আগুন, জল, মাটি আর বাতাস : এই চার দেশ নিয়ে এক পৃথিবী তৈরী হয়েছিলো। উত্তরে 'এয়ার নোমাডস্', পূর্বে 'আর্থ কিংডম', দক্ষিনে 'ওয়াটার ট্রাইব' আর পশ্চিমে 'ফায়ার নেশন'। এই সব দেশের মানুষেরা এক অদ্ভুত শক্তির রহস্য জানতো। 'টেলিকাইনেটিক পাওয়ার' অর্থাৎ মনের একাগ্রতা আর মার্শাল আর্টের সাহায্যে প্রকৃতির চার এলিমেন্ট : জল, মাটি, আগুন আর বাতাসকে বশ করতে পারা। এই বিশেষ শক্তিকে বলা হতো 'বেন্ডিং' আর যাদের ছিলো এই দুর্লভ ক্ষমতা তাদের বলা হতো 'বেন্ডার'।
আর্থ বেন্ডাররা পাহাড় কেটে রাস্তাঘাট আর প্রাচীর ঘেরা শহর বানাতেন। ফায়ার বেন্ডারদের পারদর্শিতায় গড়ে উঠেছিলো কলকারখানা, শিল্প। দুই মেরুতে ওয়াটার বেন্ডাররা নৌকা-জাহাজেই ব্যস্ত ছিলেন আবার এয়ার বেন্ডাররা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের উপাসক। আর সবার উপরে এই পৃথিবীর রক্ষাকর্তার মতন ছিলেন অবতার।
অবতার
অবতারের শক্তি ছিল অপরিসীম, চারটি এলিমেন্টের বেন্ডিং-এ তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। অবতারের আত্মার কোনো মৃত্যু নেই। তিনি বারবার বিভিন্ন পরিচয়ে জন্ম নিতেন। অবতারের পরাক্রমে চারটি দেশে শান্তি ছিলো, ছিলো না কোনো বিবাদ। কিন্তু হঠাৎ একদিন ফায়ার নেশন সারা দুনিয়াতে হুকুমত চালাবে বলে ঠিক করলো! আর শুরু হলো যুদ্ধ! দেশের মানুষদের চরম দুর্দশা, কেবল অবতারই পারেন তাদের বাঁচাতে কিন্তু এই বিপদের সময়ই তিনি গেলেন উধাও হয়ে!
অ্যাং, সক্কা ও কাতারা
তারপর কেটে গেলো একশোটা বছর, যুদ্ধ আর থামে না। ফায়ার নেশনের ফায়ার লর্ডের ভয়ে পৃথিবী কাঁপে। সাধারণ মানুষ অবতারের উপর বিশ্বাস হারিয়ে লড়াই করে কোনোমতে বেঁচে আছে। এমন এক দুঃখের সময়ে ওয়াটার ট্রাইবের মা হারা দুই ভাইবোন 'সকা' আর 'কাতারা' মাছ ধরতে গিয়ে এক হিমবাহ থেকে উদ্ধার করে 'অ্যাং' কে। যেন হিমবাহের মধ্যে অনেক কাল সে ঘুমিয়েছিলো। বাচ্চা একরত্তি ছেলে অথচ চমৎকার এয়ার বেন্ডিং জানে! কিন্তু এসব সে শিখলো কোথায়? উত্তরের সব কটি এয়ার টেম্পল তো ফায়ার লর্ডের আর্মি ধংস্ব করেছে। তবে কি অ্যাং-ই এই পৃথিবীর শেষ এয়ারবেন্ডার?
পৃথিবী বিখ্যাত সিরিজ অবতার : দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডারের গল্প এইরকম একটা রহস্য দিয়েই শুরু। ২০০৫ সালে এই সিরিজ প্রথম টিভিতে আসে। আমি তখন ক্লাস এইট, বিকেলবেলা নিকোলোডিয়ানে আসতো অ্যাং আর তার দলবল। আমেরিকান ও চীনের অ্যানিমেশনের ভাবধারার মিলনে এই সিরিজের কাহিনী আর চরিত্র গঠন। মার্শাল আর্ট আর কুংফুর উল্লেখ চীনের সংস্কৃতি মনে করায়, আর্থ কিংডমের প্রধান শহর 'বা সিং সে' অনেকাংশেই আধুনিক চীনের বেজিং। জাপানী অ্যানিমে বা আমেরিকান অ্যানিমেশনের থেকে একেবারেই অন্য ধরনের ড্রয়িং স্টাইলে প্রত্যেকটি চরিত্র আঁকা হয়েছে। চারটি দেশের বাড়িঘর, পোশাক, মানুষজনের চেহারা, আচার ব্যবহার সমস্ত কিছু আলাদা। এই অপূর্ব সুন্দর আর্ট ওয়ার্ক আর দারুণ ডিটেলিং-এর প্রশংসা করতেই হয়। গল্পের বুনন পুরো সিরিজ জুড়ে অনবদ্য আর একষট্টিটা এপিসোড একদম টানটান কেটে যায়।
উড়ুক্কু বাইসন আপ্পা এবং উড়ুক্কু লেমুর মোমো
অবতার: দ্য লাস্ট এয়ার বেন্ডার আমাদের সুন্দর এক বন্ধুত্বের গল্প বলে। অ্যাং আর তার বন্ধুদের ভলোবাসা, খুনসুটি, অভিমান, দুঃখ আর বিশ্বাসের গল্প। কাতারা আর সকার সাথে প্রথম প্রথম বেজায় ঝগড়া হলেও ওরাই হয়ে ওঠে অ্যাং এর সবথেকে কাছের বন্ধু। এই সিরিজ আমাদের অপরিসীম সাহসের গল্পও বলে। তিন বন্ধু নিজেদের উপর বিশ্বাস আর সাহস সম্বল করে যুদ্ধের অবসান করতে, ফায়ার লর্ডের মুখোমুখি হতে বেরিয়ে পড়ে। পথে আলাপ হয় অন্ধ মেয়ে 'টফ' এর সাথে, যে কিনা এই দুনিয়ার সেরা আর্থ বেন্ডার। আর ওদের সাথে ছায়ার মতো চলতে থাকে ফায়ার নেশনের রাজকুমার 'জুকো'। অ্যাংকে নাস্তানাবুদ করতে গিয়ে জুকো প্রত্যেকবার নিজেই নাজেহাল হয়। সবাই জুকোকে শত্রুদলের ভাবলেও অ্যাং-এর মনে হয় ওরা বন্ধু হবেই। আমারও কিন্তু প্রথম থেকেই পছন্দ জুকোকে। ফায়ার প্রিন্স আর লাস্ট এয়ারবেন্ডারের দোস্তি না হলে যুদ্ধ জয় হবে কী করে! প্রতিটা এপিসোডে দুর্ধর্ষ সব অ্যাডভেন্চারের মধ্যে দিয়ে অ্যাং আর তার দল শেষ পর্যন্ত ফায়ার লর্ডের সম্মুখীন হয়। আদৌ কি ওরা পারবে যুদ্ধ থামাতে? অবতার কি আর ফিরবেন পৃথিবীতে?
রাজকুমার জুকো এবং টফ
প্রকৃতির বুকে মানুষের সহাবস্থান আর প্রকৃতির চার এলিমেন্টের সাথে মানুষের আত্মার নিবিড় যোগ এই সিরিজের মূলমন্ত্র। চীনের সংস্কৃতি আর কুংফুর সাথে সাথে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবও এই সিরিজে স্পষ্ট। সৎ পথে জীবনযাপন, অন্যায়ের প্রতিবাদ, মানুষ ও সমস্ত জীবজন্তুর প্রতি সমান ভালোবাসা আর স্নেহ : চলার পথের এই সমস্ত প্রয়োজনীয় উপদেশ এই সিরিজের প্রতি পদক্ষেপে রয়েছে। তাই শুধু অ্যাডভেঞ্চার বা মজার জন্য নয় অনেক শিক্ষামূলক বার্তাও আমাদের দেবে অ্যাং আর তার বন্ধুরা। তাহলে আর দেরি না করে এই পুজোর ছুটিতেই অভিযানে বেরিয়ে পড়া যাক। সংগে তো আছেই পৃথিবীর লাস্ট এয়ারবেন্ডার!
(এই সিরিজটি ডিভিডি ফরম্যাটে এবং বই এর আকারে কয়েকটি অনলাইন স্টোরে কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়া জনপ্রিয় কার্টুন চ্যানেলগুলিতেও মাঝেমধ্যেই অ্যাং ও তার বন্ধুদের দেখা মেলে।)
ছবিঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট