গত বছর অক্টোবরের এক সন্ধ্যার গল্প দিয়ে এই লেখা শুরু করি। সেদিন সমস্ত মিশরের মানুষের মনে যেন একটাই প্রশ্ন ছিল। পারবে কি তাদের প্রিয় দল কঙ্গোর বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নিতে? পারবে কি তারা ফুটবলের শ্রেষ্ঠ দলগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে বিশ্বকাপে খেলতে?
মিশর শেষবার বিশ্বকাপ খেলেছিল ১৯৯০ সালে ইটালিতে। এই দলের অনেকেরই তখন জন্মই হয়নি। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের আগে আবার মিশরের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিলেন। আটই অক্টোবরের সন্ধ্যায় মিশরের দরকার ছিল কঙ্গোর বিরুদ্ধে জয়, আর তাহলেই তৃতীয় বিশকাপে চলে যেত ফ্যারাওদের দেশের ফুটবল টিম, যাদেরকে তাদের ফ্যানেরা ভালোবেসে 'ফ্যারাও' বলেই ডাকে।
খেলার ৮৫ মিনিটের মাথাতেও মিশর জিতছিল এক গোলে, গোটা দেশের মানুষ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলেন শেষ বাঁশি বাজার। কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন। কঙ্গোর আর্নল্ড বৌকা মটু দেশের হয়ে তাঁর প্রথম গোল করলেন ম্যাচের ৮৭ মিনিটে, ফেরালেন সমতা। মিশরের হাজার হাজার ফুটবল ফ্যান যখন ধরেই নিয়েছেন যে মিশরের বিশ্বকাপে জায়গা পেতে হলে পরের ম্যাচ অবধি অপেক্ষা করতে হবে তখনই ইনজুরি টাইমে পেনাল্টি পেল মিশর। সমগ্র দেশের প্রত্যাশার চাপ মাথায় নিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। তিনি মো সালাহ, এই মুহূর্তে মিশরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব। গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে বল পাঠালেন জালে। উদ্বেল হয়ে উঠলেন গোটা দেশের মানুষ। মহম্মদ সালাহর মুকুটে জুড়লো আরো একটা পালক।
সালাহর জন্ম ১৯৯২ সালে মিশরের ঘারবিয়া প্রদেশে। অল্প বয়স থেকে নিজের ফুটবল প্রতিভার ভিত্তিতে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। খুব কম সময়ই ক্লাবের জুনিয়র থেকে সিনিয়র দলে উত্তরণ ঘটে তাঁর। ২০১২ সালের পোর্ট সঈদ স্টেডিয়ামের দাঙ্গার পর দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা যখন নিম্নগামী তখন ইউরোপের একের পর এক ক্লাবের হয়ে তাঁর পার্ফরমেন্সের জোরে দেশের জনতার নজরে আসেন তিনি। প্রথমে বাসেল, তারপর চেলসি, রোমা হয়ে লিভারপুল। সব ক্লাবের হয়েই নিজের প্রতিভার ছাপ রেখেছেন তিনি। আর লিভারপুলের হয়ে ২০১৮ সালের পার্ফরমেন্সের ভিত্তিতে মরশুমের শেষের ব্যালন-ডি-অরের (Ballon De'or) অন্যতম দাবীদার সালাহ। এমনকি চ্যাম্পিয়ান্স লিগের ফাইনালেও সালাহর কাঁধের চোটের আগে অবধি লড়াইয়ে ছিল লিভারপুল। কিন্তু সালাহ চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে ম্যাচটা ধরে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ এবং শেষ অবধি রেজাল্ট হয় ৩-১।
ফিরে আসি সালাহর কথায়। লিভারপুল যখন সালাহকে সই করিয়েছিল তখন খুব যে হইচই হয়েছিল তা নয়। সালাহ এর আগেও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলেছিলেন চেলসির হয়ে। সেরকম সাফল্য ছিল না, তাই সালাহর ফিরে আসা নিয়ে লিভারপুল সমর্থকরা ছাড়া বিশেষ কেউ মাথা ঘামায়নি।
কিন্তু মরসুমের মাঝামাঝি পৌঁছনোর আগেই ছবিটা পালটে গেল। একের পর এক ম্যাচ জেতানো পারফর্মেন্স, একের পর এক চোখ ধাঁধানো গোল! আস্তে আস্তে সালাহ হয়ে উঠলেন লিভারপুল ফ্যানদের চোখের মণি। ইংলিশ ফুটবল ফ্যানদের অভ্যেস হচ্ছে তাঁদের দল এবং দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গান বাঁধা! ম্যাচের দিন গ্যালারী থেকে দল বেঁধে সেই গানের সুরে তারা ভরিয়ে তোলে স্টেডিয়াম। সে লিভারপুল, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড হোক বা ক্রিস্টাল প্যালেস। গান বাদ যায় না কোন মাঠেই। আর তাই সালাহও ব্যতিক্রম নয়। লিভারপুলের এক পাবে তাঁকে নিয়ে তাঁর ফ্যানদের গাওয়া গানের ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হতে বেশি সময় নেয়নি। গানের কথা ছিল,
Mo Salah, Mo Salah
Running down the wing
Salah la la la la la la la
Egyptian King
এই গানের ভিডিও রিটুইট করেছিলেন হাজার হাজার মানুষ, এমনকি সালাহর এজেন্ট নিজেও। সালাহও নাকি খুবই পছন্দ করেন এই গানটি।
আর এখানেই খেলার জাদু। ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন জনসংখ্যার একটা বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের উদ্বাস্তু সমস্যার কারণে চিন্তিত এবং মুসলিমদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ সেখানে মো সালাহর এই জনপ্রিয়তা সত্যিই এক আশাতীত ব্যতিক্রম! সালাহ যেন সত্যিই এক জাদুকর যিনি শুধু নিজের প্রতিভা দিয়ে নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে নিজের সারল্য আর ব্যবহার দিয়ে হাজার হাজার মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন, তাদের ভুলিয়ে দিয়েছেন দৈনন্দিন জীবনের অনেক সমস্যা!
এই বিশ্বকাপের সময়ও সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ফুটবল ফ্যান তাঁদের প্রিয় দলের জন্য গলা ফাটাবেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেরই নজর থাকবে মিশরের দিকে, অনেকেরই দ্বিতীয় প্রিয় দল এবার মিশর। আর সেটা শুধু মিশরীয় জাদুকর মো সালাহর জন্যেই!
(* ব্যালন-ডি-অর /Ballon De’or - বিশ্ব ফুটবলের সেরা খেলোয়াড়ের বার্ষিক পুরষ্কার)
ছবিঃ ওয়াশিংটনপোস্ট, উইকিপিডিয়া