সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
মাধাইভূত ও ডাক্তারবাবু

সন্ধ্যে থেকেই লোডশেডিং বলে সাড়ে ন'টা বাজতে না বাজতেই পাড়াটা শুনশান হয়ে গেছে।বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ডাক্তারবাবুর চেম্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে মাধাই ভাবতে লাগল, "এটাই উপযুক্ত সময়। আজ কথাটা ডাক্তারবাবুকে বলতেই হবে। তাঁর মতো দয়ালু মানুষ এ তল্লাটে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না।"

মাধাই দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। দরজার বাঁ দিকে একটি পুরনো নেমপ্লেট ঝুলছে। তাতে লেখা ডাঃ বি বি সামন্ত অর্থাৎ বিপিনবিহারী সামন্ত। ডাঃ সামন্ত টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয় এক টুকরো কাগজের উপর আঁকিবুকি কাটায় ব্যস্ত ছিলেন। মাধাই সুড়ুৎ করে ঢুকে ডাক্তারবাবুর উলটো দিকে যেখানে রোগীরা এসে বসে সেখানে বসে পড়ল।

ডাঃ সামন্ত একবার চশমাটা নাকের ডগা থেকে পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে সামনের দিকে নজর আনলেন। কিন্তু মাধাইকে দেখেও তিনি দেখলেন না মনে হল।

মাধাই মনে মনে ভাবল, এখন কি ডাক্তারবাবুকে বিরক্ত করা ঠিক হবে ? কিন্তু কোন রোগী চেম্বারে ঢুকে পড়লে সে তো কথাই বলতে পারবে না।

মাধাই একবার ঘাড়টা অনেকখানি ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল ডাক্তারবাবু পেন দিয়ে কী লিখছেন। দূর থেকে মাধাই যা দেখতে পেল তাতে তার মনে হল ডাক্তারবাবু সাদা পৃষ্টায় বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের মত একবার লিখছেন আর তারপরেই কেটে দিচ্ছেন।

মাধাই এবার একটু গলা খাঁকারি দিল। তারপর সাহস করে বলেই ফেলল, "ডাক্তারবাবু আমার একটা নিবেদন ছিল।" কিন্তু তার গলাটা যথেষ্ট পরিষ্কার শোনাল না। তবে ডাক্তারবাবু মাধাই –এর উপস্থিতি টের পেলেন ঠিকই। তিনি খাতা থেকে মুখ তুলে বললেন, কি রে মাধাই নাকি ? তা বাবা জলে ভিজে ভিজে বেশ ঠান্ডা লাগিয়েছিস মনে হচ্ছে । বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মাছ ধরার নেশাটা তোর গেলনা দেখছি। ঠিক আছে এই পাঁচটা পুরিয়া দিচ্ছি, খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। তার আগে দেখ দেখি আমার এই বর্ষাকে নিয়ে লেখা কবিতাটা কেমন হল। এইমাত্র শেষ করলাম এটা। একেবারে টাটকা বলতে পারিস।"

মাধাই কবিতার নামে জড়সড় হয়ে বসল। আগে ডাক্তারবাবুর কবিতাটাই না হয় শোনা যাক, তারপর সে তার নিজের কথা বলবে।

ডাঃ সামন্ত বললেন, "বুঝলি মাধাই এখন কারো হাতেই সময় নেই। ঘোড়ায় সবাই জিন চাপিয়ে চেম্বারে আসে। কাউকে কবিতা শোনানোর কথা বললেই বলে, ডাক্তারবাবু আজ তাড়া আছে। অন্যদিন আপনার কবিতা শুনে যাবো। দিনে দিনে মানুষগুলোর হলটা কী বলত। কবিতা কি খারাপ জিনিস ?"

মাধাই আবার কিছু একটা বলতে গেল কিন্তু ডাক্তাবাবু ততক্ষণে সদ্য লেখা বর্ষার কবিতাটা পড়তে শুরু করে দিয়েছেন। "বৃষ্টি মানেই মানকচুটির পাতায়, পড়বে ঝরে হাজার হিরের কুচি/বৃষ্টি মানেই ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ, পেটটি পুরে আলুর দম আর লুচি।" ডাক্তারবাবু বেশ দরদ দিয়েই পড়ছিলেন। কিন্তু মাঝপথে হঠা‌ৎ বলে উঠলেন, "ভালো কথা মনে পড়েছে। তোদের খালপাড়ের ওদিকটায় ট্যাংরা নামতে শুরু করেছে ?"

মাধাই এবার খানিকটা নড়েচড়ে বসল। বলল, "আইজ্ঞে ডাক্তারবাবু সেই দুঃখের কথাই তো বলতে এসেছি। গেঁদু বাবু আর জলা-টলা কিছু রাখবেন বলে মনে হয়না। গিয়ে দেখেন খাল-ডোব সব বুজিয়ে ফেলে কেমন ঝাঁ-চকচকে পেল্লাই পেল্লাই বাড়ি তুলে ফেলছেন। ট্যাংরা মাছ তো দূর অস্ত ওখানে আর চুনো-পুঁটিও পাবেন না। আমাদের পরিবারের যে ক-জন কাদা ঘেঁটে সংসার চালায় তারা পথে বসতে চলেছে। গেঁদু বাবু বলেছেন, ওখানে আরো উঁচু-উঁচু বাড়ি উঠবে। আপনি যদি কিছু একটা ব্যবস্থা করেন কত্তা, তাহলে বেঁচে যাই।"

ডাক্তারবাবু তার সদ্য লেখা কবিতাটায় কাদাজলে ব্যাঙেদের গান-টান ইত্যাদি দিয়ে শেষ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে যে আর কাদা জলে ব্যাঙেদের গান শোনা যাবে না এটা ভেবেই তিনি খুব কষ্ট পেলেন। তাই কবিতাটা আর পড়লেন না।

মাধাই হাতজোড় করে বলল, "ডাক্তারবাবু আপনার সাথে ভূমি-আপিসের বাবুদের তো বেশ চেনা-জানা আছে। তাদের বিষয়টা জানিয়ে যদি খালপাড়ের জলা-জমিটা বাঁচানো যায় তো পরিবারগুলো বেঁচে যায়।"

ডাক্তারবাবু খুব মন দিয়ে মাধাই-এর কথাগুলো শুনলেন। বেচারা বলেছে ঠিকই । গেঁদুবাবুর থাবা একবার যেখানে পড়বে সেখানটায় আর সবুজ বলে কিছু থাকবে না। কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে ছাড়বে। এই যে এখন বাইরে কী সুন্দর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এই সময়ই তো উপরের পুকুর থেকে খল্ খল্ করে জলের স্রোতে ট্যাংরার দল ভেসে এসে সারা মাঠময় ছড়িয়ে যায়। ডাঃ সামন্ত খুব ছোটবেলায় মাঠের জল ঘেঁটে ট্যাংরা মাছ ধরতে যেতেন। কতবার ট্যাংরার কাঁটা ফুটে রক্তও বেরিয়েছে হাতে পায়ে। জলে ভিজে, কাদা ঘেঁটে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা।

তিনি মাধাইকে বললে, "দিন দিন জন সংখ্যার চাপে শহর বেড়েই চলেছে। ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে জলা-জমি, সবুজ মাঠ সবকিছু।"

তারপর হঠাৎ ডাক্তারবাবু টান টান হয়ে মাধাইকে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। হ্যাঁ, এ তো মাধাই ছাড়া অন্য কেউ নয়। তিনি এতক্ষণ কবিতা লেখায় এতটাই বুঁদ হয়েছিলেন যে মাধাই-এর ব্যাপারটা তার মগজ পর্যন্ত ঢোকেই নি। আসল কথা হল মাধাই তো এখন আর মানুষ নেই। সে তো কবেই ইহলোক ত্যাগ করেছে।

মাধাইভূত ও ডাক্তারবাবু

ডাক্তারবাবু বললেন, "মাধাই তুই তো সেই কবেই মরে ভূত হয়ে গেছিস। তাহলে তুই কেন খামোখা এ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছিস ? নাকি তোরও থাকার জায়গায় টান পড়ছে ? সেই আগের নিরিবিলিটা আর পাচ্ছিস না, তাইতো ? "

মাধাই এবার হাত কচলে বলল, "আপনি ছাড়া গরিবের আর কে আছে বলুন ডাক্তারবাবু। ভূত হয়েছি বলে আপনার উপকার কী ভুলে গেছি ? "

ডাক্তারবাবু বললেন, "সে না হয় বুঝলাম যে তুই একজন গরিব ভূত, জলার ভূত, গেঁয়ো ভূত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যাঁরা বেঁচে আছে, যাদের নাকের ডগায় জলা জমি ভরাট হয়ে কংক্রিট হচ্ছে তারা করছেটা কী ? তুই ভূত হয়ে যেটা বুঝতে পারছিস তারা মানুষ হয়ে সেটা বুঝতে পারছে না কেন ? "

মাধাই বলল, "মানুষ তো চিরটাকাল নিজেই নিজের ক্ষতি করে এসেছে কর্তা। সেটা আমি ভূত হয়ে বেশ বুঝতে পারছি।"

এমন সময় বাইরের দরজায় কেউ একজন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে ঢুকে পড়তেই মাধাই নিমেষে বাতাসে মিলিয়ে গেল।

ডাক্তারবাবু সেই দিকে চেয়ে নিজের মনেই বললেন, "বেচারা মাধাই ভূত হয়েও ভালো চিন্তা করতে ছাড়ল না। শুধু বুদ্ধিমান মানুষগুলো কবে যে নিজের ভালোটা নিজে বুঝতে শিখবে কে জানে ! "


ছবিঃ মঞ্জিমা মল্লিক

পুরুলিয়ার বাসিন্দা তরুণ কুমার সরখেল জেলার প্রশাসনিক বিভাগে কাজ করেন। পাশাপাশি ছোটদের জন্য নিয়মিত লেখালিখি করেন, এবং ছোটদের জন্য একটি মুদ্রিত পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা