মেঘালয়...মেঘের দেশ
'ইচ্ছামতী'তে আগে আমার অতি প্রিয় সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের কথা লিখেছি। তিনি মূলত ছোটদের লেখক। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে। এই অপূর্ব পাহাড়ি শহর, তার সরল গাছ, পাহাড়, মানুষজন, ঝরনা, কনকনে শীত, শনশনে হাওয়া, গুবগুবিয়ে মাটির থেকে জল বেরিয়ে ভরে থাকা ছোট ছোট গর্ত, কলকলিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি ঝোরার শব্দ সব মিলিয়ে যে শৈশব তা আজীবনের জন্য সেঁধিয়ে গিয়েছিল তার মগজে, মনে, মজ্জায় মজ্জায়। তাই শিলংয়ের প্রকৃতি, পরিবেশ বারবার আমরা দেখতে পাই তাঁর লেখায়, বিশেষ করে তাঁর আত্মজীবনী 'পাকদণ্ডী' থেকে। এই সব পড়ে বড় হয়েছি, বড় হয়েও পড়েছি। শিলং নিয়ে অন্যান্য সাহিত্য-উপন্যাসও পড়ে ফেলেছি। ফলে এই জায়গাটা নিয়ে মনের মধ্যে একটা আবেগ তৈরি হয়েই ছিল। তাই যখন দেখলাম একটা বিমান সংস্থা গুয়াহাটির উড়ানেও অনেক ছাড় দিচ্ছে, তখন আর দেরি না করে কেটে ফেলা গেল টিকিট। যাব ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডায় আর টিকিট কাটলাম এপ্রিল-মে'র গরমে। থাকার জায়গার বুকিংও হল। ২০শে ডিসেম্বর বেরোব, ২৩-২৫শে শিলংয়ে কাটাব। মূলত খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী খাসিয়া সমাজ তখন ক্রীসমাস উপলক্ষ্যে উৎসবের মেজাজে সাজিয়ে তোলে শহর আর মেতে ওঠে ক্রীসমাস ক্যারল, গীর্জায় উপাসনা গান-বাজনা, খাওয়া-দাওয়ার আনন্দে। যীশুর জন্মদিন পালন হয়ে ওঠে খুবই চিত্তাকর্ষক।
চেরাপুঞ্জী, মৌসিনরাম, আসামের পবিতোরা অভয়ারণ্য আর শিলং নিয়ে ২০-২৭, মোট সাত দিনের প্ল্যান। এর মধ্যে তিনদিন শিলংয়ে থাকার বিষয়ে সঙ্গীদের একটু আপত্তি থাকলেও শঙ্খ আর আমি এ বিষয়ে অনড় ছিলাম। আর ভালো বন্ধুরা বন্ধুদের আবদার তো মেনেই নেবে। সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। মাঝের এই কটা মাস অধীর প্রতীক্ষা। ছোট্ট মরমিয়ার আনন্দ ও উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ঠিক যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে খবর এল যাওয়া-আসা দুটো উড়ানই বাতিল। কী হবে! সবাই মিলে জরুরী আলোচনা করে ঠিক হল, যাওয়ার টিকিট ট্রেনে তৎকালে কাটা হবে। নানাভাবে ব্রেক জার্নি করে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে যাওয়ার কথাও ভাবা হল। ফেরার টিকিট কাটা হল অন্য বিমান সংস্থার উড়ানে। এভাবে যখন হার না মেনে আমরা যাবই ঠিক করে ফেলেছি তখনই বন্ধুর বাবা অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। আবার সব টিকিট বাতিল! মরমিয়া বলল, সে বন্ধুর দাদুভাই সুস্থ হলে তারপর যাবে। মরমিয়ার প্রিয় বন্ধুর মা বাবাই এখন আমাদেরও প্রিয় বন্ধু!
কী করা যায় ভাবছি, ইতিমধ্যে কাকু সুস্থ হয়ে উঠলেন। আবার নতুন প্ল্যান, ট্রেনের টিকিট ইত্যাদি...তখন আগের বিমান সংস্থা নতুন করে যাত্রার দিন বেছে নেওয়ার একটা সুযোগ দিল। এই সুযোগ সীমিত, তবু তা নেওয়া গেল। এবারে পালা সমস্ত থাকার বুকিং আবার করা। এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল যাওয়া। যাওয়ার দুদিন আগে জানা গেল, ফেরার উড়ান বাতিল! এবারে হাল ছেড়ে দিলাম। যখন ভাবছি তবে গোটা ছুটিটা কীভাবে কাটাই, তখন আবার জানা গেল ফেরার টিকিট ঐ বিমান সংস্থাই অন্য বিমানে ঐদিন করতে দিচ্ছে। এইসব ঝামেলার পর যাওয়া ঠিক হল। ২৫শে ডিসেম্বর কলকাতাতেই কাটালাম। শিলংয়ের বদলে বাড়িতেই ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে আর কেক বানিয়ে ভালোই কাটল ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিলাম। ২৮ তারিখ বেরোনো। ২৭শে রাতে মরমিয়া চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল, 'মা, আমরা কি ফাইনালি যাচ্ছি শিলং?' বললাম, 'মনে হচ্ছে, হ্যাঁ!'
বেলা ৩টে নাগাদ গুয়াহাটি বিমানবন্দরে নেমে সবাই ভাবলাম, 'যাক, তাহলে আসা হল!' তখনই জানা গেল, যে গাড়িটা শিলং থেকে আসবে আর আমাদের সঙ্গে সাতদিন থাকবে সেটা রাস্তায় খারাপ হয়ে গেছে আর আসতে দু'ঘন্টার ওপর লাগবে। বুঝলাম, আমাদের গ্রহের ফের কাটেনি। আলোচনার পর সেখান থেকে ভলভো বাস ধরে গুয়াহাটির পল্টন বাজারে চলে গেলাম। সেখান থেকে পবিতোরা অভয়ারণ্যে যাওয়ার গাড়ি পেয়ে যাব আর আমাদের গাড়ি সোজা পবিতোরা চলে যাবে, এমনটাই ঠিক হল। এদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতে সন্ধের আগে নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে পড়া বাঞ্ছনীয় এমনটাই শুনে গেছি। দিন কয়েক আগে আসামে বোড়ো জঙ্গীদের আক্রমণজনিত ঘটনাও ঘটে গেছে। যদিও সেটা অন্য দিকে, তবুও চিন্তা থেকেই যায়। বিশেষ করে যখন দুই পাঁচ বছরের পরী রয়েছে সঙ্গে! কিন্তু পল্টনবাজারে গাড়ি অনেক টাকা চাইল। তাছাড়া শীতের জন্য মালপত্রও একটু বেশি ছিল, ফলে বড় গাড়ি ছাড়া সবার এক গাড়িতে ধরাও মুশকিল! তাই ঠিক হল আমাদের গাড়ির জন্যই অপেক্ষা করব। এর মধ্যে বন্ধুবান্ধবকে আর পবিতোরা অভয়ারণ্যের সরকারি পর্যটক আবাস শান্তি লজে ফোন করে জানা গেছে যে একটু রাত হলেও ভয়ের কিছু নেই। কাজেই চলল অপেক্ষা। শিলং থেকে গুয়াহাটি আসার হাইওয়ে জ্যাম। রবিবার পিকনিকের ভিড় আর ট্রাক, লরি তো আছেই। অপেক্ষা করতে করতে সবাই তখন ভাবছি আর কী দুর্ভোগ আছে এ যাত্রায়। অদৃষ্ট না মানলেও কেউ কেউ তার অদৃশ্য ইঙ্গিত (আসার আগের অত বাধা) মেনে চললেই হত এমনটা ভাবছি, আবার তাই নিয়ে হাসি ঠাট্টাও করছি। এর মধ্যে একটু চাউমিন খাওয়া গেল বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েই। বাচ্চাগুলোর উৎসাহ অদম্য। তারা ওখানেই খেলা, গল্প, ঝগড়া, সব কিছুই প্রবল পরাক্রমে করে চলল।
অবশেষে গাড়ি এল সন্ধে ৭টা-৭টা৩০ নাগাদ। উঁহু, নিস্তার নেই। এবারে ঝামেলা শুরু করল স্থানীয় চালকরা। গুয়াহাটি থেকে গাড়ি না নিয়ে শিলং থেকে গাড়ি এসে সাত দিনের ভাড়া পাবে? চলল তরজা আমাদের সারথির সঙ্গে ওদের, আমরা দর্শক। শেষে দুশো টাকা দিয়ে সারথি রফিক রফা করল। মরমিয়াও বাঁচাল। যেই না আমরা বলেছি, 'ঠিক আছে দাদা, ছাড়ুন এবার। দেখছেন তো বাচ্চাগুলো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে! ওদের খিদে পেয়েছে, ঘুম পেয়েছে, ওরা আর পারছে না।' অমনি মরমিয়া 'বাবা-মা, চল। আমি আর পারছিনা' করে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিল। আর ওরাও ছেড়ে দিল। রওনা দিলাম। পবিতোরার কাছে পৌঁছেছি। রাস্তায় ঘন অন্ধকার, রাত নটা বাজে। হঠাৎ দেখি চারটে মোটরবাইকে চার পাঁচজন স্থানীয় যুবক, চোখ তাদের লাল। তারা গাড়ি থামাল। আমরা কে, এত রাতে কেন এসেছি এই সব জিজ্ঞাস্য আর গাড়িতে একটু উঁকি মারা। এই সবের পর ছেড়ে দিল। আমরা সবাই দমবন্ধ করে বসে ছিলাম। রফিক ওদের স্থানীয় ভাষায় কথা বলল বলে সহজে মিটে গেল। কিছুই না। তাঁরা একটু নেশাতুর ছিলেন এবং নিজেদের এলাকার রক্ষাকর্তা ভাবছিলেন। কিন্তু আমাদের হাল কাহিল হয়েছিল এ কথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই। বিশেষ করে এই বারের ভ্রমণে শুরু থেকে যা হচ্ছে!
পবিতোরা গিয়ে মন ভরে গেল। চমৎকার জায়গা। রাতের খাবার বলে দিয়েছিলাম গুয়াহাটি বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে করতেই, তাই গিয়েই গরম ভাত পেলাম। খেয়েদেয়ে ঘুম! পরের দিন হাতির পিঠে চেপে যাব একশৃঙ্গ গণ্ডার দেখতে। যাক, শুরুতে যতই ঝামেলা হোক শেষটা তো ভাল হচ্ছে। কেউ যেন হাসল শুনে!
পরের দিন একটু দেরি হল বেরোতে। রফিকের বাড়ি কাছেই। ও আমাদের নামিয়ে দিয়ে রাতেই বাড়ি চলে গেছে, তাই এই রাস্তাটা হেঁটেই যেতে হল। গিয়ে শুনি হাতি বেরিয়ে গেছে। এক ট্রিপ দিয়ে আসার পর আমাদের হবে কিনা জানা যাবে। আবার অপেক্ষা। ওমা, তারপর দেখি হাতি মোটেই বেরোয় নি আর আমাদের পরে এসে সবাই টিকিট কেটে হাতির পিঠে জায়গা পেয়ে যাচ্ছে! নাকি ভিআইপি কারা আসবে! বুঝলাম। এও বুঝলাম সেই ভিআইপিদের মধ্যে কাছের বেসরকারি লজে থাকা পর্যটকরাও রয়েছে যাদের থেকে টিকিটের ন্যায্য মূল্যের বেশি টাকা নিচ্ছে লজের মালিক আর সেই টাকা ভাগ হচ্ছে সরকারি টিকিট বিক্রেতা ও ব্যবস্থাপকের মধ্যে। ভালো ব্যবস্থা! প্রায় ঘন্টা দেড়েক দাঁড়ানোর পর লেগে গেল ঝামেলা। কাউন্টারে গিয়ে এইসব দু নম্বরির বিরুদ্ধে চেঁচামেচি শুরু করল বিষাণ। তাকে সামলাতে গিয়ে শঙ্খ হাবভাব দেখানো লোকটিকে সরকারি চাকরি যাওয়ার হুমকি দিয়ে এল। সে এক চিত্তির। তারপর আমাদের সরকারি লজ থেকে ম্যানেজার এলেন, তিনিও কিছু করতে পারলেন না। অগত্যা আমরা একটা দোকানে একটু জলখাবার খেয়ে জীপে করেই রওনা দিলাম।
ছবি তুলতে পোজ দিচ্ছে গন্ডার
একদিকে ভালো হল কারণ জীপে সবাই একসঙ্গে যেতে পারলাম। একটু যেতে না যেতেই সজাগ থাকতে বলল গাড়ির চালক ও গার্ড। বাবারে, দেখি একটা শিং নিয়ে গাছেতে গা ঘষছে একটি জলজ্যান্ত গণ্ডার! সবাই পটাপট ছবি তুলতে লাগল দেখে মুখখানি ঘুরিয়ে সে কী পোজ গণ্ডার বাবাজীর! সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না আমাদের! মনে হচ্ছিল চিড়িয়াখানায় কাছ থেকে দেখছি! সব্বার মন ভাল হয়ে গেল। তারপরে শুরু হল পাখি দেখা। এরা সব শীতের যাযাবর পাখি বা মাইগ্রেটরি বার্ড। তবে আমাদের চেনা পানকৌড়ি, এমনকি হাড়গিলে পাখির দেখাও পেলাম। কত রকমের যে হাঁস! কেউ ডানা থেকে জল ঝাড়ছে তো ঝাড়ছেই, কেউ বিল থেকে মাছ ধরে ভোজনটা সেরে নিচ্ছে। কেউ বা আবার এক পায়ে দাঁড়িয়ে রোদ পোহাতে পোহাতে একটু দিবানিদ্রা দিয়ে নিচ্ছে। কত যে রংবেরঙের প্রজাপতি নিশ্চিন্তে এদিক সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। তারই মধ্যে দূর থেকে দেখা গেল বুনো মোষের শিং আর তারপরে একটা, আরো একটা, আরও একটা! ঐ যে একটা বাচ্চা আর মা…হ্যাঁ সব্বাই গন্ডার! কী কান্ড! খুশিতে ফেটে পড়ি সবাই। তারপর একবাক্যে সায় দিই যে হাতির পিঠে চাপলে আলাদা আলাদা যেতে হত আর ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে, যেখানে সেখানে থেমে ছবি তুলে, হাওয়া বাতাস রোদের ওম গায়ে মেখে এই মধুর ভ্রমণটি হত না। সব ভাল যার শেষ ভাল!
ফিরে এসে চট জলদি স্নানখাওয়া সেরে চেরাপুঞ্জী যাওয়ার পালা। কিন্তু বেলা বেড়ে প্রায় একটা। তখনই শুনি ৩১শে ডিসেম্বর মৌসিনরামের কাছে যে মলিংবনা গ্রামে আমাদের থাকার কথা আর ফসিল ট্রেক করার কথা, সেখানে ঐ দিন গাইড পাওয়া যাচ্ছে না। ৩০শে হলে পাওয়া যেতে পারে। অতএব বিষাণ লেগে পড়ে কাজে। আবার চেরাপুঞ্জী হলিডে রিসর্ট-এ ফোন। আবার দিনক্ষণ বদলানোর অনুরোধ! ভাগ্যিস ওদের ঘর ফাঁকা ছিল! ওরা ৩১ তারিখ আমাদের একটা ডর্মিটরি দিতে পারবে বলল। কাজেই সেই অনুযায়ী মলিংবনাতে বলে দেওয়া হল আমরা যাচ্ছি ৩০ তারিখ। এবারে আমাদের গন্তব্য চেরাপুঞ্জীতে সাই-মি-কা রিসর্ট। কারণ এতবার দিন পরিবর্তনের ফলে আমরা চেরাপুঞ্জীতে একসঙ্গে এক জায়গাতে দুদিনের বুকিং পাইনি। রফিক এসে গেছে সেই সাড়ে দশটা নাগাদ। কিন্তু আমাদের বেরোতে হল প্রায় দেড়টা। সে বেচারি খেয়েও আসেনি। থামতে হবে পথে। গতকাল ঘুটঘুটে আঁধারে যে রাস্তা দিয়ে এসেছি আজ তা রোদে ঝলমল। পথের ধারে পবিতোরার একটা দিক পড়ে। জঙ্গল গভীর নয়। শুধু ঘাসগুলো উঁচু। অনেক গরু চরছে আর একি, সেই বাচ্চা আর মা গণ্ডারটা! ঘাস খেতে খেতে এখন এদিকে চলে এসেছে! তারপর দেখি যেগুলোকে গরু ভাবছিলাম তার মধ্যে গরু থাকলেও গণ্ডারও বেশ কিছু। দেখে দেখে আর যেন আমাদের সেই উত্তেজনা নেই। যেন এভাবে একশিংওয়ালা গণ্ডার দেখতে পাওয়াটা কোনও ব্যাপারই না। এই নিয়ে হাসাহসি করতে করতে নংপোতে পৌঁছে রফিক গাড়ি থামাল। খাবে। সেখানে দেখি দোকানে থরে থরে বয়াম ভর্তি আচার। তার মধ্যে উত্তর পূর্ব ভারতের মানুষের অতি প্রিয় খাদ্য নানা ধরণের শুঁটকি মাছের আচারও রয়েছে।
থরে থরে আচার...শুঁটকি মাছ গুলো দেখা যাচ্ছে তো !
এদিকে তখন সন্ধের অন্ধকার নেমেছে, কিন্তু শিলং পৌঁছইনি। একটু বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আবার একে তাকে ফোন শুরু হল। শেষে ঠিক হল সাই-মি-কা থাকতে গেলে আজ পৌঁছতেই অনেক রাত হবে আর কাল ভোরেই বেরিয়ে পরতে হবে। তাই শুধুমাত্র রাতে থাকার জন্য এত হ্যাপা না নিয়ে শিলংয়েই রাতটুকু আরামে কাটিয়ে কাল সকালে হালকা মনে মলিংবনার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া যাবে। এখানে যে সামান্য টাকা অগ্রিম দেওয়া আছে তার মায়া ত্যাগ করতে হবে কিন্তু তাতেও বাকি টাকা বেঁচে যাবে। অতএব তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর শিলংয়ে গিয়ে মি-কা-সা হোটেলে আশ্রয় নেওয়া। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে চলেছে আর সেই সঙ্গে উহুউউ কী শীত! মালপত্র রেখেই বেরিয়ে পড়লাম খেতে। একটু হেঁটে শরীরটা যেন সাড় ফিরে পেল। তারপর জমিয়ে চাইনিজ খেয়ে, হোটেলে ফিরে বাচ্চাদের হট চকোলেট খাইয়ে ঘুম। কিন্তু আমাদের ঘরে মিটমিটে বাল্ব আর হলুদ আলো। যে ঘরটা দেখে ঘর নেওয়া হয়েছে সেটা এর চেয়ে বড়ো আর আলোও অন্যরকম! আমাদের তখন যা মনের অবস্থা তাতে এই পরিবেশে মনে হচ্ছিল কখন কলকাতায় ফিরে যাব! গণ্ডার দেখার রেশ তখন হাওয়া!
সারা রাত আমি আর মরমিয়া ভূতের স্বপ্ন দেখলাম। এখন হাসি পাচ্ছে? তখন কিন্তু পাচ্ছিল না! আর সকালে উঠে যখন শুনলাম মরমিয়ার প্রিয়াংকা মাসিও ভূতের স্বপ্ন দেখেছে, তখন আবার চাপে পড়ে গেলাম। কপালে আরও কী আছে কে জানে! কিন্তু সকালে বাইরে বেরিয়েই সব চাপ হালকা। রফিক এল। মালপত্র বাঁধাছাঁদা করে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। অপূর্ব রাস্তা। এবারে যেন ধীরে ধীরে লীলা মজুমদারের বর্ণনাগুলো খুঁজে পাচ্ছি! রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট পরিষ্কার দোকানে হালকা করে ভাজা পুরী, মটর সেদ্ধ আর দুধ চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম আমরা। মরমিয়া আবার চা খেতে খেতে বাইরে বেরিয়ে একটা বাড়ির সিঁড়ির ওপর উঠে পড়ল। আবার রওনা। একটু না হাঁটলে ভাল লাগছিল না। তাই বললাম আমি এগোচ্ছি, তোরা আমাকে তুলে নিস।
মলিংবনাতে আমাদের কটেজ
এই ছোট্ট গ্রামটার নাম তীরস্যাদ। কী সুন্দর ছোট্ট গীর্জা, স্কুল! সদ্য ২৫শে ডিসেম্বর পেরিয়েছে বলে সব গীর্জা সুন্দর করে সাজানো। রফিক দেখা গেল চেনে না মলিংব্না! অতএব আবার ফোন আর আমাদের জন্য রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করে রইল সার্জেম। মৌসিনরাম ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা চলার পরে সার্জেম-এর সঙ্গে দেখা। 'মলিংব্না' লেখা সাদা টী শার্ট পরে আমাদের নিয়ে যাবে বলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের গাড়িতে উঠে পড়ল। একটা নুড়ি পাথরের চড়াই বেয়ে পৌঁছলাম গন্তব্যস্থলে। খোলা পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের মধ্যে দুটোই মাত্র কটেজ। শহর থেকে এত দূরে, লোকালয় থেকে এত নিরিবিলিতে এই জায়গা অথচ আগের রাতে জমজমাট শহুরে হোটেলে থেকে যে ভয় হচ্ছিল এখানে তা উধাও! যেন নতুন করে উপলব্ধি করলাম প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা মানুষের সারল্য। প্রকৃতির অকৃপণ দানকে দূষিত করে তুলি আমরা মানুষেরাই। যদি তা না করি, তাহলে সেই আদি অকৃত্রিম মানুষ আর প্রকৃতির সহাবস্থানের চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছুই হতে পারে না। আর যা স্বাভাবিক, সরল, সেই সহজাত সৌন্দর্যের মধ্যে ভয়ের জায়গা নেই। সারাক্ষণ মুখে হাসি নিয়ে আমাদের তদারকি করে গেল সার্জেম যাকে মরমিয়া অনায়াসে সাঞ্জু আঙ্কল বানিয়ে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিল।
মলিংবনাতে এই গাছে ঝোলানো লন্ঠনটাই রাতের আলো...ভোর হয়েছে এখনো নেবানো হয়নি
কোন একটা কন্দ জাতীয় ফল পোড়ানো খেতে পেলাম জলখাবার হিসেবে। সেটা খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয়। স্বাদ তেমন ভালো নয়। জলদি স্নান সেরে, চারপাশ খোলা খাবার জায়গায় চলে গেলাম। ভাত, ডাল, সবুজ স্যালাড, আলুভাজা, বাঁধাকপির তরকারি, খুব ঝাল একটা মুলোর স্যালাড বা মুলি ক্লেহ্, দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে এবারে পালা ফসিল দেখতে যাওয়ার। যাওয়া আসা নিয়ে তিন ঘন্টার একটা ট্রেক। আমাদের ক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য সেটা চার-পাঁচ ঘন্টা। শুরু হল হাঁটা। যেতে যেতে দেখা পেলাম পিচার প্ল্যান্ট-এর। সার্জেম দেখাল কীভাবে পোকাগুলো গাছের লাগোয়া রেণুর কলসির ভেতরে ঢুকলেই ঢাকা বন্ধ হয়ে যায় আর পোকামাকড় ভেতরে আটকে মারা যায়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চড়াই উৎরাই, তারপর একটা ছোট্ট ঝোরা পেরিয়ে আবার হাঁটা। এবারে একটা জলপ্রপাত, তার ধার দিয়ে সরু রাস্তা। তখনও অর্ধেক রাস্তাও আসিনি। তাতে কী? চল সবাই। হাঁচড় পাঁচড় করে ওপরে ওঠার সময় বিয়াসকে ধরতে গিয়ে বিষাণের হাত থেকে জলের বোতল একদম সোজা নীচের খাতে। ওটার মায়া ত্যাগ করে কদম কদম বাড়ায়ে ওপরে পৌঁছলাম। ওমা ওপরে উঠে দেখি আবার খোলা মাঠের মতন, আর ঐ বিস্তৃত প্রান্তরের ওপরে বিছানো মস্ত আকাশের সে কী রূপ! এখানে আগে ছিল আগ্নেয়গিরি। লাভা জমে জমে কোথাও কোথাও মাটি এমন হয়েছে যে দেখলে মনে হবে বহু প্রাণীর পায়ের ছাপ রয়ে গেছে। সেটাকে অ্যানিমাল ফুট প্রিন্ট বলেই দেখায় ওরা।
ঠিক যেন পশুদের পায়ের ছাপ
তারপর আরও চলা। এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ। বাচ্চাদের জন্য রাখা জল থেকে এক এক ঢোক করে খেয়ে একটু বিশ্রাম। কোনও ক্যামেরাতেই ধরা গেল না সেখানকার পুরো বিস্তার। এদিকে সূর্য ডোবার পালা এগিয়ে এসেছে ফলে রঙ ধরেছে আকাশের গায়ে। তখন চুপ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। চোখ, হৃদয়, মনের মুগ্ধতার পালা পূর্ণ করে এবারে ফিরতি পথ। এবার সার্জেম ফসিল বা জীবাশ্ম দেখাল। দেখে সত্যি গায়ে কাঁটা দেয়। কোথায় এই পাহাড়ি মেঘালয়ের এক কোণে পৃথিবীর সবথেকে বেশি বৃষ্টি হওয়া অঞ্চল মৌসিনরাম পেরিয়ে ছোট্ট এই মলিংবনা গ্রাম। সেখানে পাহাড়ের মাথায় সাদা পাথরের গায়ে কিনা সমুদ্রের প্রাণীর জীবাশ্ম, তারা মাছের ছাপ! পরে অবশ্য আমাদের লস এঞ্জেলেসের এক বন্ধু ছবি দেখে বলল, ওগুলো আসলে স্যান্ড ডলার নামে এক সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম। একটা ঝিনুকের জীবাশ্মও ছিল। ভেবে অবাক লাগল যে তার মানে এখানে আগে সমুদ্র ছিল – টেথিস সাগর, যার থেকে হিমালয়ের উৎপত্তি!
স্যান্ড ডলারের ফসিল
এর পর আর কিছু না দেখলেও কোনও আফশোস থাকত না। কিন্তু তারপরেও দেখলাম, ছোট ছোট গর্ত, নদীখাতের চিহ্ন পাথুরে জমির ওপর। গর্তে ভর্তি জল আর তার মধ্যে ওমা, এ যে এক কুচো চিংড়ি! মানে, তলা দিয়ে সব যোগাযোগ রয়ে গেছে! কিছুদূর হেঁটেই দেখি এক ছোট্ট ঝোরা বয়ে চলেছে, তাতে জুতো না খুলে গেলে জুতো ভিজবে। অতএব ঠাণ্ডা জলে পা ভিজিয়ে সেটা পেরিয়ে এলাম। আবার হাঁটা! সন্ধে হয়ে আসছে। আকাশের অদ্ভূত রং ছড়িয়ে পড়েছে আরও গাঢ় হয়ে। আশে পাশে পাথরগুলো নানা অবয়ব নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। কোনওটা দেখে মনে হচ্ছে যেন আমাদের জন্য চেয়ার তৈরি করে রাখা, কোনওটা আবার যেন একটা মস্ত কোলা ব্যাঙ তো কোনওটা আবার কুমীর! ওদিকে ঝুপ ঝুপ ঝুপ্পুস করে নেমে আসছে সন্ধের অন্ধকার। অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চড়াই ওঠার কাজটা খুব মজাদার নয়! কাজেই ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মতো '…লম্ফ দিয়ে চল রে সবাই, লম্ফ দিয়ে চল' বলতে বলতে আমরা এসে পড়লাম মূল রাস্তায়। এখান দিয়ে গাড়ি চলে। ব্যস! রাস্তার ধারে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে দম নিতে লাগলাম সবাই আর ফোন গেল রফিকের কাছে। বাকিটা রথেই ফিরব। সামান্য রাস্তা, বিষাণ হেঁটেই চলল। পৌঁছেও গেলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
মলিংবনাতে সূর্যাস্ত
অস্তমিত সূর্যের রং মেখে আকাশ অবর্ণনীয় রূপ ধরেছে। অন্ধকারে কে বেশি সেই রূপ কীভাবে ক্যামেরায় ফুটিয়ে তুলতে পারে শুরু হয়ে গেল সেই খেলা। ঘরে ফিরে বিশ্রাম নিয়েই ওদের গাছের ওপর ছাউনি দেওয়া বসার জায়গায়, যেখানে আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে বসে স্থানীয় তাজা মাছ ভাজা সহযোগে শুরু হল আড্ডা। বাচ্চারা খেল অ্যাপেল জুস, যেটা শিলং থেকে কিনে আনা হয়েছিল। আড্ডার শেষে হু হু হাওয়ার জায়গায় বসে খাওয়া সেরে, গাছের ওপরে ঝোলানো হ্যারিকেনের আলোয় নিজেদের কটেজে ফিরে ঘুম।
মফ্লং-এর পবিত্র অরণ্য
পরের দিন যাব মফলংয়ের পবিত্র বন হয়ে চেরাপুঞ্জী। মফলং সেক্রেড ফরেস্ট খাসি উপজাতির মানুষের ধর্মীয় উপাসনার বন ছিল। এখানে আছে পবিত্র রুদ্রাক্ষ গাছ ও আরও কিছু গাছ যা থেকে জীবনদায়ী ওষুধ তৈরি হয়।
মফ্লং-এর পবিত্র বনে উপাসনার স্থান
এই বন থেকে কোনও কিছু বাড়ি নিয়ে যাওয়া বারণ, তাহলেই ক্ষতি হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করেন ওঁরা। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস ও ভাবাবেগেকে শ্রদ্ধা করাই কাম্য, তাই রুদ্রাক্ষের ফল আর নিয়ে আসা গেল না। এখানে এক ধরনের খুব সুন্দর দেখতে লাল রঙের ফল পড়ে থাকতে দেখলাম যা অত্যন্ত বিষাক্ত। আর দেখলাম কাঠবেড়ালির প্রিয় বাদাম পড়ে থাকতে। লম্বা লম্বা পাথর বা মনোলিথে ঘেরা উপাসনাস্থলটিও দেখা হল। এখানে একসময়ে মোষ বলি হত, এখন আর হয় না। এর পরে আর যাওয়া বারণ। আবার রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে এক স্থানীয় হাট, একটু নেমে দেখে নিলাম। কেনা হল রবারের গামবুট। ইয়ে, আমিও একখানা কিনে ফেলেছি। যদিও শঙ্খর মতে ওটা কেনাই সার, জীবনেও ব্যবহার হবে না। আমিও চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, দেখা যাক। ( চুপিচুপি বলি, এখন আমারও মনে হচ্ছে...তবু...না, একটা সুযোগ ঠিকই পাব। তাই না?)
সেভেন সিস্টার্স জলপ্রপাত আসলে একটা পাহাড় ঘিরে নেমে আসা সাতটি জলধারা। শীতের সময় শুকনো খটখটে। রফিক বলল মেঘালয়ে বর্ষায় এলে সত্যিই মনে হয় মেঘের ওপরেই গাড়ি চলছে। আর জলপ্রপাতও ভরা থাকে। কিন্তু সে সময় আবার কুয়াশার জন্য প্রায়ই সবকিছু দেখা যায় না, জঙ্গলের রাস্তায় সবসময় হাঁটাও যায় না। সবকিছু একসঙ্গে পাওয়া যাবে না এটাই জীবনের শিক্ষা। কিন্তু যেটুকু পাওয়া যায় তার রূপ, রস বর্ণ, গন্ধটুকু সব ইন্দ্রিয় খোলা রেখে নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলার কাজটা খুব কঠিন নয়। আমাদের মন ক্রমশ ভরে উঠতে লাগল। তবে পেট জানান দিচ্ছে সে এক্কেবারে খালি। কিন্তু ভালো খাওয়ার জায়গা কই?
এবার চেরাপুঞ্জী। সেখানে একটা ডর্মিটরি পাওয়া গেছে। কাল যাব এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম হিসেবে বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি পাওয়া মলিংলং গ্রামে। সেখানে মেঘালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য লিভিং রুট ব্রীজও আছে। খিদের চোটে গান গাইতে গাইতে রাস্তার এক ধারে দিব্যি সাজানো গোছানো রেস্তোরায় গাড়ি থামান হল। তখন সূর্য পাটে। ঠিক হল যা আগে পাওয়া যাবে সেটাই খাওয়া হবে, কারণ সবারই খুব খিদে পেয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি অর্ডার দিয়ে ফেল্লাম। চাইনিজ, খাসি খাবার তখন পাওয়া গেল না। কিন্তু খাবার যে আসেই না! বাচ্চারা খিদেয় কাতর, বড়রা তো আরও কাতর! তখন বোঝা গেল তাড়াতাড়ি করলেও আমরা তাড়াহুড়োয় যা মনে এসেছে সেভাবে সবার পছন্দের চার রকমের স্যুপ, চার রকমের মেন ডিশ আর দু রকমের সাইড ডিশ বলেছি। রফিক মাছ মাংস খায় না, তার জন্য নিরামিষ বলতে হয়েছে। সব খাবার একসঙ্গে দিতে গেলে দেরি হবেই। তাই নিজেদের বুদ্ধি দেখে নিজেরা হাসি মুখে আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া কীই বা করার ছিল! বাচ্চারা বাবাদের সঙ্গে বাইরে গেল যেখানে রেস্তোরার বাগানে পাথরের চেয়ার রয়েছে। কনকনে ঠাণ্ডায় ওরা আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করছিল। তার মধ্যেই পেটের আগুন নেভানোর ব্যবস্থা হল। ফটাফট সাফ হয়ে গেল স্যুপের বাটি আর খাবারের প্লেটগুলো। শান্ত মনে চেরা রিসর্টের দিকে এগোনো গেল। অন্ধকারে রাস্তার সৌন্দর্য গাড়ির হেডলাইটে দেখে আমরা সবাই উচ্ছ্বাসিত। রফিক বলে সে যত প্যাসেঞ্জার আনে, তারা শহরের এই এত দূরে, পাহাড়ের মাথায় উঠতে উঠতে বলে 'এ কোথায় নিয়ে এলে?' আর আমরা মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি! যেটা বলল না সেটা হল যে আমাদের মাথায় একটু…ঐ আর কি…। ওকে অবশ্য আমরাই মলিংব্না চেনালাম। ওই নতুন গুহাতেও ও আগে আসেনি। যেই বলেছি দেখ, তোমাকে কত কিছু দেখিয়ে দিলাম অমনি রসিক রফিকের উত্তর, 'আপনারা পয়সা দিয়ে দেখছেন আর আমি পয়সা নিয়ে দেখছি।'চেরাপুঞ্জী রিসর্ট-এ পৌঁছলাম। আগেই চেরাপুঞ্জী বা শোহরা বাজারের মৃদু আলোয়, টিপটিপে বৃষ্টিতে বড়ো ভালো লেগে গেছিল জায়গাটা। পরের দিনই বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল না। পাহাড়ের মাথায় চেরা রিসর্ট-এ ঢুকে ইচ্ছেটা আরও জোরদার হল। আগুন জ্বেলে একদল ট্যুরিস্ট আগুন পোহাচ্ছেন। দূরে বাংলাদেশের আলো দেখা যাচ্ছে। বড় সুন্দর। অদৃষ্টেও বোধহয় আমাদের ইচ্ছের প্রভাব পড়ল। একটা নয়, দুটো আলাদা ঘর পাওয়া গেল। সুন্দর ব্যবস্থা। ইন্টারনেট থেকে ক্যারম খেলা সব কিছুরই আয়োজন রয়েছে। তক্ষুণি বদলে গেল ভ্রমণ সূচি। মলিংলং ক্যানসেল। চেরাপুঞ্জীতেই পরের দিন থাকা আর গোটা দিনটা ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ-এ ট্রেকিং। ৩৩০০ সিঁড়ি ওঠানামা একদিকে। যাতায়াত মিলিয়ে কত হল? সিঁড়ি মানে টানা সিঁড়িও যেমন রয়েছে, তেমনই শুধু চড়াই উতরাইও রয়েছে। পেরোতে হবে পাহাড়ি গ্রাম, পাহাড়ি নদী, ঝুলন্ত সাঁকোর ওপর দিয়ে। ঠিক হ্যায়, চল তাই হোক।
জীবন্ত শিকড় সেতুর উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু
মলিংলং-এ জানিয়ে দেওয়া হল। খারাপ লাগছিল। কিন্তু পরের দিন বেরিয়ে পড়েও আমরা ঠিক মতো সেখানে উপভোগ করতে পারতাম না। সবারই আর ছুটতেও ভালো লাগছিল না। অতএব বছরের প্রথম দিন সকালে চীজ স্যান্ডউইচ, ডিমসেদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে শুরু হল আমাদের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ অভিযান। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে মরমিয়া সবার আগে চলল গাইড ব্যাটের সঙ্গে। তার একটা খাসি নামও আছে বটে। কিন্তু সবার সুবিধের জন্য এই নামেই সে পরিচিত।
জীবন্ত শিকড় সেতুর পথে ব্যাট আঙ্কলের সাথে মরমিয়া
কী এই লিভিং রুট ব্রীজ? এটা একেবারেই খাসি উপজাতির বৈশিষ্ট্য আর মেঘালয়েই দেখা যায়। কোনও নদী বা ঝোরার একপ্রান্তে হওয়া এক ধরণের রাবার গাছের শিকড়ের অভিমুখ গাছ বড় হওয়ার সময় লাঠির ঠেকা দিয়ে নিচের বদলে পাশে করে দেওয়া হয়। শিকড় ঐ অবস্থাতেই বাড়তে থাকে আর যখন অপর প্রান্ত ছোঁয়, তখন দিব্যি তৈরি হয়ে যায় এক প্রাকৃতিক সেতু। ওভাবেই বেড়ে চলে শিকড় ও গাছ। শক্ত হয় সেতু, যা পলকা বাঁশের সাঁকো, এমনকি অনেক কৃত্রিম সেতুর থেকেও অনেক শক্তপোক্ত আর নির্ভরযোগ্য। এক একটা এরকম সেতু তৈরি হতে কিন্তু লেগে যায় প্রায় পঁচিশ থেকে তিরিশ বছর! মেঘালয়ে বেশ কয়েকটা একতলা সেতু রয়েছে। কিন্তু ঐ অঞ্চলে দোতলা ঐ রকম ব্রীজ মাত্র একটিই যার উদ্দেশ্যে চলেছি আমরা। অনেকক্ষণ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, নদীর ওপরে কৃত্রিম দুটি ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে দুটি গ্রাম পেরিয়ে যখন উদ্দিষ্ট গ্রামে পৌঁছলাম, তখন কমলালেবু ভর্তি গাছ দেখেও অতটা উত্তেজিত লাগছিল না। তারপর আধ মিনিট হেঁটেই সামনে যা দেখলাম তার বর্ণনা করা কঠিন। শুধু কি ব্রীজ! তলায় রয়েছে দুটো জলাশয়, সেখানে পাথরের ওপরে বসে মাছ ধরছে স্থানীয় বাচ্চারা। বিভিন্ন পাথরে বসে স্থানীয় মানুষ এবং পর্যটক পিকনিক করছে – নতুন বছরের প্রথম দিনটা একটু অন্যভাবে উদযাপন করছে। ওখানে পৌঁছেই মনে হল, এই সেই লীলা মজুমদারের লেখার 'স্বর্গ'! মন ভরে গেল। আমরাও একটা পাথরে বসে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া চীজ স্যান্ডউইচ, ডিমসেদ্ধ, কলা দিয়ে পেটপুজো সেরে নিলাম। তার আগে বলাই বাহুল্য জুতো খুলে জলে হাত পা ভিজিয়ে তাজা হয়ে নিলাম সবাই।
ডাবল্ ডেকার জীবন্ত শিকড় সেতু
ফেরার ইচ্ছে ছিল না কারোরই কিন্তু ব্যাট তাড়া দিল। পৌঁছতে সন্ধে হয়ে যাবে। জঙ্গলের মধ্যে সন্ধের সময় হাঁটা কাজের কথা নয়। আমাদের শহুরে প্রাণ একটু চা-চা করছিল। ফেরার পথে ছোট্ট একটা দোকানে বসে চা খেতে গিয়ে দেখি পাশে একফালি জায়গায় ফলেছে টম্যাটো আর সর্ষে। বেশি বসা গেল না। চলা শুরু করতে হল। এবারে চড়াই অনেকটা। হাঁফ ধরে যাচ্ছে। পা দুটো একটু বিশ্রাম দিয়ে আবার চলা। ব্যাট বলেছে নিজের গতিতে চলতে। অযথা জোর কদমে চলতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তাই আমি আর প্রিয়াঙ্কা সব শেষে চললাম, মরমিয়া বাবার হাত ধরে সবার আগে। আমি বসছিলাম না, একটু দাঁড়িয়ে দম নিয়ে আবার চলা শুরু করছিলাম। মনে হচ্ছিল বসলে আর উঠতে পারবো না। অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে এক গ্রামে এসে পৌঁছলাম। এখানে এক বাড়িতে আমাদের বাড়তি কিছু মাল রেখে গেছিলাম। অন্ধকার নেমে আসছে, মনে হচ্ছিল ওখানেই থেকে যাই। কিন্তু কী করে! কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এক শিশি টাটকা মধু কিনলাম সেই বৃদ্ধ দম্পতির কাছ থেকে। তারপর হেইয়ো হো... অন্ধকারে যেতে যেতে আমি আর প্রিয়াঙ্কা পরস্পরকে সাহস জুগিয়ে চলছিলাম। আর কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। প্রিয়াঙ্কার আবার 'স্লিপ ডিস্ক', হাঁটুতে 'নী ক্যাপ' আর হাঁপানির সমস্যা। কিন্তু ওর উৎসাহ কিছুতেই দমে না। ওকে দেখে আমার চাঙ্গা লাগে। একটা জায়গায় এসে পিছনে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না দূরে ফেলে আসা অন্য পাহাড়ের চূড়োয় জঙ্গলে ঢাকা আবছা জায়গাটা পেরিয়ে এসেছি। মনের জোর বাড়ল, পায়ের জোর নয়। টুকটুক করে এগোতে এগোতে দেখা বিষাণের সঙ্গে। সে আবার পথ ভুল করেছিল। যাতে আমরা না হারিয়ে যাই, তাই আমাদের নিতে এসেছে। বাচ্চাদের গলার স্বর পেয়ে এত খুশি আর কবে হয়েছি মনে পড়ে না। শেষে পৌঁছলাম গাড়ির কাছে। হাততালি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাল বাকিরা। শুনলাম মরমিয়া আর তার বাবা সবার আগে পৌঁছে বাকি সব্বাইকে ওভাবে স্বাগত জানিয়েছে। তারপর একে একে ওদের দল ভারি হয়েছে।
কটেজে পৌঁছে বিশ্রাম, গল্প, চিকেন পকোড়া, শূয়োরের মাংস ভাজার সাথে তাস খেলে বেশ কাটল সময়টা। তার আগে সবাই ওজন করে দেখলাম এই হাঁটার পর কত করে কমেছি! পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মনের গোপনে আবার আসার ইচ্ছে রয়ে গেল। এবার যাব শিলং, পথে দেখব মৌস্মাই কেভ, নইক্কালিকাল জলপ্রপাত, সেভেন সিস্টার্স জলপ্রপাত, কোহ রামা আর একটি সদ্য আবিষ্কৃত গুহা।
মৌস্মাই গুহার ভেতরে
মেঘালয়ের গুহাভ্রমণ রোমাঞ্চকর অভিযানের তালিকায় অন্যতম। কিন্তু মৌস্মাইকে সাধারণ মানুষের দর্শনের উপযোগীও করে তোলা হয়েছে। এলোমেলো চলে পথ হারানোর সম্ভাবনা অবশ্য যথেষ্ট, সে বিষয়ে হুঁশিয়ারিও লেখা রয়েছে। গুহার ছাদ আর দেওয়ালে চুনাপাথরে জল চুঁইয়ে নানা স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট ছড়িয়ে রয়েছে। কোথাও হামাগুড়ি দিয়ে, কোথাও পাথর টপকে গুহাভ্রমণ শেষ হল। দুপুরের খাওয়া সেখানেই সেরে চলা নইক্কালিকাল জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। মরমিয়া ঘুমিয়ে রইল গাড়িতে বাবার কোলে। আমরা নেমে দেখে এলাম। ভাগ্য ভাল, এখানে এখনও অনেকটাই জল রয়েছে আর সেই জল পড়ে টলটলে নীল জলের একটা কুণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। ভাগ্যিস এটা শীতকাল! বর্ষায় এলে এই রূপ দেখা যেত না।
কোহ্ রামা
মরমিয়া বোধ হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোহ্ রামার রাক্ষসের স্বপ্ন দেখছিল। প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি এই কোহ্ রামা। একটা বিশাল লম্বা কালো পাথরের ওপরে একটা ছোট চ্যাপ্টা পাথর এমনভাবে বসানো যেন ঠিক একটা বিশাল ঢাকা দেওয়া ঝুড়ি। আশ্চর্যের বিষয় এর আশেপাশে কোথাও কোনও পাথরের নামগন্ধ নেই। আর এতবড় পাথর এভাবে এই নীচের খাদের মধ্যে আনা অসম্ভব! হয়তো ভূমিকম্প বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক কারণে হয়েছে। কিন্তু লৌকিক বিশ্বাস এই যে ঐ অঞ্চলে একসময় বাস করত এক ভীষণ দুষ্টু দৈত্য। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ গ্রামবাসিরা তাকে নেমন্তন্ন করল এক ভোজে। সেখানে তাকে এক ঝুড়ি খাবার দেখিয়ে বসতে দেওয়া হল এক আসনে, যেটা আসলে ছিল পেরেক, লোহা ভর্তি গর্ত। যেই না দৈত্য বসল, ব্যস! অক্কা পেয়ে ঐ লম্বা পাথর হয়ে গেল!
এরপর আরেকটা গুহার পথে। পৌঁছতে দেরি হল। আমরা গেলাম না, বিয়াস ছুটতে ছুটতে গেল বাবা-মা'র সঙ্গে। আর আসে না! আমরা সেখানে বসে সূর্যাস্ত দেখলাম। কাছের একটা দোকানে বসে গরম স্যুপ খেলাম। অপেক্ষা করতে করতে দেখি ওরা আসছে হাঁপাতে হাঁপাতে অন্ধকার রাস্তা ধরে। ওরাই শেষ দর্শনার্থী ছিল। গাইডের সঙ্গে একটা টর্চ আর ওরা একটা টর্চ ভাড়া নিয়েছিল। অন্ধকার গুহায় জল পেরিয়ে, ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া জলে ভিজে কিছুটা যেতে পেরেছে, তারপরে আর যাওয়া যায়নি। দেয়ালে দেখেছে প্রজাপতি, গাছের পাতার ফসিল। এছাড়া স্ট্যালাকটাইট, স্ট্যালাগমাইট তো ছিলই। কিন্তু ভয়ও পেয়েছিল বেজায়!
ত্রিপুরা ক্যাস্ল্ হেরিটেজ হোটেলের একাংশ
এখন গন্তব্য ত্রিপুরা ক্যাসেল। গিয়ে মন ভরে গেল। এটা ত্রিপুরার রাজাদের শিলংয়ের আবাস। বড় অংশ এখন হেরিটেজ হোটেলে রূপান্তরিত আর পাশে নিরাপত্তার ঘেরটোপে রয়েছে তাঁদের বাড়ি। সেখানে এখনও থাকেন তরুণ যুবরাজ। ঠাণ্ডা পেলাম এখানেই বেশি। কিন্তু বড় কাঠের ঘরে বড় রুম হীটার, গরম হাওয়ার ছোট মেশিন চালিয়ে উষ্ণতায় আরামে চোখ বুজে আসছিল। তবে রাতে খেতে যেতে হবে। ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি কিন্তু মেনুতে বাকি খাবারের দাম হেরিটেজ হোটেলের মতোই। আমরা তো অনেক আগে একটা ছাড়ের প্যাকেজের সুযোগ নিয়েছি। ব্রেকফাস্ট সহ থাকার পুরো টাকা আগেই দেওয়া রয়েছে। কিন্তু ঐ হেরিটেজ হোটেলের আ লা কার্টের চক্করে পড়া যাবে না তা হোটেলে ঢুকে দেখেশুনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চা, কফি ইত্যাদির ব্যবস্থা ঘরেই রয়েছে হোটেলের তরফ থেকে। ফলে অকারণে বেশি দাম দিয়ে আর কিছু খাব না এটা ঠিক হল। কাজেই রফিককে বলা হয়েছে একটু পরে আসতে। বৃষ্টি পড়ে চলেছে ওদিকে। সব মিলিয়ে জমজমাট পরিবেশ। রাতে আর কোনও চাপ না নিয়ে আমাদের পুরনো পরিচিত রেস্তোরাতেই চলে গেলাম গরম গরম স্যুপ আর চাইনিজ খেয়ে নিতে। ফিরে এসে ঘুম।
পরের দিন সকালে জম্পেশ ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোলাম হাঁটতে। প্রিয়াঙ্কার মোবাইলে জিপিএস-এর নির্দেশনায় এদিক সেদিক ঘুরে ঘাম ঝরিয়ে মন ফুরফুরে করে ফিরে এলাম। ওঃ, প্রথমে কিন্তু আমরা গলফ্ কার্টে করে ঐ হোটেলেরই আরেকটা বাড়িতে গিয়েছিলাম। মূল ফটক থেকে পায়ে হেঁটে চলাচল বারণ। কারণ কুকুর ছাড়া থাকে আর দিব্যি কামড়ায়! তাই পায়ে হেঁটে ঢুকতে গেলে হয় অনেকটা ঘুরে পেছন দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে নইলে ঐ গলফ কার্টের শরণাপন্ন হতে হবে। আমরা পেছনের দরজা দিয়ে হেঁটেই ফিরলাম। দুপুর হয়ে গেছে প্রায়। রফিক এল। বৃষ্টি নামল অঝোরে। বৃষ্টি থামতে এবারে আমরা গেলাম এক বাঙালি হোটেলে খেতে। মন ভরল না। বাচ্চাদের ঝাল লাগল। মনের মতো আইসক্রীম খোঁজা শুরু হল। ঐ আবহাওয়ায় গোধূলির আলোয় উমিয়াম বা বড়া পানি লেকের ছবি তোলার আশা জলাঞ্জলি দিতে হল। আমরা ওখানেই হেঁটে বেড়ালাম। কিছু কেনাকাটি হল। আইসক্রীম খেল বাচ্চারা। অনলাইন চেক ইন করে রাখল প্রিয়াঙ্কা এক সাইবার ক্যাফে থেকে। ফ্লাইট এখনও ক্যানসেল হয়নি। আমরা চা খেলাম। সন্ধেবেলায় খাবার জন্য রাস্তার মন মাতানো সুবাস ছড়ানো গরম কাবাব, বাচ্চাদের মোমো আর আমাদের রাতের জন্য খাবার নিয়ে ফিরে গেলাম ত্রিপুরা ক্যাসলে। বৃষ্টির মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে আমরা বসলাম কাবাব নিয়ে আড্ডা দিতে আর ছোটরা মোমো, কার্টুন আর ওদের গল্প নিয়ে। একটু পরেই রুম হিটারের তাপে ঘর গরম হয়ে গেল আর খাবার পেটে পড়ে আমাদের কাঁপুনি দূর হল।
এলিফ্যান্ট ফল্স্
পরের দিন সকালেও বৃষ্টি এল। কিন্তু তারপরেই আবার রোদ। চললাম এলিফ্যান্ট ফলস-এর দিকে। কেন ওরকম নাম? আগে পাথর এমনভাবে ছিল, দেখে মনে হত ঠিক যেন এক হাতি বসে আছে আর সেখান থেকে জল পড়ছে। কিন্তু এক প্রবল দুর্যোগে একটা পাথর ভেঙে যায়। ফলে হাতির চেহারাটা আমরা তেমন বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তিনটে ধাপে নিচে নেমে দেখলাম সেই জলপ্রপাত, বর্ষায় যা নামতে থাকে প্রবল রূপে।
বড়াপানি লেক
এবার চলো শিলং পীক, যেখান থেকে পুরো শহরটা দেখা যায়। সেখানে গিয়ে মেঘালয়ের নিজস্ব স্থানীয় খাসি পোশাকে মরমিয়া আর বিয়াসের ছবি তোলা হল, ঠিক যেন দুই খাসি রাজকন্যা। এদিকে সোয়েটার ছেড়ে কান খোলা পোশাকে কনকনে হাওয়ায় ওদের নাক কান ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। চট করে গরম চা খাওয়া হল সবাই মিলে। এবার যাব বড়া পানি লেক। কোথায় খাব খুঁজতে খুঁজতে এক খাসি রেস্তোরায় গিয়ে নানাবিধ খাসি খাবার খাওয়া হল। তারপর চললাম উমিয়াম লেক। মিশমিশে মেঘ করেছে। বড়াপানি লেক পৌঁছে দেখি এক কাণ্ড। সেদিন জানুয়ারী মাসের প্রথম রবিবার, তাই সবাই জমিয়ে পিকনিকে এসেছে। গান চলছে। দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু লেকের ধারে গিয়ে অদ্ভুত লাগল। ঐ বিশাল লেক! সন্ধে আর মেঘ মিলে অন্ধকারের গাঢ় রঙ আর ওইপারে এক হোটেলের টিমটিমে আলো যেন এক রহস্যাবৃত পুরীকে মনে করাচ্ছিল। আমরাও ঐ স্থানীয় গানের সঙ্গে নেচে নিলাম একটু।
খাসি খাবার...খাসা!
তারপর উঠল ঝড় আর নামল তেড়ে বৃষ্টি। দৌড় দৌড় দৌড়। গেটের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছি, এমন সময় মনে পড়ল আরে আমার কাছে তো ছাতা আছে একটা! যাই হোক মাথায় দিয়ে গুটি গুটি পায়ে চললাম গাড়ির দিকে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে হল। এত বৃষ্টির তোড় যে তাছাড়া কিছু করারও ছিল না। তারপর বৃষ্টি একটু কমতে চলা শুরু। আজ রফিক আসেনি। ওর গাড়ি সারাতে হবে। তাই আজ স্থানীয় একজনকে পাঠিয়েছে। তিনি আমাদের পাগলামির সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে যখন অন্ধকারের মধ্যে প্রিয়াঙ্কা ঠিক তাক করে যাওয়ার সময় দেখে যাওয়া রাস্তার ধারে এক রেস্তোরার বাইরে আইসক্রীম কিয়স্কের সামনে দাঁড়াতে বলল, তখন তিনি একটু অবাক হয়েছিলেন বৈকি। আমিও রেগে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টি পড়ছে, ঐ ঠাণ্ডা, লোডশেডিং, তার মধ্যে আইসক্রীম! খেতে ভালো, কিন্তু বাচ্চাগুলোর ঠাণ্ডা না লাগে। কিন্তু শেষে দেখা গেল আমি বেশি খেলাম! কারণ আমরা ঠিক করলাম যে রেস্তোরাতে বসেই বাচ্চারা আইসক্রীম খাক। তাই বৃষ্টিতে মাথায় ছাতা দিয়ে নিজেদের কোনওমতে আড়াল করে সব্বাই নেমে পড়লাম। এবার অবাক প্রিয়াঙ্কা। আইসক্রীম গাড়িতে বাচ্চাদের জন্য নিয়ে আসা হচ্ছিল, আর এখন কিনা সবাই নেমে পড়ে খেতে চাইছে! অন্ধকার রেস্তোরায়, মোমের আলোয়, বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কাজু আর কিশমিশ দেওয়া আইসক্রীম খেলাম। সন্ধের একটু খাবার নেওয়া হল আর ঠিক হল যে এবার সোজা ত্রিপুরা ক্যাসেলে ফিরে গিয়ে আরাম করে আড্ডা দিয়ে, গোছগাছ সেরে ভাল কোনও জায়গায় রাতের খাওয়া সারতে বেরোব। কারণ অদ্যই যে শেষ রজনী! তাই হল। বৃষ্টিতে আর বেরোনো হবে কিনা ভাবা হচ্ছিল এক সময়ে, কিন্তু ভালো কোথাও খেতে যাওয়ার লোভে এ ভাবনা স্থায়ী হল না। আবার ইন্টারনেটে দেখে নেওয়া হল কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে! আমাদের সারথি নিয়ে গেলেন এক জায়গায়। প্রিয়াঙ্কার নেট সার্চেও এই জায়গাটার নাম খাদ্য রসিকদের লেখাতে পাওয়া গেল। অতএব সেখানেই যাওয়া। খুব সুন্দর জায়গা, খাবারও খুব সুস্বাদু এবং দাম আমাদের বাজেটের একটু বাইরে হলেও মাত্রাছাড়া নয়। বসার জায়গায় ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। সুন্দর পরিবেশ। ফলে স্যুপ থেকে শুরু করে ডেসার্ট দিয়ে দারুণ ডিনার হল।
ফেরার পথে সবার দুশ্চিন্তা। কারণ খবর আছে স্পাইসজেটের কিছু ফ্লাইট আবার ক্যানসেল হয়েছে। সকাল বেলায় ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। রোদ ঝকঝকে বড়াপানি লেকের কাছে থামা হল একটু। তাকে সূর্যাস্তের আলোতে এক ঝলক দেখেছি শিলং আসার সময়, মেঘ, ঝড়, বৃষ্টিতে দেখেছি আগের সন্ধেয় আর আজ রোদ মাখা রূপ। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসে এক পরিষ্কার হোটেলে ভাত খেয়েই দৌড় আবার। বেশ ভিড় লাইনে। সময় হয়ে গেছে। আবার দৌড় দৌড় দৌড়। আরেকটুর জন্য মিস হয়ে যাচ্ছিল ফ্লাইট। আমাদের নিয়ে যখন আকাশে উড়ল বিমান...মনে মনে সবাই ভাবছিল আবার আসব মেঘালয়ে। আর সবার মুখে যে তৃপ্ত, স্বস্তির হাসিটা লেগে ছিল সেটার নিঃসন্দেহে একটাই মানে – যার শেষ ভাল তার সব ভাল।
ছবিঃ মরমিয়া, শঙ্খজিৎ বিশ্বাস এবং লেখক