ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে কুপ্ওয়ারা নাম –টা বহুদিন ধরেই একটা মাথাব্যথা বিশেষ। এটা হলো জম্মু -কাশ্মীর রাজ্যের একটা জেলা যার অনেকখানি জায়গা দিয়ে ভারত- পাকিস্তানের সীমান্তরেখা চলে গিয়েছে। এর খুব কাছেই , সীমান্তের ওপারে পাকিস্তান অনেকগুলো 'মিলিটারী ট্রেনিং স্কুল' খুলেছে , ওদের জঙ্গীদের কে ওরা সেখানে অস্ত্র -শিক্ষা আর, চোরাগোপ্তা যুদ্ধের নানারকম কৌশল শেখায়। তারপর, শিক্ষান্তে , ওই সব জঙ্গীদের, অস্ত্র সহ আমাদের দেশে ঢুকিয়ে দেয়। তার জন্য ওরা মাটির তলা দিয়ে বিশাল গুপ্ত সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রেখেছে। তাছাড়া , ওই জায়গা হল ঘন জঙ্গলে ভরা , যেখানে সূর্যের আলো প্রায় ঢোকেই না, আর মেঘ করলে তো কথাই নেই। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী ও সেনাবাহিনী আবার , এই ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে ওয়াকিবহাল এবং সজাগ। মে মাসে বরফ গলতে শুরু করলে এই জঙ্গীদের কার্যকলাপ বেড়ে যায়, ওরা সক্রিয় হয়ে ওঠে আমাদের সেনাবাহিনীর নজর এড়িয়ে ভারতের মাটিতে ঢুকে পড়তে। ওরা যখন সফল হয়, তখন আমাদের কত রকম ক্ষতিই না করে। আর যদি ধরা পড়ে যায় তো, প্রাণের মায়া না করে, গুলির যুদ্ধ্ শুরু করে দেয়। ওরা তো মারা পড়েই , ওদের অভিযানও ব্যর্থ হয়. কিন্তু ওদের গুলি-তে আমাদের এক-আধ জন সৈন্য -ও যে মারা পড়ে ! কত মায়ের কোল খালি হয়ে যায়, কতো মেয়ে তাদের অল্প বয়সেই বিধবা হয়, তাদের ছেলেমেয়েরা অনাথ হয়ে পড়ে ! ব্যাপারটা দু পক্ষের দেশবাসীর জন্যই ভয়ানক দু:খের। কিন্তু কেন জানি না ,বহুদিন ধরে চলে আসা এ হানাহানি আর থামে না ! ক'দিন আগে কাগজে পড়লাম , আমাদের সেনা রাম প্রতাপ যাদব ওভাবেই ওখানে মৃত্যুবরণ করেছে। আমি মনে মনে ফিরে গেলাম ১৯৮৭ সালের জুন মাসে ।
আমি তখন একটা গোর্খা রেজিমেন্টে ডাক্তার হিসাবে আছি এবং আমার রেজিমেন্ট পাঠানকোটে রয়েছে । এক বুধবার , আমাদের কাছে গোপন খবর এলো যে, কূপওয়ারা সীমান্ত দিয়ে সেই শুক্রবারই বিকেলে বেশ কিছু জঙ্গী ভারতে ঢুকবে। হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশে আমাদের পুরো রেজিমেন্ট কূপওয়ারাতে মুভ করে গেল এবং আমাদের ভাষায় এল. ও. সি.[L.O.C.] বা লাইন অব কনট্রোল ধরে ওই রাতে পজিশন নিয়ে নিলো। আমার লোকেরা মানে প্যারামেডিক্যাল জওয়ানরাও ক্যামোফ্লেজ করা একটা অস্থায়ী ডাক্তারখানা খুলে ফেললো। প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া , তবে কুয়াশা নেই। বড় আলো জ্বালানো মানা , তাই মোমবাতির আলোতে জীবন রক্ষাকারী ড্রেসিং ওষুধ আর ইনজেকশন গুছিয়ে ফেললাম।
আমার সহায়ক প্রসন্ন ধারা আমায় প্রচুর সাহায্য করলো। ছেলেটা একজন ফার্মাসিস্ট / ড্রেসার। আমাকে বাদ দিলে ও হল , ওই রেজিমেন্টের একমাত্র বাঙালী এবং ভীষণ জনপ্রিয়। মাঝে মাঝে আমার তো ওকে বেশ হিংসেই হত। যাই হোক , রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ কাজ শেষ করে দুটো রুটি আর সবজী খেলাম। তার পর খেলাম এক গ্লাস ' ডালের জল ' যেটা ওই ঠান্ডাতে বেশ আরামদায়ক। এবারে স্যালাইনের বোতলগুলো মাথার নীচে রেখে 'লম্বা' হলাম। তৃতীয়ার চাঁদ তখন দিগন্তে অনেকটা নেমে গেছে।কখন ঘুমিয়ে পড়েছি -তা মনে নেই।
সকালে ব্রেকফাস্ট ( রুটি আর চা ) নিয়ে এসে প্রসন্ন আমার ঘুম ভাঙ্গালো। রুটি-চা খেয়ে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। ঝকঝকে সকাল , চারদিকে টিলা আর জঙ্গল , আর, আর, উত্তর - পূর্ব্ব দিকে অনেক দুরে , বেশ উঁচুতে সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসা 'সিয়াচিন হিমবাহ'! কী দুর্ধর্ষ সে জিনিষ , আর একটু ভালো করে দেখব বলে সামনের টিলাতে উঠতে যাচ্ছিলাম , দেখলাম, মেজর থাপা ডাকছেন । ফিরে গিয়ে তো ওনার দাঁত -খিঁচানী খেলাম , " ডক্টর , হোয়াই মেকিং আস অবভিয়াস টু দোজ ... ?" আমি ক্ষমা চেয়ে আমার ডাক্তারখানাতে গুঁড়ি মেরে ঢুকে গেলাম। উনি ঠিক বলেছেন , আমি কি এখানে ট্যুরিস্ট ?
বিকালে খাতায় ওষুধের হিসাব লিখছিলাম। প্রসন্ন আমার কারবাইন -এর নল পরিষ্কার করে আমার হাতে দিয়ে ওপাশে গেল ওর বন্দুক পরিষ্কার করতে। হঠাৎ আমি কানের পাশে বোমার কান -ফাটানো আওয়াজ পেলাম। তারপরেই দেখি, দরজা দিয়ে এক লম্বা চেহারার মুখোশধারী আমার ঘরে ঢুকে আমার দিকে বন্দুক তাক করে ধরেছে । আমার মাথার উপরে রাখা স্যালাইনের বোতল ভাঙ্গার শব্দে বুঝলাম যে বেঁচে গিয়েছি ! লোকটা বাইরের দিকে দৌড় দিল , ততক্ষণে হুইস্লের তীব্র আওয়াজ , আরো বহু লোকের দাপাদাপি ,একটানা গুলি চালানোর শব্দ আর আর্তনাদের মাঝে আমি বিছানার নীচে ঢুকে পড়ে আমার কারবাইনের ট্রিগার চেপে রেডী হয়ে আছি। আমার কোন বিপদ হয়েছে কিনা জানতে প্রসন্ন যেই আমার ঘরে ঢুকেছে ,ওর পিছন পিছন আসা দুই জঙ্গী ওর শরীরটা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি আরো বেশ কিছু ক্ষণ চলতে থাকা সেই তান্ডবের বিবরণে আর যাব না। শুধু , যখন সব কিছু থামল . দেখা গেল প্রসন্ন ছাড়া আমাদের পোস্টের দুজন জওয়ান মারা গেছে কিন্তু, নয়জন জঙ্গীর মৃতদেহ ফেলে বাকিরা পালিয়েছে। প্রসন্নকে পরীক্ষা করে বুঝলাম, ও আর বেঁচে নেই। ওর শরীরটা ধরে যত্ন করে তুলে আমার খাটে নিয়ে শোয়ালাম। এরপর ,আমি আহত সেনা দের প্রাথমিক চিকিৎসা করে দিলাম। মন খুব খারাপ ছিল, কিন্তু ফৌজিদের তো কাঁদতে নেই !
পরদিন, বড় অফিসারদের নিয়ে ডিভিশনাল কম্যান্ডার এলেন। আমার সাথে কথা বলে , আমাদের আহতদের পাঠানকোটে হাসপাতালে পাঠালেন। প্রসন্ন সহ আমাদের মৃত জওয়ানদের শবদেহে মালা দিয়ে তাদেরকে সামরিক অভিবাদন জানালেন। এরপর উনি আমাকে অনুরোধ করলেন, প্রসন্নের কফিন নিয়ে তার দেশে যে পার্টি যাচ্ছে , তার ইন-চার্জ হিসেবে আমি যেন যাই এবং সরকারের তরফ থেকে নিয়ম মতো আত্মীয় পরিজনকে শোকবার্তা জ্ঞাপন করে আসি।
সেই কথামতো আমাদের দল ও প্রসন্ন-র কফিনবন্দী দেহ সহ কলাইকুন্ডা অবধি সামরিক হেলিকপ্টারে এসে ,গাড়ীতে চড়ে ওদের বাড়ি পৌঁছালাম। সবাই সব জেনে গেছে , গোটা গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছে ওদের উঠোনে। প্রসন্নর বাবা বেঁচে নেই , বুড়ি বিধবা মা'কে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে মনে হল বড়ই যান্ত্রিক পুরো ব্যাপারটা ,ওনাকে আমি কী বলতে পারি ! এর পর তো ওর বিধবা স্ত্রী র সাথেও আমাকে কিছু কথা বলতে হবে। ওই তো মহিলাটি , একটা সাত বছরের বাচ্ছা ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে, লাল হয়ে যাওয়া চোখে আর জল নেই ।আমি এগিয়ে গেলাম, বললাম - দিদি, আমি নিজেকে খুব বড় অপরাধী মনে করছি। বাচ্চা টাকেই বা কী বলব আমি , সেটা বুঝতে পারছি না।
মহিলা আমাকে অবাক করে দৃপ্ত কন্ঠে বললেন , ওর বাবার সৎকারের ব্যবস্থা আমি করে নেব। আপনারা যারা এসেছেন তাঁদের আমি পরিবারের তরফ থেকে ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের আর্মি কমান্ডারকে বলবেন, আমার ছেলে বড় হয়ে নিক, তারপর , ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ও ওর বাবার শূন্যস্থান পূরণ করতে চলে যাবেই। আপনারা কিচ্ছু চিন্তা করবেন না , কেমন !
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি