সেই দেশেতে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, বড়জোর দোতলা, রঙ্গীন ছাদ – হালকা গোলাপী, পেস্তা সবুজ আর আকাশনীল রঙের। পাথরের সিঁড়ি পাক খেয়ে উঠে যায় নীচু দোতলায়, আর সিঁড়ির গায়ে থোকা থোকা ফুল – কখনো বেড় দিয়ে ঘিরে আলসে লতা, আবার কোথাও ঝুপ্সি গাছের ডাল একটু জিরিয়ে নিতে হেলান দিয়ে থাকে বাড়ির দেওয়ালে। নরম নরম সব আহ্লাদী অর্কিড, রঙ নিয়ে এসেছে খোদ গঘ সাহেবের ঈজেল থেকে। খান কয়েক বাড়ি পেরতেই বড় রাস্তা এসে পড়ে। ছোটো রাস্তা বলে অবশ্য আলাদা কিছু নেই, কেবলমাত্র সিগনালের হেরফের। চারমাথার ট্র্যাফিক সিগনাল পেরোতেই সুট করে রাস্তা গুলো গলি হয়ে এদিক ওদিক ছুট লাগায়। বেশিদূর যেতে পারে না বটে, কারণ সবচাইতে লম্বা রাস্তাটাই মোটে ছাব্বিশ কিলোমিটার। এর পর কী? এর পরে?
অতলান্ত মহাসমুদ্র! আটলান্টিক!
"ওই ডানদিকে হাজার মাইল মত এগোলে পৌঁছে যাবে ফ্লোরিডার মায়ামি বন্দর আর প্রায় একই দূরত্ব বাঁয়ে গেলে আসবে সান জুয়ান, মানে পোর্ট রিকো – যার সীমানা থেকে শুরু হয় ফুটবলের ইতিহাস, ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। আর ওই প্রান্তে পোর্ট হ্যামিলটন, এ দেশের রাজধানী। এই তিনটি বিন্দু জুড়লেই সেই কিংবদন্তী ত্রিভূজ, যার হাঁ করা মুখে সর্বগ্রাসী খিদে – যুদ্ধহজাহাজ জঙ্গিবিমান সব গিলে খেয়ে ফেলা সর্বনাশী বারমুডা ট্র্যাঙ্গল!" সানগ্লাসটা মাথার ওপর তুলে দিয়ে ঝকঝকে নীল চোখে হেসে শ্যারন বলে, "যার সবথেকে কুখ্যাত বিন্দুতে আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি।"
হৃদপিন্ড নিয়ম করে একখানা বিট মিস করলো। এদেশে আসার পর থেকে থেকেই করছে। তাই বুঝি সেইন্ট মেরলিনের মাস্তুলে বাঁধা ফটফটে শাদা পতাকাটা অলস ভাবে উড়তে উড়তে ফিক করে হাসে আমার দিকে চোখ মেরে – 'কী দিদিভাই! দশহাজার মাইল উড়ে এসে, শেষে সমুদ্দুরের পেটে যাবে বলে ভয় পাচ্ছো নাকি?'
না মাস্তুল মহাশয়া। ভয় নয়। এ এক আজব মনে হওয়া। বারমুডা ট্রাঙ্গল, তুতানখামেনের মমি, মরুতীর্থ হিংলাজ – এসব নামে এমন কিছু আছে যা কিনা বেশক ভয়ের, তবে সে ভয় বড় বেশি রকমের গভীর, সেখানে শেকড়ে বাকড়ে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের থেকেও প্রাচীন সব রহস্য। জটলা বেঁধে সেখানে কিংবদন্তীদের ভিড়। পাঁজরার খাঁচায় ধুকপুকুনিটা চলতে থাকে বটে, কিন্তু রহস্যের খিদে তাতে বাড়ে বই কমে না।
মোদ্দা কথা, আমাদের সেইন্ট মেরলিন ডুবল না। একশ কুড়ি ডলার ভাড়া নিয়ে ট্যুরিস্টদের বারমুডা ট্র্যাঙ্গলের বিপদসীমা ছুঁইয়ে নিয়ে আসা যার নিত্যকার কাজ তার সঙ্গে মহাসমুদ্রের গোপন সাঁট আছে বলে যখন প্রায় দুয়ে দুয়ে চার করে ফেলেছি, তখনই শ্যারন জেকব বার্কার, আমাদের গাইড, টুপি থেকে নধরকান্তি খরগোশখানা পটাং করে বের করে ফেলল –
'বলি, প্রমাণ করতে পেরেছে আজ অবধি কেউ যে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল জাহাজ ধরে খায়? বা হেলিকপ্টার দিয়ে মুখশুদ্ধি করে? যত সরকারি বেসরকারি রেকর্ড আছে সব ঢুঁড়ে ফেল, যা পাবে তা হল শুধুই অনুমান, সারবত্তা একফোঁটাও নয়!'
'প্রমাণশুদ্ধ সব উড়ে গিয়ে থাকতে পারে তো বাপু! দানোয় পাওয়া সব কাজ কারবার, সেসবের কেই বা কবে প্রমাণ পেয়েছে!' জংলা ছাপা শার্ট গায়ে একজন বেশ খিঁচিয়েই উঠলেন।
'দানোয় পাওয়া!' শ্যারন যেন লটারি জিতেছে, 'বন্ধুরা, কথাটা খেয়াল করবেন! এটাই হককথা। এই দ্বীপ দানোয় পাওয়া! কান পেতে একবারটি শুনুন বন্ধুরা!'
হঠ করেই শ্যারন চুপ করে গেল। প্রপেলারে জল কাটার একটানা শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। স্পষ্ট টের পেলাম, এই ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানকার হাওয়া যেন একটু বেশি ভারি। ডাঙ্গা পড়ে আছে দৃষ্টিপথের বাইরে, আকাশের রঙ চোখ ধাঁধানো নীল। জল যে এখানে কত গভীর তা খোদাতালাই জানেন। এই কটি মানুষ, আমরা কজন, এই ঘিরে আছে শুধু সীমাহীন নির্জনতা – নিরেট, খানিক অচল। পৃথিবীর যেন অক্ষপথ ভুলে থমকে দাঁড়িয়ে পরেছে এই বিন্দুতে এসে।
কতক্ষণ পর জানি না, এই থম মেরে থাকা নিস্তব্ধতা ঠিক যেন ব্লেড মেরে চিরে দিলো কেউ। একটা চিৎকার, কানের পর্দায় যেন কেউ শঙ্করমাছের চাবুক আছড়ে ফেলার মত, এতো কর্কশ, এতো রুক্ষ, এতো তীক্ষ্ম চিৎকার! একটা মিলিয়ে যাওয়ার পরেই আর একটা! পর পর!
'ও কী ও?'
'বারমুডা দ্বীপের দানো!' ফিসফিফিয়ে উত্তর দিলো শ্যারন, 'কাহাও পাখি।'
দানো বৃত্তান্ত বিশদে শুনলাম টুসটুসে লাল চেরী, আনারসের কিউব আর চীজ গাঁথা ফ্রুটস্টীক সাবাড় করতে করতে। যীশুর জন্মের পর প্রায় হাজার দেড়েক বছর পর্যন্ত কেউ খোঁজ পায়নি অতলান্ত মহাসমুদ্রের উত্তর কোল ঘেঁষে এই এক গুচ্ছ দ্বীপের, যেখানে বৃষ্টির জল জমে ছোটো ছোটো হ্রদে, ফলের গাছ গজায় আপনা থেকে, আর নিশ্চিন্তে চড়ে বেড়ায় ছোট খাট তৃণভোজী জন্তু জানোয়ার – অর্থাৎ এক কথায়, রসদ ফুরিয়ে আসা ক্লান্ত নাবিকের কাছে নোনাপানীতে জন্নত। তবে এমন সম্পদের ভাঁড়ার তো মা বসুন্ধরার খানিক বিশেষ তত্ত্বাবধানেই থাকবে সে আর বেশি কথা কী! ফলে এই দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে তান্ডব নেচে বেড়ায় সমুদ্রের সবচাইতে দুর্দান্ত সন্তান, হার্মাদের যম – হারিকেন। মতি বিগরোলে পাহাড় প্রমাণ জাহাজ গুঁড়িয়ে ধুলো করে দেবার আগে ঈশ্বরের নামটুকু স্মরণ করার সময় দেবে না, তা নিশ্চিত। ফলে যুগ যুগ ধরে এই দ্বীপ ভেঙ্গেছে, গড়েছে, তবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। সেও এক মজার ব্যাপার। এ দ্বীপের গোড়া ধরে খানিক নিচে নেমে গেলে দেখা যাবে, মাইলের পর মাইল জুড়ে জলের নিচে এক আজব সাম্রাজ্য যা কিনা অনেকটা নোঙ্গরের মত আটকে রেখেছে এই গোটা স্থলভাগটুকু – সে রাজ্য প্রবালের। টকটকে লাল প্রবাল।
'আর ওই দানো পাখি?"
"রহু ধৈর্যং!" গোছের একটা ইংরেজী উত্তর দিল শ্যারন। 'দানো পাখি কাহাও আসছে! কোনও কোনও সময় এতো দুর্বিপাক সয়েও জাহাজডুবির অপঘাত বাঁচিয়ে যদি কেঊ পাথরটাথর আঁকড়ে দ্বীপে চড়েও যেত, সইতে পারত না শুনশান পাথুরে রাত্রির আতঙ্ক। যেখানে অন্ধকার নামলেই ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে নিশাচর কাহাও পাখি - তাদের ডাকে অমঙ্গলের সুর, যেন গোটা দ্বীপ জুড়ে কারা নেচে নেচে পিশাচের পুজো করে। তাই কোনওক্রমে জান বাঁচিয়ে দ্বীপ থেকে বেরোতে পারলে চারদিকে তারা রটিয়ে দিত ও দানোয় পাওয়া দ্বীপ!'
'কাহাও কি মানুষ খায়?'
'উল্টোটা।' শ্যারন কোমরের পাউচ খুলে একখানা বারমুডা ডলার বের করে। নীলচে রঙের নোটের কোণে লম্বা ডানা মেলে ছাইরঙা একখানা পাখী উড়ছে।
'কাহাও প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির রাতচরা সীবার্ড। কুচোচিংড়ি, ছোটমাছ অথবা খুদে স্ক্যুইড হলেই এদের ভরপেট মীল হয়ে যায়। কখনও স্রেফ পোকা। কিন্তু কন্ঠভরে বিধাতা দিয়েছেন এমন কামোফ্লাজ, যা কিনা আচ্ছা আচ্ছা জলদস্যুকেও নিশীথ রাতের আতঙ্কে দ্বীপ থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছে।'
এমন সময় আর একদফা কাহাওগীতি ভেসে এলো। আচমকা শুনলে একটু মুশকিল হয় বটে।
'কিন্তু এই লুকোচুরি বেশিদিন চলল না। ষোলশ শতাব্দীর আধাআধি পেরিয়ে যাবার পর, এক স্প্যানিশ নাবিক দলবলশুদ্ধ এখানে অক্ষত অবস্থায় নোঙর করলেন। এই নাবিকের নাম জ্যঁ দ্য বারমুডেজ, যাঁর নামে এই দ্বীপপুঞ্জ। খাবারদাবারে টান পড়েছিল নাকি তিনি ঐ দানোপাখি চেখে ওমনিই কিছু বুঝতে চেয়েছিলেন জানা নেই, তবে ঐ শুরু হল কাহাও ধরে খাওয়া। অতি সুস্বাদু মাংস বলে জানা যায়। পাখিগুলো খুব বোকা। অল্পেই ধরা পড়ত। এর পর থেকে চলল ঢালাও কাহাওনিধন। স্প্যানিশদের পর পর্তুগিজরা এল, ইংরেজরা এল, মারতে মারতে প্রায় শেষই করে এনেছিল এরা কাহাওদের গোটা জাতটাকে। এই ক'বছর হল ন্যাশনাল কনজারভেশন অ্যাক্টের আওতায় এনে সংরক্ষণের চেষ্টা হচ্ছে। '
কাহাওটা ডেকে ওঠে আবার। এবারে ডাকটা অতটা যেন কর্কশ লাগলো না কানে। এ দ্বীপের আদিম বাসিন্দা, আনন্দে ঘরসংসার করেছে কত শতাব্দী ধরে কে জানে। আত্মরক্ষার হাতিয়ার বলতে ছিল ঐ গলার আওয়াজ, সাম্রাজ্যবাদের ক্ষিদে আটকানোর তুলনায় যা কিনা বড্ড দুর্বল। আমেরিকান ইন্ডিয়ানরা মানুষ হয়েই পারেননি, পারেননি পৃথিবীর অসংখ্য আদিম জনজাতি। পারেননি শহরের প্রান্তে গ্রাম বেঁধে থাকা, জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ের খাঁজে গোষ্ঠী গড়ে থাকা লক্ষ লক্ষ পরিবার। এরা তো স্রেফ পাখি!
'তা বারমুডার গুপ্তকথা তো তারা ধরেই ফেলল! শ' চারেক বছর আগেই! তারপর অ্যাদ্দিন ধরেও সেসব রহস্য হয়ে রইল কি করে?'
'সেখানে দুসরা মজা। স্প্যানিশদের পর দ্বীপে একটু বড়সংখ্যায় নোঙর করে পর্তুগিজরা। বলা বাহুল্য, সকলেই জলদস্যু। সম্ভবতঃ এর মধ্যে আবহাওয়া বোঝার বিজ্ঞানের কিছু উন্নতি হয়। হারিকেনের নকআউট রাউন্ডে জিতে যাওয়া কিছু কমে যায়।
এবারে দ্বীপটার অবস্থানের গুরুত্ব বুঝতে হবে। মহাসমুদ্রের মাঝ দিয়ে এমন ঠেকনা দেওয়ার জায়গা, যার খানিক পশ্চিমে গেলেই অগুন্তি ক্রীতদাসের যোগান, সে জায়গা নতুন দাবিদার থেকে আড়াল রাখার চমৎকার উপায় ভেঁজেছিল পর্তুগিজরা। কয়েকখানা বড় জাহাজ জোর করে জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল তারা। আর কিছু মানুষকে ছোট্ট ছোট্ট ভেলায় করে নানা দিকে ভাসিয়ে দিয়েছিল তাদের মুখে অলৌকিক সব গল্প ছড়িয়ে – "এ দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি এলে জ্যান্ত গিলে খায় ঐ জন্ম ক্ষুধার্থ বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল"। আর হারিকেনের উপদ্রব তো রইলোই রটনায় ঘটনা বসাতে। ব্যস! আর যায় কোথায়! কিংবদন্তি ছড়াতে থাকে ইতিহাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে!'
মনে আছে, ডেকশুদ্ধ প্রত্যেক ক'টা মুখ একসঙ্গে হাঁ! যেন কোরিওগ্রাফ! জন্মের শোধ এপ্রিল ফুল! এবং কোটি কোটি মানুষ এখনও জানেন না যে তাঁরা এপ্রিল ফুল! এমন ব্যোমকে ছিলাম সেই গোটা সন্ধ্যে, যে রাতে ডিনারে নেওয়া পেল্লাই এক প্লেট স্প্যাগেটির থেকে আনমনে খুঁটে খেয়ে নিয়েছি সব কটা মীটবল, সস মাখানো সুতোগুলো যেমন কে তেমন পড়ে। পঁচিশ ডলারের ডিনার, ফেলে আসতে পারিনা। ঐ প্যাক করে দিতে বললাম, কিনা পরদিন খেয়ে নেব। পরের দিন প্যাকেট খুলে দেখি সস মাখানো সুতোর প্যাঁচে ফিরে এসেছে ঠিক ততগুলোই মিটবল। মনে পড়ল যে বুড়িমানুষটি পরিবেশন করছিলেন তিনি বেজায় দুঃখ করছিলেন শুধু স্প্যাগেটি কেউ খাবে কী করে! সেদিন আর একবার মনে হয়েছিল, মা জেঠিমার কি জাত ধর্ম ভাষা কিছু হয়!
এদেশে পর্তুগিজদের জলপাই রঙের চামড়া, তেমনি দো-আঁশলা ইংরেজদের রঙ শ্যাওলা। ল্যাটিন আমেরিকান মানুষগুলো মেহগনি আর চুকচুকে আবলুশ রঙের। অজস্র ফুল, ঘন সবুজ সব ঝাঁকড়া মাথা গাছ। বাড়ির সামনে খানিক উঠোন থাকবেই, যার যতটুকু জমি, এক চিলতে হলেও হবে – সে উঠোন ঘিরে ধবধবে শাদা ফালি ফালি তক্তা দিয়ে বাহারের বেড়া। একটা পাড়া শেষ হলেই ছোট্ট পার্ক, অথবা গীর্জা। শহরের কাজের সময় শুরু সকাল দশটা থেকে আর পাঁচটার মধ্যে দোকান পাট অফিস কাছারি সব গুটিয়ে গাটিয়ে সব্বাই চলে যাবে বীচে। ফূর্তি, পার্টি। গরমের সময় দিনের আলো থাকবে রাত নটা পর্যন্ত। মজাই মজা। আর সব কিছু ঘিরে গভীর নীল সমুদ্র। মজা আরও, কারন এখানে বালির রঙ গোলাপি। নরম, ফুরফুরে বালি। আসলে যে প্রবালের ঘেরাটোপে আটকে আছে মূল স্হলভাগ, তার থেকে আলগা হয়ে আসা টুকরো ঢেউএর ধাক্কায় হয়ে যায় মিহির থেকে মিহি। বালিতে মিশে গিয়ে গোটা সমুদ্রের পাড়কে করে রাখে দুধে আলতা। চড়ে গোঁজ হয়ে থাকা পাথরের চাঙড় গুলোও দীর্ঘ সময় ধরে ঐ প্রবাল মেশানো জলে ধুতে ধুতে টুকটুকে লাল হয়ে যায় গোড়ার কাছে। সব মিলিয়ে যেন আস্ত রঙের প্যালেট উল্টে দেয় কেউ রোজ দ্বীপটা জুড়ে।
এই যে এত রঙের ফুল, তার বেশিরভাগই জবাফুল। গোছা গোছা গাছ ভরে। জবাফুল ওরা খুব ভালোবাসে। যেখানে পায় ছেপে রাখে। দোকানের বিলে, মেনুকার্ডে, কফির কাপে - সর্বত্র। আমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে গলা ছেড়ে শ্যামাসঙ্গীত গাইতাম- 'আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠনা ফুটে মন'।
ওরা লোক ভাল। টুপি নামিয়ে অভিবাদন জানাতো। আমি গাইতাম আর ভাবতাম, দস্যু, ডাকাত, ঠগীদের মা - না করেছ জাতপাতের ফারাক, না দিয়েছ পাপপুণ্যের খতেন, না রেখেছ লাজশরমের ধার। তাই ব্রত কথা পাঁচালি কিচ্ছুটি নেই তোমার কালোভুষুন্ডি কপালে। তবু শখ ষোল আনা। এই যোজন যোজন দূরে ফোটা রূপকথার রাজ্যের ফুলটি ছাড়া মন উঠল না বেটির! ভয়ানক কোনও দামাল দুর্দান্ত জলদস্যুর হাতে করে এসে পৌঁছেছিল হয়ত প্রথম নৈবেদ্য! কে বলতে পারে!
একদিন বিকেলে মহাসমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে গেছি। পাড় ধরে জাহাজের সারি। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে মানুষ কাজে যান। বা বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও। সেসবের জন্য এইসব জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট, বড়, মস্ত বড়! তাদের ডেকে বাজনা বাজে। সমুদ্রগর্জনের শব্দের মত বাজনা। শুধু বাজনা। বিশাল বিশাল ভেঁপুর মত যন্ত্র দিয়ে বাজায়। একদিন স্পষ্ট শুনি, আমাদের ছোটবেলার এক জনপ্রিয় হিন্দি ছবির গানের সুর বাজাচ্ছে। 'আতে যাতে, হঁসতে গাতে...'
একবার দুবার তিনবার। কান পেতে শুনলাম। না। কোনো ভুল নেই। পুরো আধ ঘন্টা ধরে কেউ বাজালেন। সেই প্রবল ভরাট গম্ভীর যন্ত্রে কী করুণ সুর! ভাবছিলাম কে সে? আমার দেশে ছোটবেলা কাটিয়ে আসা কোন ভিনদেশি? না আমার জন্মভূমিতুতো কোনও ভাই? নাকি ওমনি কেউ অমন সুর করেছে, অবিকল?
ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। ভূগোলেও বোধহয় দূরত্ব যতখানি ম্যাপে ততখানি আকাশে বাতাসে মানুষগুলোর বেঁচে থাকায় নয়। এ গল্প বলতে বসলে শেষ হওয়ার নয়। তবে এমন করে গল্প খুঁজতে গেলে ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে আমাদের চারদিকেও। যেমন দূরপাল্লার ট্রেনে যেতে যেতে হঠাৎ একটা একলা স্টেশন চলে যায়, একচিলতে কৌতুহল তৈরি হয় আবার টুপ করে পড়েও যায়। সেগুলো জমিয়ে রেখে একদিন বেরিয়ে পড়া যাক। কিংবদন্তীর খোঁজে, কিংবা স্রেফ নিরুদ্দেশ হওয়ার জন্য।
ছবিঃ ব্যক্তিগত সংগ্রহ