বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়। গাছ-গাছালি মোরাম বেছানো রাঙা পথ থাকলেও বিশ্বভারতীর সঙ্গেও ঠিক মেলে না। ওটা বড্ড বড় আর ছড়ানো। আবার যাদবপুরের মতোও বলা যায় না। কারণ বর্ধমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচিল ঘেরা কোনও একটি নির্দিষ্ট ক্যাম্পাস নেই। বিভিন্ন পড়াশুনোর বিভাগের একাধিক ইমারত, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বা সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, গবেষক ছাত্রদের আবাসন এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গোলাপবাগের মনোরম পরিবেশে। বড় বড় পুকুর, দিঘি, পরিখা আর ছায়াতরু। পরিখাগুলোই কোনও কোনও দিকে গোলাপবাগের সীমানা। গোলাপবাগের সংলগ্ন তারাবাগে অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের কোয়ার্টার আর ছাত্রী ও গবেষিকা ছাত্রীদের হোস্টেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর আবার প্রায় এক কিলোমিটার দূরের রাজবাটীতে। তারাবাগ থেকে রাজবাটী যাওয়ার পথে পড়ে কৃষ্ণসায়র পার্ক আর পর পর ছেলেদের হোস্টেলগুলো। ছাত্রীর সংখ্যা বেশি হলেও ছাত্রীনিবাসের চেয়ে ছাত্রাবাসের সংখ্যা বেশি। গোলাপবাগ থেকে সরাসরি তারাবাগ যাওয়ার রাস্তায় পড়ে কচুরিপানা ঢাকা একটা পরিখা যা পেরোতে হয় একটা জেড আকৃতির কাঠের সাঁকো দিয়ে। সাঁকো দিয়ে অনেকে মিলে হুড়মুড় করে যাওয়া যাওয়া চলে না। দুপ্রান্তের দুখানা গেট এমন ভাবে খোলে যে একে একে লাইন দিয়ে গেট পেরোতে হয়।
গোলাপবাগে কলা বিভাগের জন্য যে অট্টালিকা আছে, তার নাম 'হিউম্যানিটিস বিল্ডিং'। তার দক্ষিণ দিকে, যেদিক দিয়ে ক্যান্টিন ও তারাবাগ যেতে হয়, সেদিকে রয়েছে অনেকগুলো বড় বড় বৃক্ষ। একটা ইঁট বাঁধানো রাস্তা ক্যান্টিন পযর্ন্ত গেছে সাঁকোটার দিকে। তবে সেই ঘাসচাপা রাস্তাটা দিয়ে কয়েকজন অধ্যাপকই যাওয়া আসা করতেন। আমরা সবাই একখানা পায়ে হাঁটা সংক্ষিপ্ত পথ ধরতাম। ঐ বিশাল গাছগুলোর নীচে আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে চলতে বেশ লাগত।
সেই গাছগুলোর শাখায় শাখায় শাখামৃগ। গোটা তারাবাগের গাছগাছালিতেও ছিল বানর সাম্রাজ্য। আস্ত কিষ্কিন্ধাই বলা যায়। তারা বড় কোনও অনর্থ বা খুনখারাপি ঘটিয়েছে বলে তখনও পর্যন্ত জানা ছিল না। তবে তাদের উৎপাতের সঙ্গে সহাবস্থান ছিল ছাত্রীনিবাসগুলোর আবাসিকদের রোজকার ব্যাপার। আমাদের নিবেদিতা হোস্টেলের পেছনের উইং-এর বেসিন চার-পাঁচবার ভাঙার পর আর নতুন করে লাগানোই হয়নি। সম্ভবত তাদের আক্রোশটা বেসিনের ওপর ছিল না। কৌতুহল ছিল দেওয়ালে লাগানো আয়নাটার প্রতি। এখন বেসিনে বসে তিনটে গোদা মিলে আয়নায় নিজেদের যমজ দেখার জন্য ঠেলাঠেলি করলে বেসিনের আর দোষ কী?
হোস্টেলের সাধারণত বৈকালিক জলখাবার ছিল চার স্লাইস কাঁচা পাঁউরুটি, একটা সিঙাপুরি কলা আর খানিকটা গরম জল। গরম জল দিয়ে আমরা হরলিক্স, কমপ্ল্যান ইত্যাদি গুলে খেতাম। চা, কফি করতে হলে ঐ হাত-সওয়া গরম জলে কাজ হত না। প্লাগ পয়েন্টে কেরামতি করে কিছু কিছু মেয়ে ঘরের মধ্যে হীটারের ব্যবস্থা করেছিল। আমিও তেমন এক অস্থায়ী বন্দোবস্তে পুঁচকে একটা ইমার্শন হীটারে চা-কফি থেকে গার্গেলের গরম জল করে নিতাম।
আমরা জানি বাঁদররা কলা পছন্দ করে। কিন্তু কোনও দিন কলা ছিনতাই করার জন্য বানরসেনা হানা দেয়নি। কিন্তু মাসের শেষে 'গ্র্যান্ড'এর দিন কেক, পেস্ট্রি, মোগলাই এসবের আয়োজন হলেই মুখ বদলানোর জন্য তারা হাজির হত। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, ঘুগনির বাটিও চেটেপুটে সাফ করে দিচ্ছে। অতঃপর লুণ্ঠিতদের সঙ্গে বাকি যারা আক্রান্ত হয়নি তারা খাবার ভাগাভাগি করে নিত দরজা এঁটে, এক-একটা খুপরি ঘরে সাত-আটজন। মেস ম্যানেজাররাও বন্ধু সেবায় লেগে যেত। ছেলেদের হোস্টেলে মেস ম্যানেজাররা নিজেদের জন্য যেমন ভালোমন্দ খাবার বেশি করে বরাদ্দ করে নিত, মেয়েদের হোস্টেলে তেমনটা হতে পারত না। সকলকে খাইয়ে যখন ম্যানেজাররা বড় ডাইনিং-এ খেতে বসত তখন কচ্চিৎ-কদাচিৎ বাড়তি মাছ জুটত তো কোনওদিন তরকারিটাও কম পড়ে যেত। তার ওপর ছিল বাঁদরের বাঁদরামি। তার ক্ষতিপূরণটাও সকলে ভাগযোগ করেই দিতাম। শুধু বাঁদর কেন, ঘরে খাবার নিয়ে যাওয়ার পথে কাকে পাত থেকে মাছ তুলে নিয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। তখন ঘেন্নায় সমস্ত খাবারটাই ফেলে দিতে হত।
একবার ভালো টিফিনের দিন এক মর্কটকে বোকা বানিয়ে নিজের তিনতলার ঘরে ঢুকে যেই দরজা দিয়েছি, অমনি শুনি পরিত্রাহী চীৎকার। আমার রুমমেট ছিল না। আমি একটু আগুপিছু না ভেবে এগিয়ে যাওয়া বোকাহাবা বলেই কিনা কে জানে, মাঝে মাঝে এমন কিছু করে বসতাম, যা অন্য মেয়েরা সাহস করত না। চীৎকার শুনে নিজের ঘর থেকে বাইরে করিডোরে এসেই খবর পেলাম শুক্তিদের ঘরে হনুমান ঢুকেছে। যে যার ঘরে ঢুকে খিল এঁটে চেঁচাচ্ছে। এমনকি করিডোরের দিকে জানলাও বন্ধ করে দিচ্ছে, যাতে দুর্বৃত্তরা হাত গলিয়ে কোনও অনিষ্ট করতে না পারে। আমি আমার ঘরের ল্যাচ্ টেনে চীৎকার ধরে এগোলাম আক্রান্তদের ঘরের দিকে। কী সর্বনাশ! দরজা বন্ধ যে! জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম বজরংবলী কাউকে খিমচোচ্ছে বা মারছে কিনা। দরজাটা বন্ধ নয়, ভেজানো মাত্র। কব্জা আলগা হয়ে বাতাসের বা তার ছেলের ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেছে। হনুমানটা তস্করবৃত্তি ছেড়ে বেরোতে না পেরে টেবিলে বসেই ভোজ সারছে।
আমি কপাট ঠেলে খুলে 'হ্যাট্ হ্যাট' বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। হতচ্ছাড়া মুখপোড়া টেবিলা জুত করে বসে এক হাতে পেস্ট্রি আর এক হাতে রোল বাগিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। সে মাসে বেশি ছুটি ছিল বলে অনেকেই বাড়িতে কাটিয়েছে বেশির ভাগ দিন। মাসের শেষে ম্যানেজারদের হাতে ভালোই টাকা ছিল। তাই আয়োজনটাও মন্দ হয়নি। আহা! হনুমানটার কী বরাত সেদিন! সঙ্গীসাথী কেউ আসেনি ও ঘরে। একাই পাঁচজনের ভোগের দখল পেয়েছে। ঘরের ভেতর পাঁচজন আমায় দেখে চেঁচানি কমিয়েছে, কিন্তু থামায়নি। তাদের আতঙ্কিত আর আমার আসহায় দৃষ্টির সামনে হনুটা কিছুক্ষণ পর তৃপ্ত হয়ে এলোমেলো খাবার ছিটিয়ে উঠে বেরিয়ে এল। আমি সভয়ে ও সসম্ভ্রমে দরজা ছেড়ে দিয়ে তফাতে সরে গেলাম। জীবন্ত হনুমানজীর প্রসাদ কে খাবে? কেকা নিজের খাবারটা একটা থালায় রেখে আর একটা থালা চাপা দিয়ে রেখেছিল। সেটা বেঁচে গেছে। আমি আমারটাও সাবধানে এনে দিলাম। তারপর দুজনের খাবার ছয় ভাগ। সঙ্গে চা আর কফি মিলিয়ে চাফি।
এমন লুটেরাদেরও ঘর সংসার থাকে। বাপেরা বাচ্চার খোঁজ না রাখলেও অঞ্জনি- রুমারা তাদের সন্তানদের বুকে করে ঘোরে। বড় করে তোলে। আর তারপর তো সবাই রোজগেরে। গাছের কলা, কৎবেল, চালতা, আম, জাম, কাঁঠাল -যখন যেটা জোটে পেড়ে বা কেড়ে খেতে তো লাইসেন্স লাগে না, মেয়েদের হোস্টেলে ঢুকে হুজ্জোতি করলেও পুলিসে ধরে না বা আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে বেসিন ভেঙে দিলে ফাইনও করা হয় না। সুতরাং বালী, সুগ্রীব, অঙ্গদরা যখন খুশি দোল খায়, যখন খুশি লুঠতরাজ চালায়।
এমন বানর-রাজ্যে একবার এক মানুষই বাচ্চা চুরির অপবাদে গণপিটুনি খায় আর কি। মানুষটা কোনও ষণ্ডাগুণ্ডা লোক নয়, কোনও দীর্ঘদেহী পেটানো চাহারার ছাত্রও নয়। এক নিরীহ পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি দৈর্ঘ্যর, উনত্রিশ ইঞ্চি ছাতির আর চৌত্রিশ কেজি ওজনের বছর একুশের একটি মেয়ে, যে তার হোস্টেলে গ্র্যান্ড ফিস্টের দিন পাঁচজন বাঁদর-বন্দিকে মুক্ত করেছিল।
আমি ডিপার্টমেন্ট থেকে সচরাচর একাই ফিরতাম। বর্ষায় টানা বৃষ্টির পর সেদিন রোদ উঠেছিল; কিন্তু গাছের তলার পায়ে হাঁটা পথটা জলে কাদায় দারুণ পেছল। কেন যে আমাদের ইঁট বেছানো রাস্তাটার কথা খেয়াল থাকত না, কে জানে? আসলে অব্যবহারে ঘাস গজিয়ে ওটা চোখেই পড়ত না, মনেও থাকত না। জল কাদা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে হাঁটছি। এক জায়গায় কাদা ডিঙোতে গিয়ে দেখি একটা পুঁচকে বাঁদর ছানা কাদা মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। মুখ, হাত, পায়ের লালচে আভা কাদার মধ্যেও ফুটে আছে। এঃ! এক্কেবারে সদ্যোজাত। মা-টা কোথায়? বেচারার নিজে ওঠার ক্ষমতা হচ্ছে না। মা, বাবা, আত্মীয়-স্বজন কেউ এসে তুলেও নিয়ে যাচ্ছে না। কী করি? এই নির্বোধ আমি মানুষটা ভাবলাম, কাদা থেকে তুলে পুকুরের জলে সামান্য সাফ-সুতরো করি। তারপর কোনও গাছের তলায় বা হোস্টেলের ছাদে রেখে দেব। ওর মা না হোক, সমাজের কারও না কারও চোখ নিশ্চই পড়বে।
চিটচিটে কাদার মধ্যে এঁটে থাকা বাচ্চাটাকে বেশ কসরৎ করে তুললাম। কাঁধের ব্যাগ মাটিতে আছাড় খেলো। ছাতাখানা পড়ে ভূপতিত। ব্যাগটা ফের কাঁধে ফেলে বাচ্চা হাতে যখন হিউম্যানিটিস বিল্ডিং-এর কাছাকাছি পুকুর পাড়ের দিকে এগোচ্ছি, কানে ধুপ্ধাপ্ ঝুপ্ঝাপ্ আওয়াজ এল। সেই সাথে পাতার ঝর্ঝর্ খস্খস্। দশ-বারো সেকেন্ডে বুঝলাম শব্দটা আসছে মাথার ওপর থেকে। আরও বেশ কয়েক সেকেন্ড লাগল টের পেতে গাছের ডালে ডালে কিষ্কিন্ধা-রাজ্যে শোরগোল পড়ে গেছে। মোটা বুদ্ধিতে আরও দেড় সেকেন্ড লাগল অনুমান করতে বাঁদর বাহিনী বাচ্চা চুরির অপরাধে আমার দিকেই ধেয়ে আসছে। তারপর আর সময়ের হিসাব মনে নেই। হাত থেকে কচি শিশুকে মাটিতে ফেলে দিয়েই দিকবিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে কাদা হাতে, ব্যাগ কাঁধে দে চম্পট। আমার ছাতাখানা গাছতলায় ডিগবাজি খাচ্ছে। সেটা তুলতে আর সাহস হল না। ছুট-ছুট-ছুট। সেদিন ইঁটের রাস্তাখানা খুঁজে পেয়েছিলাম। পথটা যদিও দীর্ঘ, কিন্তু শর্টকাটের মতো পেছল নয়। তারাবাগ যাওয়ার সাঁকোটার দুই মুখে গ্রীলের স্পীড ব্রেকার। ওদিক থেকে কয়েকজন আসছিল। তাদের পাশ দিয়ে যাওয়া যাবে না। ওরা পেরিয়ে এলে তবে আমি যেতে পারব। অত সময় নেই। দমও নেই। দৌড়ে ক্যান্টিনে ঢুকে পড়লাম।
কোনওদিন সঙ্গীসাথীর পরোয়া করিনি। সেদিন অন্য বিভাগের দুই ছাত্রী হোস্টেলে ফিরছে দেখে তাদের সঙ্গ নিলাম। ওরা আমার হোস্টেলের নয়। একজন সরোজিনী আর বাকি দুজন মীরাবাই ছাত্রীনিবাসের দিকে হাঁটা দিল। আমি ছুটলাম নিবেদিতার দিকে।
পরে সন্দেহ হত, সত্যিই কি আমায় বাঁদরকূল তাড়া করেছিল, নাকি আমি খামোখা ভয় পেয়েছিলাম? কিন্তু তারপর থেকে গরমের ছুটি পড়া পর্যন্ত ঐ তল্লাটে বাঁদর হনুমান দেখলেই ছাতা দিয়ে, বলা বাহুল্য, নতুন কেনা ছাতা দিয়ে মুখ আড়াল করে চলতাম।
ছবিঃশিলাদিত্য বোস