ওফ্! জীবনে কোনদিন এত অন্ধকারের মধ্যে হাঁটিনি!
এখন ঘড়িতে রাত প্রায় সাড়ে তিনটে। অফিসের কাজে আটকে গেছিলাম। সন্ধ্যে ছটার সময় বিজনেস থেকে একটা আর্জেন্ট রিকোয়েস্ট এসে হাজির। সব কিছু শেষ করে ইউএস টিমকে রেজাল্ট পাঠিয়ে, বুঝিয়ে বেরোতে বেরোতে আড়াইটে বেজেছে। পনেরো ঘন্টা অফিস করার পর শরীরের আর কিছু ছিল না। তাও ভালো, বাড়ি ফেরার জন্য অফিসের গাড়ি পেয়েছি। সঙ্গে আরো দুজন ছিল, কল সেন্টারের শিফট্ শেষ করে ফিরছে। প্রথমে টুকটাক কথা হচ্ছিল। ক্রিকেট, পলিটিক্স, অফিসের নতুন ড্রেস কোড। তারপর সকলেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। বাসস্ট্যান্ডে থেকে রাস্তাটা এত অন্ধকার হবে বুঝতে পারিনি, নাহলে বাড়ি অবধি গাড়িটা নিয়ে নেওয়া যেত।
চারদিকে লোড শেডিং কিনা কে জানে! একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো পর্যন্ত জ্বলছে না। এদিকে আকাশেও বোধ হয় মেঘ করেছে। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ল বলে মনে হল। চাঁদ তো দূরের কথা তারাগুলোর সামান্য আলোটুকু নেই। এইরকম নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা ছোটবেলায় হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গা ছমছম করা বইগুলোয় পড়েছি। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলে সত্যিই বোঝা যায় না। মনে হচ্ছে যেন ঘন, জমাট অন্ধকারের স্তর ভেদ করে হেঁটে যাচ্ছি।
আহ্... হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ পেলাম। এই অন্ধকারের মধ্যে খুব আস্তে ওটা কীসের শব্দ! কারো পায়ের শব্দ কি? কেউ কি পেছনে আছে? হাঁটতে হাঁটতেই একবার পেছন ফিরে তাকালাম। অন্ধকারে ভালো না বুঝলেও মনে হল যেন একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম।
যাহ্... চোর-ছিনতাইবাজ নাকি! এই রকম অন্ধকারেই তো ওদের সুবিধা। হঠাৎ আক্রমণ করবে না তো! সঙ্গে দামী মোবাইল ফোন, ঘড়ি, পার্স রয়েছে। হয়তো সেগুলো কেড়েকুড়ে নেবে। কে জানে লোকটার সঙ্গে অস্ত্রও থাকতে পারে। বন্দুক-রিভলবার না হোক, ছুরি-ছোরা তো আজকাল জলভাত! আর আমার সঙ্গে একটা ব্যাগ পর্যন্ত নেই, শুধু খালি হাত। ভয়ে আমার গলাটা শুকিয়ে গেল। এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়েই গেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো গায়ে এসে লাগছে। এবার একটু জোরেই পা চালালাম সামনের দিকে। বৃষ্টিটা ক্রমেই বাড়ছে। পেছনের ছায়ামূর্তিটা কিন্তু এখনো আমার পেছনেই আসছে। আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। কিন্তু আগের মতই শুধু অবয়বটুকু ছাড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। আশ্চর্য ব্যাপার, ঐ লোকটার মাথাতেও ছাতা নেই। অথচ এই বৃষ্টির মধ্যেও না থেমে সমানে আমার পেছন পেছন আসছে।
হঠাৎ চারদিক বিদ্যুতের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কয়েক মুহূর্তের সেই উজ্জ্বলতা, তারপর আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার।
কড়্-কড়্-কড়্...প্রচণ্ড জোরে বাজের আওয়াজ! আশেপাশেই কোথাও বাজ পড়েছে মনে হল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুচ্চমকের মত চিন্তাটা মাথায় এল, 'পেছনের লোকটা ভূত নয় তো!'
ভেবেই এক মুহূর্তের জন্য আমার মেরুদন্ড বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। গাটা শিরশির করে উঠল। ঘাড়ের পেছনের রোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল।
ভূতে আমার বড্ড ভয়। সেই ছোটবেলা থেকেই রাতের অন্ধকারে আমি বেরোতে ভয় পাই। মনে হয় ঐ অন্ধকারে লুকিয়ে কতগুলো চোখ যেন আমাকে দেখছে। ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধবদের কাছে এই নিয়ে কম লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়নি আমায়। ক্লাস নাইনের স্কুল এক্সার্সানে গিয়ে শ্যামল আর ইন্দ্রজিৎ মাঝ রাত্তিরে সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে ডাকবাংলোর জানলা দিয়ে যা ভয় দেখিয়েছিল সেই গল্পটা আজও স্কুলের বন্ধুদের আড্ডায় নিয়মিত ওঠে আর হাসাহাসি হয়।
তারপর হঠাৎই মনে পড়ে গেল।
ভূতে আর আমার ভয় নেই। চোর-ডাকাত, কোন কিছুতেই ভয় নেই। সব ভয় কাটিয়ে উঠেছি আমি।
আসার পথে, একটা সময়ের পর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যাত্রীরা তো বটেই, এমনকি গাড়ির ড্রাইভারও। কী করবে বেচারা! আগের দিন সারা রাত চালানোর পর আবার মালিকের চাপে টানা চোদ্দ ঘন্টা ধরে একের পর এক অফিস ট্রিপ মারছিল সে। সারাদিন পর চোখ তো লেগে যেতেই পারে।
সায়েন্স সিটির কাছে উল্টোদিক থেকে প্রচণ্ড গতিতে আসা একটা লরির ধাক্কায় আমাদের সুমোটা উল্টে গেছিল। এখন বোধহয় পুলিশের লোকজন আমাদের মৃতদেহগুলো পরপর সাজিয়ে রেখেছে থানায়। অশরীরী হয়ে নিজেকে বেশ হালকা লাগছিল। তারপর রোজকার অভ্যেসে ফিরে এসেছিলাম নিজের পাড়ায়।
কিন্তু এখন সত্যি আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই।
তাহলে কি ঘুরে দাঁড়াব? চোরছ্যাঁচড়দের কি ভূতের ভয় থাকে?
নাকি পেছনের জনও আমার মতই এক অশরীরী?
তাহলে কি জিজ্ঞেস করে দেখব, দুজনে একসঙ্গে থাকা যায় কিনা?
ছবিঃ পিনাকী দত্ত