা দিঘির পারে যেতাম। পরিষ্কার জল দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত, আমি পারে দাঁড়িয়ে শত চিৎকার করলেও উঠে আসত না। পথে কোনও ফল গাছে দেখলে তরতরিয়ে গাছে উঠে তিন-চারটে ফল পেরে আনত। নীতি শিক্ষা দিতে গেলে বলত “ওই ফল গাছের পাখি আর হনুমানেও নষ্ট করে। আমিও না হয় একটা হনুমান।” বিমলের মধ্যে তীব্র নাস্তিকতা ছিল লক্ষণীয়। সাধারনতঃ গ্রামের মানুষদের মধ্যে এইরূপ নাস্তিক দেখা যায় না। বিমল কে কোনদিনও স্কুলের সরস্বতী পুজোয় আসতে দেখিনি। গ্রামের দূর্গাপুজোর সময় মণ্ডপের ধারেকাছে সে আসত না। পথ চলতে চলতে কোন মন্দিরের সামনে কাউকে প্রণাম করতে দেখলে, অদ্ভুত অবজ্ঞার হাসি নিয়ে তাকে দেখত। ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে জনসাধারণের এহেন ভক্তি দর্শনের মধ্যে যেন ভারী কৌতুকপূর্ণ কিছু লুকিয়ে আছে। সেই কৌতুক যেন সেই কেবল দেখতে পায়। হয়ত বিধাতাপুরুষ বাল্যকালে যাদের জাগতিক ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেন, তারা এইভাবেই তাঁর কর্মের মধ্যে কৌতুকের উৎস খুঁজে নেয়।
এক প্রতিবেশীর সহায়তায় বিমলের মায়ের জন্য একটা জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। ওনাকে মাসিমা বলে ডাকতাম। ছেলে স্কুলে যাওয়ার পর উনি সেলাইয়ের দোকানে কাজ করতে যেতেন। সন্ধ্যের পর ছেলের সাথে আবার চায়ের দোকানে বসতেন। বিমল ওই দোকানেই বই নিয়ে বসত। কেবল পরীক্ষার সময় দোকানে বসত না। তবে শত চেষ্টা করেও বিমলের সকালে জল বাড়ি বাড়ি জল দেওয়ার কাজ বন্ধ করতে পারিনি। বহুকালের পরিচিত প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজন যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন দৈব-রূপে সাক্ষাত শয়তান এলেও বোধ করি আর্তের মধ্যে এমন বিহ্বলতা প্রকাশ পায়। বিমলের বাবা অবর্তমানে সে ও তার মা হয়ত আমার মধ্যে এক আকাঙ্ক্ষিত অভিভাবক কে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাদের প্রতি সামান্য সহানুভূতি বা ভদ্রতাও তাদের কৃতজ্ঞতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিত।
গ্রীষ্মের ছুটিতে দুপুরবেলা বিমল মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে আসত। আমার ঘরে নানারকম রঙিন ছবিওয়ালা বিদেশি বই থাকত। আমি বসে কোনও একটা বই পড়তাম বা রেডিও শুনতাম, আর বিমল সেই সব বই আর পত্রিকার পাতা উলটে পালটে দেখত। পাশ্চাত্যের শহরের গগনচুম্বী বহুতল অট্টালিকা, ঝর্ণা, গাছের পাতার ওপর বসে থাকা উজ্জ্বল কীট-পতঙ্গ, এই সব ছবি বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখত। সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত, তুষার মণ্ডিত গিরি-শৃঙ্গর ছবি দেখে বলত “এরকম ছবি কারা তোলে? কি করে তোলে? কোথায় এরকম দেখা যায়?...” সেই ছবিগুলো আরও একবার দেখার আকর্ষণেই সেই বার বার আমার বাড়িতে আসত। আমার একটা ক্যামেরা ছিল, তাতে সাদা-কালো ছবি তোলা যেত। মাঝে মাঝে সেই ক্যামেরা নিয়ে বেরোতাম, আর ছবি তুলতাম। বিমল সেই ক্যামেরার লেন্স-এ চোখ রেখে চারিদিক দেখত আর ছবি তোলার ভান করত। ক্যামেরা হাতে পেয়ে গ্রাম্য কিশোরের সেই বালকোচিত আচরণ বড়ই অদ্ভুত দর্শন ছিল।
বিমল মেধাবী ছিল না, ঠিক ভাবে লেখাপড়া করার মত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু প্রবল মানসিক দৃঢ়তাকে সম্বল করে সে দু’বার মাধ্যমিকে ফেল করেও তৃতীয়বার পরীক্ষা দিল, এবং ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল। পাশ করার খবর পেয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল “তিন বছর একই জিনিস পড়া তো, তাই তিন বারের বার ঠিকঠাক শেখা হয়েছে... এক বারে পাশ করে গেলে শেখা হ’ত না।” ছেলে মাধ্যমিক পাশ করেছে বলে মাসিমা মৌরলা মাছের বাটি চচ্চড়ি খাইয়েছিলেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্যে ঋণ পরিশোধের প্রবল আকুতি মুহুর্মুহু প্রকাশ পেত। সেই আকুতি নিয়েই প্রতিবার তিনি বলতেন “আবার এসো বাবা...”।
জেলা হাইস্কুলে বিমল একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হ’ল। ঠিক সেই সময়, অপ্রত্যাশিত ভাবে আমি কলকাতায় একটি চাকরি পেয়ে গেলাম। খড়গপুরের বাসা ত্যাগ করার সময় ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগল। কলকাতা ফেরার ক’দিন আগে বিমলদের বাড়িতে গেলাম ওদের সাথে শেষবার দেখা করে নিতে। আমার কলকাতা ফেরার খবর শোনার পরেও বিমলের ভাবলেশহীন চোখে অভিব্যক্তির কোনও পরিবর্তন হ’ল না। তবে সেদিন ওদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় মাসিমার চোখের অবলম্বনহীন অসহায়তা সারা জীবন হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।
কলকাতায় ফিরে আসার মাস ছয়েক পর একবার খড়গপুরে গেছিলাম। কিন্তু বিমলদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম দরজায় তালা ঝুলছে। পাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানলাম বিমল ও তার মা খড়গপুর ছেড়ে চলে গেছে। কোনও এক পরিচিত আত্মীয় বিমলের জন্য শহরে কাজের ব্যবস্থা করেছে, তারা তার সাথেই চলে গেছে। বিমল এইভাবে ছ’মাসের মধ্যে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কর্মসন্ধানে আত্মীয়র শরণাপন্ন হ’বে, একথা ভাবতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বিমল বা তার মায়ের সাথে খড়গপুর অথবা কলকাতায় আর দেখা হয়নি। মাসিমার চোখে সেই সজন হারানোর শূন্যতাই শেষ স্মৃতি হয়ে থেকে গেল।
... ... ... ... ...
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেলো। সেই সময় আমি কলকাতায় থাকি। আমার এক বন্ধুর সাথে ছুটির দিনে নাটক, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্র প্রদর্শনী অথবা আলোচনা সভায় যেতাম। বেশ লাগত সৃষ্টিশীল সমাজের কেউকেটাদের নানারকম মতামত শুনতে। শহরের বিদ্বজ্জনের কথোপকথনের একটা-দুটো টুকরো হঠাৎ ভেসে এলে মাঝে মাঝে কৌতুকও বোধ করতাম। সেইরকম একদিন ‘অপ্রতিম’ নামক এক এক শিল্পীর আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখতে গেলাম। তার নাম আগে কখনও শুনিনি, তবে “ওয়াইল্ড লাইফ”-এর ওপর কিছু ছবি অনবদ্য। শুনলাম তিনি বেশ কিছু বছর বেলজিয়ামেই কাটিয়েছেন... তারপর আফ্রিকা মহাদেশে এবং ব্রাজিলে। শিল্পী সেই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু আলোকচিত্রের নিপুণতা দেখে তাঁর সাথে দেখা করার ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার সেই বন্ধুর চেষ্টায় কিছুদিন পরেই শিল্পীর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির হ’লাম।
দোতলা বাড়ির সদর দরজায় নেম প্লেট, তাতে স্পষ্ট লেখা ‘অপ্রতিম’। বেল বাজাতে একজন বেয়াড়া এসে দরজা খুলে দিল। সেই পথ দেখিয়ে আমাদের দোতলায় নিয়ে চলল। বাড়ির প্রতিটা দেওয়াল জুরে অসাধারণ সব আলোকচিত্র। বর্ণ, আকৃতি, আলো-ছায়া চারিদিকে খেলা করছে। বেয়ারা আমাদের প্রশস্ত ড্রইং-রুমে বসিয়ে তার দাদাবাবু কে ডাকতে গেল। ড্রইং-রুমের চারিদিকে চোখ বোলাতে গিয়ে একটা দেওয়ালে কেবল মাত্র একটি ছবি চোখে পড়ল। এক প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক নির্মল হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই মুখ অতি পরিচিত। তবে সেই মুখে কোনও মলিনতা নেই, দৃষ্টিতে করুণ আকুতি নেই, সহানুভূতির প্রতিদানে অসহায় কৃতজ্ঞতাবোধের চিহ্ন নেই। নিশ্চিন্ত, প্রশান্ত দৃষ্টি। সেই ছবিতে মোটা রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে। আর তার ঠিক নীচে একটা ছোট পিঁড়ির ওপর একটা মালা রাখা, আর তার চার পাশে ফুল ছড়ানো। সোফা থেকে উঠে এক পা এক পা করে সেই ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম জলচৌকির ওপর একজোড়া পুরনো হাওয়াই চটি। তারই ওপর মালা রাখা, আর চারপাশে ফুল ছড়ানো। বুঝতে অসুবিধে হ’ল না এ চটি কার। সেদিনের গ্রাম্য, হতশ্রী, নাস্তিক বিমল আজকের প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিম হয়েছে। তবে তার মা কে যথার্থ ভাবে দেবীর সম্মান দিতে ভোলেনি। মাসিমার স্মিতহাস্য মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেড়িয়ে গেলাম। বন্ধুর পিছু-ডাক গ্রাহ্য করতে ইচ্ছে হ’ল না। বিমল বা অপ্রতিম কারও সাথেই আর দেখা হয়নি।
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প