দ্রোণ মহাভারতের এক বিশিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই বিশাল কাহিনীর মধ্যে ঘুরেফিরে বারেবারেই তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে। ভরদ্বাজ মুনির পুত্র ছিলেন এই দ্রোণ। অপ্সরা ঘৃতাচী তাঁর মা। ঋষি ভরদ্বাজ তাঁর সময়ে খুবই নামকরা শিক্ষক এবং অস্ত্রগুরু ছিলেন। নানা দেশের রাজপুত্রদের তাঁর কাছে পাঠানো হত লেখাপড়া ও অস্ত্রচালনা শিখতে। তাদের সঙ্গেই দ্রোণও বাবার কাছে লেখাপড়া শিখতে শুরু করেন। বেদ-বেদান্ত শিক্ষা শেষ হবার পর পুত্রের অস্ত্রশিক্ষার প্রতি অনুরাগ দেখে ঋষি তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য ঋষি অগ্নিবেশের কাছে দ্রোণকে পাঠান অস্ত্রচালনা শিখতে। সেখান থেকে তিনি অস্ত্রশিক্ষায়, যাকে আজকের দিনে তোমরা বলো এ+, তাই পেয়ে উত্তীর্ণ হলেন। মোটামুটি গুরুগৃহে থেকে পড়াশোনা শেষ করা পর্যন্ত সময়টাকে সেকালে বলা হত ব্রহ্মচর্য। এরপরে আসে গার্হ্যস্থ, অর্থাৎ বিয়ে করে সংসারী হবার পালা। তখনকার দিনে ছেলেরা পিতার আদেশ কখনও লঙ্ঘন করতেন না। কাজেই পড়াশোনা শেষ করেই দ্রোণকে পিতার ইচ্ছায় শরদ্বান ঋষির কন্যা কৃপীকে বিয়ে করতে হল। দ্রোণ ও কৃপীর একটিমাত্র ছেলে, নাম অশ্বত্থামা।
দ্রোণের জীবনকে যদি কয়েকটা ভাগে ভাগ করে যায়, যেমন আমাদের সকলেরই হয়, তবে এই অংশটাকে জীবনের শুরু বা প্রথম অংশ বলা যেতে পারে। পুত্রের জন্মের পর তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হল। অশ্বত্থামাকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। কিন্তু দারিদ্র্যের জন্য তার সব আবদার পূর্ণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না। গল্পে আছে, শিশু অশ্বত্থামা দুধ খাবার জন্য বায়না ধরলে তার মা তাকে পিটুলির গোলা খাইয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। যাই হোক, দ্রোণ চিন্তা করতে লাগলেন, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে কি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়। মহাঋষি পরশুরাম এইসময় মহেন্দ্রপর্বতে ( বর্তমানে যাকে বলে পূর্বঘাট পর্বতমালা ) বাস করছিলেন। শোনা গেল, তিনি তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ দান করছেন। দ্রোণ সেখানে ছুটলেন কিছু ধনার্জনের আশায়। কিন্তু তাঁর একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ঋষি বললেন, " বৎস দ্রোণ, আমি সমস্ত পার্থিব সম্পদ দান করে দিয়েছি। এখন আমার ধ্যানে বসবার সময় হল। তুমি তো বড্ড দেরি করে এসেছ। যাই হোক, প্রার্থী হয়ে তুমি যখন এসেছ, সাধ্যমত তোমার আশা পূর্ণ করার চেষ্টা করব। দেখ, এখন আমার কাছে আছে কেবলমাত্র আমার শরীর আর আমার অস্ত্রগুলি। তুমি কি আমার অস্ত্র-শস্ত্রগুলি নিতে ইচ্ছুক? " পরশুরামের বহু সাধনায় লব্ধ অস্ত্রগুলি যে কোন যুদ্ধাস্ত্র-শিক্ষার্থী মানুষের কাছে প্রার্থনীয় ছিল। দ্রোণ তাই খুশিমনেই সেগুলি গ্রহণ করলেন। তারপর পরশুরামের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সেই অস্ত্রগুলির ব্যবহার শিক্ষা করলেন।
পরশুরামের অস্ত্র দ্রোণকে যতই সমৃদ্ধ করুক না কেন, তাঁর দারিদ্র্য তো ঘুচল না। ভাবতে ভাবতে দ্রোণের মনে পড়ল দ্রুপদের কথা। পাঞ্চাল দেশের রাজপুত্র দ্রুপদ এসেছিলেন ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে শিক্ষালাভ করতে। তখনই তাঁর সঙ্গে দ্রোণের খুব ভাব হয়েছিল। খাওয়া- শোওয়া একসঙ্গে, পড়ার অবসরে সময় কাটানো একসঙ্গে, এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে দ্রুপদ বারবার বলতেন, তিনি যখন রাজা হবেন, তখন দ্রোণকে অদেয় তাঁর কিছুই থাকবে না। এক রাজ্য ভাগ করে দুজনে শাসন করবেন। আজ দুঃসময়ে সেই কথা দ্রোণের মনে এল।
স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে দ্রোণ এলেন পাঞ্চাল রাজ্যে। বহু আশায় বুক বেঁধে রাজসভায় দাঁড়িয়ে দ্রুপদকে মনে করিয়ে দিলেন তাঁর পূর্ব প্রতিজ্ঞা, শৈশব থেকে একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠার দিনগুলির কথা। কিন্তু একি! সিংহাসনে বসে দ্রুপদ সেই বন্ধুত্বের কথা ভুলে গেছেন। ভরা রাজসভায় সকলের সামনে দরিদ্র ব্রাহ্মণের সঙ্গে রাজপুত্রের সখ্যতাকে স্বীকার করতে তাঁর লজ্জা হল, সম্মানে বাঁধল। তিনি রূঢ়স্বরে দ্রোণকে অপমান করে সভা থেকে তাড়িয়ে দিলেন। লাঞ্ছনায় দ্রোণের ব্রহ্মতেজ, ক্ষাত্রতেজ একসঙ্গে জ্বলে উঠল। তিনি উচ্চৈঃস্বরে সভাস্থ সকলকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করলেন, " রাজা, আমি দরিদ্র হতে পারি, কিন্তু ধন বাদে তোমার থেকে কোন অংশে খাটো নই। এছাড়াও আমি তোমার গুরুপুত্র। শিষ্টতার সমস্ত সীমা তুমি লঙ্ঘন করে আমায় অপমান করলে। এর প্রতিফল তুমি পাবে। শীঘ্রই যুদ্ধে বন্দী হয়ে তুমি আমার কাছে নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা করবে। "
হস্তিনাপুরে তখন কুরুবংশের রাজত্ব চলছে। বীরত্বে, সুশাসনে এই বংশের দেশজোড়া নাম। একশ-পাঁচজন রাজকুমার অস্ত্রগুরু কৃপের কাছে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করে। পরিবারের অভিভাবক জ্যেষ্ঠ কুমার ভীষ্মের মনে হল, আরো উন্নত ধরণের যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার জন্য একজন উচ্চস্তরের অস্ত্রগুরুর প্রয়োজন। পরশুরামের শিষ্য হিসেবে প্রতিভাবান দ্রোণের নাম তিনি শুনেছিলেন। তাঁর ইচ্ছানুসারে কৃপাচার্য নিজের ভগ্নীপতি দ্রোণকে আমন্ত্রণ জানালেন। তাই দ্রোণ আজ এসেছেন হস্তিনাপুরে।
হস্তিনাপুরের রাজপুরীটি বড় সুন্দর। বিরাট ঘরগুলি কি সুন্দরভাবে দামী আসবাব দিয়ে সাজানো। বাড়ির পাশে এক বিশাল কানন। সে যেন এক বিরাট বনভূমির সমান। সেখানে কতরকম ফুল গাছে শোভা পাচ্ছে, ফলভারে নত বড় বড় গাছ চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। আরও আছে মস্ত বড় পুকুর, টল্টলে জলে ভেসে বেড়াচ্ছে হাঁসেদের ঝাঁক। কানন পেরিয়ে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, রাজবাড়ির গরু-মহিষগুলি এখানেই খেতে আসে সবুজ ঘাস। কৃপাচার্যের বাড়িতে স্ত্রী-পুত্রকে রেখে দ্রোণ এই কাননে এলেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে চিন্তাক্লিষ্ট হৃদয়কে একটু বিশ্রাম দেবার আশায়।
কুরুবংশের একশপাঁচ রাজপুত্র রোজই এই বনে খেলতে আসে; আজও এসেছে। আজ তারা খেলছিল এখনকার দিনের ক্রিকেটের মত একটা খেলা। খেলা খুব জমে উঠেছে, এমন সময় হায়, হায়! একি ছন্দপতন? বলটা উড়ে গিয়ে পড়ে গেল পাশের একটা গভীর কুয়োর মধ্যে। অল্পবয়স্ক রাজপুত্রেরা দৌড়ে গেল কুয়োর কাছে, কোথায় গেল বলটা দেখবার জন্য উঁকিঝুঁকি মারছে, হঠাৎ আরেক বিপত্তি। বড়কুমার যুধিষ্ঠিরের হাত থেকে আংটিটা খুলে পড়ে গেল সেই কুয়োরই ভিতর। বল আর আংটি তোলবার জন্য রাজপুত্রেরা যখন কুয়োর ভিতর নামবার উদ্যোগ নিচ্ছে, পিছন থেকে একটা স্বর শোনা গেল, " কুরুবংশের বীরপুত্রেরা, সংকট যতই গুরুতর হোক না কেন, সাধারণ মানুষের মত তার সমাধান করা কি তোমাদের সাজে? সংকট মোচনে অস্ত্রই তোমাদের একমাত্র সহায় হওয়া উচিত। তোমরা যদি না পারো তবে আমি কি তোমাদের সাহায্য করতে পারি? "
যুধিষ্ঠির পিছন ফিরে তাকাল। শ্যামবর্ণের সৌম্য চেহারার এক ব্রাহ্মণ স্মিতমুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। মলিন বেশ-ভূষা দেখে রাজোচিত অহংকারে যুধিষ্ঠির প্রথমে তাকে আমলই দিল না, পরম অবজ্ঞায় হেসে উঠল। কিন্তু কিছু বলবার আগেই বাকি বালকেরা দ্রোণকে ঘিরে কলরব করে উঠল, " আর্য, আপনি দয়া করে আমাদের জিনিষগুলি তুলতে একটু সাহায্য করবেন? "
দ্রোণ ভাবছিলেন কি করে পিতামহ ভীষ্মের কাছে নিজের পরিচয় দেবেন। এখন তাঁর মনে হল এটাই সুযোগ। তিনি এগিয়ে এসে বিচিত্র কৌশলে তীরের ব্যবহার করে বালকদের আংটি ও বল কুয়ো থেকে উদ্ধার করে দিলেন। বিস্মিত, উ্ৎফুল্ল রাজপুত্রেরা যখন তাঁকে পুরস্কার দিতে চাইল, তখন তিনি তাদের এই ঘটনাটা ভীষ্মের কাছে বর্ণনা করতে বললেন। ভীষ্ম শুনেই বুঝলেন এই মানুষটিই তাঁর প্রার্থিত জন যাঁর হাতে তিনি যুদ্ধবিদ্যা শিখবার জন্য কুরুবংশের বালকদের নিশ্চিন্তে সঁপে দিতে পারেন। হস্তিনাপুরে দ্রোণের আসন কুরুকুলের অস্ত্রগুরু হিসেবে নিশ্চিত হল।
অর্থোপার্জনের চিন্তা দূর হলে দ্রোণ আন্তরিকভাবে কুরুবালকদের অস্ত্রশিক্ষায় মন দিলেন। সকলেই যে যার মত করে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠল, অর্জুনের প্রতি যেন তাঁর টানটা একটু বেশি। অর্জুনের একাগ্রতা, বুদ্ধি, অস্ত্রের প্রতি অনুরাগ, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, ছাত্র হিসাবে গুরুর সবচেয়ে বেশি ভালবাসা দখল করে নিয়েছিল। অর্জুনকে তাঁর শ্রেষ্ঠ ছাত্র বলে বারবার সর্বসমক্ষে ঘোষণা করতে তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না।
তোমার যেমন মাঝে মাঝে ক্লাসটেস্ট হয়, তেমনই দ্রোণও মাঝে মাঝে তাঁর ছাত্রদের শিক্ষার অগ্রগতির পরীক্ষা নিতেন। বনে জঙ্গলে, খোলা মাঠে লক্ষ্যভেদ, গদাযুদ্ধ বা শুধুই শারীরিক কসরৎ - নানাভাবে এই পরীক্ষা হত। সবেতেই অর্জুন প্রথম হত। এরকমই এক পরীক্ষার সময় একদিন মাঠে প্রবেশ করল কর্ণ নামে একটি কিশোর। সে নিজেকে সূত অধিরথের পুত্র বলে পরিচয় দিয়ে দ্রোণের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে চাইল। এজন্য সে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতেও রাজি। তার সুগঠিত দেহ, তার ধনুকের টংকার, তার বীরোচিত ভাবভঙ্গি যেন বলে দিচ্ছিল একমাত্র সে-ই অর্জুনেরই যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। সমস্ত প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করা দ্রোণের মনে এই প্রথম আশঙ্কা হল, যদি অর্জুন হেরে যায়। তিনি তাকে শিষ্যত্ব দান করতে অস্বীকার করলেন, সূতপুত্র বলে ধিক্কার দিলেন, বললেন, তিনি রাজা বা রাজকুলোদ্ভব ছাড়া কাউকে শিক্ষা দেননা। দুর্যোধন পাঁচ পাণ্ডবভাইদের খুব হিংসা করতেন। অর্জুনের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী এসে গেল মনে করে তিনি কর্ণকে আদর করে ডেকে নিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে অঙ্গদেশের রাজা বলে ঘোষণা করলেন। কিন্তু কর্ণ দ্রোণের কাছে আর শিক্ষা নিতে আসেননি।
তখন অর্জুন দ্রোণের শ্রেষ্ঠ ছাত্র বলে স্বীকৃত হয়েছে। একদিন নিষাদ বালক একলব্য এল দ্রোণের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখবার জন্য। তার জীবনের স্বপ্ন দ্রোণকে গুরু হিসাবে পাওয়া। কিন্তু তিনি রাজগুরু, তুচ্ছ নিষাদ বালককে শিক্ষা দিতে তাঁর মর্যাদায় আঘাত লাগল; তিনি ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিলেন। এর বেশ কিছু বছর বাদে একদিন তিনি ছাত্রদল সহ অরণ্যভ্রমণে বেরিয়েছেন, সঙ্গে তাঁদের পোষা কুকুর। কুকুরটা আগে যেতে যেতে ঘন বনের ভিতর ঢুকে গেছে। ভীম আর দুর্যোধন গদা ঠোকাঠুকি করতে করতে চলেছে, নকুল-সহদেব খোলা গলায় গান ধরেছে, এমন সময় সবাইকে সচকিত করে কুকুরটার আর্ত চিৎকার ভেসে এল। পরক্ষণেই সে বেড়িয়ে এল, মুখে কয়েকটা তীর বেঁধা; এমনভাবে সেগুলি ছোঁড়া হয়েছে যাতে তার প্রাণ যায়নি, কিন্তু মুখটা আট্কে গেছে। সবাই অবাক হয়ে এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। শেষে গুরুকে অনুসরণ করে গিয়ে সবাই দেখল, একটি পর্ণকুটিরের সামনে বসে একটি ছেলে এক মনে তীর-ধনুক নিয়ে অভ্যাস করছে, সামনের উঠানে দ্রোণাচার্যের একটি মৃন্ময় মূর্তি। দেখলেই বোঝা যায়, মূর্তিটি নিত্যদিন পূজিত হয়।
বিস্মিত দ্রোণ বালকটির সামনে এসে তার গুরু-পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। এই সেই একলব্য, যাকে দ্রোণ শিষ্যত্বে বরণ করতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপর থেকে একলব্য প্রতিদিন নিজের মত করে অভ্যাস করেছে আর সেই অভ্যাস উৎসর্গ করেছে গুরু দ্রোণকে। মনে মনে দ্রোণ তার তারিফ না করে পারলেন না। কিন্তু অর্জুন? তার তবে কি হবে? অর্জুনকে তিনি হাতে ধরে তৈরি করেছেন; আর এ তো বিনা সাহায্যেই এত বড় হয়েছে। তিনি নিজে রাজবংশের বেতনভুক্, রাজপুত্রদের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা দিতে বাক্যবদ্ধ, তবে তাঁরই বা ভবিষ্যৎ কি? সব দিকের স্বার্থ রক্ষা করতে দ্রোণ তাঁর জীবনের প্রথম অন্যায়ের পথে পা বাড়ালেন। এক ভীষণ পরিকল্পনা করে একলব্যকে বললেন, " তুমি নিজেকে আমার শিষ্য বলে দাবি করছ। তুমি কি জান, গুরুদক্ষিণা না দিলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না? " নিশ্চয় গুরুদেব, কি দক্ষিণা দেব আজ্ঞা করুন, " উৎসাহিত চোখে একলব্য গুরুর দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে দ্রোণ সেই ভীষণ দক্ষিণাটি চাইলেন, " তোমার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি আমায় দান কর "।
হঠাৎ বজ্রপাত হলেও কেউ এমন চম্কে উঠত না। উপস্থিত সকলেই একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল। একলব্য মূহুর্তেই বুঝে গেল এই দক্ষিণার আসল উদ্দেশ্য কি। অবিচল দ্রোণের সামনে সেও কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে রইল। তারপর এক কোপে প্রার্থিত আঙ্গুলটা কেটে গুরুর চরণে উপহার দিল। মুখের এতটুকু বিকৃতি নয়, কোনো কাতরোক্তি নয়, ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজবংশের উত্তরাধিকার চিত্রার্পিত হয়ে সেই অন্যায় সংঘটিত হতে দেখল।
এর পরে কেটে গেছে আরও কিছুকাল। রাজপুত্রদের শিক্ষা সমাপ্ত হল। এবার প্রকৃত পরীক্ষার পালা। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের দিতে হবে গুরুদক্ষিণা, শোধ করতে হবে গুরুঋণ। দ্রুপদের কাছে লাঞ্ছনার কথা দ্রোণের মনে তুষানলের মত জ্বলছে। আজ এই গুরুদক্ষিণার মধ্য দিয়ে তিনি সেই লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিতে চাইলেন।
যথাসময়ে কুরুরাজপুত্ররা আর তাদের সৈন্যরা পাঞ্চালরাজ্যে উপস্থিত হল। দ্রুপদরাজ ভীষণ যুদ্ধ করলেন; শেষ পর্যন্ত অর্জুনের হাতে তিনি বন্দী হয়ে দ্রোণের সামনে উপস্থিত হলে ঈষৎ হাস্যে দ্রোণ তাঁকে প্রাণরক্ষার আশ্বাস দিয়ে বাল্যকালের প্রতিজ্ঞাগুলি স্মরণ করিয়ে দিলেন। দ্রুপদের তো আর কোন উপায় নেই। তাই উত্তর পাঞ্চালের অহিচ্ছত্র নগর দিয়ে দ্রোণের সাথে সন্ধি করলেন। দ্রুপদ সভামধ্যে বলেছিলেন, বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। আজ দ্রোণও রাজা হয়েছেন; তাই আজ আবার পাঞ্চালরাজের সঙ্গে তাঁর নতুন করে সখ্য স্থাপিত হল। তারপর নিজের অংশও দ্রুপদের হাতে সমর্পন করে সদলবলে রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন।
মহাভারতে এই ঘটনাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দ্রুপদ এই অপমান ভুলে যাননি। তখনকার মত সন্ধিস্থাপনে বাধ্য হলেও তিনি রাজ্যে ফিরে এক বিশেষ যজ্ঞ করান, যেখান থেকে তাঁর এক পুত্রের উদ্ভব ঘটে, নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন। মহাভারতের যুদ্ধে এই পুত্রই দ্রোণকে বধ করেছিলেন।
অস্ত্রগুরু হিসেবে কুরুরাজপুত্রদের সঙ্গে দ্রোণের অনেক দিন কেটেছে। কুরু-মন্ত্রীসভায় তিনি একজন বিশিষ্ট মন্ত্রণাদাতা ছিলেন, তবে সর্বদাই ভীষ্মকে অনুসরণ করতেন। রাজপদের জন্য যুধিষ্ঠিরের ন্যায্য দাবিকে সমর্থন করতে দ্বিধা করেননি, তবে তাঁর ইচ্ছাকে দুর্যোধন কখনও মান্যতা দেননি। কৌরবদের জন্য অনেক যুদ্ধে তিনি যোগ দিয়েছিলেন, তবে বেশিরভাগ সময়ে তাঁকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও অন্যায় যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছিল। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় তাদের খোঁজবার জন্য দুর্যোধন যে বাহিনী পাঠিয়েছিলেন, তাতে ভীষ্মের সঙ্গে দ্রোণও ছিলেন। সেখানে তাঁদের কাজ ছিল বিরাটরাজের গোধন চুরি করা। এবং তাঁরা সেখানে হেরে ল্যাজে-গোবরে হয়েছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি দ্বিতীয় প্রধান সেনাপতি। ভীষ্মের পতনের পর তিনি সেনাদলের ভার নিলেন। তাঁর সৈনাপত্যের প্রধান ঘটনা হল অর্জুনপুত্র অভিমন্যুকে বধ করা। অন্যায় যুদ্ধে যে ষোল বছরের কিশোরটিকে সপ্তরথী একসঙ্গে মিলে নিরস্ত্র অবস্থায় বধ করেছিলেন, তার অন্যতম ছিলেন দ্রোণ। পরিকল্পনাটির রচয়িতাও তিনি। যে অর্জুনকে তিনি শিষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন, তারই সুযোগ্য পুত্রকে এইভাবে হত্যা করা তাঁর মত যোদ্ধার সুনামকে যে ভীষণভাবে কালিমালিপ্ত করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
অথচ দ্রোণের চরিত্রে মহত্ত্বের অভাব ছিল না। তিনি সেনাপতি হবার পর যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে আশীর্বাদ এবং যুদ্ধসংক্রান্ত পরামর্শ চাইতে গিয়েছিলেন। শত্রুপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও প্রিয় শিষ্যদের উদারভাবে আশীর্বাদ ও পরামর্শ দিয়েছিলেন। অর্জুনকে তিনি কঠিনভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় গুরুকে সামনে দেখে সে যেন দুর্বল না হয়; দিব্যাস্ত্র সহ সমস্ত অস্ত্রশিক্ষা উজাড় করে তাঁকে হারাতে সচেষ্ট হয়। দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্মের কারণ তিনি জানতেন, তবুও তাকে যত্ন করে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন।
কিন্তু অস্ত্র হাতে থাকলে দ্রোণকে হারানো সহজ ছিল না। তাই প্রিয় পুত্র অশ্বত্থামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে পাণ্ডবরা তাঁকে অস্ত্রহীন করল। অস্ত্র ছেড়ে পঁচাশি বৎসর বয়স্ক দ্রোণ রথে বসে পুত্রশোকে হাহাকার করে কাঁদতে লাগলেন, তারপর সেখানেই যোগাসনে বিষ্ণু-পাদপদ্ম ধ্যান করতে লাগলেন। যে কারণে ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম, সেই মহামূহুর্ত উপস্থিত হয়েছে। সুযোগ বুঝে পাণ্ডবসেনাপতি সেই অবস্থায় দ্রোণের শিরশ্ছেদ করল।
দ্রোণ সবসময় দুঃখ করতেন যে কুরুবংশের বেতনভুক্ ছিলেন বলে এত অন্যায় তাঁকে মুখ বুজে স্বীকার করতে হয়েছিল। মহাযুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে পরশুরামের শিষ্য মহাবীর ভাগ্যতাড়িত দ্রোণের সব যন্ত্রণার অবসান ঘটল। সর্বশক্তিময়ী নিয়তিও বোধহয় সেদিন অলক্ষ্যে অশ্রুবিসর্জন করেছিলেন।
কাহিনী সূত্রঃ
পৌরাণিকা, প্রথম খণ্ড
মহাভারতঃ সি রাজাগোপালাচারী
ছবিঃঅনুভব সোম