এটা অনেকদিন আগেকার গল্প। তখন আমাদের দেশে অনেকগুলো ছোট ছোট রাজ্য ছিল আর সেখানে সব রাজারা রাজত্ব করত। সেই রকমই একটা রাজ্য ছিল কাঞ্চনপুর আর কাঞ্চনপুরের রাজা ছিলেন রাজা বজ্রমোহন। ওনার রাজ্যে প্রজারা সুখেই ছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা নতুন বিপদ এসে হাজির হল। এক চোর উদয় হল কাঞ্চনপুরে। সত্যি বলতে কী চুরিচামারি জাতীয় অপরাধ কাঞ্চনপুরে মোটেই ছিল না কোন কালে। লোকে ঘর-বাড়িতে, সিন্দুক, আলমারিতে তালা টালা দিত না মোটেই। তারপর যখন সেখানকার দুজন বড়লোক ব্যবসায়ীর বাড়িতে চুরি হল তখন সবার টনক নড়ল। এদিকে সে চোর বড়ই সেয়ানা। সে কেবল মণিমুক্তো আর দামি গয়নাগাটি চুরি করে! লোকে তখন চুরির ভয়ে ঘর-বাড়িতে, আলমারিতে সিন্দুকে তালা দিতে শুরু করল। এখনকার মতন ব্যাঙ্কের লকার তো আর তখন ছিল না! চোর দেখল চারিদিকে মস্ত মস্ত তালা ঝুলছে তাই সে যেখানে তালা নেই সেখানে গেল – রাজবাড়ি! আর কোপটা পড়ল রাজার ওপর। রাজার রত্ন ভান্ডার থেকে বহুমূল্য রত্ন চুরি গেল। রাজা তো শুনে রেগে কাঁই!
মন্ত্রী বিদ্যাপতিকে ডেকে বললেন, "নাহ, এটা তো মোটেই সহ্য করা যাচ্ছে না! প্রজারা তাদের ঘরে তালা দিচ্ছে বলে আমার রত্ন ভান্ডার থেকে চুরি! তোমাকে কালকের মধ্যেই এই চোরকে ধরতে হবে!"
মন্ত্রীর তো সেদিন রাতের ঘুম চলে গেল! রাত জেগে ভাবছিলেন কী করে চোর ধরবেন এমন সময় ওনার ছোট ছেলে আর্যপতি এসে জিজ্ঞেস করল, "কী হয়েছে বাবা? ঘুমোবে না আজকে?"
এখন আর্যপতি বয়সে ছোট হলে কী হবে ওর মাথায় খুব বুদ্ধি। সে বাবার কাছে সব শুনে বলল, "তুমি কী কাউকে সন্দেহ করছ?"
"রাজবাড়ির কেউই হবে বলে মনে হয়। নাহলে রত্ন ভান্ডার কোথায় সে হদিশ বাইরের লোক পাবে না। ওটা বেশ ভাল ভাবেই লুকোনো আছে। কিন্তু রাজবাড়িতেও তো অনেক লোক কাজ করে, তাদের মধ্যে থেকে কে সেটা কী করে বুঝব?"
"আচ্ছা, আমার মাথায় একটা উপায় এসেছে। আমার মনে হয় এটাতে কাজ হবে!"বলে মন্ত্রীর ছেলে বাবাকে উপায়টা বলে দিল।
শুনে মন্ত্রীমশাই তো খুব খুশি, ওনার মুখে হাসি ফুটল।
পরদিন মন্ত্রীর পরামর্শে রাজা ঘোষণা করলেন যে রাজবাড়ির সবার জন্যে তিনি একটা বিশেষ ভোজ রেখেছেন। সবাই শুনে খুব আনন্দিত হয়ে খেল। খাওয়া শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ বিদূষক আর রাজ পুরোহিতের খুব শরীর খারাপ! অন্যদেরও অবস্থা ভাল নয়। মন্ত্রী কিছুই খাননি। সবার শরীর খারাপ হচ্ছে দেখে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "খাবারে বিষ মেশানো ছিল। যেই এই খাবার খেয়েছে তারই শরীর খারাপ করবে এবং কিছুক্ষণ পরই নিশ্চিত মৃত্যু! বাঁচার একমাত্র উপায় হল রাজকোষের বড় হিরে শুভ্রদ্যুতি আর চুনি রক্তনিশা। ওই দুটো পাথরের কোন একটা মুখে নিলে এই বিষ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়! মহারাজ, আপনি এখুনি ওই দুটো পাথর এখানে আনাবার হুকুম দিন!"
রাজামশাই শুকনো মুখে বললেন, "কী করে আনতে বলব, সেই দুটো পাথর তো চুরি গেছে!"ভয়ে ওনার মুখ কালো। খাবারটা তো উনিও খেয়েছেন!
ভয়ে, শরীর খারাপে সবাই কাতর! সবাই মনে করছে এই বুঝি সে মরে যাবে! এমন সময় মন্ত্রীর ছেলে এসে বাবার কানে কানে কিছু একটা বলে দিয়ে গেল।
মন্ত্রী বিদ্যাপতি টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, "মহারাজ, আপনার কথা মতন রত্ন ভান্ডারের চোর কে সেটা জেনে ফেলেছি। রাজমহলের এক পাহারাদার টিকম সিং হচ্ছে চোর। এবার আপনি সেনাপতিকে আদেশ করুন ওকে ধরে নিয়ে আসতে। আমি আমার ছেলে আর্যপতিকে প্রাসাদের বাইরে দাঁড়াতে বলেছিলাম যাতে কেউ পালাচ্ছে কিনা দেখে এবং তার পিছু নেয়। আমি যেই হিরে আর পান্নাতে ওষুধের কথা বলেছি টিকম সিং সুট করে সরে পড়ে বাড়ি গিয়ে ওগুলো চুষছিল! আর্য সব দেখেছে! ওই হল কাঞ্চনপুরের চোর আর এবার আর প্রজাদের কাউকে বাড়িতে বা সিন্দুকে তালা দিয়ে রাখতে হবে না! আপনাদের খাবারে শুধু মাত্র একটা বিশেষ গাছের শিকড়ের রস মেশানো ছিল, বিষ টিষ কিছু নয়! কবিরাজ মশাই বলেছেন একটু কষ্ট হবে কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। চোর ধরার জন্যে আপনাদের সবাইকে কষ্ট দিলাম বলে ক্ষমা চাইছি!"
গল্পটা শুনে টুকান কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবল তারপর বলল, "আচ্ছা মাসি তালাচাবি কে আবিষ্কার করেছিল জানো?"
টুকানের ওই এক দোষ, বড্ড প্রশ্ন করবে! আমি বললাম, "এই খেয়েছে আমি আবার জি.কে. তে বড্ড কাঁচা, কিন্তু এখন তো গুগল রয়েছে! চল দুজনে মিলে দেখি!"
যবে থেকে মানুষের কিছু জিনিসপত্র সম্বল হল তবে থেকেই সেগুলোকে আগলে রাখার প্রবণতা এসে গেল। প্রথম প্রথম তালাচাবি বলতে শুধু মাত্র দড়ি বা অন্য কিছু দিয়ে বাঁধা, মানে কেউ না জিজ্ঞেস করে ঢুকেছিল কিনা সেটা বোঝা যাবে। সময়ের সাথে সাথে সত্যিকরের তালাচাবি ব্যবহার হতে শুরু করল মানুষ। সেগুলো সব কাঠ বা ধাতুর তৈরি। ঠিক কে বা কোন সভ্যতায়ে যে প্রথম তালাচাবি ব্যবহার হয়েছিল সেটা সঠিক ভাবে বলা যায় না। অনেক ইতিহাসবিদরা মনে করেন মিশর, গ্রীস আর রোম এই তিনটে জায়গাতেই স্বাধীনভাবে তালাচাবির আবিষ্কার ঘটে।
কাঠের তৈরি প্রথম তালা মিশরে ব্যবহার হয়েছে প্রায় ৬০০০ বছর আগে। সেগুলো কিছুটা আমাদের এখনকার দেখা খিলের মতন। অবশ্য এর চাবি থাকত। খানিকটা টুথব্রাশের মতন দেখতে, বিশেষ ফুঁটো দিয়ে সেগুলো ঢুকিয়ে খিল বা হুড়কোটা খোলা যেত। তবে সেই চাবি হত বিশাল এক একটা কাঠের টুকরো, মানে সেটাকে বয়ে বেড়ানোই একটা সমস্যা!। পুরাতত্ববিদরা খোরাসাবাদ প্যালেস (মেসোপোটেমিয়ার নিনেবাহ শহরের কাছে, আধুনিক ইরাক) সব থেকে পুরোনো তালাটা খুঁজে পেয়েছেন সেটা ৪০০০ বছর পুরনো।
নবম শতাব্দীর অ্যাংলো ভাইকিং যুগের চাবি
ওই ভারী চাবি আর কাঠের তালা ঠিক কাজ করছিল না। কাঠের তালা খুব শক্তিধররা ভেঙে ফলতে পারছিল। তাই যিশুখৃষ্টের জন্মের ১০০০ বছর আগে গ্রীক ও রোমানরা ভালো তালাচাবি তৈরির চেষ্টায় নেমে পড়ে। গ্রীকদের তালাগুলো তত ভাল হয়নি কিন্তু রোমানরা তাই দেখে শিখে ফেলে আরো ভাল জিনিস তৈরি করে ফেলল। ওরা তালা বানাতে ধাতুর ব্যবহার করল এবং তাতে চাবিগুলো অনেক ছোট হল যাতে বয়ে বেড়ানো যেতে পারে। ওরা চাবি পকেটে, বা হারে বা আংটিতে ঝুলিয়ে পরত। সেই প্রথম এমন তালা তৈরি হয় যেগুলোকে ধাক্কা মেরে বা পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলা যেত না আর সেই প্রথম খাঁজকাটা চাবির ব্যবহার হল।
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর বেশ কিছু সময় পর্যন্ত তালা চাবির জগতে কোন নতুন আবিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়নি।
আধুনিক কম্বিনেশন তালা
শেষে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বেশ কিছু নতুন ধরনের তালাচাবির আবির্ভাব হয়। স্বাভাবিক ভাবেই যে তালাকে চোরেরা সহজে খুলতে পারে না সেই তালাকে তত ভালো বলে ধরে নেওয়া হত। ইংল্যান্ডের রবার্ট ব্যারোন (১৭৭৮) দু রকম ভাবে কাজ করা 'টাম্বলার লকের' আবিষ্কার করেন। ১৭৮৪ তে জোসেফ ব্রামাহ এমন একটি তালা বার করেন যেটা প্রায় পরবর্তি ৬৭ বছর ভাঙতে পারেনি চোরেরা! জেরেমিয়াহ চাব ১৮১৮ সালে ডিটেকটার লক বার করেন। আমেরিকার লাইনাস ইয়েল (সিনিয়ার) এখনকার ব্যবহার করা 'পিন টাম্বলার' তালার আবিষ্কার করেন (১৮৪৮)। ওনার একটি তালাচাবির দোকান ছিল। ওনার পুত্র লাইনাস ইয়েল (জুনিয়ার) ভাল ছবি আঁকতে পারতেন । বাবার চাপে পোট্রেট আঁকা ছেড়ে লাইনাস জুনিয়ার যখন পৈত্রিক ব্যবসায় ঢোকেন তখন তিনি আঁকার প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু ভাল তালাচাবি ডিজাইন করেন। বাবার তৈরি ওই পিন টাম্বলার ডিজাইনটাকেও উনি আরো উন্নত করেন। ওনার তৈরি তালার ডিজাইন এখনকার সময়ও ব্যবহার হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেমস সার্জেন্ট ১৮৫৭ আর ১৮৭৩ সালে কম্বিনেশান তালা আর দুটো চাবি দিয়ে খোলা তালা (যেমনটা ব্যাঙ্কের লকার ইত্যাদিতে ব্যবহার হয়) আবিষ্কার করেন। ব্যাস এই হল তালার ইতিহাস।
চাবির গোছা
এখন তো কত রকমের তালা বাজারে তার ঠিক নেই। সেই সব তালা খোলার জন্যে কত চাবি! গাড়ির জন্যে চাবি, বাড়ির জন্যে চাবি, আলমারির, চাবি, ব্যাঙ্কের লকারের চাবি...চাবির শেষ নেই! তবে ভাগ্য ভাল সেগুলো সব আকারে ছোট, খিল বা হুড়কোর মতন সাইজের একগাদা চাবি সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াতে হলে আর দেখতে হত না!
টুকান সব দেখে শুনে বলল, "ভাগ্যিস কিছু লোক বুদ্ধি খরচা করে ছোট ছোট চাবি বানিয়েছিল নাহলে যা হত না!"
ছবিঃউইকিপিডিয়া ও ফ্রিইমেজেস