সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

প্রাণপনে ফুঁ দিতে থাকে চিংড়ি। হাতে ধরতে পারছে না এত গরম! দু হাতে লোফালুফি করে। ডান থেকে বাঁ, বাঁ থেকে ডান। আলি, সুমনা, মৌমিতা, সুজয় সবাই হাসছে ওর কান্ড দেখে। মিনুর মুখ ভার। হবেই তো। হেরে গেছে যে! মিনু মুখ বাঁকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় আর অমনি ওটা হাত ফসকে সোজা মাটিতে! যাহ! বাঁধের ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে গড়াতে জাহিরা চাচির বাড়ির সামনের ঢাল বেয়ে জলের দিকে গড়াচ্ছে! সবাই দৌড়ে দৌড়েও ধরতে পারছে না! মিনুর সে কি হাসি! এখন জোয়ার আসছে। সব সুন্দরী গাছের মাথা টুকু শুধু ভেসে আছে! নাহ! আলি ঝাঁপ দিয়ে শেষ চেষ্টা করে একবার- কিন্তু পারলো না। সোওওজা জলে পড়ে গেল আর জোয়ারে ভেসে গেল চিংড়ির অত সাধের গরম গরম ডিম সিদ্ধ! চিংড়ির চোখ ফেটে জল আসে। সব শূন্য হয়ে যায়। হাসির আওয়াজে পিছনে ফিরে দেখে মিনু হাত তালি দিয়ে  ঘুরে ঘুরে নাচছে আর ওকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে "কাঁচকলা খা...হুঃ একটা গোটা ডিম সিদ্ধ একা খাবে একবারে খাবে ...গরম গরম ডিম সিদ্ধর লাল লাল হলুদ হলুদ কুসুম খাবে...আহারে! হেরো হেরো!" সুমনা বলে "কেন হেরো কেন? ডিম দেবে কিনা সেই নিয়ে বাজি ছিল! ডিম তো দিয়েছে, তাহলে ও তো জিতেছে! মিনু বলে " তোকে কে সর্দারি  করতে বলেছে?  আজ ডিম খেতে পারবে কি না সেই নিয়ে বাজি ছিল? কিরে চিংড়ি? তুই বলিস নি, কাল কলকাতা থেকে দিদিরা আসবে ,কেলাশ নেবে মজা করে আর আমরা মজা করে  ডিম সিদ্ধ খাবো?" ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলে আর মৌমিতা বলে " হ্যাঁ তা কিন্তু ঠিক। চিংড়ি এটাই বলেছিল"; মিনু চেঁচায় "বলে ছিলোই তো! গেলবার আমার বোনের ইশকুলে এসেছিল না ? কেক, কলা আর মিষ্টি দিয়েছিল। ডিম মোটে দেয়নি! তাই তো আমি বললাম যে "ওই আনন্দেই থাক! কাল আর ডিম খেতে হচ্ছে না! কি রে আলি? বলিনি?" আলি চুপ করে থাকে । সুমনা তবু বলে "কিন্তু ডিম তো দিয়েছিল! হাত থেকে পড়ে গেলে ও কি করবে?" মিনু বলে "আমি তার কি জানি? ওর ডিম খাওয়া হয় নি, ও আমাকে ওর নতুন রং পেন্সিল গুলো দেবে ব্যস!" সুমনা এবার চিংড়ির ওপরেই রেগে যায়। "হলতো? তোর সবেতে বেশি বেশি। বললাম ডিমটা খেয়ে নে , আমরা তো তখনি খেয়ে নিলাম!" এখন ডিমও গেলো রং পেন্সিলও গেল! এখন কি করবি? রং পেন্সিল দিলে খুব মার খাবি তো !"

মিনু ভেংচায় "তোর দেখি চিংড়ির ওপর খুব দরদ! তাহলে তুইই দে ...সেবার তো তুইও কুইজে পেরাইজ পেলি? এতই যখন তোদের ভালবাসা, দে তাহলে? তাহলে তো চিংড়িকে আর কাকার  পাখার বাড়ি খেতে হয় না! নাহলে ওর হয়ে তুই খেয়ে আয় গিয়ে পেটানি...হি হি হি" সুমনা আর পারে না। " কুচুটে  কোথাকার"! বলে রেগে গিয়ে এক ধাক্কা দেয় মিনুকে! মিনুও খামচি মারে "তবে রে!" বাকিরা ওদের ছাড়াতে চেষ্টা করে । মিনু আর সুমনাকে ছাড়ায় ওরা। মিনু হঠাৎ চিংড়িকে এক  ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালায়। আচমকা ধাক্কা সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে বাঁধ থেকে ও। সবাই চিৎকার করে ওঠে। আলি ওর পা টেনে ধরে "এই দি? দি?" – আলি আবার ওকে দি বলছে কেন ভাইয়ের মত? কে কাঁদছে খুব জোরে জোরে? মায়ের গলা ভেসে আসে... "ধিঙ্গি মেয়ের ঘুম দেখো বোনটা কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছে? ধর ওটাকে!" জোরে জোরে পা ধরে টানে আলি...ব্যথা লাগে এবার।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসে চিংড়ি। ভোর হয়ে গেছে। রোদ আসছে ভেতরে। বোনটা তেনা ভিজিয়ে কেঁদে যাচ্ছে, ভাই পা ধরে নাড়াচ্ছে। বাইরে থেকে মা এসে ঢোকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে। চিংড়ি চোখ মুছে বোনকে ধরতে যায়। মা ছিনিয়ে নেয়। "হয়েছে, আর করতে হবে না। তুমি যাও ঘুমাও গিয়ে। তারপর  উঠে এক ধামা মুড়ি গিলে ইশকুলে চলে যাও !  ব্যস! জন্মের কাজ শেষ! মা বোনকে কোলে নিয়ে ভেজা কাপড় আর চট নিয়ে বাইরে চলে যায়।  চিংড়ির চোখ থেকে জল গড়াতে থাকে। আর কত করবে ও! ওতো ভাই বোনকে অনেক দেখে! কাঁদতে কাঁদতে স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। স্বপ্ন ভেবে যে একটু স্বস্তি পাবে সেটাও পারে না। এবার ওর ভয় করে।  নতুন রং পেন্সিল গুলো আগের বার ইশকুলে দৌড়ে পেরাইজ পেয়েছিল। একটা সুন্দর বারোটা পেন্সিলের  প্যাকেট আর একটা আকাঁর খাতা- ফাস্ট পেরাইজ। যদি সত্যি ওটা মিনুকে দিয়ে দিতে হয় তাহলে যে কি মারটা পড়বে সেটা ভেবে পায় না। ওর বুক ধুকধুক করে।

 সুন্দরবনের একটা দ্বীপের বাসিন্দা ওরা। গ্রামে এখনো ইলেকট্রিক আসেনি সব জায়গায়। সবে কাজ শুরু হয়েছে। পোল বসছে। কিন্তু এলেও ওরা লাইন নিতে পারবে না মনে হয়। তেমনটাই তো বাবা বলছিল মাকে সেদিন। ওরা খুব গরিব। নিজেদের জমি নেই। আয়লাতে ভেসে  গেছিল বাড়ি ঘর। তবু ত্রাণের পর সরকারি সাহায্যে একটা মাথা গোঁজার জায়গা হয়েছে কিন্তু জমি তো কাকারা ঠকিয়ে সবটা নিজের নামে করে নিল! ওর দিদি শহরে লোকের বাড়ি কাজ করে। দিদির বয়স ১৬ হল। বিয়ের কথা চলছে। কিন্তু টাকা নেই বলে হচ্ছে না। কি করে হবে? দিদির পড়াশুনো হয় নি। এখন আবার আঠেরো বছরের আগে বিয়ে দিলে পুলিশ ধরবে। যদিও লুকিয়ে অনেকে দিয়ে দেয়। মা বলেছে ভালো ছেলে খুঁজতে থাকি, পেলে দিয়ে দেবো। টাকার  যোগাড় করতে হবে, সময় তো লাগবে, বলা যায় না বিয়ে হতে হতে আঠারো হয়েও যেতে পারে। তাহলে আর পুলিশের ঝামেলা নেই! ওর আরো দুটো ছোট ভাই বোন আছে। একজন চার আর একজন দু বছর। মা মীন ধরে, কাঁকড়া ধরে,অন্যের জমিতে খাটে আর বাবা জঙ্গল করে। গভীর জঙ্গলে আরো অনেকের সঙ্গে মধু আনতে যায়, কাঠ আনে, মাছ ধরতে যায়। নিজের নৌকো নেই। বাঘ আর কুমীরের ভয় আছে। পারমিট ছাড়াই কখনো অনেক ভেতরে যেতে হয়। একবার ধরাও পড়েছে।  ডাকাত ও আছে। বাবা জঙ্গলে গেলে ওর খুব ভয় করে। ওর ইচ্ছে করে মায়ের আঁচলের মধ্যে সেঁধুতে, কিন্তু ছোট ভাই বোনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। বোনটা তো এখনো বুকের দুধ খায়। ভাইও কেঁদে ওঠে রাতে। বিছানা ভেজায় দুজনেই। মা চিংড়িকেই বলে ওদের ধরতে, আর তারপর রেগে রেগে এক ঘা দেয় ভাইকে- তারপর অন্যদিকে সরে শোয়, কখনো শুকনো ছেঁড়া কাপড় পাতে। চিংড়ির তো দশ পেরোল। ভাই বোন সামলাতে ও ঘরে থাকলে মা আরো বেশি কাজে বাইরে যেতে পারতো কিন্তু  চিংড়ি ইশকুলে এলে মিড ডে মিল পায় আর সরকার কিসব অনেক টাকা দেয় মেয়েদের উঁচু কেলাশ অবধি পড়তে পারলে, তাই ওকে ইশকুলে দিয়েছে। মিড ডে মিলের ডাল ভাত দু গরাস খেয়ে বাকিটা ও বাড়ি নিয়ে যায়। মা যদি পারে, বাড়িতে অল্প ভাত রাঁধে আর ওর ভাত ডাল তরকারি যা থাকে সব মিলিয়ে ওরা খেয়ে নেয়। বেচারি কোনদিন আধখানা ডিমও একা খেতে পায় না। আয়লার সময় হাঁস দুটো মরে গেল। না হলে আগে খুব করে কাঁদলে বা অসুখ করলে মা ওকে একটা ডিম দিত নমাসে ছমাসে। সে অনেক বছর হয়ে গেল তো! একবার ইশকুলেই ও খেয়ে নিয়েছিল মিড ডে মিলের গোটা ডিমটা। ভেবেছিল মা বুঝবে না। কিন্তু কবে কি দেয় মা খুব জানে আর আলু ঝোল দেখে মা বুঝে গেছিল। সেদিন পুরো একটা পাখা ভেঙেছিল বাবা ওর পিঠে। মার জন্যই হয়েছিল। বাবা সবে আগের রাতে জঙ্গল করে  ফিরেছে; সেই মানুষের সামনে এমন বকাঝকা করলে, চেঁচালে তার কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যদি শোনে বুড়ো ধাড়ি মেয়ে ভাই বোনের কথা না ভেবে, লোভে পড়ে গোটা ডিমটা নিজে খেয়ে এসেছে- তাহলে তার রাগ চন্ডাল হবে নাই বা কেন? সেদিন থেকে চিংড়ির আর সাহস হয়নি অমনটা করার। এমনকি ও একটু ভেঙেও খায় না আর। কিন্তু যেদিন ইশকুলে কলকাতা থেকে দাদা-দিদিরা এসে কেলাস নেয়, সেদিন যারা কেলাশ করে, মিড ডে মিল এর সঙ্গে তারা আলাদা টিপিন পায়। গেল বছর থেকে এই দাদা দিদিরা আসছে। উঁচু কেলাশে দু তিনবার এসেছে কিন্তু ওদের ক্লাসে একবারই এলো। সেবার  ছোট ছোট বাপুজি কেক, কলা, ডিম সিদ্ধ দিয়েছিল। সেদিন অনেক দিন পর চিংড়ি একটা গোটা ডিম খেয়েছিল। আহা! আস্ত ডিম সিদ্ধ! কি যে ভালো খেতে! লালচে হলুদ কুসুমটা আলাদা করে অল্প নুন আর লংকার গুঁড়োর টাকনা মাখিয়ে  একটুস করে জিভে দিয়ে খেতে হয়। প্রথমে ঝাল নুন আর লংকার গুঁড়োটা জিভ দিয়ে চেটে নিয়ে তারপর কুসুমের সবটুকু মুখের ভেতর  জিভের জল মাখিয়ে কামড়ে কামড়ে খেতে হয়। ডিম সিদ্ধ হাতে পেয়েই তো জিভে জল এসে মুখ ভরে যায়! তারপর গন্ধ তারপর সোয়াদ! গরম হলে আবার সোয়াদ আলাদা! সেবারে  ঠান্ডা ডিম সিদ্ধর খোলা ছাড়িয়ে খেয়েছিল সব শেষে। বাড়ি আসার আগে সব সাফ হয়ে পেটের ভেতর। মা কিছু বলেনি। জিজ্ঞেসও করেনি। ভাবেও নি আলাদা টিপিন দেবে দিদিরা। আর ও-ও কিছু বলেনি। ইশকুলে কবে কি হচ্ছে সে খবর বাবা মা এত রাখে না। সেদিন মিড ডে মিলেও ডিম ছিল, সেটা ও পুরোটাই নিয়ে গেছিল বাড়িতে যেমন যায় আর ওর ভাগের টুকু ও মাকে দিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল পেটব্যথা করছে। মিড ডে মিলে ছোট ছোট মুরগির ডিম দেয়। সেটাই মা তিনভাগ করে দেয় ওদের। বাবা থাকলে কখনো বাবাকেও দেয়। বাবা না না করে কিন্তু মা জোর করে মুখে পুরে দেয়। নিজের জন্য রাখেই না।  মা সেদিন ওইটুখানি ডিম রেখে দিয়েছিল। রাতে মুড়ির সঙ্গে খেলো একটু একটু করে ওই সিকিভাগ ডিমটুকু। রাতে  ওদের এমনিতেই  ভাত হয় না আদ্ধেক দিন। আর সেদিন বাবা জঙ্গল করতে গেছিলো । বাবা না থাকলে মা আরোই রাতে রাধেঁ না। কিন্তু বছর ঘুরে গেলো তারপর থেকে ও আর একটাও গোটা ডিম সিদ্ধ খায় নি।
 
দিদি যে বাড়িতে কাজ করে, সে বাড়িতে বিয়ে লাগল শীতকালে, তার আগে বাড়ি ধোয়া , মোছা, রং করা এই সব কাজের চাপে দিদিও আসেনি কতদিন বাড়ি। ও এলে হাতে কিছু টাকা আনে। ওর কাজের মামি দিয়ে দেয় আলাদা করে বাড়ি আসার সময়ে। তখন ও ডিম কিনে আনে একদিন। ও তো ডিম খায় ওখানে। ওদের নাকি ফি হপ্তায় দু তিন দিন ডিমের ঝোল হয় আর সব্বাই গোটা গোটা ডিম খায় এমনকি দিদিও। দিদির তখন ওর জন্য মন খারাপ করে- দিদি বলেছে ওকে। আর তা বাদেও নাকি ঝিল্লি দিদি, মামি, মামা, বিতান দাদা রোজ সকালে আস্ত আস্ত ডিম খায়। সিদ্ধ, ভাজা, কম- সিদ্ধ। কম-সিদ্ধর কুসুম নাকি নরম,  আরো ভাল খেতে হয়। তাকে বলে হাফ বয়েল। খেয়েছে দিদি দু একদিন। দারুন খেতে। আবার ঝিল্লি দিদির প্রিয় হল পোচ। তাতে আস্ত কুসুমটা গোল হয়ে ওপরে টলটল করে। নুন, মরিচ দিয়ে খেতে হয়। এটা দিদি খায়নি , শুধু একদিন গাড়ি এসে গেছিলো বলে ঝিল্লি দিদি পুরো না খেয়ে বেরিয়ে গেছিল, সেদিন খেয়েছিল বাকিটা। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল বলে অতটা ভালো লাগেনি। একদিন দিদি খাবে ঠিক করে রেখেছে। আর ওকেও খাওয়াবে বলেছে একদিন।  কিন্তু মা যা বকে দিদি গোটা গোটা ডিম সবার জন্য কিনে আনলে! ঝোলের গুলোই  ভাগ করে দুবেলা চালায়। তাই বেচারির গোটা ডিম আর খাওয়াই হয় না। প্রায়ই ভাবে আবার কবে কলকাতা থেকে ওরা আসবে? গরম গরম ডিমের ঝোলের থেকে নিয়ে গরম ডিমটা যেদিন খেয়েছিল মিড ডে মিলে, সেদিন যে সোয়াদ পেয়েছিল! আহা! অমরেত! কুসুমের মধ্যে একটু ঝোল দিয়ে মাখিয়ে খেয়েছিল কৌটোর  ঢাকনি করে। খুব সাবধানে আলতো করে তুলে নিয়েছিল ডিম আর একটুসখানি ঝোল। তারপর ঢাকনি ধুয়ে শুকিয়ে কৌটো চাপা দিয়ে বাড়ি গেছিল কিন্তু তাও ধরা পরে গেলো মায়ের কাছে!

 সেই গরম ডিমের সোয়াদ আরেকবার পেতে ও ঠিক করে রেখেছিল যে এবার কলকাতার দাদা-দিদিরা এলে, টিপিনের ডিমটা রেখে দেবে। ছুটির পরে ঘাটের কাছে চায়ের দোকানের কেষ্টদাকে বলে ডিমটা খোলা সুদ্ধ একটু গরম  জলে রেখে গরম করে নেবে। নুন লংকা গুঁড়ো একটু চেয়ে নেবে। তারপর বাঁধে বসে মজা করে খাবে! কেষ্টদা ওকে খুব ভালোবাসে। গেলেই দিদির কথা, ভাই বোনের কথা জিজ্ঞেস করে। বাবার বন্ধুর ছেলে কেষ্টদা। খুব ভালো। কেষ্টদা এখন দোকানে ডিম রাখে। সিদ্ধ করে দেয় পয়সা দিলে। ও ভেবে রেখেছে দিদিকে বলবে যে ওকে যদি পয়সা দিতে পারে একটু তাহলে কেষ্টদার দোকানে গিয়ে ওই বয়েল আর পোচটা খাওয়া যেতে পারে। কেষ্টদাকে দিদি রান্নাটা শিখিয়ে দিতে পারবে না? কিন্তু বাবা মা যেন জানতে না পারে সেটা বলে দিতে হবে কেষ্টদাকে। দিদিও ওর মত ডিম খেতে ভালোবাসে। তাই ওর দুঃখু একমাত্র দিদি বোঝে! কিন্তু এখন কি হবে? ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয়! এবার সত্যি যদি রং পেন্সিল দিয়ে দিতে হয়! আর একটা কেনার ক্ষমতা নেই ওদের! আর "ইশকুলের ইস্পোট্স" আসতে এখনো ঢের দেরি! এবারে রং পেন্সিল দেবে কিনা তাও তো জানে না! গেলবারের আগের বার তো  মগ, টিপিন বাক্স এসব দিয়েছিল! সেবারেও ও পেরাইজ পেয়েছিল! সেই বাক্স নিয়েই ও ইশকুলে যায় এখন। পেন্সিল নিয়ে ভাইও রং করে। চিংড়ির প্রাণের চেয়ে প্রিয় এগুলো। তবু না দিলে মা বকে বলে দিতে হয় ভাইকে কিন্তু সুযোগ পেলেই লুকিয়ে রাখে ওগুলো। মাঝে মাঝে মা না থাকলে ভাইকে একঘা দিয়েও দেয় ওর রং পেন্সিল নেওয়ার জন্য।  
 
মিনুর নজর আছে এগুলোর ওপর। ওদের অবস্থাও কিছু ভালো নয়। তবু ও হেরে গেলে ওর দুটো জরি দেওয়া লাল ফিতে আর পোজাপতি কিলিপ দুটো- সব দিয়ে দেবে বলেছিল! ওর মাসি গেলবার পুজোয়  দিয়েছিল। এক্কেরে নতুনই রয়েছে! কেন যে রাজি হল! দিদিকে বললে দিদি ঠিক এনে দিতে পারত কম দামে! সে দুদিন দেরি হত তো হত। আসলে  রং পেনসিলের ওপর মিনুর লোভের জন্যই এইটা হল! মিনুটা এত হিংসুকুটি! পাশেই থাকে। ওর জন্যই তো ইশকুলে সবাই জেনে গেল ওর নাম চিংড়ি! সবাই ওই বলেই ডাকে। দিদিমনি আর স্যারেরাও! ওই তো প্রথম দিন কেলাসে যেই শ্যামলী দিদিমনি সবার নাম জিজ্ঞেস করে ওর বেঞ্চে এসে ওকে জিজ্ঞেস করেছে – চিংড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ওর ভালো নাম যে বকুল সর্দার  তা বলার আগেই অমনি মিনু পট করে "ওর নাম চিংড়ি, দিদিমনি! " বলে চেঁচিয়ে দিয়েছে! শ্যামলী দিদিমনি বাংলা পড়ায় আর ওদের -হেসে বলল "তাই নাকি? চিংড়ি? মানে গলদা চিংড়ি তিংড়ি ,মিংড়ি?" সবাই হেসে উঠল। ওর তখন ইচ্ছে করছিল মিনুকে এক খামচি মারে। নিজের তো একটা বই দুটো নাম নেই তাই হিংসে! "ইস্পোট্স" এ তো পারে না কোনবার। হিটেই ফেল। আর সেখানে ও বছর বছর পেরাইজ পায়। তাই তো আরো হিংসে! কিন্তু আজ যদি ডিম  না দেয়? আর ও যদি না খেতে পায়? না বাবা , ডিম দিলে ও তখনি খেয়ে নেবে সুমনাদের সঙ্গে। আর গরম খেয়ে কাজ নেই। আবার মায়ের গলা পাওয়া যায়। তিড়িং লাফ দিয়ে উঠে পড়ে চিংড়ি। মাকে বেশি চটালে মুশকিল।     

তাড়াতাড়ি পুকুরে ডুব দিয়ে এসে মুড়ি নিয়ে বসে যায় ও। ভাইকে দেয়। নিজে একটু কম নেয় । যদি মা খুশি হয়! কিন্তু মা এতেও রেগে যায়। "কি হল শুকনো মুড়ি গলা দিয়ে নামছে না আজকাল? রোজ রোজ পান্তা অথবা গরম ভাত চাই নাকি? আরেকটু নাও। এখন আছে খেয়ে উদ্ধার কর। যেদিন টিন শূন্য থাকে সেদিন তো খাই খাই করে জ্বালিয়ে খাও। নাও আর দুটো মুড়ি নাও। নইলে তো আবার ইশকুলে গিয়ে আঁধার দেখবে, দিদিমনি ডেকে পাঠাবে। অত আর পারবো না।"

 তা ওদের ইশকুলে অমন আধাঁর প্রায়শই দেখে ছেলে মেয়েরা আর বাড়ি থেকে বাবা মা কাউকে যেতে হয় ইশকুলে, আসলে রাতে মুড়ি খেয়ে, সকালে একটু মুড়ি খেয়ে এই বাড়ন্ত বালক বালিকাদের চোখে আধাঁর না দেখাই তো অস্বাভাবিক!  প্রায় খালি পেটে মিড ডে মিলের ঘন্টার অপেক্ষায় থাকে ওরা। তাও কি সবাই পুরো খেতে পারে ওখানে? বেশিরভাগই চিংড়ির মত কোনমতে পিত্তি রক্ষে করে বাড়ি নিয়ে আসে বাকিটা। রাস্তা-ঘাটে গাছে বা গাছের তলায় ফল মূল কিছু পেলো তো ভালো নাহলে পেটে কিল মেরে বসে থাকো! আগে তাও বেশি ফল টল পাওয়া যেতো এখন তাও পায় না খুব একটা! যাদের গাছ তারা নিজেরা খায়, আর বিক্কিরি করে তাই কড়া নজর রাখে।  ওরা অবশ্য পুকুর থেকে মাছটা পায়। অনেকসময় মা পুড়িয়ে দেয় । মাসের প্রথম দিকে ভাজা বা ঝোলও পায়। ভাতও পায় ঠিকঠাক। দিদির মাইনে এলে কদিন ভালো কাটে। বাবা জঙ্গল ভালো করলেও ভালো খায় দু চারদিন। কিন্তু দিদির বিয়ের জন্য আবার এর থেকেও টাকা জমাচ্ছে মা। তাই আরো কষ্ট! মাছ খেতে ভালো কিন্তু শুধু মাছে কি হয়? ওদের বাড়িটা তো খাঁড়ির দিকে। অল্প সবজি গাছ লাগালেও নোনা জল ঢুকে সে সব মরে যায়! তবু মা গেঁড়ি গুগলি, শাক সেদ্ধর ব্যবস্থা করে বহুদিন। ধান কাটার কাজে গেলে মা খাবার পায়- মাও কিছু বাড়ি নিয়ে এসে ওদের দেয়। শীতকালে ট্যুরিস্টের ভীড় হয়, তখন কাঁকড়া, চিংড়ি ধরলে ভালো লাভ হয়। তখন কদিন পেট ভরে দুবেলা খেতে পায়। ইশকুল ছুটি থাকলে মিড ডে মিলও বন্ধ থাকে! তখন মাকে বেশি চাল খরচ করতে হয়! অনেক সময় মা  কুসুমদের বা ইন্দুদিদের গোয়াল পরিষ্কার করে কিছু সবজী বা একটু দুধ নিয়ে আসে। সবজী সিদ্ধ করে নুন লংকা দিয়ে মেখে দেয় কিন্তু ভাতের খিদে মেটে না তাতে। দুধ পেলে ছোট বোন আর ভাইকেই দিয়ে দেয় মা।
 
চিংড়ি চুপচাপ আরেকটু মুড়ি ঢেলে জল দিয়ে মেখে নেয়। শুকনো মুড়ি খেতে রোজ রোজ কারই বা ভালো লাগে? একটু তরকারি বা একটু লংকা তেল দিয়ে মেখে নিলেও ভালো লাগে। কিন্তু আজ আর ওর সাহস হল না তেলের শিশির দিকে হাত বাড়াতে। একটু খানি  পড়ে রেয়েছে কালই দেখেছে। বাবা কাল শহরে গেছে। আজ  দিদির মাইনে নিয়ে আসার সময় আবার তেল নুন সব নিয়ে আসবে। থাক বাবা!

বাঁধের  ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় কলকাতার দাদা-দিদিদের নিয়ে ঘাটে বোট আসছে দেখে দৌড় দিল ইশকুলের দিকে। আর মনে মনে যত ঠাকুর আছে সব্বাইকে ডাকতে লাগল যেন ওর ভোরের স্বপ্ন সত্যি না হয়। যেন ওরা আজ ডিম দেয়, যেন ওকে রং পেন্সিল দিয়ে দিতে না হয় মিনুকে। রক্ষে কর মা বনবিবি,বাবাকে যেমন রক্ষে কর আমাকেও কর; মা দুগগা রক্ষে কর; পীরবাবা রক্ষে কর; আমি তোমার মাজারে রোজ সন্ধ্যেবেলা প্রণাম করে আসব। রক্ষে কর যীশু বাবা। রিপনের সঙ্গে এই বছর বড়দিনের আগে  তোমার গীর্জায় কেত্তন গাইতে আমি যাবোই। রক্ষে কর মা কালী এবার আর আওয়াজ বাজিতে ভয় করবো না, শেষ রাতে তোমার পুজো শেষ না হওয়া অবধি ঘুমোব না; রক্ষে কর বাবা লোকনাথ- মা মারলেও ইন্দুদিদির বাড়ি তিন সন্ধ্যেবেলায় আমি তোমার সিরিয়াল দেখতে যাবোই। রক্ষে কর মা সরস্বতী! গেলবার পুজোর আগে কুল খেয়েছি, ক্ষমা করে দিও এবার পুজোর পরেও আর খাবো না...এবার রক্ষে কর শুধু ; হে মা মনসা- তোমার থানে মাথা কুটবো তিনবার, দুধ কোথায় পাবো বল? কিন্তু কাত্তিক কাকার থেকে একটা গাছের কলা  তোমার থানের সামনের অজগরের গত্তে রেখে আসবো (বন্ধুরা সবাই বলে ওটা অজগরের গত্ত) রক্ষে কর। বিড়বিড় করতে করতে ইশকুলে পৌঁছয় ও। মিনু লাস্টে বসে হাসল ওর দিকে তাকিয়ে কাঁচকলা দেখিয়ে! ও মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

আজ একটা নতুন দাদা আর দিদি এসেছে। কি সুন্দর করে বোঝাচ্ছিল হেসে হেসে গল্প করে, খেলালো আবার। কিভাবে নিজের শরীরের যত্ন নিতে হয়, কিভাবে নিজেদের বিপদ থেকে, দুষ্টু বদমাইশ লোকেদের থেকে বাঁচাতে হয় এই সব নিয়ে আবার ছোট ছোট সিনেমা দেখাচ্ছিল, কিভাবে বিয়ে করার লোভ দেখিয়ে বিক্কিরি করে দেয় নিয়ে গিয়ে মেয়েদের এইসব বলছিল! চিংড়ির দিদির কথা মনে করে ভয় করছিল। ও সব নম্বর টুকে নিল। কোথায় গেলে বা কোথায় ফোন করলে দুষ্টু লোকেদের ধরিয়ে দেওয়া যায় বা বিপদে পড়লে বাঁচা যায় এই সব বলছিল দিদিরা। কখন যেন ভোরের দুঃস্বপ্নের কথাটা ভুলেই গেছিল চিংড়ি। এবার দিদি যখন বলল যে "কি? খুব খিদে পেয়েছে তো? আমারও পেয়েছে! চল খেয়ে নিয়ে আমরা তারপর একটা সিনেমা দেখবো আর কিছু প্রশ্ন উত্তর নিয়ে খেলবো। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চলে এসো সবাই। এখন একটা বাজে। ঠিক দুটোয় আবার শুরু করব কেমন? আমরা কলকাতায় ফিরবো, তোমরা বাড়ি ফিরবে, তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে তো?" ওর ভয়টা ফিরে এলো আবার। ওরা এখান থেকে প্যাকেট নিয়ে মিড ডে মিলের খাবার নিতে গেছিল গেলবার। এবারেও তাই বলল স্বপন স্যার এসে। আজ তো ওরা সবাই মিড ডে মিলের খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে কৌটো এনেছে। ওই তো সুজিতদা, পালানদা ,মৌটুসিদি ,ইতিদি, আনোয়ারদা, মামনিদি সবাই  খাবারের ঝুড়ি নিয়ে এসে গেছে! ওরা সবাইকে জায়গায় বসতে বলে হাতে হাতে দিয়ে যাচ্ছে প্যাকেট। চিংড়ির হাতেও প্যাকেট পৌঁছয়। ও তাকাতে পারেনা কোনদিকে। খুলতেও পারে না প্যাকেট। সুমনা ওর প্যাকেট খুলতে থাকে। ভয়ে চোখ বুঁজে ফেলে চিংড়ি।  ভীষণ কান্না পায়। কেন যে বোকার মত বাজি ধরতে গেছিলো। আসলে  মিনুই এই বাজিটা রাখার জন্য বলেছিল আর বারবার এমন করে বলল যে ও দুম করে আচ্ছা ঠিক আছে- ধর বাজি ! বলে বসল!  মাথাটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল বোধহয়! এখন আর ওর ডিম খাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেছে! আজ বাড়ি থেকে বেরোনর সময়েও ভাই রং করছিল ওগুলো নিয়ে। ও জোর করে  নিয়ে আসে অন্য দিন, আজ আর কিছু বলতে পারলো না! যদি কাল দিয়ে দিতেই হয়! ওর নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল বেদম!অন্তত রং পেন্সিল গুলো বাঁচুক ভগবান!  হঠাৎ হাতের তালুতে গরম গরম কিসের ছেঁকা! চমকে উঠে চোখ খোলে চিংড়ি! একি ওর হাতে সাদা সাদা গোলপানা- গরম গরম এটা কি? এটাও স্বপ্ন নয় তো!  সুমনা ফিসফিস সুর করে করে বলে "আস্ত গোটা ডিম ! তুই জিতে গেছিস!" চিংড়ি সুমনার দিকে তাকায়! সুমনা ইশারা করে মিনুর দিকে। মিনুর প্যাকেট খোলা। মুখ গম্ভীর আর কাঁদো কাঁদো!

স্বপন স্যার বলে " কিছু কিছু ডিম খুব গরম রয়েছে। দেখে খাস। যা তাড়াতাড়ি মিড ডে মিল নিয়ে নিগে যা সব। তারপর যেটা খাবি খেয়ে নে। দেরি করবি না। পৌনে দুটোর মধ্যে এসে যাবি সব। দিদি দাদারা কিন্তু ঠিক দুটোয় শুরু করবেন। লাইন করে যাবি।" সবাই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে।  সুমনা বলে "তুই এখন আমার থেকে ডিমটা খা, আর বাঁধে বসে তোরটা আবার দুজনে ভাগ করে খাবো!" চিংড়ি মাথা নাড়ে। গরম তো রয়েছেই! এখানেই খেয়ে নেবে বাবা!  ওরা দিদিদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শোনে স্বপন স্যারকে নতুন দিদি জিজ্ঞেস করছে  "কিছু ডিম গরম কেন?" স্যার বলছে " আসলে আজ মিড ডে মিলেও ডিম। এতগুলো ডিম কাল পাওয়া যায়নি একেবারে। কিছু কম পড়েছিল দিদি। আবার আজ গোসাবা গিয়ে আনতে হল।  মিড ডে মিলের ডিম রেখে যেগুলো ছিল বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর মিড ডে মিল নামার পরে এই পরের ডিমগুলো বসানো হয়েছিল। ডিম ছাড়াই বাকি সব প্যাকেট করে একটা ঝুড়িতে রেখে দিতে বলেছিলাম। এই একটু আগে ডিম নামিয়ে ওগুলো প্যাকেটে ভরা হয়েছে। তাই এখনো বেশ গরম রয়ে গেছে! তাই সাবধান করে দিলাম!" গলা নামিয়ে বললেও কানে আসে চিংড়ির "আসলে এখানে অনেকেরই এমন অবস্থা দিদি, এই ওয়ার্কশপের এক্সট্রা ডিম পেলে ওদের আর তর সয় না। তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে বসবে! মিড ডে মিলের ডিম বেশিরভাগই বাড়ি নিয়ে যায়। বোঝেনই তো!" দিদির কথা শুনতে পায় না ও আর। সুমনা হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। ও পিছন ফিরে দেখে নতুন দিদি ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। ওর নিজের দিদির মত লাগল ঠিক!

মিড ডে মিলের লাইনে মিনু ওদের আগেই দাঁড়িয়েছে। ওদের দিকে তাকাচ্ছে না। সুমনা ওর গায়ে চিমটি কেটে ইশারা করে। আলি, মৌমিতা সবাই খুশি। ওরা কেউ মিনুকে পছন্দ করে না।  সুমনা বলে "আজকেই বাড়ি গিয়ে নিয়ে নিবি কিন্তু! নাকি কাল আনতে বলবি? তাড়াতাড়ি নিয়ে নে। নইলে ও যা! বলবে হারিয়ে গেছে!  দেবেই না দেখিস! বেশ হয়েছে! হিংসুকুটির মুখ দেখ না এক্ষুনি যেন কেঁদে  ভাসাবে!" চিংড়ি হাসতে পারে না! মিনু খাবার নিয়ে ওদের পাশ দিয়েই যায়। চিংড়িদের লাইন এগোয়। সুমনা তাড়া দেয়, "তাড়াতাড়ি কর, ডিমটা ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!" ওরা কৌটয় বাড়ির জন্য মিড ডে মিলের ভাত ডাল ডিমের ঝোল নিয়ে গিয়ে বসে স্কুলের পুকুরের ধারে বাঁধানো ঘাটে। সুমনা একটু নুন নিয়েছে আলাদা করে ডিমের জন্য। লংকা গুঁড়ো পাওয়া মুশকিল। কিন্তু দেখো চিংড়ি আলাদা নুন ও নিল না! যাকগে ও বেশি করেই নিয়েছে! মিনু এমনিতে এখানেই খায়। ওদের দেখে সরে বসে। অন্যদিন ওর সঙ্গে কেউ না কেউ থাকে। আজ ও একাই বসেছে। প্যাকেট ও খোলেনি। ডিম-ভাতও খাচ্ছে না! পাশে টিপিন কৌটো রাখা! চিংড়ি আর  সুমনা দুজনে খাবারের প্যাকেট খোলে। সুমনা জিজ্ঞেস করে "তুই এখুনি খেয়ে নিবি?" চিংড়ি কিছু বলে না। সুমনা বলে "তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুইই হেরেছিস!কি রে শরীর খারাপ করছে?" চিংড়ি হঠাত উঠে যায় মিনুর কাছে। সুমনা খুশি হয়। ও একদিন চিংড়ির থেকে  কিলিপ দুটো নিয়ে পড়বে। ওরকম ওদের কারোর নেই। খুব সুন্দর পোজাপতি দেওয়া কিলিপ দুটো!  ওই দেখো! যা ভেবেছে ঠিক তাই? মিনু কেঁদে ফেলল চিংড়ির হাত ধরে, আবার চিংড়ি কি বলছে? সান্ত্বনা দিচ্ছে? হুঃ ঢং!! সুমনা জোরে ডাক দেয়। দেরি হয়ে যাচ্ছে না! চিংড়ি ফিরে আসে। হাসি হাসি মুখ। এসেই ডিমটা হাতে নেয়। একটু দেখে নেয়। পুকুর পাড়ের শক্ত বাঁধানো মাটিতে ঠুকে ঠুকে ফাটিয়ে খোলা ছাড়ায়। সুমনার কৌতূহল বাড়ে। সেও ডিমের খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে " এই! আমাকে একদিন দিবি তো পরতে? আজকেই দেবে? না কাল?" চিংড়ি হাসি মুখে ওর দিকে তাকায়- "আমি বলে এলাম যে আমার লাগবে না"! "মানে?" সুমনার গা পিত্তি জ্বলে যায়! চিংড়ি ডিমের গন্ধ শোঁকে ! ডিমের কুসুমটা সাবধানে বের করে নেয়! সুমনা বলে " ও জিতলে নিত না তোর থেকে? ঘাড় ধরে নিয়ে নিত আর তুই মার খেয়ে মরতিস" চিংড়ি গরম কুসুমে একটু নুন মাখাতে মাখাতে বলে "জানি"!
সুমনা ডিম খেতে ভুলে যায় "জানিস? আর তাও! কেন নিলি না? দেখতিস কিরম মারটা খেতো ও কাকির কাছে!" চিংড়ি কুসুম একটু ভেঙ্গে মুখে ফেলে পরম তৃপ্তিতে চিবোতে চিবোতে বলে "ওই জন্যই তো! ইস! এখনো কি গরম আছে রে! হেব্বি!" আরামে আবেশে তার চোখ বুজেঁ আসে। তার ওই পরম তৃপ্তিভরা মুখের দিকে চেয়ে সুমনা আর কিছু বলতে পারে না। মিনু এসে খুব আসতে করে ডাকে-"চিংড়ি"! চিংড়ি চোখ খোলে । মিনু একটা ছোট কাগজের পুরিয়া বাড়িয়ে দেয়।  সলজ্জে বলে " ঝাল নুন  আর লংকার গুঁড়ো- অনিমারা খাচ্ছিল- আমি চাইলাম তোর...তোদের জন্য!" ওদের হাঁ করা মুখ দেখে চোখ নামিয়ে বলে, "আমি ঠান্ডা ডিম পেয়েছি। ছুটির পরে কেষ্টদার দোকানে গরম করে বাঁধের ধারে বসে ভাগ করে খাবি?" সুমনা ওর খোলা ছাড়ানো ডিমটা প্যাকেটে ভরে টিপিন কেক বের করে হাসে মিনুর দিকে তাকিয়ে। "খোসা ছাড়িয়ে নিলাম আর গরম করা যাবে?" চিংড়ি তার আধখাওয়া ডিম সুমনাকে দিয়ে বলে "এটাও ঢুকিয়ে নে। গরম জলের বাটির মধ্যে খোসা শুদ্ধু ডিমটা দিয়ে ঢাকনির ওপর এগুলো রেখে দিলেই গরম হয়ে যাবে। চল আর সময় নেই।  তাড়াতাড়ি এগুলো খেয়ে নিই নইলে..." মিনু আর সুমনা বলে "চোখে আধাঁর দেখব" সবাই হেসে ওঠে।
গোটা আস্ত গরম ডিম  একবারে একা কারোরই খাওয়া হয় না কিন্তু একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখো তো ইশকুলের ঘাটে বসে ওই যে তিনটে ছটফটে মেয়ে গোগ্রাসে কলা, মিষ্টি আর টিপিন কেক খাচ্ছে- বিশেষ করে দেখো মাঝখানের ওই  মেয়েটা যে তিড়িং বিড়িং করে হাত নেড়ে কি সব বলছে আর সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে- ওই দেখো ওদিকে আবার আলি, মৌমিতারাও গিয়ে জুটেছে! ভালো করে দেখে বলতো দেখি ...এই মুহূর্তে ওদের থেকে সুখি আর কে আছে?

বলতে পারলে বারোটা রং পেন্সিলের সবকটা, দুটো জরিদেওয়া  লাল ফিতে আর দুটো প্রজাপতি ক্লিপ সঅব তোমাদের।

 

ছবিঃ শিল্পী ঘোষ

মৌপিয়া অধ্যাপনা করেন। পাশাপাশি নানা জায়গায় বেড়াতে, খেতে এবং খাওয়াতে, দিশি-বিলিতি ছবি দেখতে আর বই পড়তে বড়ই ভালবাসেন। দুষ্টু-মিষ্টি কচিকাঁচাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চান। 'কুটুস' এর সাথে মৌপিয়ার নিত্যিদিনের ওঠাবসা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা