সামনেই দুর্গাপুজো। আর কদিন পরেই মায়ের আরাধনায় মেতে উঠবে সবাই। মজা, আনন্দ, ঠাকুর দেখা, খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে জমজমাট একটা সময়। প্রতি বছর পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের বাঙালীরাই বছরের এই কটা দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন।
সেরকম ফুটবলের দুর্গাপুজো হল বিশ্বকাপ। তবে এটা বছর-বছর আসে না। এর আবির্ভাব হয়ে প্রতি চার বছরে একবার। সারা বছর যতই ক্লাব ফুটবল হোক, যতই লোকে মোহন বাগান-ইস্টবেঙ্গল, রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা বা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড-চেলসী নিয়ে হইচই করুক বিশ্বকাপের যে অন্যরকম একটা আকর্ষণ আছে সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। ফ্যানেরা তো বটেই এমনকি খেলোয়াড়রাও অপেক্ষা করেন বিশ্বকাপের জন্য। তাঁরা জানেন বিশ্বকাপের একটা চোখ ধাঁধানো খেলা বদলে দিতে পারে তাঁদের জীবন। আবার এটাও জানেন যে, ক্লাব ফুটবলে যতই সন্মান পান না কেন, নিজের দেশের হয়ে বিশ্বকাপ বা ইউরোর মত ট্রফি জিততে না পারলে গ্রেটনেসের সেই উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যাওয়া যায় না।
২০১৮ ছিল বিশ্বকাপের বছর। ২০১৪ সালের ব্রাজিলের পর এবছর বিশ্বকাপের আসর বসেছিল রাসিয়ার বিভিন্ন শহরে। দারুণ খেলা হয়েছে এবছর। বহু অনামী দল তাঁদের অনামী খেলোয়াড়দের নিয়ে আটকে দিয়েছেন বড় দলগুলিকে। বিশেষ করে জার্মানীর গ্রুপ লিগ থেকে বিদায়ের চেয়ে বড় চমক বোধ হয় আর হয় না!
আর ছোট-বড় দল নির্বিশেষে বহু খেলোয়াড় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন তাঁদের প্রতিভার জোরে। আবার কোন কোন খেলোয়াড়দের জন্য শুধু তাঁদের পারফর্মেন্স নয় তাঁদের জীবনকাহিনী বাকিদের নজর কেড়ে নিয়েছে। এই বিশ্বকাপের এরকম কয়েকজন গোলকিপারকে নিয়েই এই লেখা।
ফুটবল মাঠে গোলকিপাররা সব সময়ই একটু আলাদা। মাঠের বাকি দশজন যখন গোটা মাঠ দৌড়ে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের পা থেকে বল কেড়ে নিতে ব্যস্ত, গোলকিপার তখন এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাই বলে তাঁকে অস্বীকার করা যায় না। একজন ভালো গোলকিপার কিন্তু ঐ গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়েই পুরো দলকে উজ্জিবীত করতে পারেন। তাঁর একটা দুর্দান্ত সেভ বা ক্লিয়ারেন্স বাড়িয়ে দিতে পারে পুরো দলের মনোবল। এমনকি বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্সের অধিনায়ক কিন্তু একজন গোলকিপার। একত্রিশ বছর বয়সী হুগো লরিস ফ্রান্সের জাতীয় দলে খেলছেন গত দশ বছর। জাতীয় দলের নিয়মিত ক্যাপ্টেন তিনি ২০১২ সাল থেকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পারের হয় নিয়মিত খেলেন লরিস।
ক্যাসপার স্মাইখেল
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নজর কাড়া আর এক গোলকিপার হলেন ডেনমার্কের ক্যাসপার স্মাইখেল। বাবা পিটার ছিলেন বিশ্ব ফুটবলের একজন লিজেন্ড। ডেনমার্কের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে দাপিয়ে খেলেছিলেন পিটার। বিখ্যাত বাবার সঙ্গে তুলনার চাপে গুটিয়ে যেতে অনেক খেলোয়াড়কেই দেখেছি আমরা, কিন্তু ক্যাসপার সেসব কাটিয়ে নিজের একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলে। বিশেষ করে ২০১৫-১৬ মরশুমে যখন সারা পৃথিবীর ফুটবলবোদ্ধাদের অবাক করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জিতেছিল লেস্টার সিটি তখন তাঁদের গোলে ছিলেন বিশ্বস্ত ক্যাসপার। গোটা মরশুমে পুরো দলের মতই নিজেকেও অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে গেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপেও ডেনমার্কের হয়ে অসাধারণ খেলেছেন ক্যাসপার। বিশেষত প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে নিজের প্রতিভার ছাপ রাখেন ক্যাসপার। পুরো ম্যাচে অসাধারণ গোল কিপিং করার সঙ্গে সঙ্গে নাটকীয়ভাবে এক্সট্রা টাইম খেলার একদম শেষ মুহূর্তে ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদ্রিচের পেনাল্টি রুখে দিয়েছিলেন তিনি। গ্যালারীতে তখন লাফাচ্ছেন বাবা পিটার। পেনাল্টি শুটআউটে আরো দুটি পেনাল্টি বাঁচালেও শেষ অবধি ডেনমার্ককে পরের রাউন্ডে নিয়ে যেতে পারেননি ক্যাসপার। কিন্তু তাতেও তিনি পেয়েছেন তাঁর জীবনের সেরা পুরস্কার! খেলার শেষে গর্বিত বাবা পিটার ট্যুইট করেছেন দলের সব খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্য, ছেলেকেও ভোলেননি তিনি,
Lost for words. Can’t be more proud of my country, my son, his teammates, all the staff and our fantastic national coach Åge Hareide. When all the tears have dried out we will realise how well we did #WorldCup
এসাম এল-হাদারি
আর এক নাটকীয় পেনাল্টি সেভ হয়েছিল মিশর বনাম সৌদি আরবের ম্যাচে। ততদিনে দুটো দলই বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছে। তাই মিশরের কোচ সেই ম্যাচে খেলার সুযোগ দেন এসাম এল-হাদারিকে। সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম তুলে ফেলেন এসাম। বিশ্বকাপের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এসাম হলেন সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড়। ৪৫ বছর ১৬১ দিনের মাথায় খেলেন বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচ। শুধু তাই নয় ম্যাচে একটি পেনাল্টিও বাঁচান তিনি। যদিও শেষ অবধি নিজের দলকে জেতাতে পারেননি এসাম কিন্তু ঐ একটা ম্যাচেই নিজের প্রতিভার ছাপ রেখে যান তিনি।
আলিরেজা বেইরানভ্যান্ড
এসামের মতই নজর কেড়েছেন আলিরেজা বেইরানভ্যান্ড। ইরানের গোলকিপার আলিরেজার জন্ম ইরানের ছোট্ট গ্রাম সারবিয়াসে। তাঁর পরিবার ছিল যাযাবর। নিজেদের পোষ্যদের নিয়ে ঘাসের খোঁজে ঘুরে ঘুরে কাটত তাঁদের জীবন। তার মধ্যেই ফুটবলের প্রেমে পড়েছিলেম আলিরেজা। কিন্তু বাড়ির বড়ছেলে খেলাধুলো নিয়ে মেতে থাকবে সেটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি তাঁর বাবা। এসেছে বহু বাধা, এমনকি রাগে তাঁর জার্সি এবং গ্লাভস ছিঁড়ে দিয়েছেন অনেকবার। কিন্তু এসব কিছু আলিরেজাকে দমাতে পারেনি। শেষ অবধি খেলার প্রতি ভালোবাসা থেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে তেহরানে চলে গেছিলেন তিনি। সেখানে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পেলেও আর্থিক দিক দিয়ে বহু সংরাম করতে হয়েছে তাঁকে। কখনো কাজ করেছেন জামাকাপড়ের কারখানায়, গ্যারেজে, পিজ্জার দোকানে এমনকি কিছুদিন ঝাড়ুদারের কাজও করতে হয়েছে। কখোন থেকেছেন রাস্তায় বা ক্লাবের প্রার্থনাগৃহে। আলিরেজা গল্প করেছিলেন, একবার নাকি কোথায় জায়গা না পেয়ে রাতে একটি ক্লাবের দরজার সামনে শুয়েছিলেন। পরদিন সকালে উঠে দেখেন চারদিকে অনেক খুচরো পয়সা পড়ে আছে। সবাই ভেবেছিল তিনি একজন ভিক্ষুক। কিন্তু সেই টাকা দিয়েই নিজের জন্য অনেকদিন পর ভালো প্রাতরাশ কিনেছিলেন তিনি!
এইভাবেই জীবনসংগ্রামের মধ্যে দিয়েই নিজের খেলার জোরে সবার নজরে আসেন তিনি। ২০১৪ সালে সুযোগ পান ইরানের জাতীয় দলে। তারপর থেকে নিয়মিত খেলেছেন দেশের হয়ে। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তাঁর বারোটা ক্লিনসিটের জোরে সহজের বিশ্বকাপে সুযোগ পায় ইরান। সেখানেও স্পেন আর পর্তুগালের মত শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধেও খারাপ খেলেননি আলিরেজা। দুটি খেলাতেই মাত্র একটি করে গোল খান তিনি। একটুর জন্য দ্বিতীয় রাউন্ড না যেতে পারলেও অনেকেরই নজর কেড়েছেন আলিরেজা, তার ভিত্তিতে স্বপ্ন দেখছেন ইউরোপে খেলার। যাযাবর তো, এক জায়গায় থেমে থাকলে তো তাঁর চলবে না!
হ্যানেস হ্যাল্ডরসন
বিশ্বকাপের এক নতুন দল ছিল আইসল্যান্ড। বিশ্বকাপে এখনো অবধি যত দেশ খেলছে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট্ট দেশ আইসল্যান্ড। দেশের জনসংখ্যা মাত্র ৩ লাখ ৩৪ হাজার। মানে কলকাতার মোট জনসংখ্যার ৭.৫%। দেশে মোট রেজিস্ট্রার্ড খেলোয়াড়ের সংখ্যা ২১,০০০। তাদের মধ্যে থেকেই ২৩ জন খেলোয়াড় নিজেদের দেশকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বকাপের আসরে। তাঁদের অনেকেই খেলার বাইরে আরো বিভিন্নভাবে পার্ট-টাইম কাজ করেন। দলের কোচ একজন পার্ট-টাইম ডাক্তার। কিন্তু সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলেন আইসল্যান্ডের গোলকিপার হ্যানেস হ্যাল্ডরসন। ২০১২ সালে পাকাপাকি ফুটবলে ফোকাস করার আগে হ্যানেস ছিলেন একজন চিত্রপরিচালক। নিজের প্রোডাকশান হাউস থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন এবং মিউজিক ভিডিও পরিচালনা করেছেন তিনি। এই বিশ্বকাপের আগেও কোকাকোলার বিশ্বকাপ-স্পেশাল অ্যাড পরিচালনা করেন তিনি। বিশ্বকাপের সময় গোটা দেশ জুড়ে দেখানো হয়েছে সেই অ্যাড। আর তারই ফাঁকে বিশ্বকাপে হ্যানেস লড়ে গেছেন আর্জেন্টিনার সঙ্গে। লিওনেল মেসির পেনাল্টি বাঁচিয়ে দেশকে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে এক পয়েন্ট। এই বিশ্বকাপের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ছিল হ্যানেস হ্যাল্ডরসনের পেনাল্টি সেভ যা তাঁকে এনে দিয়েছিল ‘ম্যান-অফ-দ্যা-ম্যাচের’ পুরস্কার। এখনো আরো কিছুদিন চুটিয়ে ফুটবল খেলতে চান হ্যানেস। কিন্তু তারপর ফিরে যেতে চান নিজের প্রথম প্রেম পরিচালনায়। একদিন পরিচালনা করতে চান একটি পূর্ণ দৈর্ঘের চলচ্চিত্র!
এরকমভাবেই বিশ্বকাপে নজর কেড়েছেন আরো অনেক গোলকিপার। ক্রোয়েশিয়ার সুবাসিচ, বেলজিয়ামের কুয়োর্টোসিস, ব্রাজিলের অ্যালিসন বা মেক্সিকোর ওচোয়া! তাঁদের জীবনের গল্প আসবে অন্য কোনদিন ইচ্ছামতীর পাতায়।
ছবি এবং তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট।