সালটা ১৯৯৭। ভারতে বসেছে মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর। কলকাতার ইডেন গার্ডেনের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছে দুই প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। দুই দলেই এক ঝাঁক তারকা ক্রিকেটারের ভিড়। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক বেলিন্ডা ক্লার্ক তার কদিন আগেই করেছেন একদিনের ক্রিকেটের প্রথম দ্বিশতরান। সঙ্গে কারেন রল্টন এবং ক্যাথরিন ফিজপ্যাট্রিকের মত বিশ্বসেরা খেলোয়াড়। অন্যদিকে আছেন ডেবি হকলি। কিন্তু হকলির লড়াকু ৭৯ রান সত্ত্বেও সহজেই ৫ উইকেটে জেতে অস্ট্রেলিয়া।
মাঠের ধারের বিভিন্ন বলবয় এবং বলগার্লদের মধ্যে ছিল বছর চোদ্দ-পনেরোর, চোখে পড়ার মত লম্বা একটি মেয়ে। যার উচ্চতার জন্য বন্ধুরা তখন থেকেই তাকে ‘তালগাছ’ বলে ডাকে। মাঠের বাইশজন খেলোয়াড়ের মধ্যে এক মনে সে দেখেছে ক্যাথরিন ফিজপ্যাট্রিকের বোলিং। বাড়ি ফেরার পথেই ঠিক করে ফেলেছে যে তাকেও ক্রিকেটার হতে হবে। বলের জোরে উড়িয়ে দিতে হবে ব্যাটারদের স্টাম্প, ঠিক ফিজপ্যাট্রিকের মত।
চাকদহের গোস্বামীবাড়ির মেয়ে ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোয়ে উৎসাহী। প্রথমে ফুটবল দিয়ে শুরু করলেও ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখে ক্রিকেটের প্রেমে পরে গেল দশ বছরের ছোট্ট মেয়েটা। বাড়ির আশেপাশে খেলার মাঠ থাকলেও সেইভাবে দেখিয়ে দেওয়ার মত কেউ নেই। অবশেষে কলকাতা বিবেকানন্দ পার্কের ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিলেন তার বাবা। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। শুরুতে সপ্তাহে দুদিন করে ভোর সাড়ে পাঁচটার রানাঘাট লোকাল ধরে শিয়ালদহ। সেখানে থেকে বাসে করে গোলপার্ক লেকের কাছে কোচিং। আবার কোচিং শেষে সেইভাবেই বাড়ি ফেরা। হাঁফিয়ে যেত ছোট্ট মেয়েটা। কিন্তু তখন থেকেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার জন্য তৈরি ছিল সে। সেখান থেকেই ডাক পেল ১৯৯৭ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে বলগার্ল হওয়ার। ২৯শে ডিসেম্বরের ফাইনালে জীবন বদলে গেল মেয়েটার।
পরের কয়েক বছর শুধু কঠিন পরিশ্রম আর নিজেকে উন্নত করে তোলার চেষ্টা। মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ের এই ক্রিকেট খেলাকে সবাই ভালোভাবে মেনে নেয়নি। সব সময়ে জোটেনি দরকারি সুযোগ সুবিধা। তা সত্ত্বেও থেমে থাকেনি সে। ১৬ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়েছে বাংলার অনূর্ধ-১৯ দলে এবং তারপরে রাজ্য দলে। আর এইভাবেই পাঁচ বছরের মধ্যে সে জায়গা করে নিয়েছে ভারতীয় দলে, দশ বছরের মাথায় হয়েছে আইসিসির বিচারে বছরের শ্রেষ্ঠ মহিলা ক্রিকেটার আর ঠিক ২০ বছর পর, ২০১৭ সালে নিজের আদর্শ ফিজপ্যাট্রিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে মহিলাদের একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট-শিকারীর শিরোপা।
এতক্ষণে নিশ্চই বুঝতে পেরেছো, মেয়েটি আর কেউ নয়, ভারত এবং বাংলার গর্ব ঝুলন গোস্বামী। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ঝুলুদি’!
ঝুলন গোস্বামীকে শেষ ম্যাচে বিদায় সংবর্ধনা জানাচ্ছেন দলের মেয়েরা
এবছর মহালয়ার আগের দিনটিকে নিজের ২০ বছরের বর্ণময় ক্রিকেট জীবনের শেষ দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ঝুলন। নিজের শেষ খেলাতেও বল হাতে সবার নজর কেড়ে নিয়েছেন তিনি। ভারতকে সাহায্য করেছেন ইংল্যান্ডের মাটিতে তাদের ৩-০ ফলে নাস্তানাবুদ করতে। কিন্তু শেষের আগে ফিরে যাই শুরুর দিনগুলোতে।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক। ক্রিকেট মানেই তখন শচীন, সৌরভ, জয়সূর্য, আক্রমদের দাপট। এর মধ্যে মহিলা ক্রিকেটের খবর কজনই বা রাখে।যদিও মহিলাদের ক্রিকেট নতুন কিছু নয়। মহিলাদের প্রথম টেস্ট খেলা হয়েছে সেই ১৯৩০ এর দশকে। ১৯৭৬ সাল থেকে ভারতীয় মহিলা দল টেস্ট এবং একদিনের ক্রিকেট খেললেও শান্তা রঙ্গস্বামী বা ডায়না এডুলজির মত পরিচিত নাম হাতে গোনা। এই সময়ই মহিলা ক্রিকেটে শুরু হল ‘মিতালি-ঝুলন’ যুগ। ১৯৯৯ সালে নিজের প্রথম একদিনের খেলাতেই শতরান করে শুরু করেছিলেন মিতালি আর ২০০২ সালের ৬ জানুয়ারী চেন্নাইয়ের গুরু নানক কলেজ গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যাত্রা শুরু হল ঝুলনের। প্রথম খেলাতেই মাত্র ১৫ রানের বিনিময়ে তুলে নিলেন দুই উইকেট। ভারত সহজেই হারালো ইংল্যান্ডকে।
আর ফিরে দেখতে হয়নি ঝুলনকে। ঠিক এক সপ্তাহ পরে, লখনৌয়ের কে ডি সিং বাবু স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেললেন ঝুলন। ভারতীয় দলের একঝাঁক নতুন খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মিতালিও। সেই শুরু, পরের ২০ বছর ভারতীয় ক্রিকেটের দুই স্তম্ভ হয়ে উঠলেন বাংলার ঝুলন এবং হায়দ্রাবাদের মিতালি। একজন বল হাতে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছেন বিপক্ষের ব্যাটারদের, অন্যজন ব্যাট হাতে ভেঙ্গেছেন একের পর এক রেকর্ড।
শুধু তাই নয়, ২০ বছরের দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের এক গৌরবময় যাত্রার সাক্ষী এই দুজনে। শুরুর দিনগুলিতে সাফল্য সত্ত্বেও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সম্পূর্ণ সহযোগিতা ছিল না। ছিল না ভক্তদের হইচই। এমনকি ২০০৪ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে খেললেও সেই নিয়ে দেশের কোথাও বিশেষ উত্তেজনা ছিল না। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে ছবিটা পাল্টাতে থাকে। ঝুলন, মিতালি, হরমনপ্রিত কউর, স্মৃতি মান্ধানার মত নামগুলো আস্তে আস্তে পরিচিত হতে শুরু করে। ২০১৭ সালের বিশ্বকাপ হয়ে ওঠে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের জন্য এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট। টিভিতে লাইভ খেলা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে সোশাল মিডিয়ার প্রচারের জোরে আস্তে আস্তে সারা দেশ চোখ রাখে মেয়েদের খেলায়। মিতালির নেতৃত্বে আবার বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে ভারত। ফাইনালে দশ ওভারে ২৩ রান দিয়ে ৩ উইকেট তুলে নেন ঝুলন। আউট করেন ইংল্যান্ডের দুই সর্বোচ্চ স্কোরার ন্যাট শিভার আর সারাহ টেলরকে। শেষ মুহূর্তে আন্যা স্রাবসোলের অসামান্য বোলিংয়ের দৌলতে মাত্র ৯ রানে জেতে ইংল্যান্ড কিন্তু এই ম্যাচ ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটকে নিয়ে যায় এক অন্য উচ্চতায়।
আস্তে আস্তে মহিলা ক্রিকেটের ফ্যানের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাড়ে স্পন্সর, টিভি আর নিউজ চ্যানেলগুলোর প্রচার। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের মতই ভারতের মহিলা ক্রিকেটারদের ওপর বাড়তে থাকে প্রত্যাশার চাপ, উঠে আসে শেফালি ভার্মা আর রিচা ঘোষের মত নতুন নজরকাড়া খেলোয়াড়। আর এসবেরই পেছনে ছিল ঝুলন এবং আরো অনেক খেলোয়াড়ের বছর পর বছরের পরিশ্রম।
বিশ্বক্রিকেটে ঝুলনের রেকর্ডের কথা লিখলে শেষ হবে না। একদিনের ক্রিকেটে ২৫৫ উইকেটের অধিকারি ঝুলন যেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাবনিম ইসমাইলের উইকেটের সংখ্যা ১৯১। ভারতীয়দের মধ্যে দেখতে গেলে ঝুলনের সঙ্গে বাকিদের দূরত্ব অবিশ্বাস্য। নিতু ডেভিড (১৪০) আর নুশিন আল খাদির (১০০) ছাড়া আর কোন ভারতীয় বোলার একদিনের খেলায় ১০০ উইকেট পাননি। ভারতীয় পেসারদের মধ্যে ধরলে ঝুলনের সবচেয়ে কাছাকাছি আছেন অমিতা শর্মা যার উইকেট সংখ্যা ৮৭।
ভারতীয় মহিলা দল এখন অবধি ৩০১টি একদিনের ম্যাচ খেলেছে যার ২০৪টি (প্রায় ৬৮%) ম্যাচেই প্রথম একাদশের সদস্য ছিলেন ঝুলন। একের পর এক ম্যাচে ভারতকে নিয়ে গেছেন জয়ের পথে। এই ২০৪ ম্যাচে ২২.০৪ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ঝুলন কিন্তু ভারত যেসব খেলায় জিতেছে সেখানে ঝুলনের সংগ্রহ ১৭.৪২ গড়ে ১৫০টি উইকেট। ব্যাট হাতেও খেলেছেন বহু দরকারী ইনিংস। এমনকি ২০২১ সালের ঝুলনের ব্যাটের জোরেই অস্ট্রেলিয়ার ২৬-ম্যাচ জয়রথ ভেঙ্গেছিল ভারত।
মেয়েদের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডের স্মারকরূপে ঝুলন গোস্বামীর ছবি দিয়ে বিশেষ স্ট্যাম্প ছাড়ে ভারতীয় ডাক বিভাগ
২০ বছরের ক্রিকেট জীবনে মাত্র ১২টি টেস্ট খেলেছেন ঝুলন। এর দায় অনেকটাই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের যারা মেয়েদের টেস্ট ক্রিকেটকে প্রাপ্য সন্মান দেননি। এই ২০ বছরের মধ্যে ২০০৬ থেকে ২০২১, এই পনেরো বছরে মাত্র দুটি টেস্ট খেলেছিল ভারতীয় দল কিন্তু তাতেই নজর কেড়ে নিয়েছেন ঝুলন।
২০০৬ সালে সবচেয়ে কম বয়সে টেস্টে দশ উইকেট তুলে নেওয়ার রেকর্ড গড়েন ঝুলন। তাঁর ১০/৭৮ এর দৌলতে টনটনের মাঠে ইংল্যান্ডকে পাঁচ উইকেটে হারায় ভারত। সব মিলিয়ে ১২ টেস্টে তিনবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট সহ ৪৪ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন ঝুলন। সেরকমই ৬৮টি আন্তর্জাতিক টি-২০ খেলায় ৫৬টি উইকেট আছে ঝুলনের নামে। ২০১২ সালে বিশাখাপত্তনমে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তুলে নিয়েছিলেন মাত্র ১১ রানে ৫ উইকেট।
২০১০ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অর্জুন পুরস্কার। এর দু বছর পর দ্বিতীয় মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী। শেষ কয়েক বছর ভারতীয় দলের একগাদা নতুন মেয়ের আদরের ‘ঝুলুদি’ হয়ে উঠেছিলেন ঝুলন। সাম্প্রতিককালে শিখা পান্ডে, মেঘনা সিং, রেনুকা সিংদের মত একের পর এক পেসার উঠে এসেছে ভারতীয় ক্রিকেটে। বড় দিদির মত তাদের কাঁধে হাত রেখেছেন ঝুলন। নিজে খেলোয়াড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালন করেছেন কোচের দায়িত্ব। আপাতত হয়তো কিছুদিন বিশ্রাম, কিন্তু নিজের প্রিয় খেলাকে বেশীদিন দূরে সরিয়ে রাখার পাত্রী নন ঝুলন আর তাই হয়তো কিছুদিনের মধ্যে কোচের ভূমিকায় দেখতে পাওয়া যাবে ঝুলনকে। তুলে আনবেন আরো অনেক ঝুলনকে। যাদের মধ্যে দিয়েই ঝুলনের অধরা বিশ্বকাপের ট্রফিটা একদিন এদেশে আসবে।
প্রতিকৃতিঃ পার্থ মুখার্জি
ম্যাচ-এর ছবিঃ টুইটার
স্ট্যাম্প এর ছবিঃ লিগ অফ ইন্ডিয়া