সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
শিকারি

মীন ধরছিল হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে জনা ছয়েক ছেলে মেয়ে। কলবল করে চলেছে নিজেদের মধ্যে। বড় বড় দাড়িগোঁফওয়ালা একটা লোক নদীর ধারে পৌঁছতেই বাচ্চাগুলো চুপ করে গেল। জল ভরা প্লাস্টিকের থলেতে কিলবিল করছে মাছের চারা বা 'মীন'। হারুন নামটা তাদের কাছে ডাঙার বাঘ কিংবা জলের কুমিরের প্রায় সমার্থক। হারুন যখন বন্দুক কাঁধে ঘুরত তখন তাকে বিশেষ কেউ দেখেনি, কেবল গল্প শুনেছে তার অব্যর্থ নিশানা, অদম্য সাহস আর নিষ্ঠুরতার। আর এখন যখন তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে দেখা যাচ্ছে তখন তার হাতে ছিপ কিংবা খাপলা জাল ছাড়া আর কিছু থাকে না; কিন্তু শোনা গল্পের দৌলতে শিকার ছেড়ে দেওয়া মানুষটাকে সকলেই যেন ভয় মেশানো সমীহের চোখে দেখে। বন বিভাগের সঙ্গেও নাকি তার বেশ খাতির। অপরাধীরা অপরাধের পথ ছেড়ে দিলে যেন সাধারণ ভালো মানুষের চেয়ে বেশি সম্মানীয় হয়ে ওঠে। তাদের অন্ধকার অতীতটাই তখন গৌরবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সেই সেবার পুজোর আগে, বছর চার পাঁচ হবে, এক মহিলা বুক চাপড়ে কাঁদছিল। তার দশ বছরের মেয়েটাকে কুমিরে টেনে নিয়ে গেছে। হারুন শুনে বলেছিল, "ইস্‌! সেই যদি কুমিরেই খাওয়ালি মেয়েটাকে আমায় দিতি, আমি বাঘের টোপ করতাম"। এর পর থেকে রটে যায় হারুন মহম্মদ বাচ্চাদের ধরে টোপ বানিয়ে বাঘ শিকার করে। অনেকে বলত, "ধুর! ও মস্করা করেছে"। কিন্তু সন্তানহারা মায়ের কান্না দেখে যে অমন মস্করা করতে পারে ছোটরা তাকে দেখে ভয় খাবে এ আর আশ্চর্য কী? আবার সেই হারুনই আজকাল সরকারি অনুমতি নিয়ে মানুষখেকো ছাড়া বন্দুক চালায় না, বরং চোরা শিকারি ধরতে সাহায্য করে এও কি কম আশ্চর্যের?

এক সাংবাদিক এসেছে লাহিড়ীপুরে, সঙ্গে ক্যামেরা কাঁধে এক আলোকচিত্রী। তারা হারুনের দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করছিল। হারুনের ছোট ছেলে হামিদ অবাক হয়ে দেখছে। তার বাবাকে কিছু দিন আগে পর্যন্ত পুলিসে খুঁজত, ইদানিং বন বিভাগের লোক তলব করছে। কিন্তু এরা তো কোনওটাই নয়। ক্যামেরাওয়ালা লোকটা হারুনের বৌ রশিদা, ছেলে হামিদ, উঠোনে বাঁধা ছাগোল, ছেঁড়া খাটিয়া সব কিছুর পটাপট ছবি তুলে যাচ্ছে। বাবাকে খবর দিতে ছোড়দাদা মুন্না সেই গেছে নদীর ধারে, এখনও ফেরার নাম নেই। নির্ঘাৎ এই ফাঁকে খেলে নিচ্ছে ফজল, আমিনুলদের সাথে। হামিদকে কেমন কায়দা করে ঘরে রেখে গেল।

ঐ তো দাদা লাফাতে লাফাতে ঢুকছে। পেছনে বাবাও। থলির নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে মাছ আছে। রশিদার হাতে মাছের থলি তুলে দিয়ে দাওয়ায় বসা লোকগুলোর মুখোমুখি হল হারুন। "কখন আসলেন। চা পানি কিছু নেন নাই? রশিদা রশিদা –"
সাংবাদিক দুজন সঙ্গে পানীয় জল নিয়ে এসেছিল। শুধু এক কাপ লিকার চা খেতে সম্মত হল। ক্যামেরাওয়ালা তৈরি হতেই সাংবাদিকটা মুখের কাছে মাইক ধরে প্রশ্ন শুরু করল।
"আপনি কতদিন ধরে শিকার করছেন?"
"তা বছর বারো তেরো বয়স থেকে। ভালো মনে নাই"।
"বন্দুক চালানো শিখলেন কার কাছে?"
"দাদুর কাছে। বাপ-দাদারা সবাই শিকারি ছিল। আমাদের তো দামী বন্দুক ছিল না। দিশি বন্দুক দিয়েই দাদু কত বাঘ আর কুমির মারছে। একবার তো এক রয়্যাল বেঙ্গল গুলিতে একটু জখম হওয়ার পর দাদুর বন্দুক দিয়ে আর গুলি বাইরায় না। তখন কোমরে গোঁজা টাঙ্গি দিয়ে তারে কেটে টুকরা টুকরা করে দেয় দাদু"। বলতে বলতে হারুনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।
"শুধুই কি বাঘ কিংবা কুমির মেরেছেন?"
"না মিছা বলব না, মহিষ, হরিণও .." বলতে বলতে হঠাৎ থম মেরে গেল হারুন মহম্মদ।
"আপনি এখন চোরা শিকারি ধরতে সরকারকে সাহায্য করেন। কিন্তু আগে তো নিজেই চোরা শিকারি ছিলেন। লুকিয়ে শিকার করতে গিয়ে কখনও ধরা পড়েননি?"
"এই গোসাবায় তো দূর গোটা সোঁদরবন এলাকায় হারুন মহম্মদকে ধরে এমন কোনও বাপের ব্যাটা পয়দা হয়নি। আমি নিজে থেকে ধরা না দিলে কোনও অফসারের খ্যামতা হোত না আমার ছায়াকেও ধরে"।
"আজকাল কী করেন?"
"এখন ছাগল, মুরগি পালে আমার বৌ। আমি মাছ ধরি। আমার বড় ছেলে এখানকার এক মাজারে কাজ পাইছে। তাইতে কষ্টেশিষ্টে চলে যায়"।

শিকারি

"চোরা শিকারে আমদানি কেমন হত?"
"আমদানি যখন হত তখন আসমান ফুঁড়ে টাকা আসত। আবার বর্ষার জঙ্গল ঘন হলে, বন্যা হলে কুমীর পাওয়া গেলেও যেসব জানোয়ারের ডিমান্ড বেশি সেগুলো খুঁজে পাওয়া ভার। তখন আমাদের শুখা মরশুম। আমরা জীবনের বাজি লাগিয়ে শিকার করি, আর ঐ দালালরা কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেয়। ধরা পড়লে আমরা পড়ি, তারা ওপর মহলে ঘুষ খাইয়ে পার পেয়ে যায়"।
"রোজগারের গ্যারেন্টি নেই, অথচ ধরা পড়ার ভয়, এই জন্যই কি শিকার ছেড়ে দিলেন? মনে হল এভাবে জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে আত্ম সমর্পণ করলে সরকার জেলেও ভরবে না, উল্টে পুরস্কার জুটবে?"

হারুন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। একটু পরে থমথমে মুখ করে বলল, "হারুন কাউকে ডরায় না কত্তা। রাতের পর রাত খাড়িতে গলা জলে ডুবে থেকেছি শিকারের আশায়। সুন্দরী হেতালের ছুঁচলো শেকড়ে ভরা কাদা নোনা মাটিতে পা ডুবিয়ে হেঁটেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তেনার কথা তো বাদই দিলাম, কুমীর কামটে তো হামেশাই মানুষ জলে টেনে নিয়ে যায়। বনবিবির দয়ায় তারাই ছুঁতে পারেনি তো মানুষ পুলিসকে ভয়। কারণ অন্য"।

"সেটা জানতেই তো আসা। কেন শিকার ছাড়লেন?"
"বলতে পারি। কিন্তু আপনারা শুনে বিশ্বাস যাবেন কিনা জানি না। একবার এক ঝাঁক হরিণকে অনেক দূর তাড়া করে গুলি ছুঁড়ি। একটার গায়ে লাগতে বাকিরা পালাল। তারপর.." হারুন থেমে গেল।

"তারপর?"

"তারপর দেখি একটা বাচ্চা হরিণ এসে – ঐ মাদিটারই ছানা, লাফাতে লাফাতে এসে মরা হরিণীটার গা থেকেই দুধ টানতে লাগল। সত্যি বলছি সার। জীবনে মানুষ মা বাছাদের জন্য অমন হয়নি, বাচ্চা মেয়েকে কুমীর খেয়েছে বলে মেয়েমানুষকে কাঁদতে দেখে ইয়ার্কি দিয়েছি। নিজের পোয়াতি বৌকে তিন ছেলেমেয়ে সমেত ফেলে রেখে দিনের পর দিন ঘরে ফিরি নাই শিকারের ধান্দায়। কিন্তু চোখের সামনে ঐ হরিণছানার অবস্থা দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারি নাই। কতদিন পর্যন্ত মরা মায়ের শরীর থেকে বাচ্চাটার দুধ খাওয়ার ছবিটা চোখ থেকে মুছতে পারিনি। আমি তো বাঘিনীকেও দেখেছি ছানাপোনা সমেত। সেও তো মা। আমার মতো শয়তানের কী যে হল, সেই যে হাত থেকে বন্দুক খসে পড়ল, আর ধরতে পারলাম না"।

ক্যামেরাম্যান হারুনের চোখের জল ক্যামেরায় ধরার জন্য মুখটা ক্লোজআপে ধরল। সাংবাদিক হারুনকে সময় দিয়ে বলল, "এখন তো মানুষখেকো মারো"।

"হ্যাঁ সার। ফরেস্টের লোকেরাই আমায় এই কাজ দিয়েছে। কাজ হলে পয়সাও পাই, কিন্তু কাজটা করতে আমার আর ভালো লাগে না।... সার, আজ আমি পিচাশ থেকে ভালো হয়েছি, মানুষকে বাঁচানোর জন্য কেবল মানুষখেকো মারি কুমির মারি, তবু মানুষের বাচ্চাগুলো আমাকে দেখলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যায়"।


ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী

সোদপুর, কলকাতার বাসিন্দা শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিভিন্ন পত্রিপত্রিকায় লেখেন। এছাড়াও তথ্য প্রযুক্তি এবং ভ্রমণ বিষয়ে ব্লগ লিখতে ভালবাসেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা