আমরা প্রায়ই শুনতে পাই যেখানে সেখানে গাছপালা কেটে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে, তখন কি আমাদের মনে হয় না, এভাবে গাছপালা নির্মূল করে দিলে পুরো পৃথিবীই একদিন মরুভূমিতে পরিণত হবে? প্রকৃতি যতই শক্তিশালী হোক, মানুষের লোভের কাছে কি সে একদিন হার মেনে নেবে? পৃথিবীতে একদিকে জনসংখ্যা যত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চাহিদা বাড়ছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যেখানে সেখানে চলছে বৃক্ষ নিধন।গাছপালা কাটতে কাটতে অরণ্য আজ হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিমাণে যদি গাছপালা কাটা হয়, গাছপালার আবরণ সরে যেতে থাকে, তাহলে মাটির আবরণও যে আলগা হয়ে যায়, এ কথা কে কাকে বোঝাবে? মাটি যত ক্ষয় হতে থাকবে, পৃথিবী তত দুর্বল হয়ে পড়বে, হারিয়ে ফেলবে তার উর্বরতা। এক একসময় মনে হয় যেসব জায়গায় মরুভূমি নেই, সেখানেও হয়তো একদিন মরুভূমির সৃষ্টি হবে।
তুমি কি কখনো বেড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করেছ, একদিন যেখানে দেখেছিলে সবুজ মাঠ, আজ সেই মাঠ রোদে ঝলসানো বিবর্ণ মাঠে পরিণত হয়েছে, সবুজের চিহ্ন কোথাও নেই, সরস কোমল মাটি রুক্ষ মাটিতে পরিণত হয়েছে, নদী ক্রমশ জলশূন্য হচ্ছে আর বালির বিস্তার শুকিয়ে যাওয়া নদীর গতিপথকে চিনিয়ে দিচ্ছে? আমাদের চারপাশ যে একদিন সবুজ ছিল,এখন আর তা বিশ্বাস হয় না। অদূরে নেড়া পাহাড় আর নিঃসাড় প্রকৃতি নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে।
সভ্যতা যত এগোচ্ছে, শিল্পায়ন বাড়ছে, বন জঙ্গল কেটে তৈরি হচ্ছে কলকারখানা, শহর আর তার ফলে বিষাক্ত হয়ে উঠছে পরিবেশ। আমরা তো জানি, মানুষ ও জীবজন্তু বাতাস থেকে অক্সিজেন শুষে নেয় আর বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে আর সেই কার্বন ডাই-অক্সাইড গাছপালা গ্রহণ করে বায়ুকে শোধন করে। সেই বাতাস পরিশোধন হবার সম্ভাবনা যত কমতে থাকবে, পৃথিবী মানুষ ও জীবজন্তুর কাছে বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
তোমরা যারা রাজস্থানের যোধপুর, জয়শলমীর দেখতে গিয়ে মরুভূমির আভাস পেয়েছ, হয়তো রোমাঞ্চিত হয়েছ, কিন্তু একবার যদি বিস্তীর্ণ মরুভূমির মধ্যে গিয়ে পড়, দেখবে আতঙ্ক তোমাদের গ্রাস করবে। পৃথিবীতে অনেক মরুভূমি আছে, কিন্তু এখানে তোমাদের আমি থর মরুভূমির কথা জানাচ্ছি।
তোমরা থর মরুভূমির নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। মরুভূমিতে পরিণত হবার আগে সেখানেও ছিল বড় একটি গ্রাম। হঠাৎ জলের অভাব হওয়াতে সুজলা সুফলা শষ্যক্ষেত শুকিয়ে গিয়েছিল আর ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ধূসর বালির আবরণে।
মরুভূমিতে বালির ঝড়ের কথাও নিশ্চয়ই তোমাদের জানা আছে। সেই ভয়াবহ ঝড়ের মধ্যে যেসব অভিযাত্রীরা পড়েছে তারা জানে এর ভয়ংকর রূপ। আকাশ ও মাটির মাঝখানকার শূন্য জায়গাকে বালি দিয়ে এমনভাবে ভরে তোলে যে দিনের প্রখর রোদ ম্লান হয়ে অমাবস্যার অন্ধকারে ভরে যায়। কত পথিক যে দিকভ্রষ্ট হয়, তখন কম্পাসও ঠিকমত কাজ করে না। আসলে বালির নিচে ম্যাগনেটাইট থাকে যার মধ্যে চৌম্বকীয় শক্তি রয়েছে আর সেইজন্যই হয়তো কম্পাস ঠিকমত কাজ করে না। তখন একমাত্র ধ্রুবতারা লক্ষ্য করেই পথ হাঁটতে হয়।
মরুভূমি বা Desert এর ল্যাটিন প্রতিশব্দের অর্থ হল পরিত্যক্ত বা মানুষের বর্জিত ভূমি। আরবের মানুষেরা মরুভূমিকে বলে 'বহর বেলামা' অর্থাৎ নির্জলা সমুদ্র। মরুভূমি কিন্তু আকারহীন নয়। আকারে সে যতই বিশাল হোক না কেন, সব মরুভূমিরই একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। বৃষ্টিহীন, নদীহীন, তৃণহীন যে কোনো অঞ্চলকে আমরা মরুভূমির আওতায় ফেলতে পারি।
রাজস্থানের থর মরুভূমির কথা বলছি। থর মরুভূমি অবশ্য রাজস্থানের সীমার মধ্যে নিথর হয়ে নেই, তা পশ্চিমে সিন্ধুপ্রদেশ ও বেলুচিস্থানের মধ্য দিয়ে ইরাকের অভিমুখে চলে যাচ্ছে। প্রায় আড়াই লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে এই মরুক্ষেত্রের মধ্যে জনবসতির অবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্রাবিড় সিন্ধুসভ্যতার মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা।
থর মরুভূমি এমন এক মরুভূমি, যা উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং পাকিস্থানের বিশাল অঞ্চল জুড়ে থাকলেও তার মধ্যে এক ফোঁটাও মরুদ্যান নেই। মরুভূমির সঙ্গে যেসব গাছের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, সেই ক্যাকটাস ও নেই, শুধু কাঁটাগাছ ঢেকে রেখেছে সমস্ত মরুক্ষেত্রকে।
'থর' শব্দটি এসেছে 'থল' থেকে যার অর্থ হল বালির পাহাড়। অন্যান্য মরুভূমির চেয়েও অনেক বেশি বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি আছে এই মরুভূমিতে। আপাতদৃষ্টিতে একটানা বালির বিস্তার হলেও বালির সঙ্গে আছে লালচে ও বাদামি মাটি। অনেক জায়গায় বালি ও মাটি লবণাক্ত হয়ে উঠেছে, কয়েকটি লবণহ্রদ সৃষ্টি হয়েছে।
বালির প্রাধান্য আর বালিতে লবণের স্তর থাকা সত্ত্বেও থর মরুভূমিতে নানারকম গাছপালা আত্মপ্রকাশ করে বৃষ্টির ছোঁয়া লাগামাত্র। পশ্চিমে বালিয়াড়ির মধ্যে দেখা যায় খেজুর ও 'জাল' গাছ। বালিয়াড়ির নিচের দিকে 'ফগ' এর ঝোপ, উটের প্রিয় খাবার। যাযাবররা এই গাছের শুকনো পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। লোনা বালিতে তিন ফুট উঁচু, ছোট গাছ দেখা যায়, নাম তার 'লানা' শীতকালে তা ভরে যায় হলুদ রঙের ফুলে। মরুভূমির সমতল অঞ্চলে কের, কুল, আঁকরা, ঝুঝনি নামের নানারকমের গুল্ম দেখা যায়। হেমন্ত থেকে শুরু করে শীতের শেষ পর্যন্ত এইসব গুল্ম ভরে যায় কমলা, বেগুনি, হলুদ ও সাদা ফুলে। একটু বড় আকারের গাছও দেখা যায়, যেমন বাবলা, ধও, পলাশ, গুগগুল ইত্যাদি।
মরুভূমির পুবদিকে মহুয়া, সেগুন এমন কি বাঁশগাছও দেখতে পাওয়া যায়। বৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বালির ওপরে সবুজ ঘাসের আবরণ পড়ে। আর কোনো মরুভূমিতে কিন্তু এমন প্রাণশক্তির চিহ্ন দেখা যায় না। মনে হয় এখানে আগে অরণ্য ছিল। এসব গাছপালা তারই অবশেষ। মানুষ সেই অরণ্যকে নির্মমভাবে নির্মূল করে দিয়েছে।
থর মরুভূমির গাছপালার মধ্যেই শুধু নয়, রকমারি প্রাণীর মধ্যেও সেই লোপ পাওয়া অরণ্যের চিহ্ন দেখা গেছে। সন্ধ্যার পর অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই বেরিয়ে আসে নানা ধরনের গিরগিটি আর গোসাপ।তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বালি-মাছ।
সমস্ত মরুভূমি জুড়ে চরে বেড়ায় কৃষ্ণসার হরিণ। তারা ঘাস খেয়ে পেট ভরায় আর জলের তেষ্টা মেটায় জলের গর্ত থেকে। জলের আধারের কাছাকাছি বুনো শুয়োরের পালকেও দেখা যায়। থর মরুভূমির মধ্যে বাঘ আর চিতাবাঘও আছে। আগে যে বন ছিল, তা লোপ পেলেও তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিন্তু এখনও রয়ে গেছে।এরা খাঁটি মরুভূমির প্রাণী নয়। মরুভূমির প্রাণীর মধ্যে আছে উট, মরু-ইঁদুর আর ব্যাং। জলের প্রয়োজন তাদের এত কম যে, মরুভূমির নির্জলা পরিবেশে তাদের দিব্যি চলে যায়।
থর মরুভূমির প্রাণীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল সিংহ আর বুনো গাধা। সিংহরা থাকে গুজরাটের 'গির'এর বনে। 'গির'এর বন অবশ্য নামেই বন, আসলে তা থর মরুভূমির পশ্চিম অংশের ঘাসে ঢাকা অংশ। বন লোপ পেলেও যেসব প্রাণী লোপ পায়নি, সিংহ তাদের অন্যতম।
বুনো গাধারা কিন্তু অরণ্যের আড়ালে থাকে না। উটের মতই তারা মরুচারী জীব। একদিন সমস্ত মরুভূমি জুড়ে ছিল তাদের বিচরণ, এখন তারা আশ্রয় নিয়েছে গুজরাটের অন্তর্গত কচ্ছে। কচ্ছের 'রাণ' (Rann) লোনা জলের খাড়ির শুকনো জায়গা, তাকে মরুভূমির ক্ষুদ্র সংস্করণও বলা চলে। গৃহপালিত গাধার চেয়ে আকারে বড় বুনো গাধার রঙ মরুভূমির বালির মত ধূসর ও সাদায় মেশানো।মরুভূমির বালির সঙ্গে মিলেমিশে তারা লুকিয়ে থাকলেও পালিয়ে বেড়ানো তাদের স্বভাব।
আমরা অবশ্য তাদের দেখা পেয়েছিলাম। দল বেঁধে তারা কাঁটা ঝোপ পেরিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছিল। তখন সূর্য ঢলে পড়ছে। সূর্যাস্তের আলোয় তাদের যে কী চমৎকার লাগছিল, কী বলব!
আমরা নীলগাইও দেখেছিলাম। আর একটি প্রাণী থরমরুভূমির সঙ্গে একাত্ম। এটি বিরল বিড়াল শ্রেণীর 'ক্যারাকেল'। খুব সাহসী। আকারে ছোট হলেও এরা ছোটখাটো হরিণ শিকার করতে পারে।
থর মরুভূমির মধ্যে খুব আশ্চর্যজনকভাবে কুমীরও রয়েছে। মরুভূমির হ্রদের আশ্রয়ে তারা থাকে। নদী যেখানে সমুদ্রে এসে মিশেছে, সেখানে সাধারণত তারা থাকে। লক্ষ লক্ষ বছর আগে আরব সাগর তার ভৌগলিক সীমা ছাপিয়ে রাজস্থানে এসে পৌঁছেছিল। কুমীররা হয়তো তখন থেকে গিয়েছিল সমুদ্র সরে যাওয়ার পরও লোনাজলের হ্রদগুলোর মধ্যে।
থর মরুভূমিতে নানারকমের পাখিও দেখতে পাওয়া যায়। বুলবুল, ঘুঘু, পায়রা, দোয়েল, চিল, বালি-মোরগ আর ময়ূর। থর মরুভূমির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পাখি হল বাস্টার্ড। আকারে বিশাল, জয়শলমীরের বিরল তৃণভূমি ও কাঁটাবনে বাস করে। তারা মরুভূমির সাপ, গিরগিটি, কুল ও নানারকমের ফল খেয়ে থাকে। খুব কম জল খেয়ে তারা থাকতে পারে।
'কচ্ছের রান' এর লবণাক্ত জলের ধারে থাকে ফ্লেমিংগো। হাজার হাজার ফ্লেমিংগো 'রানে'র বালিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। জলার ধারে বাস, লোনাজল থেকেই মেটে তাদের তৃষ্ণা। ফ্লেমিংগোকেই প্রধানত মরুভূমির পাখি বলা হয়, কারণ মরুভূমির শুকনো পরিবেশের সঙ্গে তারা দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে।
থর মরুভূমির মধ্যে রাজস্থানের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের বাস হলেও সকলকে মরুচারী বলা চলে না। কারণ, তাদের মধ্যে অনেকেই এখানে স্থায়ী বসবাস গড়ে তোলে না। ঘুরে বেড়াতেই তারা ভালবাসে। এখানে 'ওয়াধা' সম্প্রদায় ছাড়াও 'ভীল', 'গাদি', 'লোহার'রাও আছে। কিন্তু মুক্ত মরুচারীর জীবন যাপন হয়তো বেশিদিন আর সম্ভব নয়। কারণ, ভূবিজ্ঞানীরা মরুভূমির বালিতে চাপা পড়া খনিজ সম্পদের খোঁজ পেয়ে গেছেন। প্রতিটি খনিকে কেন্দ্র করে তাই শহর গড়ে উঠছে।
জল ছাড়া মাটি নির্জীব, মাটিকে সম্পদ করে তুলতে তাই জলের সঙ্গে সংযোগ দরকার আর এই মাটিকে আঁকড়েই তো গাছপালা বাঁচবে। মাটিকে ধরে রাখার জন্য গাছপালাকে তাই অক্ষত রাখা দরকার।
এখন এই অবস্থায় আমাদের গাছপালা ও জলের আধারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজন, বৃক্ষ-নিধন বন্ধ করা দরকার। প্রয়োজনমত আমাদের প্রতিবাদও করতে হবে। আমরা সকলে মিলে পৃথিবীকে এই মরুগ্রাস থেকে যেন রক্ষা করতে পারি।
ছবিঃ লেখক