(মানভূমের লোককথা)
ঠাকুরমশাই একদিন ভাবলেন, অনেকদিনই তো ঘরে বসে আছি, একবার তীর্থে গেলে কেমন হয়? মা গঙ্গা তাঁকে ডাকছেন। গঙ্গায় স্নান করলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়। তাই একদিন ঠাকুরমশাই তীর্থে রওনা দিলেন। গঙ্গাস্নান সেরে পবিত্র হয়ে সন্ধে হয় হয় এরকম সময় বাড়ি ফিরে এলেন। একটু জিরিয়ে নিয়ে পরনের ধুতিটি খুলে আলনায় রেখে অভ্যাসমতো চললেন নদীর দিকে।
নির্জন স্থানে ভগবানের নাম জপ করতে অনেকটা সময় কেটে গেল। নদী থেকে বাড়ির পথ বেশ খানিকটা দূরে। ঠাকুরমশাই দেখলেন আঁধার নেমে এসেছে। পথ-ঘাট শুনশান। তিনি কি অনেক দেরি করে ফেলেছেন? তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগলেন। পথে একটা শ্যাওড়া গাছ পড়ে। গাছটা ডালপালা ছড়িয়ে চারপাশটা ঢেকে ফেলেছে। পাশাপাশি আরো অনেকগুলো শ্যাওড়া গাছের ঝোপ রয়েছে। ঠাকুরমশাই সেখানে পৌছে একটু থমকে গেলেন। কে যেন কথা কয়! তিনি কি ভুল শুনছেন? না, কাদের যেন গান শোনা যাচ্ছে। তবু গানের সুরটা একেবারে বেখাপ্পা। গানের আওয়াজ যেদিক থেকে আসছিল সেখানে গিয়ে তো তাঁর আক্কেল গুড়ুম। একি সত্যি হয় নাকি? গোটা দশ বারো ভূত অন্ধকারে মিশে গিয়ে নাচ শুরু করেছে। নেহাত ঠাকুরমশাইয়ের চোখটা খারাপ হয়নি তাই তিনি আবছা আবছা সব ভূতগুলোকেই দেখতে পেলেন। ঠাকুরমশাই পৈতেটা চেপে ধরে আরো একটু কাছে এগিয়ে গেলেন।
অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে তিনি দেখলেন দলে ভূত ও ভূতুনি সকলেই রয়েছে। তিনি গলা খাঁকারি দিতেই সব চুপ হয়ে গেল। ঠাকুরমশাই বললেন, “কে রে তোরা? হেঁড়ে গলায় গান গাইছিস যে বড়! এত আনন্দ কীসের?” প্রথমে কেউ উত্তর দিল না। একটু পরে একটা গোদা ভূত বলল, “ঠাকুরমশাইয়ের আজ কিঞ্চিৎ বিলম্ব হল বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিন তাড়াতাড়িই বাড়ি ফেরেন কি না, তাই শুধোলাম। আমরা আজ একটু আনন্দ ফুর্তি করছি। মানে ইয়ে, আমার নাতনির বিয়ে কিনা! ঠাকুরমশাই এরপর ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন কালো ও বেঁটে ভূতের দলে একটা ভূতুনিও গলায় কী একটা ফুলের মালা পরে বসে রয়েছে। তিনি বুঝলেন, এরই বিয়ে হবে হয়ত। ভূতগুলোর ব্যবহার মন্দ নয় দেখে তিনি সাহস দেখিয়ে বললেন, “তা বিয়েটা হচ্ছে কোথায়? পাত্র কেমন?” এই প্রশ্নের উত্তরে ভূতগুলো এমন চুপ হয়ে গেল যে মনেই হবে না এখানে গোটা দশেক জলজ্যান্ত ভূত ঠাকুরমশাইয়ের মুখোমুখি বসে আছে। ঠাকুর বার তিনেক প্রশ্নটা করেও কোনো সাড়া পেলেন না। এতে তিনি একটু বিরক্তই হলেন। তারপর এক ধমকের সুরে বলে উঠলেন, “কথা কি কানে যাচ্ছে না?” পালের গোদা ভূতটা বিনয়ের অবতার হয়ে বলল, “আজ্ঞে ঠাকুরমশাই পাত্রটা আপনার বাড়িতেই আছে বটে। আপনার বাগালটার সাথেই আমার নাতনির বিয়ে হবে কাল ঠিক এমন সময়।” তাই আজ একটু আনন্দ ফুর্তি করে নিচ্ছি। এ কথা শুনে ঠাকুরমশাই তো একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। বলে কী এরা! ভুকলা হবে ভুতের জামাই! তা কী করে সম্ভব? মানুষের সঙ্গে ভূতের বিয়ে হয় নাকি? ব্যপারটা তো পরিষ্কার হচ্ছে না ঠিকমতো। তিনি বললেন, “একটু খোলসা করে বল দেখি, তোদের মতলবটা তো সুবিধের মনে হচ্ছে না। ভুকলা কি এতে রাজি হয়েছে? ও কি ভূতকে বিয়ে করবে?” গোদা ভূতটা এক হাত লম্বা জিভ বের করে বলল, “অপরাধ নেবেন না হুজুর। আপনার বাগালটা কাল ভূত হয়েই বিয়ে করতে আসবে, মানুষ হয়ে নয়। ও যে কাল সকালেই ভূত হবে। এরকমটাই ঠিক করা আছে।” একথা শুনে ঠাকুরমশাই একেবারে চুপ করে গেলেন। এর মানে হচ্ছে ভুকলাকে এরা মেরে ফেলবে। বেচারা বাগালটা তাদের ঘরেই মানুষ হয়েছে। ঠাকুরমশাইয়ের কোনও সন্তান নেই তাই ওকেই তিনি ছেলের মতো ভালোবাসেন। তিনি উঠে পড়লেন। না, যেমন করেই হোক ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে। ভূতের নজর ছেলেটার উপর যখন একবার পড়েছে, বিপদ একটা হবেই!
ঘরে ফিরে এসে ঠাকুরমশাই যারপরনাই মনমরা হয়ে পড়লেন। তবে গিন্নিকে এসব কিছুই বললেন না। কী হবে বলে? শুনে দুঃখ পাবে। তার চেয়ে তিনি ঠিক করলেন, ভুকলাকে সারাদিন ঘরেই রাখবেন। কাল আর তাকে গোরুর পাল নিয়ে মাঠে যেতে দেবেন না।
পরদিন ভোরে উঠে ভুকলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ছেলেটা ঠিক সময়ই এসে পড়ল। ঠাকুরমশাই তাকে ডেকে বললেন, “ঘরে আজ অনেক কাজ রয়েছে। গোরু-বাছুরগুলোর বাঁধন খুলে দে। ওগুলো নিজে নিজেই চরে আসুক। ভুকলাও সেইমতো গোয়ালে গিয়ে গোরুগুলোর গলা থেকে দড়ির বাঁধন খুলে দিল। ছাড়া পেয়ে সবগুলো বাইরে বেরিয়ে এল। শুধু কালোমতো একটা বলদ কিছুতেই বের হতে চাইলো না। ভুকলা যতই তাকে লাঠির বাড়ি মেরে বাইরে বের করতে যায়, ততই সেটা রাগে চোখ লাল করে ফোঁস ফোঁস করে। ব্যাটাকে যেন ভূতে পেয়েছে! সামনের পা দুটোকে অনবরত মাটিতে ঠুকছে। ভুকলা এর কারণ কিছুই বুঝতে পারলনা। সেও রেগে গেল। বেয়ারা বলদটাকে জব্দ করতে শিং লক্ষ করে লাঠি চালাল। কিন্তু বলদটা চরকি কেটে এক চক্কর ঘুরে গেল। তারপর শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকিয়ে ভুকলার দিকে ধেয়ে এল। নিমেষের মধ্যে ধারালো শিং ঢুকিয়ে দিল ভুকলার পেটে। বেচারা সেইখানেই লুটিয়ে পড়ল।
ঠাকুরমশাই হায় হায় করে উঠলেন। তিনি সব জেনেও ছেলেটাকে বাঁচাতে পারলেন না। এই সাত সকালেই তার কপালে মৃত্যু লেখা আছে এটা কি তিনি একবারও ভাবতে পেরেছিলেন?
ঠাকুরমশাই ভুকলার দেহটাকে গোয়ালঘর থেকে বের করে এনে বাইরে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। তারপর একটা ধুতি দিয়ে শরীরটাকে ঢেকে এই দুর্ঘটনার খবরটা সবাইকে জানাতে ছুটলেন। সকলে এসে দেখলেন, ঠাকুরমশাইয়ের ঘরে ভয়ানক কান্ড ঘটে গেছে। কালো বলদটা তখনো সমানে ফোঁস ফোঁস করে যাচ্ছে। রাগে তার চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। শিং দুটোতে লেগে রয়েছে রক্তের দাগ। দশ-বারো জন মিলে সেটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল।
ঠাকুরমশাইয়ের মন পড়ে ছিল নদীর ধারে ঐ শ্যাওড়া গাছ তলায়। গোদা ভূতটাই ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে জামাই করবে বলে। ছেলেটা সত্যি সত্যি কালো ভূতুনিটাকে বিয়ে করবে নাকি? এটা না জানা পর্যন্ত তার একটুও শান্তি নেই। তাই আঁধার একটু ঘন হতেই একলা বেরিয়ে সোজা নদীর পথ ধরলেন। শ্যাওড়া গাছতলায় এসে দেখলেন সব চুপচাপ। কেউ এখনো আসেনি। রাত বাড়ছে। ঠাকুরমশাই অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি শেয না দেখে ফিরবেন না। বেশ কিছুক্ষন পরে একটা খস্ খস্ শব্দ শোনা গেল। আবছা অন্ধকারে তিনি গোদা ভূতটাকে চিনতে পারলেন। ভূতটা ঠাকুরমশাইকে দেখেই পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই তিনি তার পথ আগলে দাঁড়ালেন। বললেন, “বিয়ের আর কত দেরি?”
গোদা ভূতটা এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বিয়েটা আর হল কই ঠাকুর? আমার হবু জামাইকে তো আপনি স্বর্গে পাঠিয়ে দিলেন । আমরা আপনার কালো বলদের উপর ভর করে ওকে মেরে তো ফেললাম। কিন্তু মরে গিয়েই ছেলেটা সোজা সগ্গে চলে গেল। আমরা ধরে রাখতে পারলাম কই? ঐ যে আপনি তীর্থে ভ্রমণ করে এসে ধুতিটা খুললে রেখেছিলেন। ঐটি যেমনি ছেলেটির গায়ে পড়ল তাতেই ওর সব পাপ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল আর অমনি সেও সোজা সগ্গে চলে গেল। বিয়েটা হবে কার সাথে?”
সব শুনে ঠাকুরমশাই এত দুঃখের মধ্যেও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক্, ছেলেটাকে ভূত-পেত্নী নিয়ে ঘর সংসার করতে হল না।
ছবিঃ চন্দ্রিমা ঘোষ