সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
এমনটাও ঘটে

বীরেশ্বর শিকদারের গরু একদিন সকালে হঠাৎ দুধ দেওয়া বন্ধ করতে তিনি গরুর ডাক্তারকে ডেকে পাঠালেন। হেমকান্ত ডাক্তার এসে পরীক্ষা টরীক্ষা করে বললেন, "নাহ, শরীরে তো কোন গন্ডগোল নেই। তার মানে হয় আপনার গরুটা দুষ্টু জেদি অথবা কোন ডাইনি ওকে মন্ত্র দিয়ে দিয়েছে!" বলে হা হা করে হাসতে লাগলেন। ওনার কথা শুনে বীরেশ্বরও হাসলেন।

"ওই যে টিপির ধারে বাড়িটা আছে না আশা পালের, ডাইনি যদি এই এলাকায় কাউকে বলতেই হয় তাহলে ওকেই বলা যায়!" হেমকান্ত ডাক্তার চোখ টিপে বললেন, "কিন্তু আজকের দিনে ওই সব কথা আর কে বিশ্বাস করে বলুন?"

বীরেশ্বরের যে আশা পালের সঙ্গে কিছুদিন আগেই ঝামেলা হয়েছে সেটা সবাই জানে তাই উনি আর কিছু বললেন না। আশা পালের পোষা বেড়ালটা বীরেশ্বরের গাড়ির তলায় চাপা পরে মারা যায়।

বীরেশ্বর অবশ্য সেই ঘটনাটার জন্যে নিজে গিয়ে আশা পালের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, বলেছিলেন, "আমি সত্যি খুব দুঃখিত দুর্ঘটনাটার জন্যে। আমি আজই আপনাকে ঠিক ওই রকম দেখতে একটা বেড়ালছানা কিনে দেবো।" মহিলা যদিও সেই কথায় মোটেই নরম হয়নি। একরাশ ঘৃণা ভরা দৃষ্টি দিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "ওই বেড়ালটাকে আমি এই এত্তটুকুনি থেকে বড় করেছি। ওকে আমি আমার ছেলের মতন ভালবাসতাম। তোমার পাপের শাস্তি তোমাকে পেতে হবে বীরেশ্বর!"

বীরেশ্বর তাও একটা নতুন বেড়ালছানা কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর আর কিছু শোনেননি।

এখন ওনার গরুটা দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, তারপর ওনার গাড়িটা একদিন দুম করে রাস্তায় খারাপ হয়ে গেল। সে কি ভোগান্তি! এদিকে ওনার স্ত্রীরও পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে গেল।

বীরেশ্বর মনে মনে ভাবলেন, "ইদানিং আমার সময়টাই বড্ড খারাপ যাচ্ছে," তারপর ভাবলেন, "আচ্ছা এটা ওই আশা পালের কাজ নয় তো? সে হয়তো তার প্রতিশোধ নিচ্ছে!" পরক্ষণেই নিজের সেই চিন্তাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে বললেন, "ধুস! আজকাল ওই সব কুসংস্কারে আবার কেউ বিশ্বাস করে নাকি? বীরেশ্বর, তোর মন খারাপ তাই তুই এই সব আজে বাজে কথা ভাবছিস!"

বীরেশ্বরের বৃদ্ধ ঠাকুরদা কিন্তু ওই সব ডাইনি টাইনি শয়তান টয়তানেতে খুব বিশ্বাস করতেন। উনি বীরেশ্বরকে একবার বলেছিলেন, "ওরে বীরু, ডাইনিবা শয়তানরা তো থাকবেই কিন্তু ওদের থামানোরও উপায় আছে। একটা কালো জাম গাছ খুঁজে সেটার গুঁড়িতে ওদের একটা ছবি আঁকতে হবে। তারপরছবির হৃদয়টা যেখানটায় সেখানে একটা দাগ কেটে সেই দাগে একটা পেরেক পুঁতে দিতে হবে। রোজ সেই পেরেকটাকে হাতুড়ি পেটা করে একটু করে গাছের গুড়িতে ঠেলে দিতে হবে। যদি ওরা সত্যি কিছু গন্ডগোল করে থাকে তাহলে ওদের ব্যথা লাগবে।ছটফট করবে। তখন তারা হয় নিজে আসবে বা কাউকে তোর কাছে কিছু চাইতে পাঠাবে। তারা যা চাইছে তা যদি তুই দিয়ে দিস তাহলে পেরেকটা আর কাজ করবে না, যদি না দিস তাহলে হয় সে তার কাজ থামাতে বাধ্য হবে নাহলে ব্যথার চোটে মরে যাবে!"

তা সেতো গেল বীরেশ্বরের সেকেলে দাদুর কথা। বীরেশ্বর নিজে এই সবে বুজুরুকিতে বিশ্বাস করেন না, তিনি ভাবেন, "যত্ত সব! দাদু কোনদিন স্কুলে টুলে যাননি তাই ওই সব হাবিজাবিতে বিশ্বাস করতেন!" বীরেশ্বর নিজে কলেজে পড়েছেন ওনার ও সব ভাবা মানায় না!

কিন্তু পরের দিন ওনার কুকুরটা হঠাৎই দুম করে মরে গেল। কিছুই হয়নি তার, দিব্যি সুস্থ ছিল। খুব ভালবাসতেন তিনি কুকুরটাকে, তাই এবার বীরেশ্বর সত্যিই খুব রেগে গেলেন। অত পড়াশোনা সব কিছু ভুলে গিয়ে বলে উঠলেন, "নাহ আর পারা যাচ্ছে না, এটা নিশ্চয়ই আশা পালের কাজ!"

এমনটাও ঘটে

রাগের মাথায় তিনি ছেলের ঘর থেকে একটা লাল রঙের পেনসিল নিয়ে বাড়ির পিছনের জঙ্গলটায় গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে প্রচুর কালো জাম গাছ আছে তিনি জানতেন। একটা কালো জাম গাছ পেয়ে তাতে আশা পালের ছবি এঁকে ফেললেন তিনি। হৃদয়টা যেখানে হওয়া উচিত ঠিক সেই জায়গায় একটা দাগ কেটে একটা পেরেক মেরে দিলেন সেখানে। তারপর বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের স্ত্রীকে বললেন, "নিজেকে না খুব বোকা বোকা লাগছে!"

স্ত্রী হাসলেন, "লাগাই উচিত! এই যুগে ওই সব আবার কেউ বিশ্বাস করে নাকি?"

পরদিন হাবুল বলে একটা ছেলে বীরেশ্বরের বাড়িতে এসে হাজির। সে বলল, "আশা দিদার শরীরটা ভাল নেই। উনি একটু চিনির জল খাবেন বলে আপনাদের বাড়ি থেকে একটু চিনি নিয়ে যেতে বললেন।"

বীরেশ্বর ভীষণ আশ্চর্য হলেন। কী যেন ভেবে ধাঁ করে বলে বসলেন, "আমি দুঃখিত, কিন্তু বাড়িতে তো একটুও চিনি নেই!"
ছেলেটা চলে যেতে উনি তড়িঘড়ি আবার ওই জঙ্গলের জাম গাছটার কাছে গিয়ে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে পেরেকটাকে এক ইঞ্চি আরো ঢুকিয়ে দিলেন।

পরদিন হাবুল ছেলেটা আবার এসে পীড়াপীড়ি করতে লাগল, "আশাদিদার শরীরটা সত্যি খুব খারাপ। চিনি ওনার চাইই চাই।"
"ওনাকে বলে দিও আমাদের বাড়িতে চিনি নেই!" বীরেশ্বর জবাব দিলেন।
বীরেশ্বরের স্ত্রী রেগে গিয়ে বললেন, "তোমাদের এই ছেলেখেলা এবার বন্ধ করতে হবে। চিনি চাইতে এসেছিল তা দিয়ে দিলেই পারতে, মিথ্যে কথা বলতে গেলে কেন? দাদুর বলা ওই সব গল্পকথায় বিশ্বাস করা বন্ধ করো!"
"আশা পাল নিজের খেলা বন্ধ করুক, তাহলে আমিও করব!" বীরেশ্বর চোয়াল শক্ত করে বললেন।

সেদিন সন্ধ্যা নামার একটু আগে বীরেশ্বর বাড়ির বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে আশা পালের বাড়িটাকে দেখতে লাগলেন। মনে মনে বললেন, "কী জানি কী চলছে ওখানে!"

একটু পরই উনি দেখতে পেলেন অন্ধকারের মধ্যেই আশা পাল নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওনার বাড়ির দিকে হেঁটে আসছে। বুড়ি যে খুব কষ্ট করে হাঁটছে দেখেই বঝা যাচ্ছিল। সে কাছে আসতে উনি দেখলেন ওর শীর্ণ, চামড়া কুঁচকে যাওয়া শরীর, সাদা শণ নুড়ির মতন চুল, সত্যি তাকে দেখতে ডাইনির মতনই লাগছিল।

"ওর মনে হয় সত্যি খুব লাগছে," ভেবে বীরেশ্বর জঙ্গলের দিকে পা বাড়াবেন, ভাবছেন পেরেকটা তুলে নিতে এমন সময় মহিলা কথা বলতে শুরু করল। ওর লাল চোখদুটো ভাঁটার মতন জ্বলছিল, চিৎকার করে সে বলল, "ওরে বীরে, প্রথমে আমার বেড়ালটাকে মারলি, তারপর আমাকে একটু চিনিও দিলি না শয়তান!"
বলে সে দুম করে বীরেশ্বরের পায়ের কাছে পড়ে গিয়ে স্থির হয়ে গেল।

xxxxx

ডাক্তার এসে সব দেখেশুনে বললেন, "এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অনেক বয়স হয়েছিল বুড়ির। প্রায় নব্বই হবে মনে হয়। হার্ট অ্যাটাকেই গেল শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে।"
"লোকে মনে করত ও বুঝি ডাইনি!" বীরেশ্বর আমতা আমতা করে বললেন।
"হ্যাঁ, সে সব গল্প অনেক শুনেছি। কুসংসারে আচ্ছন্ন এখানকার মানুষ!" ডাক্তার মাথা নাড়লেন।
"আমি একজনকে চিনি যে মনে করছিল আশা পাল ওর ওপর মন্ত্র টন্ত্র দিয়েছে তাই সে একটা জাম গাছে ওর ছবি এঁকে তাতে পেরেক পুঁতেছিল ওকে জব্দ করার জন্যে।"
"ও, সে সব তো অশিক্ষিত লোকেদের কুসংস্কার!" ডাক্তার মুচকি হেসে বললেন, "আমাদের মতন লোকেদের ওসব কথায় কান দেওয়া কী শোভা পায়, আপনিই বলুন?"


[ অ্যাল্‌ভিন শোয়ার্টজ (Alvin Schwartz, April 25, 1927- March 14, 1992)কিশোর এবং অল্পবয়সী পাঠকদের জন্যে প্রাচীন উপকথা, লোককথা ঘেঁটে গল্প লিখতে ভালবাসতেন যাতে তারা সেই সব গল্প জানতে পারে। নিজের পছন্দ মত একটু আধটু বদলও অবশ্য উনি করে দিতেন। 'এমনটাও ঘটে' ওনার গল্প 'সাচ থিংস হ্যাপেন' এর অনুবাদ। এই গল্পটা নিয়ে লেখক যা বলেছেন সেটাও এখানে দিলাম "'সাচ থিংস হ্যাপেন' গল্পটা একটা খুব পুরনো আমেরিকান উপকথা থেকে নেওয়া, যেখানে একজন লোকের মনে ধারণা জন্মেছিল যে এক ডাইনি তাকে অযথা বিরক্ত করছে। আমি গল্পটার মধ্যে এযুগের একটা টানাপোড়েন ঢুকিয়ে দিয়েছি। শিক্ষা আর কুসংস্কৃতির মধ্যের দ্বন্দ্ব, যেটা অনেক সময়ই আমাদের চোখে পড়ে যখন এমন একটা কিছু ঘটে যায় যা আমাদের আয়ত্তের বাইরে।"]


অনন্যা দাশ কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। নেশা বই পড়া আর গল্প লেখা। শিশুদের জন্যে সামাজিক গল্প ও কিশোরদের জন্যে রহস্য গল্প লিখতে ভালবাসেন। বাংলাতে প্রকাশিত অধিকাংশ শিশু কিশোর পত্রিকাতেই লিখেছেন কোন না কোন সময়ে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা