তোমার স্কুলে পূজোর ছুটি তো আর কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে। আমার ছোটবেলার স্মৃতি থেকে বলতে পারি পুজোর ছুটির আনন্দের আমেজই আলাদা। একের পর এক দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, ভাইফোঁটা - সব কিছু মিলিয়ে কি ভাবে যে একটা মাস কেটে যায় বুঝতেই পারা যায়না। প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা, বন্ধুদের সাথে একসাথে বসে গল্প করা, বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের যাতায়াত, আর তার সাথে এই কয়েকটা দিন বাড়িতে বড়দের শাসনের মাত্রা একটু কমে যাওয়া সব নিয়ে যেন একটা স্বপ্নের সময়। এবারে পুজো শুরু হওয়ার আগে আগেই আবার পেয়ে গেলে একটা উপরি পাওনা। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। কমনওয়েলথ্ গেমস্-এর কথাই বলছি। তার উপরে এই প্রথমবারের জন্য কমনওয়েলথ্ গেমস্ আয়োজিত হতে চলেছে আমাদের দেশে, দিল্লীতে অক্টোবর মাসের ৩ থেকে ১৪ তারিখ অবধি। দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু স্টেডিয়াম ছাড়াও আরও অনেকগুলো ইন্ডোর আর আউটডোর মিলিয়ে আয়োজিত হবে বিভিন্ন খেলার আসরগুলো।
অলিম্পিক আর এশিয়ান গেমস্-এর পর কমনওয়েলথ্ গেমস্-ই বিভিন্ন ধরণের খেলাধূলো নিয়ে সবচেয়ে বড় খেলার আসর। অন্য বড় প্রতিযোগিতাগুলোর মত এটাও আয়োজিত হয় প্রতি চার বছর অন্তর। ১৯৩০ সালে যখন প্রথম শুরু হয়েছিল তখন এর নাম ছিল 'ব্রিটিশ এম্পায়ার গেমস্'। মাঝে তিনবার নাম পরিবর্তন করে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৮ সাল থেকে এর নাম হয় 'কমনওয়েলথ্ গেমস্'। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে 'কমনওয়েলথ্ অব্ ন্যাশনস'-এর অন্তর্ভুক্ত ৫৪ টি দেশের প্রতিযোগীরা। ভাবছ তো যে এরকম একটা কঠিন নামের কি অর্থ আর কারাই বা অন্তর্ভুক্ত এই 'কমনওয়েলথ্ অব্ ন্যাশনস'-এর। একটু সহজ করে বলতে গেলে এই সংগঠনের দেশগুলো সকলেই নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক কিছু কিছু মূল্যবোধের দিক দিয়ে নিজেদের মধ্যে একমত আর এগুলোর সঠিক রূপায়ণ আর উন্নয়নের জন্য তারা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করে থাকে। তাই খেলার সাথে সাথে অন্য দিক দিয়েও এই প্রতিযোগিতার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন দেশের খেলোয়ারদের সাথে সাথে তাদের দেশের সাংবাদিক আর সাধারণ মানুষও হাজির হবে নিজেদের দেশের দলকে উত্সাহ দেওয়ার জন্য। তারা ঘুরে বেড়াবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আর পরিচিত হবে আমাদের দেশের সাধারন মানুষ আর সংস্কৃতির সাথে। আর তাদের সাথে কথা বলে আমরাও জানতে পারব তাদের কথা, তাদের দেশের কথা। তাই তোমার যদি এরকম কারও সাথে আলাপ করার সুযোগ হয়ে যায় তুমি কিন্তু তাদের যথাযোগ্য সন্মান দিয়ে বন্ধুর মত আপন করে নিয়ো - আর তাহলে দেখবে তারাও তোমাকে নিজেদের বন্ধু করে নেবে, আর তারপর নিজেদের দেশে গিয়ে তোমাকে নিয়ে কত গল্প করবে। আর তুমিও যদি পুজোর ছুটির সাথে সাথে নতুন দেশের নতুন বন্ধু পেয়ে যাও, তাহলে তো ছুটির আনন্দটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে, তাই না?
অলিম্পিক শুরু হওয়ার আগে অলিম্পিকের মশাল বিভিন্ন দেশে ঘোরার কথা নিশ্চয়ই শুনেছ। কমনওয়েলথ্ গেমস্-এও সেরকম কমনওয়েলথ্-এর প্রধান, যিনি এখন ইংল্যান্ডের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, তার ব্যাটন ঘুরতে থাকে সমস্ত অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে। এই ব্যাটনে খোদাই করা থাকে রাণীর বার্তা - সমস্ত অংশগ্রহণকারী দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে। লন্ডনে রাণীর প্রাসাদ বাকিঙ্গহাম প্যালেস থেকে গত বছরের ২৯শে অক্টোবর যাত্রা শুরু করে সব দেশ ঘুরে ৩রা অক্টোবর এই ব্যাটন পৌঁছবে উত্সবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময়। সেখানে ইংল্যান্ডের রাণীর প্রতিনিধি সেই খোদাই করা বার্তা পড়ে শোনাবেন সকলের উদ্দেশ্যে - সকলকে এই উত্সবে যোগদান করে উপভোগ করার জন্য। এইবারের প্রতিযোগিতার জন্য এই ব্যাটনের নক্সা তৈরী করেছেন আহ্মেদাবাদের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব্ ডিজাইন-এর মাইকেল ফোরে। লম্বাটে, ত্রিকোণাকার, সর্পিল আকৃতির এই ব্যাটনটির মাথার দিকে রয়েছে একটি সোনার পাতায় খোদাই করা বার্তা। বিভিন্ন দেশে যখন ব্যাটন ঘুরেছে, তখন সেই দেশের পতাকার রঙ অনুযায়ী পরিবর্তন হবে ব্যাটনের রঙ।
এবারের গেমস্-এর যে ম্যাসকট তার ছবি নিশ্চয়ই তুমি এর মধ্যেই অনেক জায়গায় দেখে ফেলেছ। কমনওয়েলথ্ গেমস্-এর টি-শার্ট, শর্টস, জুতো-মোজা পরা এই হাশিখুশি বাঘটির নাম হল 'শেরা' - দেখলে মনে হবে যেন হাত নেড়ে সবাইকে ডাকছে উত্সবে সামিল হওয়ার জন্য। তার সাথে থাকছে গেমস্-এর থিম সং 'জিয়ো উঠো বাড়ো জিতো'। হিন্দী আর ইংরাজী মেশানো এই গানের কথাগুলি লিখেছেন মেহবুব আর গানটির সুর দিয়েছেন আর গেয়েছেন এ. আর. রহমান।
১২ দিন ধরে চলা এই প্রতিযোগিতায় থাকবে দৌড়, লং-জাম্প, সাঁতার, ডাইভিং, টেনিস, ব্যাডমিন্টন, স্কোয়াশ, টেবল টেনিস, কুস্তি, বক্সিং, হকি, শুটিং, জিমন্যাস্টিক-এর মত অনেক ধরণের খেলা। তুমি নিজের ইচ্ছেমত নজর রাখতে পারবে নিজের পছন্দের খেলাগুলোর দিকে। ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে যে শেষ কমনওয়েলথ্ গেমস্ আয়োজিত হয়েছিল তাতে ৫০ টি পদক জিতে ভারতের স্থান ছিল চতুর্থ - অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর কানাডা-র পরে। এর মধ্যে ছিল ২২ টি সোনা, ১৭ টি রূপো আর ১১ টি ব্রোঞ্জ পদক। এবারেও বেশীরভাগ খেলাতেই অংশ নেবে আমাদের দেশের প্রতিযোগীরা। এর মধ্যে থাকবে আমাদের হকির দল, শুটিং-এর বিভাগে থাকবেন সমরেশ জং, অঞ্জলি ভগবত, তেজশ্বিনী সাওয়ান্ত, টেনিসে থাকবেন লিয়েন্ডার পেজ, মহেশ ভূপতি, রোহন বোপান্নাদের মত অভিজ্ঞদের সাথে সানিয়া মির্জা, সোমদেব দেববর্মনের মত তরুণেরা, ব্যাডমিন্টনে থাকবেন সাইনা নেহওয়াল, চেতন আনন্দ, স্কোয়াশে জোশনা চিনাপ্পা, তিরন্দাজীতে তরুণদীপ রাইয়ের মত আরও অনেকে। এদের মধ্যে সমরেশ জং ২০০৬-এর কমনওয়েলথ্ গেমস্-এ একাই জিতেছিলেন সাতটি পদক।
ব্যাডমিন্টনে সাইনা নেহওয়ালের নাম এতদিনে অনেক জায়গাতেই হয়তো শুনে থাকবে। হরিয়ানার হিসারে জন্ম হওয়া আর হায়দ্রাবাদে বড় হওয়া ২০ বছরের এই মেয়েটি এর মধ্যেই বিশ্ব-ক্রমপর্যায়ে তৃতীয় স্থানে চলে এসেছেন আর জিতে ফেলেছেন অনেক বড় মাপের প্রতিযোগিতা।
সদ্য শেষ হওয়া ইউ. এস. ওপেন টেনিসে ছেলেদের ডাবলস-এর রানার-আপ ট্রফি জিতেছেন রোহন বোপান্না। তাই আমরা আশা করতেই পারি যে এরা সকলে ভাল খেলে আমাদের দেশকে অনেক পদক এনে দেবেন।
গত ৩রা তারিখের সন্ধ্যাবেলা দিল্লীতে এক বর্নাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হয়ে গেছে গেম্স্। তোমার সাথে সাথে আমিও মনেপ্রাণে চাইছি যেন সবকিছু ভালভাবে আয়োজিত হয়ে আমাদের দেশের সন্মান রক্ষা হয় আর আশা করছি যেন এবারে আমরা আগেরবারের থেকে আরও বেশী পদক জিতে আরও ভাল ফল করতে পারি। তাহলে যে পুজোর ছুটির আনন্দ সব মিলিয়ে একদম পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে!
লেখাঃ
পাভেল ঘোষ,
টেম্পি, আরিজোনা
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
বিভিন্ন ওয়েবসাইট