(১)
সেটা ছিল ১৯৮৮ সাল। আমি তখন সেনা বাহিনীর রিক্রুটিং মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে রাজস্থানের 'কোটা' শহরে কর্মরত । এখানে সেনাবাহিনীর যে এরিয়া বা ক্যান্টনমেন্ট ,সেটা 'মালা রোড ' বলে একটা রাস্তার গায়ে । শহরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন , কিন্তু ভীষণ গরম । গরম কালে দিনের বেলা গড় তাপমাত্রা থাকে ৪৪-৪৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সর্বদাই 'লু' বইছে , কখনো বা দূর থেকে বালির ঝড় ছুটে আসে -আমাদের কষ্ট আরো বাড়ানোর জন্য।
রাজস্থানের অল্পবয়সীদের মধ্যে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেবার অসম্ভব উৎসাহ , পশ্চিমবঙ্গে যে কথাটা ভাবা-ই যায় না । প্রতি বছর হাজার হাজার মাধ্যমিক-পাস ছেলে ফর্ম ভর্তি করে প্রথমে থিওরি পরীক্ষাটা পাস করার চেষ্টা করে । সফল হলে, মেডিক্যাল টেস্ট দিতে হয় কোটা শহরে এসে। এই পরীক্ষা উতরানো বেশ কঠিন। সামরিক গাইড-লাইন অনুযায়ী নেওয়া প্রাথমিক পরীক্ষাতেই বহু-জন আনফিট ঘোষিত এবং বাতিল হয় । বাকিদের চূড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতা প্রমানের জন্য নানান কসরত করে দেখাতে হয় -যেমন, জাম্প , ভারোত্তোলন , গাছে চড়া ও দ্রুত নেমে আসা , কুস্তি এবং দুরে রাখা টার্গেটে বল ছোঁড়া। এইভাবে প্রতিদিনের বেলা একটা-র মধ্যে চূড়ান্ত ১০০ জন-কে বেছে নিয়ে দুপুরের খাবার বা লাঞ্চ দেওয়া হয়। তার এক ঘন্টা পরে দিনের শেষ পরীক্ষা নেওয়া হয়- এটা হলো পিঠে ব্যাগ, জলের ভরা বোতল -সহ ভারী বুট পড়ে দৌড় । আঁকা -বাঁকা , গর্তে ভরা ও জল-জঙ্গল মেশানো রাস্তা দিয়ে ১২ মিনিটে ওদের ৩ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ফিনিশ-পয়েন্টে আসতে হবে। পিছনে জীপে চড়ে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে ওদের ফলো করা আমার মতো ডাক্তার-দের কাজ , যাতে কেউ আহত হলে সেবা দেওয়া যায় আর আগে থেকে বুঝে ফেলে কারো অকালমৃত্যু আটকানো যায়। হ্যাঁ , এমন ঘটনাও ঘটে ।
সেই বছর , শেষ দিনে , লাঞ্চ শেষ হবার পর আমি জীপের পাশে দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের জিনিস আর ওষুধ মিলিয়ে নিচ্ছি, এমন সময় এক বৃদ্ধা আমার কাছে এলেন। ওনাকে অমি চিনি, আমাদের মেস-এ বাসন মাজার কাজ করেন। আরেকটা ব্যাপার হলো,উনি বাঙালি হয়েও এই রাজস্থানের মত জায়গায়, স্বামী মারা যাবার পর ছেলে সহ রয়ে যান। উনি বললেন , ওনার একটিই বেকার ছেলে, সে-ও ওঁর বিধবা -ভাতার উপর নির্ভরশীল । ছেলে দর্জি-র কাজ শিখেছে, সামরিক বাহিনীতে সেই হিসেবে ঢুকতে চায় । গত দুই বারই সে এই শেষ পরীক্ষা অবধি এসে ফেল করে যাচ্ছে।
(২)
বুঝলাম, সব-ই বুঝলাম। শেষ একশ মিটারের আগে যে ছোট খাড়াই ,ওটা পার হতে গিয়ে ছেলেটার জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখি, কি করা যায় ! আমার অ্যাম্বুল্যান্সের ড্রাইভার কে বললাম, আজ তুই আমার আগে আগে চলবি। উত্তর পেলাম, ঠিক হ্যায়,সাব-জী।
শেষ দৌড় সবাই শুরু করলো। অনেকেই বেশ ভালো দৌড়াচ্ছে , কয়েক-জন হিসাব করে মাঝারি গতিতে চলছে। ওরা শেষভাগে সময় মেক-আপ করার জন্য শক্তি জমিয়ে রাখছে। আসলে , এই শেষ একশ জনের সবাই যদি সময়ের মধ্যে দৌড় শেষ করতে পারে তো, সবার-ই চাকরি বাঁধা। এটাতেই,ওই বুড়ির ছেলেটা মার খেয়ে যাচ্ছে। এই তো ,আজকেও তো , ওকে পিছনে ফেলে বাকিরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ও বেচারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মিনিট দশ শেষ হয়ে গেল। সামনেই সেই চড়াই ,ওটা টপকে প্রায় সবাই নিচে নেমে যাচ্ছে। ওদের এখান থেকে দেখা যাবে না। আম্বুল্যান্সকে হর্ন দিয়ে এগিয়ে যেতে বললাম ।আমি যা অনুমান করে রেখেছিলাম, সেটাই দেখলাম। ঐ ছেলেটা এই মুহুর্তে সবার পিছনে , এখনো খাড়াই রাস্তাটা অর্দ্ধেক পেরোনো বাকি। আম্বুল্যান্স-ও ঢাল বেয়ে নেমে গেলো ফিনিশিং পয়েন্ট-টার দিকে। জীপের স্পিড বাড়ালাম এবং ছেলেটার কাছাকাছি গিয়ে টেনে নিয়ে চলন্ত জীপে তুলে নিয়ে চড়াইটার মাথায় নামিয়ে দিলাম। আমাদের কেউ দেখতে পায় নি। আর কয়েক মিনিট-ই বাকি আছে । ছেলেটা প্রানপণ দৌড় মারলো এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েও সে ফিনিশিং পয়েন্টে পৌঁছে গেল । তখনো তিরিশ সেকেন্ড মতো বাকি।
কাজটা আমি ঠিক করি নি। এই রকম জিনিষ কেউ করুক সেটাও আমি চাই না। তবু, সেই বাঙালি বৃদ্ধার কাকুতি-ভরা মুখটা মনে ভেসে উঠতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম ।
ছবিঃ শিলাদিত্য বোস