ও রাস্তে পর, ও সড়ক মে
এক মোড় আয়া, এক মোড় আয়া..."
দুটো চ্যাপটা পাথরে ঠোকাঠুকি করে তালে তালে আমি ও ভাই গান গাইতে শুরু করলাম। বিকেলের ক্লান্ত যাত্রীদের অল্প ভিড় রয়েছে। ভিড়ের মানুষজনের মধ্যে কোনোক্রমে মাথা গলিয়ে এগিয়ে চলেছি। এখানে একটু ভিড় কম। দুজনে দাঁড়ালাম। গান গাইতে গাইতে সমানে চোখ যায় সামনের সিটে সাদা ইস্কুলের জামা পরা সেই মেয়েটার দিকে।ঘাড়ের দুপাশে দুটো বিনুনি দুলছে। হাতে নীল স্কুল ব্যাগ। টানা টানা চোখ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। পাশে ওর মা বসে আছে।ওরা থাকে পার্কের যে পাশে আমাদের ঝুপড়ি তার উল্টোদিকের ফ্ল্যাট বাড়িতে। ওদের লোহার জাল ঘেরা গোল বারান্দায় খাঁচায় একটা সবুজ টিয়া পাখি মুখ গুঁজে বসে থাকে প্রায়ই। মাঝে মধ্যে মেয়েটা বারান্দায় এসে পাখিটার সঙ্গে কথা বলে। তক্ষুনি পাখিটা "টিয়া টিয়া" করে চ্যাঁচায় আর ডানা ঝাপটায়। মেয়েটা ঘরে ঢুকে গেলে পাখিটা আবার চুপ করে বসে থাকে। আমার খুব খারাপ লাগে।
গান শেষে আমি ও ভাই সবার কাছে গিয়ে হাত পাতি। যদি দয়া করে কেউ কিছু পয়সা দেয়। কেউ দেয়, কেউ দেয়না। মুখ ফিরিয়ে রাখে কেউ। আবার কেউ দাঁত খিঁচিয়ে ঝেঁঝে ওঠে "কাজ করবি? চল আমার বাড়ি।" এভাবে এগোতে এগোতে একসময় সেই মেয়েটার সামনে দাঁড়াই।হাত পাতি। পাশে বসা ওর মা ব্যাগ থেকে এক টাকা বের করে আমার হাতে দিল। আমি শুধু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমারও খুব ইচ্ছে করে ইস্কুলে যেতে। ওর মতো ইস্কুলের জামা, জুতো আর ব্যাগ নিয়ে মায়ের সঙ্গে ইস্কুল যদি যেতে পারতাম –! মা বোধ হয় এতক্ষণে কাগজ-প্লাস্টিক কুড়িয়ে ঝুপড়িতে ফিরে এসেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
পার্কের প্যান্ডেলে ঠাকুর এসেছে। চারদিকে খুব হইচই হচ্ছে। মাইকে সানাই বেজে উঠল। 'ঢ্যাম-কুড়া-কুড়' তালে ঢাক বাজছে। আমি ও ভাই আমাদের ঝুপড়ির ত্রিপল সরিয়ে এক দৌড়ে প্যান্ডেলে। চারদিকে আলো ঝলমল করছে। কত লোক। চলতে ফিরতে সবাই একবার দেখে নিচ্ছে এবারের ঠাকুর কেমন হল। এদিকে ট্রাক থেকে ঠাকুর নামাতে শুরু হয়েছে চিৎকার চ্যাঁচামিচি। সব সামলে সাবধানে ধরাধরি করে ঠাকুর নামাতে ব্যস্ত। দুগ্গা ঠাকুরের দিকে তাকাতেই আমি অবাক! ঠাকুরের গায়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি, খোলা চুল, বড় বড় চোখ, কি সুন্দর দেখাচ্ছে। টানাটানা চোখে যেন চেয়ে আছে আমাদের দিকে। ঠিক যেন আমার মা!
আজ পুজোর প্রথম দিন। প্রথম দিনে এত্ত ভিড়! চারদিকে মানুষে মানুষে গুঁতো গুঁতি করে ভিড় জমিয়েছে ঠাকুর দেখতে। আমি ও ভাই একপাশে প্যান্ডেলের লোক দেখছি। হঠাৎ দেখি মা কেমন দামী শাড়ি পরে সেজেগুজে আমদের সামনে দাঁড়াল। হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে আমদের দিকে। আমি তো অবাক! কেমন যেন খটকা লাগে মনে। যেন দুগ্গা ঠাকুরই আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে! নিজের হাতে চিমটি কাটি, বিশ্বাস হচ্ছেনা।মা অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করে - "কি রে, তোরা এমন অবাক হয়ে চেয়ে আছিস যে! যাবিনা – ঠাকুর দেখতে? চল চল.." আমার চমক ভাঙ্গে। চেয়ে দেখি, আমি একটা দুধ সাদা কী সুন্দর কুঁচি দেওয়া জামা পরে আছি। এটা পার্কের পাশে জামা কাপড়ের দোকানে ঝোলানো থাকতে দেখেছি। পায়ে সাদা জুতো, মাথায় হাত দিয়ে দেখি সাদা ফিতে! কি অদ্ভুত, দোকানের সামনে সাজানো কালো পুতুলের গায়ের প্যান্ট, জামা-জুতো ভাই পরে আছে। নতুন জামা পড়ে খুব ভাল লাগছে। মা আমাদের ঝাঁকুনি দিয়ে আবারও বলে – "কি হল রে – চল! সন্ধ্যে হয়ে এল তো?"
মায়ের হাত ধরে আমরা একটার পর একটা প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াচ্ছি। আনন্দে মন ভরে গেছে। কত রকমের কত সুন্দর সুন্দর ঠাকুর দেখে বেড়াচ্ছি। কত, কত সুন্দর সাজানো প্যান্ডেল আর রং বেরং-এর আলো ঝলমল করছে চারদিকে। নানা সাজের মেয়ে পুরুষের ছবি লাগানো বড় বড় ছবি, সিনেমার পোস্টার, রাস্তায় ছুটন্ত গাড়ি, ফুটপাতে লম্বা লাইনে মানুষজনের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ভরে যাচ্ছে চারদিক। আগে কখনো এভাবে ঠাকুর দেখিনি। এদিকে ভাই হাতে সাদা কাগজের বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বাজিয়ে বাজিয়ে প্রায় লাফিয়ে হাঁটছে। ফুচকা, এগরোল এমনকি আইসক্রীম খেয়েছি মাঝে মাঝে। আবার হাঁটা অন্য প্যন্ডেলে। মাঝে কোথায় যেন পার্কে নাগর দোলায় চেপে আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে আকাশ ছোঁয়া ঘরবাড়ি, মানুষজন, রাস্তা, রাস্তার লাইন দেওয়া গাড়ির সাড়ি, প্যান্ডেল, আলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম বারে বারে। দারুন মজা হয়েছে। আবার মুখ হাঁ করা লম্বা রেলগাড়িতে ঘুরেছি বেশ মজা করে। রেলগাড়ির মুখটা কীরকম ভয়ানক একটা জন্তুর মত, মা দুর্গার সিংহের মত। তারপর সাদা ভুট্টা ভাজা খেতে খেতে এগিয়ে গেছি অন্য প্যান্ডেলে। হঠাৎ একটা খেলনার দোকানের সামনে ভাই বায়না ধরে একটা খেলনা পিস্তল কিনে দিতে হবে। মা কিনে দিল হাসি মুখে। ভাই ভীষন খুশি। পাশের দোকানটায় আমার চোখ আটকে গেছে। মা ঠিক বুঝতে পেরেছে। একগাছা চুড়ি মা আমাকে কিনে দিল। হাতে পড়ে হাঁটছি সঙ্গে ঝিনঝিন শব্দ তুলছে। বেশ লাগছে। কিন্তু রাত অনেক হয়েছে মা বলল এবার ফিরতে হবে।
ফেরার পথে পার্কের পাশে সেই দামী হোটেলের সামনে মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে দাঁড়ালো। চেয়ে দেখি লম্বা মোটাগোঁফওয়ালা দারোয়ানটা অবাক চোখে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। অন্য সময় আমাদের দেখলে 'দূর-দূর' করে তেড়ে আসত। কিন্তু আজ আমাদের জামা কাপড়, সাজগোজ দেখে ওর চোখ ছানাবড়া। অন্য সময় হোটেলের কাঁচের দেওয়ালের মধ্যে দামী চেয়ার টেবিলে বাবুরা সব দামী খাবার খেত খোশ মেজাজে, আর আমরা বাইরে থেকে লোভীর মতো চেয়ে থাকতাম। খাওয়া শেষে বাবুরা বেরিয়ে এলে হাত পেতে ভিক্ষে চাইতাম। এই দারোয়ানটা তাড়িয়ে আসত। আমাদের দূরে হঠিয়ে দিত।
মা আমাদের হাত ধরে যেই হোটেলে ঢোকার জন্য দাঁড়িয়েছে অমনি দারোয়ানটা ভ্রু কুঁচকে আমাদের দেখে নিয়ে দরজা খুলে দিল। ভাই মজা করে হাতের বাঁশিটা দারোয়ানটার দিকে তুলে ধরে খুব জোরে 'ভোঁ-ভোঁ' করে বাজিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বেচারা দারোয়ানটা বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
চারদিকে চেয়ার টেবিলে লোকজন গল্প করতে করতে খাচ্ছে। চামচ-প্লেটের ঠুং-ঠাং শব্দ ভেসে আসছে। হাল্কা আলো জ্বলছে। আর ভাল ভাল খাবারের গন্ধে ম-ম করছে। কত রকমের খাবারের নাম বলল মা। আমি বিরিয়ানি চাইলাম। ভাই চাউমিন চাইল। খাবারের গন্ধে জিভে জল এসে যাচ্ছে। আমি খুব জোড়ে নিশ্বাস টানি শব্দ করে। মা আমাকে দেখে মুচকি হাসে।
মায়ের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখি সকালের সোনালী রোদ আমাদের ঝুপড়ির ছেঁড়া ত্রিপল দিয়ে ঢুকে পড়েছে। সূর্য অনেকটা উপরে উঠে পড়েছে। পেছনে পার্কের প্যান্ডেলে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। মাইকে সানাই বাজছে। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারিনা। বোকার মতো মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। মায়ের মুখটা কেমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে। মা আবার আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করে – 'কিরে – কী দেখছিস অমন করে?' ভাইও ততক্ষণে উঠে পড়েছে। চোখ কচলাতে থাকে। মা আমাদের দুজনকে বলে – 'আমি বেরোচ্ছি, হাঁড়িতে পান্তা ভাত আছে খেয়ে নিস। থালা বাসন ধুয়ে গুছিয়ে রেখে দিস'। বলেই মা প্লাস্টিক কুড়োনোর বস্তাটা কাঁধে ফেলে বেড়িয়ে যায়। আমি বসে থাকি।
ট্রেনের লোকজনের মধ্যে আমি আর ভাই ভিড়ের মধ্যে এগোতে গিয়ে থমকে যাই! চেয়ে দেখি সামনের সিটে পার্কের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের সেই মেয়েটা আর তার মা বসে রয়েছে। আমার স্বপ্নের সেই জামাটার মতো একটা জামা পরে মেয়েটা বসে আছে আর আমার মায়ের সেই শাড়িটার মতো একটা ঝলমলে শাড়ি পরে মেয়েটার মা বসে আছে। আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি। চমক ভাঙে ভাইয়ের পাথর ঠোকার তালে। আমার কান্না পাচ্ছে। আমি জোর করে তাল ঠুকতে ঠুকতে গাইতে শুরু করি- "ম্যায় নিক্লা, ও ম্যায় নিক্লা…"
ছবিঃ পিনাকী দত্ত