আজও একা একা থাকলে মাঝে মাঝে চলে যেতে ইচ্ছে করে –এভিস দ্বীপের সেই নির্জন সৈকতে অথবা বারাটাং-এর রহস্যময় চুনাপাথরের গুহায়।
বছর ছয়েক আগের কথা। পোর্ট ব্লেয়ার, হ্যাভলক ঘুরে চলেছি মায়াবন্দরের দিকে।
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মিডল আর নর্থ আন্দামানের ভেতর দিয়ে যে চওড়া রাস্তাটা মায়াবন্দর ছুঁয়ে আরও উত্তরে চলে গেছে তার নাম আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড। পথের ডানদিকে আদিগন্ত নীল সমুদ্র আর বাঁদিকে সবুজ পাহাড়। এই পথেই বাঁহাতে পড়ল রঙ্গতের ট্যুরিস্ট বাংলো 'হকসবিল নেস্ট'। বাংলোর সামনেই সমুদ্র সৈকত 'কাথবার্ট বে'। শীতের সময় এখানে রাতের আধাঁরে দলে দলে কচ্ছপেরা ডিম পাড়তে আসে– অলিভ রিডলে, হকসবিল, লেদার ব্যাক, গ্রিন-সি টারটল কত না তাদের নামের বাহার।
সন্ধে নাগাদ পৌঁছালাম মায়াবন্দর। ছোট্ট শহর। কিন্তু মাথা গোঁজার পছন্দসই ঠাঁই মিলল বেশ খানিক খোঁজাখুঁজির পর। ঝকঝকে তকতকে নতুন হোটেল, তখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। হাসিখুশি ভারী চেহারার মালকিন জায়না বিবি পেশায় উকিল। সহকারী মহিলাটি বাঙালি। সেই আমাদের ঘরের ব্যবস্থা করে দিল। ভালো রাঁধুনি না পাওয়ায় এখনও রেস্টুরেন্ট খোলা সম্ভব হয়নি জানালেন মালকিন।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে হোটেলের পিছনের বারান্দায় দাঁড়াতেই নীল সমুদ্র আর কমলা আকাশ স্বাগত জানায় – সঙ্গে গরম চা। খানিক পরেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ি। জেটির ধারের ছোট্ট দোকানে জলখাবার সেরে নিয়ে নীল-সবুজ সাগরের বুকে ভেসে পড়ি আদরের নৌকোয়। ছোট্ট ডিঙি ভেসে চলে ঢেউয়ের তালে তালে তরতর করে। সমুদ্রের জল ছিটকে এসে ভিজিয়ে দেয় শরীর। ঝলমলে রোদ্দুরে যতদূর চোখ যায় সমুদ্র সফেন। কোথাওবা সবুজ দ্বীপের রেখা। ছোটবেলায় দেখা ওই সিনেমাটির কথা খুব মনে পড়ছিল। আমরাও যেন সন্তু-কাকাবাবুর মতো ভেসে পড়েছি কোন অজানা রহস্যের সন্ধানে।
এভিস দ্বীপ
দূর থেকে চোখে পড়ে রুপোলী বেলাভূমি আর নারকেল গাছে ছাওয়া নির্জন দ্বীপ -এভিস। দ্বীপের কোলের কাছে নৌকো থামে। সৈকতে পা রেখে মুগ্ধ হই – বেলাভূমিতে ছড়িয়ে রয়েছে নানা রঙের কোরাল, পাথর আর অজস্র ঝিনুক-কড়ি। বাচ্চাদের সঙ্গে আমরাও কড়ি আর ঝিনুক কুড়াতে থাকি দুহাত ভরে। শনশন হাওয়ায় মাথার ওপর কাঁপে নারকেল গাছের পাতারা। হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন দলছাড়া হয়ে যাই। একা হলেই অসম্ভব নির্জনতা – পাতার ফাঁকে বয়ে যাওয়া বাতাসের ইশারা, ঢেউয়ের ছলাৎ ছল, পাখির ডাক – নিজেকে রবিনসন ক্রুসো অথবা অরণ্যদেব বলে মনে হয়।
খানিক একলা ভ্রমণের পর সকলে জড়ো হই পাহারাদারের ডেরার কাছে। নিরালা এই দ্বীপের বাসিন্দা মাত্র দুজন। একজন গেছেন মায়াবন্দরে রসদ আনতে। অন্যজন কাটারি নিয়ে আমাদের জন্য নারকেল কাটতে বসলেন। কিং কোকোনাটের জল থেকে ফোঁপড়া, শাঁস সব পেটপুরে খাওয়া হল। এখানে দেখি মানুষ থেকে মুরগি, কুকুর-বেড়াল সকলেরই খাদ্য এই নারকেল।
ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনা তবু সেই মায়াবী বেলাভূমিকে বিদায় জানিয়ে আবার ভেসে পড়ি নৌকায়।
মায়াবন্দরে ফিরে দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে বেরিয়ে পড়ি কারমাটাং সৈকতের পথে। বনপাহাড়ির পথে শেষ বিকেলের নরম আলোয় ছুটে চলে গাড়ি। রাস্তা বেশ খারাপ। সৈকতে পৌঁছনোর প্রায় দু-কিলোমিটার আগেই গাড়ি শেষমেষ দাঁড়িয়ে যায় – এবার পদব্রজে।
দুপাশে ধানিজমির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়ি। এ যেন বাংলার কোন এক গ্রামের বড় চেনা দৃশ্য। রাস্তার ধারে বড় বড় প্যাডক গাছগুলো আন্দামানে আছি সেটা মনে করিয়ে দেয়। অনেকটা হাঁটার পর জঙ্গল শুরু হয়। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ডানদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে 'সুইফলেট নেস্ট'-এ – মায়াবন্দরের সরকারি ট্যুরিস্ট রিসর্ট। উল্টোদিকের কাঁচা রাস্তা ধরে আমরা সৈকতের দিকে এগোই।
কারমাটাং সৈকত
কারমাটাং সৈকতে পৌঁছতে পৌঁছতেই দেখি বেলাভূমির বিপরীতে সূর্য ডুবছে। সমুদ্র তীরের মাটিতে খুদে কাঁকড়ার দল আর লতানো গাছেরা যেন আলপনা এঁকে রেখেছে। এও আর এক নিরালা সৈকত – আমরাও চুপ করে অনুভব করি সমুদ্রের সেই একান্ত নির্জনতা।
পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়ি। পথে মাড ভলকানো আর লাইমস্টোন কেভ দেখে ফিরব পোর্টব্লেয়ার। রঙ্গতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে এল। আরও খানিক পথ পেরিয়ে উত্তরা জেটিতে পৌঁছে গাড়ি সুদ্ধু বার্জে চড়ে সাগর পাড়ির পালা। ওপারে নেমে গাড়ি চলল মাড ভলকানোর দিকে। কিছুটা এগিয়ে নেমে পড়তে হল। জঙ্গলে ছাওয়া পাহাড়ি পথে হাঁটা। গাছপালা কমে আসতেই তীব্র রোদ্দুর। পাহাড়ি এক টিলার মাথায় ঘেরা ছোট একটা জায়গায় কাদার মধ্যে বুড়বুড়ি উঠছে – একটু হতাশ হলাম বৈকি। পাশে ছাউনির নীচে বাঁশের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিই। এলোমেলো ঠাণ্ডা হাওয়ায় খানিক ক্লান্তি কেটে যায়। নেমে এসে পথের পাশের দোকান থেকে অমৃতের মতো ঠাণ্ডা নিম্বুপানি খেয়ে শরীর যেন জুড়িয়ে গেল।
বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছালাম বারাটাং-এ। গাড়ি উঠল বার্জে – ওপারে যাবে। আমরা ভেসে পড়লাম ছোট্ট ডিঙিতে – লাইমস্টোন কেভ দেখে সেখানে যাব। নীল-সবুজ জলে হেলতে দুলতে ভেসে চলল ডিঙা। খানিক এগোতেই জঙ্গলের চরিত্র আমূল বদলে গেল। একপাশে ম্যানগ্রোভ অরণ্য আর অন্যদিকে ঘন নীল সমুদ্রের বুকে মাঝেমধ্যেই এক চিলতে সবুজ দ্বীপ। সকালের রোদ্দুরে ভেসে যেতে যেতে মনে হয় অপরূপ এই পথ শেষ না হলেই যেন ভালো হত।
ঘন ম্যানগ্রোভের মধ্যে দিয়ে চলেছে ডিঙি
প্রায় ঘন্টাখানেক যাওয়ার পর নৌকোটা হঠাৎ বাঁক নিয়ে একটা চওড়া নালার মধ্যে ঢুকে গেল। মনে হচ্ছে যেন আন্দামানে নয়, সুন্দরবনের আশেপাশে কোথাও রয়েছি। দুপাশে ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল ঝুঁকে পড়েছে জলের ওপর। খেয়াল না করলে গায়ে-মাথায় গাছের ডালের ধাক্কা লাগছে। নালার ভেতরে এঁকেবেঁকে চলেছে আমাদের ছোট্ট ডিঙি। শেষে বাঁশ আর কাঠের পাটাতনে তৈরি ছোট একটা সেতুর নীচে ভিড়ল তরী। ব্রিজ পেরিয়ে এবারে হাঁটার পালা।ডিঙির মাঝিই আমাদের পথের গাইড। ধানক্ষেতের সরু আল পেরিয়ে আবার কখনো বা উঁচু-নীচু পাহাড়ি পথে পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রীতিমতো ব্যালেন্স করে চলা – দারুণ এক অ্যাডভেঞ্চার। ছোটোরাতো বটেই আমরা বড়রাও বেশ উত্তেজিত। যত এগোচ্ছি জঙ্গল ততো ঘন হয়ে আসছে – খুঁজে খুঁজে চলি - পথ আর ফুরায় না।গুহার কাছে এসে রাস্তা সমতল হয়। ভেজা ভেজা গুহার ভিতরে ঢুকি। ভেতরটা কোথাও প্রশস্ত কোথাওবা সরু হয়ে গেছে। অন্ধকার গুহায় ভরসা গাইডের লন্ঠন। আর সেই আলোয় সব কেমন অপার্থিব লাগে। মনে হয় সময় যেন থমকে রয়েছে কোন অতীতেই। প্রকৃতির আপন খেয়ালেই গুহার দেওয়ালে সাদা আর হলুদ চুনাপাথরের ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে হাতির শুঁড়, ঝুলে থাকা পদ্ম এমন নানা কারুকাজ। যেন অজানা ভাস্কর লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে গড়েছেন মূর্তিগুলি। এরপর আবার গাইডের পিছু পিছু গ্রামের আল, মাটির বাড়ির নিকোনো উঠোন দিয়ে ফেরা। গ্রামের তরুণী বধূ ধানমাড়াই করছে – নিত্যদিনের ঘরকন্নার ছবি দেখতে দেখতে গাড়ির রাস্তার দিকে এগোই।
আজ এতদিন পরেও নীল সমুদ্র আর সবুজ দ্বীপের টুকরো টুকরো সেই ছবিগুলো মনের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে। আবার যদি কখনও দেখা হয় – সেই অপেক্ষাতেই আছি।
মনে রাখতে হবেঃ
আন্দামান বেড়ানোর সেরা সময় নভেম্বর থেকে মার্চ। সারাবছরই অল্পবিস্তর বৃষ্টি হয় আন্দামানে। মার্চের পর থেকে বৃষ্টি বাড়তে থাকে।
আন্দামানের কোন কোন দ্বীপে যেতে সরকারি পারমিট লাগে। পোর্টব্লেয়ারের আন্দামান-নিকোবর পর্যটন দপ্তর থেকে যাবতীয় অনুমতি পাওয়া যায়।
কোনও দ্বীপে প্লাস্টিক বা বর্জ্য পদার্থ ফেলবে না। প্রবাল বা অন্য কোন সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করবে না। ভারতীয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে প্রবাল সংগ্রহ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
ছবিঃ রত্নদীপ দাশগুপ্ত