অমৃতসর শহরে সে বছর জানুয়ারী-তে খুব ঠান্ডা পড়েছিল। ইউনিফর্মের উপরে পালকের তৈরী জলপাই রং-এর কোট পড়েছি, হাতে গ্লাভস ,পায়ে মোটা মোজা সহ ভারী ডি-এম-এস জুতো পড়ে আছি, তবু মাঝে -মধ্যে শীতে কেঁপে যাচ্ছি। অফিসার্স মেসে -র দেওয়ালে টাঙানো ওয়েদার থার্মোমিটার-টার দিকে চোখ গেলো। রিডিং দেখাচ্ছে -২ ডিগ্রী সেলসিয়াস , এখন সবে বিকেল সাত -টা [ হ্যাঁ ,এখানে আটটা নাগাদ সন্ধ্যা হয় ] তার মানে আজ রাতে কপালে আরো দুঃখ লেখা আছে ।
মেস -ম্যানেজার আমার জন্য এক গ্লাস গরম 'পাঞ্জাবী - চা' এনে টেবিলে রাখলো । পাশের টেবিলে আর একজন অফিসার কফি খাচ্ছিলো। এরা সবাই হলো গাড়োয়ালী , ঠান্ডা পাহাড়ী জায়গার লোক। এদের তাই আমার মতো শীত লাগে না- কলকাতায় কোনো শীতকালে থার্মোমিটারের পারদ ১৫ ডিগ্রী-তেই কি নামে ?
গরম দুধের মধ্যে চিনি ও একটু চা -পাতা ফেলে অনেক ক্ষণ ফোটানোর পর 'পাঞ্জাবী - চা' তৈরী হয়। ওদিকের লোক এটাকে ' পাও -মে- পাত্তি' বলে। যাই নাম হোক, জিনিষ -টা অতীব স্বাদু বটে । আর ভীষণ গরম থাকে বলে, একটু একটু চুমুক দিয়ে খেতে হয়। ওটা খেয়ে মিনিট দশ পর শরীর-টা যেন একটু গরম হলো । প্যাকড ডিনারের অর্ডার দিয়ে আমি আমার কোয়ার্টার্সে ফিরে এলাম। আবার, এই ঠান্ডার রাতে ডিনার করতে বেরোনো যাবে না ।
কপালে দু:খটা হিসাব মতো রাতে না জুটলেও, সকালে জুটে গেল । তখন -ও সূর্য ওঠে নি, এক জওয়ান , অপ -ইমিডিয়েট লেখা ফাইলে করে কমান্ডিং অফিসারের অফিসে আর্জেন্ট মিটিং-এ ' মাস্ট এটেন্ড ' বলে টাইপ করা ও লাল দাগ দেওয়া চিঠি নিয়ে এসে সই করিয়ে, আবার ছুটতে ছুটতে ফিরে গেল ।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফুল -ইউনিফর্মে বড় সাহেবের ঘরে উপস্থিত হলাম। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন ভাগের অফিসারেরা চলে এসেছেন। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জীপ্ থেকে নেমে বড় সাহেব ঘরে ঢুকলেন। ওঁকে দেখে বুঝলাম , মনে মনে উনি দারুন উত্তেজিত আছেন। সৌজন্য -বিনিময় সংক্ষেপে সেরে, উনি আমাকে বললেন, ডক্টর , কুইকলি টেল মি ,কাল রাত অবধি কত জওয়ান আনফিট লিস্টে ছিলো ? আমি বললাম, চার। উনি বললেন ,ওদেরকে দিয়ে সিগন্যাল -কমিউনিকেশানের কাজটুকু করানো যাবে কি ? অবস্থা বুঝে আমি বললাম, 'শিওর ,তারপর আমি তো আছি' । সাহেব বললেন ,দ্যাট'স ফাইন। আর আমাদের কেউ পিছনের ওই আর্মি হসপিটালে তোমার দৌলতে আরাম করছে না তো ? আমি মাথা নাড়লাম। ওয়েল , কোত -হাবিলদারের কাছে গুলি-বন্দুকের লেটেস্ট হিসাব-মোতাবেক এই মুহুর্তে কয়টা হেভী -মেশিনগান রেডি রয়েছে ? একটা অল্প-বয়সী রোগা, ফর্সা ছেলে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম করে বললো ,পুরে কে পুরে তৈয়ার হ্যায় ,হজুর ! কাল হি হ্যাম উও -সব কো চেক করকে অলাগ ঘর মে চাবি দে রাখা। বড় সাহেব বললেন, সাবাস বেটা। তুম , থ্রী -টন গাড়ী মে সব গোলি, বন্দুক ডাল কে বাহার মে মুভ করনে কে লিয়ে তৈয়ার হো যাও । আর,কোত -ঘর ক চাবি সাথ মে লে আনা , পিছে ছোড় কে যাও মত্ । এরপর উনি জুনিয়র অফিসারদের বললেন , আপ লোগ মুভমেন্ট-শিডিউল মান কর বর্ডার কে তরফ জলদি জানে কি তৈয়ারী করো । আভি ইঁহা মেরে পাস ইয়ে ডক্টরসাব ঔর পল্টন কা সিনিয়র কমান্ডার লোগ রুখ যাও ,বাকি লোগ আপনা তৈয়ারী করো -জলদি !
এবার নীচু কিন্তু ঠান্ডা গলায় বড় সাহেব আমাদের বললেন, শুনিয়ে সাহেবান , ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ,দেলহী থেকে খবর টা এসেছে যে আমাদের প্রতিবেশী দেশ গত এক সপ্তাহ ধরেই ইন্টারন্যাশনাল বর্ডারের দিকে এক্সট্রা পল্টন শিফট করাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলে,উত্তর দিচ্ছে যে ওটা রুটিন মেনে ইন্টারনালি ওরা করছে। কিন্তু কাল বিকালে ওরা যখন দু খানা দুরপাল্লার ট্যাঙ্ক নিয়ে এলো, তখন আমাদের ডিফেন্স মিনিস্ট্রি আমাদের ব্রিগেড -কে খবর পাঠালো, মুভ টু বর্ডার উইথ ওয়ান ফুল রেজিমেন্ট। আজ বেলা নয়টার মধ্যে আমরা ওখানে পৌঁছে বাঙ্কার- গুলো পরিষ্কার করব. তারপর আমার পয়েন্ট -আউট করে দেওয়া তিনটে বাঙ্কার এক্টিভেট করবেন একটা হেভী মেশিনগান, দুটো জনি আর একটা ফার্স্ট -এইডার উইথ হিজ মেডিসিন দিয়ে। এখন কোয়ার্টার্সে ফিরে রেডি হোন। ফ্যামিলি -কে বলবেন যে দুদিনের জন্য স্পেশাল চেকিং করতে যাচ্ছেন। আজ বিকালে আমার ছেলেকে নিয়ে পরীক্ষা দেওয়াতে জলন্ধর যাবার কথা। সে সবই বরবাদ ..... এনি ওয়ে , লেট আস আপকিপ আওয়ার মরাল, ফর সেক অফ মাদারল্যান্ড। অল দ্য বেস্ট টু ইউ অল । বড় সাহেব উঠে পড়লেন।
আমার পিঠ দিয়ে ঠান্ডা কিসের স্রোত যেন নেমে গেলো। তাহলে কি যুদ্ধ লাগছে ? মায়ের মুখ-টা মনে ভেসে উঠলো । আবার ,উত্তেজনাও প্রবল পরিমাণে হতে লাগলো। আমরা যে যার কাজ তদারকি করে মুভ শুরু করলাম। পিছনে রেখে গেলাম চারজন সেন্ট্রি -জওয়ান কে । আপাততঃ ওরা-ই ইউনিটের দেখভাল চালিয়ে যাবে।
অমৃতসর থেকে ১৪ কিলোমিটার দুরে ওয়াগা বর্ডার। আমরা সবাই আটটা নাগাদ ওখানে পৌঁছে গেলাম। আমার লোকজন এম্বুলেন্স গাড়ীকে একপাশে পার্ক করে দ্রুত মাটি কোপাতে শুরু করলো, যাতে আজ বিকেলের মধ্যে মাটির তলায় দুই বেড সহ মেডিকেল রুম খুলে ফেলা যায়। আমাকে বড় সাহেব ডাকছেন। কাছে যেতে, উনি বললেন ওনার সাথে আমাকে বর্ডারের গায়ে যে বাঙ্কারগুলো আছে , সেগুলো পরিদর্শনে যেতে। চলতে চলতে জানলাম, এমনিতে গাছ-পালা দিয়ে বাঙ্কার -গুলো ঢাকা থাকে ,যাতে দূর থেকে বোঝা না যায়। বাঙ্কারের মধ্যে থেকে মেশিনগান আর মর্টারের মুখ বার করা থাকে। জওয়ানেরা বাঙ্কারের ভিতরে থেকে ওগুলো অপারেট করে । বাম্কারের উপর অনেক সময় ওপার থেকে কামানের গোলা এসে পড়ে , কিন্তু ক্ষতি হয় না । ভয়টা অন্য -সেটা হলো সাপের উপদ্রব।
অব্যবহৃত বাঙ্কার খুলতে গেলে প্রচুর বিষাক্ত সাপ বেরোবে। জওয়ানরা জানে কিভাবে ওদের মারতে হয় , তবু ডক্টর -সাব সাথ মে হ্যায় জানলে ওদের মনের জোড় বেড়ে যায়। শুকনো হাসি হাসলাম , আমার যে বমি পাচ্ছে - সেকথা তো বলা যাবে না । হায় ভগবান, কি কুক্ষণেই না ফৌজে চাকরি নিতে গেলাম!
একটা বাঙ্কারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম যেটাকে বড় সাহেব পয়েন্ট -আউট করে, আগে এগিয়ে গেছেন। দেখি ,খানিকটা কুঁড়ে -ঘরের মতো জিনিস ,তার মধ্যে তিনটে জানালা- মতো গর্ত ,যার ভিতর দিয়ে মেশিনগানের নল বেরিয়ে আছে। একটা বড় লম্বাটে গর্তকে বুঝি দরজা হিসেবে সৈন্য -রা ব্যবহার করে। এটা ঝোপ -ঝাড় দিয়ে ঢাকা। সত্যি ,চট করে কিছু বোঝা যায় না, কি সুন্দর ক্যামোফ্লাজ ! ওই দরজার উপরে পড়ে থাকা গাছের ডাল টা সরিয়ে, একটু ভিতরে উঁকি মারতে যেতেই আমার পিছনের কোন জওয়ানের ধাক্কায় মাটি-তে মুখ থুবরে পড়লাম।ওকে চিনতে পারলাম,আমাদের কোত -হাবিলদার! কাল মেডিকেল লিভ চাইছিলো ,আমি দেই নি। দেখি, বেয়নেট খুলে হাতে নিয়েছে ! কি রে বাবা, এভাবেই কি ও রাগ-টা পোষাবে ? এর পরই একটা হিস্ শব্দ হলো আর,ও আমার উপর, থুড়ি পাশে, ঝাঁপিয়ে পড়ল ! তারপর -ই দেখি একটা বড়, কালো ল্যাটা মাছের মতো কিছুর মাথা ও বেয়নেটে কেটে ফেলেছে। ও হেসে আমাকে বললো , সাব্জী, আপ বচ গয়ে ! বুঝলাম,গাছের ডাল থেকে ঝুলতে থাকা সাপটাকে আমি খেয়াল করি নি । আমার মনটা ওর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল । যাই হোক,আমি আমার মেডিকেল রুমের তদারকি করতে গেলাম।
লাঞ্চ করে সবে তাঁবুর বাইরে এসেছি ,দেখলাম ওই কোত -হাবিলদার আমার দিকে ছুটে আসছে। আবার কি হল ? ওকেই কি সাপে কামড়ালো ? ছেলেটা আমাকে একা দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সোজা পা-দুটো জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো আর বলতে লাগলো-সাব , মুঝে বচা লো। কুছ উপায় করো নহি তো মেরা জান ঔর নোকরী দোনোই চলা জানে ওয়লা হ্যায়। ভাবলাম , ঠিক এই কথাই না ওকে আমার বলার ছিল !
যাই হোক , যা বুঝলাম সেটা হলো যে ও তাড়াহুড়ো করে আসবার সময় কোত -ঘরের চাবি টা আনে নি, ওর বিছানার তলায় ফেলে এসেছে। কিন্তু , বড় সাহেব আজ সন্ধ্যা বেলা ওই সব কিছু চেক করবেন!
ভাবলাম , কিছু তো করতেই হয় । ওকে আমার প্ল্যান বা চালাকির ব্যাপারটা বোঝালাম। ও একটু দোনামনা ভাব করেও সামলে নিয়ে রাজী হয়ে গেল। আমি তখন বড় সাহেবকে ফোনে বললাম যে আমাদের কোত -হাবিলদার পা মচকে ফেলেছে। একবার এক্স -রে করে যদি দেখি যে ভাঙ্গে নি তাহলে সুবিধা হয় । এম্বুলেন্স পাঠিয়ে , আর্মি হাসপাতাল থেকে ছবি করিয়ে নি ? উনি বললেন, ইয়েস , ইউ ক্যান ডু ইট , কিন্তু ফর হেভেনস সেক , কাউকে ভর্তি করে দিয়ে এই সময় আমার স্ট্রেংথ বা ম্যান- পাওয়ার কমিযো না - এই বলে উনি লাইন কেটে দিলেন।
কোত -হাবিলদারকে নিয়ে এম্বুলেন্স গাড়ী তখুনি অমৃতসর গেল এবং দুই ঘন্টার মধ্যে ফিরেও এলো। ওই চাবি পকেটে নিয়ে ছেলেটা নীরব কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেল।
ঋণ -শোধ করে আমার -ও কি কম আনন্দ হয়েছিল ?
ছবিঃশিলাদিত্য বোস